“সুখ আপনার ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখা বস্তু নয়। সুখ হলো বর্তমানের অভিলাষ।”- আমেরিকান উদ্যোক্তা এবং মোটিভেশনাল বক্তা জিম রন
কিংবদন্তী ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল কিন্তু জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারেই। শৈশব থেকেই তার কোনো কিছুর অভাব ছিল না। কৈশোরে এসে দেখলেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে তাদের পরিবারের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তিও। তার দাদা জন রাসেল ছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তার ধর্মপিতা জন স্টুয়ার্ট মিল তো সে সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিকদেরই একজন। অথচ বার্ট্রান্ড রাসেল কি না ছিলেন সর্বোপরি নিরানন্দ, অসুখী, নিঃসঙ্গ এক বালক! নিজের আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন যে বালক বয়স থেকেই একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু কেন? যাবতীয় ভোগ আর আভিজাত্যের মধ্যে বসবাস করেও সুখ কেন তার নিকট সোনার হরিণে রূপান্তর হচ্ছিল? সেসবের কারণ খুঁজতে নিজেই অবশ্য ‘কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ রচনা করেছিলেন। তার সে আলোচনার সাথে আজকের যুগের আধুনিকতার যাঁতাকলে মানুষের বিষণ্ণ হয়ে ওঠার অনেক সামঞ্জস্যই রয়েছে।
আধুনিককালে এসে বিষণ্ণতা আর মানসিক অশান্তি আমাদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়ন, শিল্পায়ন, শহরায়ন, অর্থনৈতিক কাঠামোতে নতুন নতুন সংযোজন, সবকিছুই হচ্ছে মানুষের জীবনকে আরেকটু সহজ ও স্বাচ্ছন্দ করতে, মানুষকে পূর্বের চেয়ে অধিক সুখী করতে। অথচ পৃথিবী যত আধুনিকায়নের দিকে আগাচ্ছে, মানুষের মানসিক সুখ ততই ফিকে হয়ে আসছে! সুখের খোঁজে হন্যে হয়ে সামনে ছুটতে গিয়ে এখন যেন উপলব্ধি হচ্ছে যে, সুখ পেছনে ফেলে আসা হয়েছে। পৃথিবীর বুকে সুখ নামক নুড়ি পাথর কুড়াতে কুড়াতে মাথা তুলে আকাশের দিকে চাইতেই যেন ভুলে গেছে মানুষ!
মানুষ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক বস্তুবাদী হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এককথায় বস্তুবাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিলে নিজের সাথে নিজেই প্রতারণা করবেন কেবল। আধুনিকতা আমাদের সুখ কেড়ে নিচ্ছে বলে কেউ নিশ্চয়ই পূর্বেকার সময়ে ফিরে যেতে চাইবেন না। মনের কথাগুলো চিঠির মাধ্যমে অন্তত সপ্তাহ পরে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেয়ে ফোনের বাটনে চাপ দিয়ে সরাসরি প্রিয়জনকে ভিডিও কলের মাধ্যমেই দেখতে চাইবেন অধিক সংখ্যক মানুষ। তাই, আধুনিকতার ইতিবাচক দিকগুলোকে বিবর্ণ করে দিচ্ছে যে নেতিবাচক দিকগুলো, আমাদের আলোচনা হওয়া উচিৎ সেগুলো নিয়েই।
অ্যাটেনশন ইকোনমি
আধুনিক পৃথিবী আসক্তির, মনোযোগ আকর্ষণের, প্রলোভনের। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অগণিত প্রলোভনের মাঝে বসবাস করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যে, চাইলেও কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত না হয়ে থাকা যায় না। মোবাইলে-কম্পিউটারে ভিডিও গেম, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, সিনেমা, নাটক, অপেরা, সোশ্যাল মিডিয়া, ক্যাসিনো, ফাস্ট ফুড, দেশী ফুড, ‘ট্রলিং’ ভিডিও, ‘রোস্টিং’ ভিডিও, পর্ণ ভিডিও, নিত্যনতুন প্রযুক্তি, পণ্য, সৌখিন পণ্য, রূপচর্চার পণ্য, ত্বকের যত্ন, চুলের যত্ন, মেদ কমানো, সিক্স প্যাক, স্মার্টফোন, ডিএসএলআর ক্যামেরা, টরেন্ট, নেটফ্লিক্স, আইপিএল, বিপিএল, বিগব্যাশ, প্রিমিয়ার লিগ, সিরি আ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, নাইটক্লাব, পার্টি সেন্টার… বিনোদনের একটার পর একটা বিকল্প অসীম ধারা আসতে থাকে। কখনো ভেবে দেখেছেন, এ ধারার প্রতিনিয়ত প্রলোভন থেকে কিছুতেই যে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না?
