কোনো সাফল্য অর্জনের পর কখনো কি এমন মনে হয়েছে, “এই রে, ভাগ্য ভালো ছিলো বলে জিতে গেলাম। কিন্তু দ্রুতই আমি ধরা পড়ে যাবো। সবাই বুঝে ফেলবে যে, আমি আসলে জানিই না কী করে কী হলো! এমনিতে আমি তো একটা গোবর গণেশ।” অথবা ধরুন, কোনো প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে জিতে জাতীয় পর্যায়ে এলেন। এমন কি কখনো মনে হয়েছে, “আগেরবার ভাগ্যবান ছিলাম দেখে উতরে গেছি! এইবার স্টেজে উঠে অপমানিত হতে হবে।” নিজেকে ‘কাকতালীয়ভাবে সৌভাগ্যবান’ আর সেই সাথে পাশের প্রতিযোগীদের প্রকৃত যোগ্য কি কখনো মনে হয়েছে? কিংবা সেই প্রতিযোগিতা থেকে স্বর্ণপদক নিয়ে ফিরে আসবার পরে নতুন কোনো প্রতিযোগিতায় গিয়ে আবারও কি “এই রে.. এইবার অন্তত ঠিকই ধরা খেয়ে যাবো” ধরনের অনুভূতি হয়েছে?
অনৈতিক উপায়ে কোনো অর্জন থেকে থাকলে এমন ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আপনি নায্যভাবেই নিজের গুণেই কিছু একটা অর্জন করলেন তখন? তখন ওপরের ব্যাপারটি মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় কি? মজার ব্যাপার হলো, উচ্চ সফল ব্যক্তিদের ভেতর এমন অনেক মানুষই আছেন, যারা ওরকম করে ভাবেন। এত অর্জনের পরও নিজের যোগ্যতা নিয়ে আস্থার অভাবে ভোগেন তারা। নিজের অদৃশ্য ‘অযোগ্য’ রূপ যেন তারা একাই দেখতে পান, এবং এজন্যই এই ভয়ে তটস্থ থাকেন, পাছে লোকে বুঝে ফেলে আমার অযোগ্যতা! এরকম মনস্তত্ত্বেরও কিন্তু আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এই ধরনের চিন্তা মূলত এক প্রকার মানসিক ব্যধি, নাম ইমপোস্টার সিনড্রোম।
ইমপোস্টার সিনড্রোম আসলে কী
ইমপোস্টার শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রতারক, শঠ, ঠক। তো ইমপোস্টার সিনড্রোম শব্দটির বাংলা করতে গেলে সেটি দাঁড়াবে ‘প্রতারক ব্যাধি’। নামকরণ থেকে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হলো না রোগের ধরনটা? সেটাই স্বাভাবিক। নামকরণের প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে এক্ষেত্রে একটু বিশদ আলোচনার প্রয়োজন।
দুই মার্কিন মনস্তত্ববিদ পলিন ক্লেন্স ও সুজেন আইমেস ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ‘ইমপোস্টার সিনড্রোম’ পরিভাষা ব্যবহার করেন। এই পরিভাষা দ্বারা এক অদ্ভুত ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বান্দ্বিকতার কথা বলা হয়। এই দ্বন্দ্বে ভোগা একজন ব্যক্তি নিজেকে অপকৃষ্ট বা ইনফেরিয়র ভাববে নানা দিক থেকে, হোক সে বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ, মর্যাদা, খ্যাতি ইত্যাদিতে; অথচ যেখানে কিনা তাদের বলার মতো অনেক অর্জনই আছে। এরা প্রবলভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী যেমন হয়, তেমনি নিজের স্ব-আরোপিত দুর্বলতা নিয়ে সবসময় দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। কীসের দ্বিধা? সেই চিরন্তন দ্বিধা। পাছে লোকে কিছু বলে! অন্যরা এই বুঝি দেখে নিলো, এই বুঝি জেনে নিলো, এই বুঝি ধরা পড়ে যাবো- এমন একটা ভয় তাদের সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা মনে করে, এই ইনফিরিয়রিটি কিংবা স্ব-আরোপিত দুর্বলতাগুলোই তাদের আসল রূপ, যেটাকে মেকি আত্মবিশ্বাস ও নানারকম ‘সৌভাগ্যপ্রসূত’ অর্জনের মুখোশে সে ঢেকে রেখেছে। এর কারণে তার নিজেকে প্রতারক প্রতারক মনে হতে থাকে এবং মনে হতে থাকে প্রতিনিয়তই এই ‘প্রতারক’কে সবাই ‘চোখে চোখে রাখছে’; এবং শীঘ্রই সবাই তার ‘আসল’ রূপ জেনে যাবে। এটিই হচ্ছে ইমপোস্টার সিনড্রোম।
ইমপোস্টার সিনড্রোমের কথা হচ্ছে, অনেক উচ্চ সফল ব্যক্তিরও একটি গোপন দিক থাকে। আড়ালে আড়ালে এত অর্জন থাকবার পরও তারা তারা মনে করেন, তাদের যত সফলতা, সবটাই হয়তো দৈবিকভাবে হয়ে যাচ্ছে। লোকে যখন তাকে সফল ভাবছে, তখন তার ভেতর ভেতর মনে হয়, ‘আমার কৃতিত্ব তো সামান্যই।’ এ দ্বন্দ্বের দরুন নিজেকে প্রতারকই মনে হয় বৈকি। আর প্রতারক মনে হলে ‘প্রতারণা’ ধরে পড়ে যাওয়ার ভয়ও থাকে। সব মিলিয়ে ইমপোস্টার সিনড্রোম মানেই এক বিতিকিচ্ছিরি মানসিক অবস্থা।
