বর্তমান সময়টা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। আর বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা আজ এমন সব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারছি যা কিনা ২০ বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল। বাবা-মার কাছ থেকে পরদেশে থাকা সন্তান ইচ্ছে হলেই বাবা-মাকে চোখের দেখা দেখতে পারে একটা ভিডিও কলের মাধ্যমে, এক্ষেত্রে দূরত্ব আর কষ্ট উভয়ই কিছুটা হলেও কমে। বলছি ইন্টারনেটের সুবিধার কথা। ইন্টারনেট সমগ্র বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষকে তার ধুম্রজালে জড়িয়ে রেখেছে। ইন্টারনেটের সুবিধা আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে।
বিনোদন, যোগাযোগ, শিক্ষা, গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইন্টারনেট আমাদের জন্য খুবই সহায়ক। বিশাল তথ্য ভান্ডার আর বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে ইন্টারনেট মানুষের কাছে এক পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে। শিশুরাও ইন্টারনেটের জটিল জালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একজন অভিভাবক হিসেবে কখনো ভেবে দেখেছেন কি যে অনেক সহজলভ্যতার এই ইন্টারনেট আপনার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ নাকি ক্ষতির কারণ? আসুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক এ সম্পর্কেই।
আধুনিক যুগের বাবা-মায়েদের মুখে আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, শিশুরা ইউটিউবে মজার মজার কার্টুন না দেখে নাকি খাবার খেতেই চায় না! ঘটনা অনেকাংশেই সত্য। বর্তমানে ভালোভাবে বেঁচে থাকা এবং সন্তানের আগামী ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাবা ও মা উভয়কেই জীবিকা অর্জনের পথ বেছে নিতে হয়। স্কুলের পরে হয়ত সন্তানকে বেশ কিছুটা সময় বাবা-মাকে ছাড়াই থাকতে হয়। এই সময়টা যাতে তার ভালোভাবে কাটে সেজন্য অনেক অভিভাবকই খুব ছোটবেলা থেকেই সন্তানের হাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দেন ইন্টারনেট সংযোগ সহ। শুধু এই কারণেই নয়, অনেক সময় স্কুলের বিভিন্ন প্রোজেক্ট বা পড়াশোনা বিষয়ক আরো তথ্য সংগ্রহের জন্যও শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা সন্তানকে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ করেই ভেবে বসেন সন্তান আমার এবার অনেক কিছু শিখবে। তারা ভুলে যান প্রত্যেকটা জিনিসেরই একটা ভালো এবং খারাপ দিক থাকে। ইন্টারনেট যেমন আমাদের জন্য অনেক ভালো তথ্যবহুল একটি বন্ধু, ঠিক তেমনই কিছু খারাপ লোকের চিন্তার ফলস্বরূপ ইন্টারনেটে অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট, গ্যাম্বলিং সাইট ও বহু অনিরাপদ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে, যা সম্পর্কে একজন অভিভাবকের সতর্ক থাকা উচিত এবং সে অনুযায়ী তার সন্তানকে সচেতন ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এমনটা হওয়া উচিত নয় কখনো যে আপনার সন্তান আপনার চেয়ে অনেকটা বেশী ইন্টারনেটের অলিগলি সম্পর্কে অবগত।
প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন শিশুরা সাধারণত কম্পিউটারে অনেক সময় অনলাইনে গেম খেলে থাকে। এরপর মাধ্যমিক স্কুলে উঠার পর অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন স্কুলের বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে ইন্টারনেটের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় পড়াশোনার পাশাপাশি বয়সগত কারণে সবার বন্ধু তৈরির প্রবণতাটা বেড়ে যায়। পড়াশোনার তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি তারা নানা রকম সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে ফেলে নতুন বন্ধু খোঁজার উদ্দেশ্যে। সব বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে নজর রাখার প্রয়োজন হলেও এই বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশী সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