এই হাজারো বিকল্প বিনোদন ক্ষেত্রের কল্যাণে আমরা ডুবে আছি একপ্রকার অতিপ্রাকৃত পাপের মাঝে, যা আমাদের নৈতিকতা গ্রাস করছে আমাদের অগোচরেই। প্রতিনিয়ত ট্রলের নামকরে বডি-শেমিং, সংবেদনশীল বর্ণবাদী ও লিঙ্গবৈষম্যে ভরপুর হাজারো মিম, ‘স্টকিং’ এর নামে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার তোয়াক্কা না করা, প্র্যাংক ভিডিও বানাতে গিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যবোধে ব্যাঘাত ঘটানো, এসবই আমরা জেনে-বুঝে-সজ্ঞানে করছি। বিনোদন বিক্রয়ের জন্য আমাদের বিবেক লোপ পাচ্ছে, আমরা বুঝতেই পারছি না কীভাবে সমাজের বড় ক্ষতি করে ফেলছি, কারো ব্যক্তিস্বাধীনতায় আঘাত করছি। একইভাবে যারা এই বিনোদন নামক প্রলোভনের শিকার, তারাও বাস্তব অভিজ্ঞতার শিকার না হওয়া পর্যন্ত এই বিনোদন মোহে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে এবং ভুলে যায় নীতি ন্যায্যতা।
‘অ্যাটেনশন সিকিং ইকোনমি’ বা দর্শক, শ্রোতা, সর্বপরি ‘ক্রেতা’র মনোযোগ আকর্ষণের যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তার প্রধান বাজারই হলো সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এই যোগাযোগের মাধ্যমগুলো একদিকে যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, অন্যদিকে আমাদের অজ্ঞানে করে ফেলছে অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণাকে আমাদের অজান্তেই বদলে দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে মানুষের মন-মানসে পরিবর্তন আনছে এবং ঠেলে দিচ্ছে বিষণ্ণতার দিকে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। প্রায় প্রতিটি গবেষণাতেই ৪টি কারণ সর্বাগ্রে উঠে এসেছে। সেগুলো জানা প্রয়োজন।
- তুলনা করার মানসিকতা– সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমাদের মাঝে একপ্রকার তুলনা করার মানসিকতা গড়ে তুলছে। ফেসবুক বা টুইটারে প্রবেশ মাত্রই চোখে পড়বে নানাজনের নানা সফল্যের গল্পগাথা, যেগুলোর অধিকাংশই হয় অতিরঞ্জিত। কারো চাকরির খবর, কারো বা চাকরিতে পদোন্নতির সংবাদ, কারো প্রেমের সাফল্য, কারো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠালাভ, কারো নতুন গাড়ি কেনা, কারো নতুন বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট ক্রয়, কারো বা দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়াসহ হাজারজনের হাজার রকমের সাফল্য আর প্রাপ্তির সংবাদ ও ছবির ভিড়ে একজন মানুষ না চাইলেও সেগুলো নিজের সাথে তুলনা করতে বাধ্য! আর বাস্তবতা হলো, সকলের সাফল্য আকাশছোঁয়া হবে না, হওয়া সম্ভব নয়। তাই তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকাদের একাংশ অনুপ্রেরণা নিলেও বড় অংশটাই হতাশ হয়ে পড়ে নিজের জীবন, নিজের অবস্থান নিয়ে।
