আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন,
ইন্টারনেটে আমার নামে প্রচারিত উক্তিগুলো বিশ্বাস করবেন না। কারণ, ওগুলোর অধিকাংশই আমি বলিনি।
না, এটাও আসলে আইনস্টাইনের কথা না। কারণ আইনস্টাইনের সময় ইন্টারনেটই ছিল না। তবে কথাটি শতভাগ সত্য। কোনো এক অদ্ভুত কারণে মানুষ বিভিন্ন উক্তি বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে চালিয়ে দিতে বেশ পছন্দ করে।
ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত উক্তিগুলোর একটা বড় অংশই আসলে ভুল। এ ভুলগুলো মোটামুটি তিন প্রকার। প্রথমত, কিছু উক্তি আছে যেগুলো পরিবর্তিত বা বিকৃত উক্তি। মূল বক্তা যা বলেছিলেন, সেটা বিকৃত হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সেগুলোর মূল অর্থই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, কিছু উক্তি আছে যেগুলো বলেছেন অখ্যাত অথবা কম বিখ্যাত কেউ, কিন্তু সেগুলো ইন্টারনেটে পরিচিতি পেয়েছে অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির নামে। আর তৃতীয়ত, কিছু উক্তি আছে যেগুলোর উৎসের কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না, কিন্তু ইন্টারনেটে সেগুলো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম দিয়ে অহরহ ব্যবহৃত হয়।
ভুল অথবা মিথ্যা উক্তির সৃষ্টি হতে পারে অজ্ঞতা বা স্মৃতির দুর্বলতা থেকে। কিন্তু অনেক সময়ই এটি হয়ে থাকে, নিজের বক্তব্যকে জোরালো করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের বক্তব্যকে বিখ্যাত কারো নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে। ইন্টারনেটের কল্যাণে তথ্যের প্রবাহ সহজ হয়ে যাওয়াতে, যেকোনো ব্যবহারকারীর পক্ষেই বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির ছবির নিচে একটি উক্তি টাইপ করে ফেসবুক বা অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, যা হয়তো ধীরে ধীরে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।
ভুল অথবা মিথ্যা উক্তির আরেকটি বড় উৎস হলো চলচ্চিত্র এবং সাহিত্য। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী অবলম্বনে যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হয় অথবা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, তখন তা হুবহু ইতিহাসকে অনুসরণ করে না। শিল্পের স্বার্থেই নির্মাতা সেখানে কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেন, কাল্পনিক সংলাপ রচনা করেন। দর্শক বা পাঠকরা অনেক ক্ষেত্রেই এই সংলাপগুলোকে ঐতিহাসিক সত্য বলে ভুল করেন।
ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি ভুয়া উক্তি ব্যবহৃত হয় সম্ভবত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামে। এরপরেই আছেন আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, থমাস জেফারসন সহ অন্যান্যরা। চলুন দেখে নেই ইন্টারনেটে বহুল প্রচলিত কিছু বিখ্যাত উক্তি, যেগুলো আসলে ভিত্তিহীন।
১। প্রত্যেকেই প্রতিভাবান। কিন্তু যদি আপনি একটি মাছকে তার গাছে চড়ার সক্ষমতা দিয়ে যাচাই করেন, তাহলে সে সারাজীবন নিজেকে বোকা মনে করেই কাটিয়ে দিবে।
– আলবার্ট আইনস্টাইন
ইন্টারনেটে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মোটিভেশনাল কোট এটি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার পর তাদেরকে সান্তনা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার গলদ বোঝানোর জন্য এই উক্তিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। উক্তিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনস্টাইনের নামে উদ্ধৃত করা হলেও, বাস্তবে এর সাথে আইনস্টাইনের কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর ৪৯ বছর পর, ২০০৪ সালে সর্বপ্রথম উক্তিটির ব্যবহার দেখা যায়।
২। দুটো জিনিস অসীম- মহাবিশ্ব এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতা। এবং মহাবিশ্বের ব্যাপারে আমি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত না।
– আলবার্ট আইনস্টাইন
এটি সম্ভবত আইনস্টাইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তি। কিন্তু উক্তিটি আসলেই আইনস্টাইনের কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। উক্তিটি সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯৪০ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে, যেখানে লেখক ফ্রেডেরিখ এস পার্লস বলেন,
একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বলেছেন, “আমরা যতদূর জানি, দুটো বিষয় অসীম- মহাবিশ্ব এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতা।” কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি, উক্তিটি সম্পূর্ণ সত্য না। কারণ আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন যে, মহাবিশ্ব সসীম।