হরেক রকম ইমপোস্টার সিনড্রোম
আচরণের ধরনের ওপর ভিত্তি করে অনেক রকম ইমপোস্টার সিনড্রোম দেখা যায়। এই বিভিন্নতা সৃষ্টি হয় কারো সামাজিক-পারিবারিক অবস্থা, ব্যক্তিত্ব ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। বিশেষজ্ঞ ভ্যালারি ইয়ং তার বই ‘দ্য সিক্রেট থটস অফ সাক্সেসফুল উইমেন: হোয়াই ক্যাপাবল পিপল সাফার্স ফ্রম দ্য ইমপোস্টার সিনড্রোম এন্ড হাও টু থ্রাইভ ইন স্পাইট অব ইট’-এ ইমপোস্টার সিনড্রোমে ব্যক্তির আচরণকে ৫টি প্রকারে ভাগ করেছেন।
১। পারফেকশনিস্ট বা অতি-নিখুঁতভাবে চলতে চাওয়া ব্যক্তি
২। অতিমানবীয় ব্যক্তি
৩। সহজাত প্রতিভাবান
৪। অতি স্বাতন্ত্র্যবাদী
৫। দক্ষ-অভিজ্ঞ
এই পাঁচ ধরনের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ইমপোস্টার সিনড্রোম প্রকাশের রূপও যায় বদলে।
- ধরুন আপনি পারফেকশনিস্ট, কারণ আপনি সব কিছুই নিখুঁতভাবে করতে চান, দলের বাকিদের ওপর ভরসা করতে ইচ্ছে করে না। কারণ তারা আপনার মতো ‘নিখুঁতভাবে’ কাজ করতে পারে না। তো, যদি হন পারফেকশনিস্ট, আপনি নিশ্চয়ই প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আর এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা সবসময় পূর্ণ হওয়ার নয় বলে আপনার সন্তুষ্টিও সহজে আসে না। অসন্তুষ্টি থেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাব, আর তা থেকেই আসে ইমপোস্টার সিনড্রোম।
- ধরুন, আপনি দিনরাত অমানবিক/অতিমানবিক খাটুনি খাটেন। এমনকি কর্মক্ষেত্রে পরিশ্রম দেখাতে গিয়ে সাধ, আহ্লাদ, শখ সব বিসর্জন দিয়েছেন। আপনি নিজেকে কোথাও হয়তো কম যোগ্য ভাবছেন। তাই অতি পরিশ্রম দেখিয়ে প্রাপ্ত সাফল্যকে ‘হালাল’ করতে চাইছেন।
- কিংবা আপনি সহজাত প্রতিভাবান। পারফেকশনিস্টের মতোই আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আপনার ইমপোস্টার সিনড্রোমের ধরনটা হবে পারফেকশনিস্টের মতোই। কেবল আপনি একবারের বা অল্প প্রচেষ্টায় সব পেতে গিয়ে প্রায়শ হতাশ হন, এটাই পার্থক্য।
- অতি স্বাতন্ত্র্যবাদীরা মনে করে, কারো সাহায্য নিলে বোধ হয় তার কৃতিত্ব আর থাকবে না। এজন্য একাই তারা সব কাজ করতে যায়। এদের ক্ষেত্রে ইমপোস্টার সিনড্রোম আরেক রকম। সাহায্য নিতে তারা এজন্য ভয় পায় যে, পাছে লোকেরা ভাবে তার নিজের যোগ্যতা নেই! যোগ্যতার স্ব-আরোপিত এ অভাব ঢাকতে তারা আরো অদ্ভুত আচরণ করে।
- দক্ষ বা অভিজ্ঞরা অনেকসময় নিজের অদক্ষতা বা অনভিজ্ঞতা আড়াল করবার জন্য তটস্থ থাকেন। এই বুঝি কেউ বলে বসলো, “এই আপনার অভিজ্ঞতা!” ব্যস, আরেক ধরনের ইমপোস্টার সিনড্রোমের লক্ষণ দেখা দেবে।
ইমপোস্টার সিনড্রোম থেকে বেরুনোর উপায়
যেহেতু ব্যক্তিজীবনের সাফল্যের সাথে সরাসরি সংযুক্তি আছে এ সিনড্রোমের, তাই কর্মজীবনের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবার সাথেও ইমপোস্টার সিনড্রোম যোগ আছে। এই সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থেই এ সিনড্রোম কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
সামাজিক দক্ষতা বাড়ান
ইমপোস্টার সিনড্রোমে আপনি সবসময়ই ভাবেন, আপনি অযোগ্য, অন্যরাই প্রকৃত যোগ্য, যারা আপনাকে ‘বিচার’ করছে। অর্থাৎ এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, আপনি মানসিকভাবে অন্যদের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। সুতরাং সকলের সাথে মিশুন। দারুণ কিছু বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলুন কর্মক্ষেত্রে। তাতে করে আপনি তাদের সীমাবদ্ধতা জানতে পারবেন, মানসিক দূরত্ব কমে আসবে এবং নিজে আশ্বস্ত হবেন যে, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন ‘অযোগ্য’ আপনি নন!