- ব্যক্তিযোগাযোগের অপ্রতুলতা– মোবাইল, টেলিফোন, ফেসবুক, ইমো, ভাইবারের যুগে ব্যক্তিযোগাযোগ আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। মানবমনের সবচেয়ে বড় উৎকর্ষ সাধনের উপায় হচ্ছে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, অর্থাৎ একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাৎ, কথাবার্তা, সম্পর্ক। অথচ এ ব্যাপারগুলো এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সেরে নিচ্ছি আমরা। ফেসবুকে ২ হাজার বন্ধু আছে এমন ব্যক্তিকেও এখন ডিপ্রেশনে ভুগতে দেখা যায়, কারণ, দিনশেষে নেটওয়ার্কের বাইরে গেলেই সে একা! পাড়া-মহল্লায় একত্র হয়ে আড্ডা দেয়ার এখন সময় কই? সর্বক্ষণ নিজের ভার্চুয়াল ইমেজ তৈরিতেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। একটি প্রোফাইল ছবি পরিবর্তনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে, নানারূপ কসরত করে ছবি তোলা, সেটি বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সম্পাদনা করা, সেটি আপলোড করবার পর বন্ধুতালিকার লোকজনের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা, প্রতিটি মন্তব্যের যুতসই প্রতিউত্তর দেয়া, এসব করতে করতে সূর্য কখন উদয় হচ্ছে আর কখন অস্ত যাচ্ছে সেসবও ভুলে যাচ্ছে অনেকে! এমনকি একত্রে বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা কোনো সফরেও সবাই ব্যস্ত হয়ে থাকছে যার যার নীল স্ক্রিনেই। ফলে বন্ধুত্ব এখন কৃত্রিম, সম্পর্ক এখন ভার্চুয়াল, যা দিনশেষে নিঃসঙ্গতা দূর করতে ব্যর্থ হয়।
- আত্মিক আনন্দ ও উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত- কোথাও ভ্রমণে গিয়েছেন, ভ্রমণ শেষে স্মার্টফোনের গ্যালারিতে ১ হাজার ছবি নিয়ে ফিরেছেন, কিন্তু কী কী দেখেছেন তা গ্যালারিতে প্রবেশ না করে বলতেই পারছেন না, এরকম কখনো হয়েছে আপনার? আপনার না হলেও আপনার পাশের বন্ধুটিই এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন নিশ্চিত। একসময় মানুষ পাহাড় দেখতে যেত তার বিশালত্ব উপলব্ধি করতে, সমুদ্রের গর্জনের সাথে তার অসীমত্ব দেখে নিজের ক্ষুদ্রতাকে আবিষ্কার করতে, সবুজ অরণ্যের মাঝে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে সজীব করতে। অথচ স্মার্টফোন আর ডিএসএলআর ক্যামেরার যুগে মানুষের ভ্রমণের কেন্দ্রে চলে এসেছে ছবি তোলা! ফেসবুকে, ইন্সটাগ্রামে আপলোড করবার জন্য বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল আর ফ্রেম বিবেচনা করে ছবি তুলতে তুলতে ক্যামেরার চোখে সবকিছু দেখেই আমাদের ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়, নিজের চোখে দেখা হয় না কিছুই! একবার ভাবুন তো, মাত্র ১৫/২০ মেগাপিক্সেলের ফোনের ক্যামেরা কিংবা ১২০ মেগাপিক্সেলের ডিএসএলআর দিয়ে তোলা ছবি মোবাইল/কম্পিউটারের সীমিত মেমোরিতে জমা করার জন্য কসরত না করে আমরা যদি আমাদের সাথে ৫৭৬ মেগাপিক্সেলের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো ২.৫ পেটাবাইট (২৫ লক্ষ গিগাবাইট) ধারণক্ষমতার জৈবিক মেমোরিতে সংরক্ষণ করতাম, সেটি কতই না আন্দদায়ক হতো!