আপনার অনুপস্থিতিতে ইন্টারনেট আপনার সন্তানের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যা আপনার কাছে অনুচিত বলে মনে হচ্ছে তার গ্রহণযোগ্যতা বয়স ও অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার ভিত্তিতে আপনার সন্তানের কাছে ভিন্নও হতে পারে। তথ্য ও ছবি সমৃদ্ধ অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু আপনার সন্তানের মন-মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং অসংলগ্ন আচরণের কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। আপনার সন্তানের সামনে কী কী অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু চলে আসতে পারে তার একটা তালিকা এখানে দেয়া হলো:
- পর্নোগ্রাফি
- গ্যাম্বলিং সাইট
- অশ্লীল বচন সমৃদ্ধ তথ্য
- কিছু ওয়েবসাইট আছে যা বর্বরতা, অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, এমনকি আত্মহত্যার প্রতি অনুপ্রাণিত করে
- ছবি, ভিডিও বা গেমস যা অন্যান্য মানুষ বা প্রাণীর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা দেখায়
- অনিরাপদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা চ্যাট রুম
কৌতুহলবশত এসব সাইটে জেনে বা না জেনে আপনার সন্তানের একটি লিংক ক্লিক তাকে ইন্টারনেটের একটি অন্ধকার জগতে নিয়ে যেতে পারে।
হাজারো উপকার সত্ত্বেও ইন্টারনেট আপনার সন্তানের জন্য কীভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে তা নিম্নরূপে ব্যাখ্যা করা হলো।
- ইন্টারনেটে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওয়েবসাইটের অভাব নেই। এছাড়া নানা ধরনের সাইট অ্যাড পোস্টের মাধ্যমে চলে আসে। আর এসব থেকে আপনার সন্তান খুব সহজেই অ্যাডাল্ট চ্যাট রুম, সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট, পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটসহ আরো নানা ধরনের অনুপযুক্ত ওয়েবসাইটের সান্নিধ্যে চলে আসতে পারে, যা আপনার সন্তানের মানসিক বৃদ্ধিতে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- শিশুরা নতুন নতুন অনেক বন্ধু পেতে ভালবাসে। বাস্তবে একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া এবং একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির চেয়ে অনলাইনের অদৃশ্য জগতে বন্ধু তৈরি করা অনেক সহজ। কারণ ভার্চুয়াল জগতে নিজের মিথ্যে পরিচয় তৈরি করা খুব সহজ এবং অপরপ্রান্তের মানুষটির সাথে যেহেতু সরাসরি দেখা হচ্ছে না, তাই মিথ্যের আশ্রয়ে অনেক সম্পর্ক তৈরি হয়। অনেক কথার ভীড়ে হয়ত আপনার সন্তান তার সম্পর্কে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছে, যা মোটেও নিরাপদ নয়। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আপনার সন্তানটিও এমন করুক।
- অনলাইনে মিথ্যে পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে কোনো এক বিকৃত মনের মানুষ অথবা কোনো এক ক্ষতিকারক ব্যক্তি। পরিচয়ের পথপরিক্রমায় শিশুরা এমনকি বড়রাও অনেক সময় অনেক ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। বিপদটা হয় তখন, যখন এই ব্যক্তিগুলো অনলাইনের দুনিয়া থেকে বের হয়ে এসে বাস্তবে যোগাযোগ করতে চায় বা ক্ষতি করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা শিশুদেরকে তাদের টার্গেট বানিয়ে থাকে।
- অনলাইনে অনেক সময় বেশ কিছু আপত্তিকর ছবি বা কথপোকথন দেখা যায়, যা আপনার সন্তানের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। আপনি কি চাইবেন যে আপনার অনুপস্থিতিতে বা অগোচরে আপনার সন্তান সেসব দেখুক?