লক্ষণীয়, লেখক এখানে মূল উক্তিটির ক্ষেত্রে ‘একজন জ্যোতির্বিদ’ এর কথা বলেছেন। আর বাক্যের শেষে আইনস্টাইনের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন, যা থেকে বোঝা যায়, মূল উক্তিটি আইনস্টাইনের না। তবে এই লেখক একই বইয়ের পরবর্তী সংস্করণগুলোতে একাধিকবার উক্তিটি আংশিক পরিবর্তন করেন এবং সেটিকে আইনস্টাইনের বলে উল্লেখ করেন।
৩। আপনি যদি একটি বিষয় আপনার দাদীকে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, তার মানে আপনি বিষয়টি বোঝেননি।
– আলবার্ট আইনস্টাইন
এই উক্তিটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু এর সাথেও আইনস্টাইনের কোনো সম্পর্ক নেই। মূল উক্তিটির বক্তা হচ্ছেন মার্কিন সাহিত্যিক কার্ট ভনেগাট। মূল উক্তিটি হচ্ছে এরকম: “কোনো বিজ্ঞানী যদি আট বছর বয়সী কাউকে বোঝাতে না পারেন যে তিনি কী করছেন, তাহলে তিনি একজন প্রতারক।”
৪। যদি আমি জানি যে একটি গাছ কাটার জন্য আমার হাতে আট ঘণ্টা সময় আছে, তাহলে আমি প্রথম ছয় ঘন্টা সময় ব্যয় করব কুড়াল ধার দেওয়ার কাজে।
– আব্রাহাম লিংকন
গবেষক গ্যারসন ও’টুলের মতে, এই উক্তিটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ১৯৫৬ সালে একটি কৃষি বিষয়ক গবেষণাপত্রে, যেখানে একজন কাঠুরের উদ্ধৃতি দিয়ে এটি উল্লেখ করা হয়েছিল। মূল উক্তিটি ছিল এরকম: “এক কাঠুরেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনাকে যদি একটি গাছ কাটার জন্য মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হয়, তাহলে আপনি কী করবেন? কাঠুরে উত্তর দিয়েছিল, আমি প্রথম আড়াই মিনিট ব্যয় করব আমার কুড়ালটি ধার দেওয়ার কাজে।”
৫। আপনি সবসময়ই কিছু মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন এবং কিছু কিছু সময় সব মানুষকেই বোকা বানাতে পারবেন, কিন্তু আপনি সব মানুষকে সবসময় বোকা বানাতে পারবেন না।
– আব্রাহাম লিংকন
আব্রাহাম লিংকনের নাম দিয়ে এই উক্তিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও ব্যবহার করেছিলেন! কিন্তু উক্তিটি লিংকনের না। এর মূল উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না।
৬। মন্দ লোকদের বিজয়ের জন্য ভালো মানুষদের চুপ থাকাই যথেষ্ট।
– থমাস জেফারসন
‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ কোটেশান্স’ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী এই উক্তিটি হচ্ছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তি। অসাধারণ উক্তি, সন্দেহ নেই, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন কখনোই এটি বলেননি। এই উক্তিটি দার্শনিক এডমুন্ড বার্কের বলেও প্রচলিত আছে। কিন্তু গবেষক অ্যানা বার্কার্স প্রমাণ করেন যে, উক্তিটি থমাস জেফারসন বা এডমুন্ড বার্ক দুজনের কারোই না। ধারণা করা হয়, ১৮৬৭ সালে দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল সর্বপ্রথম এটি বলেন।
৭। রাগ পুষে রাখা হচ্ছে উত্তপ্ত কয়লা ধরে রেখে আশা করার মতো যে, এতে অন্য কারো হাত পুড়বে।
– গৌতম বুদ্ধ
এই উক্তিটি গৌতম বুদ্ধের ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধ ঠিক এভাবে বলেননি। তিনি বলেছেন,
“যখন আমরা অন্যের প্রতি রাগ প্রদর্শন করি, তা আমাদের দিকে এমনভাবে ফিরে আসে, যেন সূক্ষ্ম ধূলিকণাকে বাতাসের বিপরীতে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে।”
৮। আমি আপনার বক্তব্য পছন্দ করি না, কিন্তু আপনার বক্তব্য দেওয়ার অধিকার আমি আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করব।
– ভলতেয়ার
অত্যন্ত জনপ্রিয় এই উক্তিটি ভলতেয়ারের নামে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও ভলতেয়ার কখনোই এটি বলেননি। এটি তার জীবনীকার এভেলিন বিয়েট্রিস হল ভলতেয়ারের জীবন দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের ভাষায় লিখেছিলেন।
৯। আমেরিকানদের উপর সবসময় ভরসা করা যায় যে তারা সঠিক কাজটি করতে পারবে, কিন্তু সেটা অন্য সবগুলো চেষ্টা করার পর।
– উইনস্টন চার্চিল
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের এই উক্তিটি আমেরিকানদেরকে উপহাস করার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। কিন্তু মূল উক্তিটি আসলে চার্চিলের না, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এফ. ই. স্মিথের।
১০। ব্যাংকার হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আপনাকে একটি ছাতা ধার দেবেন, কিন্তু ঠিক যখন বৃষ্টি পড়া শুরু হবে, তখনই তা ফেরত চেয়ে বসবেন।
– মার্ক টোয়েন
অসাধারণ বাস্তবসম্মত উক্তি। কিন্তু মার্ক টোয়েন এটি কখনো বলেছিলেন কিনা, তার কোনো প্রমাণ নেই। TwainQuotes ওয়েবসাইটেও এই উক্তিটি সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়া আছে যে, এটি মার্ক টোয়েনের উক্তি কিনা, তা প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করা উচিত হবে না।