- ঘুম ও মনোযোগে ব্যাঘাত– সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এখন তরুণ সমাজ শৈশবের ‘আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ’ কবিতাটি ভুলে গেছে। অর্ধেক রাত স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে চেয়ে থেকে পার করে দেয়াই এখন নতুন ট্রেন্ড। অধিক রাত জেগে থাকা এবং সকালবেলা দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা মানসিক এবং শারীরিক, উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। এতে করে অনেকেই নিদ্রাহীনতায় ভোগেন। অন্যদিকে পড়ালেখা বা অফিসের কাজকর্ম করার সময় কিছুক্ষণ পর পর টুংটাং শব্দে ম্যাসেঞ্জার তার অস্তিত্ব জানান দেয়। ফলে কোন ধরনের কাজেই পূর্ণ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যাসেঞ্জারে কিছুক্ষণ বন্ধুর সাথে খুনসুটি কাজে সুফলের চেয়ে কুফলই বয়ে আনে বেশি।
মূলধারার মিডিয়ার বাণিজ্যিকিকরণ
বর্তমানকালে মিডিয়ার প্রতি পুঁজিবাদী হয়ে যাওয়া নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে তা অনেকাংশেই সত্য। মিডিয়া এখন আর সাধারণ মানুষকে প্রকৃত সত্যের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না, বস্তবতার গভীর প্রবেশে সহায়তা করছে না। বরং, পুঁজিপতি মালিকের স্বার্থোদ্ধ্বারে প্রয়োজনমাফিক অতিরঞ্জন, প্রকৃত সত্যের বিকৃতি, আংশিক সত্য উপস্থাপন, মিথ্যা আশ্বাস প্রদানের মতো কাজ করে চলেছে। ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় মানুষের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করতে মিডিয়া তাদেরই ধ্যানধারণা আর দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করছে, কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। সিনেমাগুলো এখন আর বাস্তবতার সাথে মানুষের মেলবন্ধনের মাধ্যম নেই। কাল্পনিক সুখ, স্বাচ্ছন্দের গালভরা ইতিবাচক আশ্বাসে ভরপুর সিনেমাগুলোতে থাকছে না বাস্তবতার ছিটেফোঁটাও। ফলে মিডিয়ার সংস্পর্শে মানুষ যে পৃথিবীর সাথে পরিচিত হয়, প্রাত্যহিক জীবনে খুঁজে পায় সম্পূর্ণ বিপরীত, অধিকতর রূঢ় এবং অসমতায় ভরপুর এক পৃথিবী। তাতে করে মানুষের মানসিক প্রশান্তি কমছে বৈ বাড়ছে না।
যান্ত্রিক শহরায়ন
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা!” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২১ শতকে একজন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজে বলে দেয়া যায়। ঘুম থেকে ওঠা, গণপরিবহন যোগে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, একটানা ৮-১৬ ঘন্টা (উন্নত/অনুন্নত দেশে কর্মঘন্টার তফাৎ রয়েছে) কাজ করা, পুনরায় গণপরিবহনে চড়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে যাওয়া। এর মাঝে তাড়াহুড়ো করে তিনবেলা উদরপূর্তি। সকালে ঘড়ি কিংবা মোবাইলের অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, কনস্ট্রাকশন সাইটের শব্দ, শিল্পকারখানার ভারী শব্দ, যানবাহনের শব্দ, মাথার উপর দিয়ে খানিক পরপর উড়ে যাওয়া বিমানের শব্দ, রেলের শব্দ, স্মার্টফোনের শব্দ, চারদিকে শুধু শব্দ আর শব্দ। দিনের শুরু থেকে শেষ শহুরে মানুষের সময় কাটে নানাবিধ যান্ত্রিক শব্দ শুনে শুনে। এত কোলাহলের মাঝে নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা করা, একাগ্রতা সহকারে ধ্যান করার কোনো সুযোগ নেই। চাইলেও পাওয়া যায় না কিছুটা একান্ত, কোলাহল মুক্ত সময়। পরিসংখ্যান বলছে, শহরায়নের সাথে সাথে বিশ্বে একদিকে যেমন বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, অন্যদিকে বাড়ছে শব্দ দূষণের মাত্রাও। আর গবেষণা বলছে, শব্দদূষণের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবটি পড়ে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।