নিজের অর্জনগুলোর দিকে বারবার তাকান
আপনি নিজের অর্জনকে ‘ছোট’ করে দেখছেন নিজেকে তার ‘যোগ্য’ মনে না করে। তার মানে এটা তো অবশ্যই মানেন যে, আপনি কিছু হলেও ‘অর্জন’ করেছেন? ব্যস, এই অর্জনগুলোর দিকেই ফোকাস করুন। কেননা বুদ্ধিমানেরা একটি গ্লাসকে অর্ধেক খালি দেখে না; অর্ধেক ভরা দেখে। নিজের সবথেকে বড় অনুপ্রেরণার আধার করুন নিজেকেই।
রমিজের আয়না নাটকে ভাগ্য ফেরাতে রমিজ গিয়েছিলো এক জ্যোতিষের কাছে। জ্যোতিষ বুঝেছিলেন, রমিজের সমস্যা কোথায়! তিনি রমিজকে একটি আয়না দিয়েছিলেন। রমিজ রোজ ঐ আয়না দেখতো, আর পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে অফিসে যেতো। আয়নার প্রতি বিশ্বাসের জোরে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিলো, যার গুণেই ফিরেছিলো রমিজের ভাগ্য। পরে জ্যোতিষের কাছে গেলে রমিজকে জ্যোতিষ বলেন “এই আয়নার আর কোনো প্রয়োজন নেই!” রমিজও বুঝতে পারে যে, আয়না দেখে তার ভাগ্য ফেরেনি, রমিজ নিজের গুণেই নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছিলো। নিজের সেই গুণ উপলব্ধি করুন। বিশ্বাস রাখুন, আপনি আগেও পেরেছেন, এবারও পারবেন; ভাগ্য নয়, নিজের গুণেই আগেও জিতেছেন, সামনেও জিতবেন।
সমালোচক নয়, আত্মসত্তাকে গড়ে তুলুন প্রশিক্ষক হিসেবে
আত্মসমালোচনাকে বন্ধ করতে বলা হচ্ছে না, কেবল বলা হচ্ছে সেই সমালোচনাকে কিছুটা উৎপাদনমুখী করুন। অর্থাৎ সমালোচকের মতোই সমালোচনা করে ‘খালাস’ হয়ে যাবেন না যেন! নিজের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করুন, দরকার হলে অন্যেরও সাহায্য নিন। শুধু নিজের খাদে পড়ে যাওয়া নিয়ে আফসোস বা সমালোচনা নয়, খাদ থেকে নিজেকে টেনে তুলবার জন্য আরেকটি হাত নিজেই বানান। নিজের ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত হয়ে দুর্বলতাকে স্থায়ী জ্ঞান করবেন না।
অন্যদের সাথে কথা বলুন, নিজের সত্তাকে বারবার আবিষ্কার করুন, নিজেকে চিনুন। অন্যান্য সফল ব্যক্তিরা সাফল্যকে কীভাবে গ্রহণ করেন, জানুন; ব্যর্থতা থেকে তারা কীভাবে উঠে দাঁড়ায়, তা-ও জানুন। ইমপোস্টার সিনড্রোম তো হয় নিজেকে ভাগ্যগুণে সাফল্য পাওয়া কোনো এক ‘অযোগ্য’ জ্ঞান করা থেকেই। সুতরাং আত্মসত্তার প্রশিক্ষণে নিজেকে অযোগ্য মনে হবার কারণগুলোকেই ঝেড়ে ফেলুন।
ফিচার ইমেজ: The Post Athens