হয়ত আপনার অজান্তেই আপনার সন্তান ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাবের দ্বারা হেনস্থার শিকার হয়ে পড়েছে। এই লক্ষণগুলো জেনে রাখুন ভবিষ্যতের জন্য, যদি কখনো দেখেন যে এই লক্ষণগুলোর মধ্যে একটিও মিলে যাচ্ছে, তবে অতিসত্বর আপনার সন্তানের সাথে কথা বলুন।
- ইন্টারনেট শিকারিরা ধীরে ধীরে, কখনো কিছু দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে কথপোকথনের মাধ্যমে নিজেদেরকে শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত করে তোলে। এরপর শুরু হয় হেনস্থা। খেয়াল করে দেখুন তো, আপনার সন্তান কি প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম করে অনলাইনে আসছে কিনা।
- হতে পারে আপনার সন্তান স্কুল শেষ করে কিছুটা স্বস্তির সাথে তার ল্যাপটপ বা কম্পিউটারটি বন্ধ করে উঠছে। কিন্তু এর উল্টোটাও হতে পারে। হয়তবা সে ইন্টারনেটে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির সাথে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে এবং কথোপকথন শেষে তার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
- হঠাৎ করে লক্ষ্য করছেন যে, আপনার সন্তান সবসময় অনেক বিষণ্ণ থাকছে। হতে পারে সে অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার কারণে কোনো বিপদে পড়েছে এবং আসন্ন জটিলতার কথা চিন্তা করে সে সবসময় চিন্তিত থাকে।
- লক্ষ্য করে দেখুন তো, যখন আপনার সন্তান অনলাইনে থাকে, তখন কি সে কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করার চেষ্টা করে? সে অনলাইনে কি কাজ করছে তা আড়াল করা বা আপনার উপস্থিতিতে হঠাৎ করে পিসি অফ করে দেয়?
সন্তানের ইন্টারনেটের সুব্যবহার নিশ্চিত করা অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব। আপনি খুব সহজেই কিছু কাজ করতে পারেন যা আপনার সন্তানকে ইন্টারনেট ব্যবহার ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে।
- আপনি নিজে বা আপনার নিকটাত্মীয় যার সাথে আপনার সন্তানেরও সুসম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির দ্বারা ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে পারেন। যার ফলে সে ছোটবেলা থেকেই সচেতন হয়ে উঠবে।
- আপনি বেশ কিছু প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেট করে দিতে পারেন, যার ফলে আপনার সন্তান সেসব নির্দিষ্ট সাইটে প্রবেশ করতে পারবে না।
- অল্প বয়সে সন্তানের হাতে মোবাইল বা ট্যাব জাতীয় ছোট ডিভাইস তুলে দিবেন না।
- ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার করতে না দিয়ে বরং এমন একটি কম্পিউটারে কাজ করতে দিন যা সে ছাড়া আরো অনেকেই ব্যবহার করে।
- তার ব্যবহারের কম্পিউটারটি এমন জায়গায় রাখুন যেখানে প্রায়শ বাড়ির লোকজন হাঁটা-চলা করে থাকে।
- তার ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়টি আপনি নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন, যেমন- আপনি যখন বাড়িতে থাকেন কেবলমাত্র সেই সময়ে তাকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিলেন।
- ইন্টারনেট ব্যবহারের পূর্বে তাকে সচেতন করা যেন সে তার ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি কখনো ইন্টারনেটে কারো সাথে শেয়ার না করে এবং অনলাইনে পরিচিত হওয়া কোনো ব্যক্তির সাথে সরাসরি যেন কখনোই দেখা না করে।
সন্তানের অভিভাবক হিসেবে আপনারই দায়িত্ব তাকে ইন্টারনেটের করাল গ্রাস থেকে নিরাপদে রাখার। আপনি চাইলেই আপনার সন্তানদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সুব্যবহারকে নিশ্চিত করতে পারেন।একটু সচেতনতা আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আপনার সন্তানের অনলাইন যাত্রাকে সুরক্ষিত করুক।
ফিচার ইমেজ: time.com