ধর্মীয় ও সামাজিক আচার প্রথার বিলোপ
আধুনিক সমাজের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রচলিত ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রথাবিরোধী মনোভাব। সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ম চর্চা কমছে, হালকা হয়ে যাচ্ছে ধর্মের অনুশাসন। ‘দ্য জার্নাল অব হ্যাপিনেস অ্যান্ড ওয়েলবিং’ এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধর্মীয় অনুশাসন লোপ সমাজের সামষ্টিক সুখে টান পড়ার অন্যতম কারণ। এই গবেষণা অনুযায়ী ধার্মিক ব্যক্তিরা অধার্মিকদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সুখী। এর প্রধানতম কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে সন্তুষ্টি এবং কৃতজ্ঞতাবোধের ব্যাপারটি। ধার্মিকগণ সাধারণত ভাগ্যে বিশ্বাসী হন। ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টার পাশাপাশি তারা নিজেদের বর্তমান অবস্থানের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যদিও বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থায় এর ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আত্মতুষ্টির কারণে ধার্মিকগণ চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন না। তবে এ গবেষণায় বস্তুবাদীদের জন্য উঠে এসেছে বিপরীত এক তথ্য। বস্তুবাদীরা সাধারণত ভাগ্যে বিশ্বাসী হন না এবং তারা সাফল্যের কোনো সীমানা নির্ধারণ করেন না। আধুনিকমনা একজন বস্তুবাদী মানুষের জন্য চূড়ান্ত সাফল্য বলতে কিছু নেই। আর এ ব্যাপারটি তাকে ঠেলে দেয় অসীম প্রতিযোগীতার মাঝে। কোনো অর্জনই তখন সন্তুষ্টি আনয়ন করতে পারে না। ফলে, নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং গতানুগতিক সাফল্যের পরও হতাশাই বয়ে বেড়ায় একটা বড় অংশ।
এক্ষেত্রে তথাকথিত ‘ভার্চুয়াল মোটিভেশন’ এরও কিছুটা ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের ক্ষেত্রে যারা জীবনের নানা সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে সমাধান খুঁজতে নানাবিধ অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতা (মোটিভেশনাল স্পিচ), প্রেরণাদায়ী নাটক, ভিডিও, সিনেমা দেখে থাকে। অথচ তার পরিবারই হতে পারতো তার সহজতম সমাধান! ভার্চুয়াল জগতের এসব অণুপ্রেরণা পুরোটাই থাকে জয়ীদের জন্য। পরাজিতদের নিয়ে কিছু তৈরি হয় না। এসব বক্তৃতা বা ভিডিও কন্টেন্ট তরুণদের মাঝে এমন বিশ্বাস জাগায় যে, যে কেউ চেষ্টা করলে অ্যাপলের সিইও কিংবা নাসার বিজ্ঞানীদের মতো সফল হতে বাধ্য। এখানে সাফল্যের মাপকাঠি ঠিক করে দেয়া হয় অনেক উঁচুতে, যা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। অনেকের জন্যই এই অনলাইন আধেয়গুলো উপকারী হলেও পাশাপাশি আরেকটা বড় শ্রেণীকে এটি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলছে। কেননা, একটি সহজাত সত্য হচ্ছে সমাজের প্রতিটি মানুষ সম পরিমাণ সাফল্য পায় না। বরং, বড় অংশই থেকে যায় চূড়ান্ত সাফল্য থেকে দূরে। সাফল্য থেকে দূরে থাকা এই শ্রেণী নিজেদের কোনো অর্জনকেই গ্রহণ করতে পারে না। কারণ, তাদের মনমগজে বদ্ধমূল থাকে সাফল্যের উচ্চ মাপকাঠি। এভাবে হতাশাগ্রস্ত তরুণের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।
ভোগবাদ
জনাব সাদিক (কাল্পনিক নাম) মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে তার দিনকাল সুখেই কেটে যাচ্ছিল। তার স্ত্রী টিভিতে নিজের একটি পছন্দের চরিত্রকে আইফোন-১০ ব্যবহার করতে দেখে সাদিকের কাছে বায়না ধরলো তা কিনে দেয়ার জন্য। সাদিক কিস্তিতে স্ত্রীকে একটি আইফোন-১০ কিনে দিল। পরের মাস থেকে কিস্তির টাকা দেয়ার জন্য তার আর সঞ্চয় রইলো না। পরবর্তী মাসে তার মেয়ে বায়না ধরলো দামি ‘পাখি জামা’র জন্য। মাসিক কিস্তি দেয়ার পর সাদিকের সে বায়নাও পূরণ করতে হলো। এরপর পাশের বাসার ভাড়াটিয়ারা সোফা কেনায় সাদিককেও ধারদেনা করে বাণিজ্যমেলা থেকে দামী সোফা কিনতে হলো। অন্যদিকে, আগে সাদিক স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ছুটির দিনে ঘুরতে যেতেন। এখন তাদের আবদার রক্ষা করতে তার যেতে হচ্ছে কোনো ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টে। সব মিলিয়ে সাদিকের খরচ এত বেড়ে গেল যে তার পার্টটাইম চাকরির জন্য চিন্তা করতে হলো। তার সংসারেও আগের মতো স্বচ্ছলতা রইলো না।
এই কাল্পনিক গল্পটি কিন্তু বর্তমান সমাজের হাজারো সাদিকের বাস্তব জীবনের গল্প। বর্তমান সমাজ সর্বক্ষণ বিজ্ঞাপন আর পণ্য বিপণনের আধেয়তে ভরপুর মিডিয়ার কল্যাণে এতটা ভোগবাদী হয়েছে যে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে এখন আর মানুষ সুখ খুঁজে পাচ্ছে না। প্রত্যহ মিডিয়ার প্রচারণার দরুন নতুন নতুন অমূলক চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, আর সে চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আরাম আয়েশ সব বিসর্জন দিতে হচ্ছে মানুষকে। একটি আইফোন (আরো যেকোনো পণ্য হতে পারে) না থাকলে সাদিকের স্ত্রীর জীবনে কোনো সমস্যাই হতো না। অথচ মিডিয়ার অত্যধিক অতিরঞ্জিত প্রচারণার কাছে নতি শিকারের পর তার মনে হয়েছিল আইফোন হয়তো জীবনটাকে আরেকটু সুখের করবে! লেখক শাহজাদ ফিরদাউসের ‘শাইলকের বাণিজ্যবিস্তার’ বইটির নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে ভোগবাদের কাছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কাছে মানুষ বিসর্জন দিচ্ছে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, নিজস্বতাবোধ আর সর্বোপরি নির্মল মানসিক প্রশান্তি।
আধুনিককালে মানুষ কেন মানসিকভাবে অসুখী হয়ে যাচ্ছে, তার ফিরিস্তি দিতে থাকলে আর শেষ হবে না। তবে উপরে উল্লিখিত কারণগুলোকে বলা যেতে পারে প্রধানতম কিছু কারণ। এগুলো সমাধানের উপায় কী? উপায় আর কিছুই না, কেবল উপলব্ধি। আপনাকে কেবল উপলব্ধি করতে হবে আপনার মানসিক অশান্তির কারণগুলো, ভেবে দেখতে হবে সে কারণগুলোর সাথে আপনি কতটা সম্পর্কিত। অতঃপর কীভাবে এই সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সুখী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তা নিজে থেকেই জেনে যাবেন।