আমেরিকান ড্রিম! শব্দ দুটো শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনেক কিছু। সে স্বপ্নে স্ট্যাচু অব লিবার্টির মশালও থাকতে পারে, আবার ফুলের বাগান সহ একটা ডুপ্লেক্স বাড়িও থাকতে পারে। আবার অনেকে চোখে হয়তো ভেসে ওঠে লাস ভেগাসের ক্যাসিনোর ঘূর্ণনরত ঝকঝকে রুলেট। কী আসলে এই আমেরিকান ড্রিম? যার জন্যে খোদ আমেরিকা তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষ তার নিজভূমির মায়া, আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমায় ?
বাস্তবতায় ঢোকার আগে একটু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে নেয়া যাক। আমেরিকান ড্রিম নিয়ে রয়েছে কালজয়ী মার্কিন নাট্যকার আর্থার মিলার রচিত নাটক ‘Death of a Salesman’, নাটকটিতে একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত আমেরিকান পরিবারের কাহিনী বলা হয়েছে। যারা বহু বছর ধরে সাধের আমেরিকান ড্রিম অর্জন করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বহু বছরের চেষ্টায় পরিবারে কোনো উন্নতিই হয়নি। পরিবার আর বন্ধুবান্ধবের প্রত্যেকেরই আছে আমেরিকান ড্রিম সম্পর্কে নিজস্ব সংজ্ঞা। যে যার সংজ্ঞা অনুসারেই ধাওয়া করে চলে নিজের স্বপ্নকে, সময়ের সাথে সাথে প্রতিকূলতা বাড়তে থাকায় সে স্বপ্নে আবার প্রতিনিয়ত পরিবর্তনও আসে।
আর্থার মিলারের সেই নাটকের মতো বাস্তবতাও ভিন্ন কিছু নয়। মাঠে নামলে দেখা যায় একেক মানুষের কাছে আমেরিকান ড্রিমের সংজ্ঞা একেক রকম, আবার যতদিন যাচ্ছে, স্বপ্ন পূরণও ততো কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে সময়ের সাথে সাথে একই ব্যক্তির কাছে আমেরিকান ড্রিমের সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে। দুদিন আগে বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি থাকা ছিলো আমেরিকান ড্রিম, এখন একটি থাকাই আমেরিকান ড্রিম। যে ব্যক্তির কাছে বাড়ির মালিক হওয়াই আমেরিকান ড্রিমের মূল কথা ছিলো, এখন হয়তো শুধুমাত্র দায়-দেনামুক্ত থাকতে পারাটাই স্বপ্ন।
আমেরিকান ড্রিমের উৎপত্তি
১৯৩১ সালে মার্কিন লেখক জেমস ট্রুসলো অ্যাডামস প্রথম ‘The American dream’ নামক এই শব্দদ্বয়ের প্রচলন ঘটান তার ‘The American Epic’ বইয়ের মাধ্যমে। মজার বিষয়, লেখকের মূল কথা ছিলো বস্তুগত উন্নতির থেকে বরং আদর্শিক কিছু ধ্যান-ধারণার বিস্তার ঘটানো। লেখকের ভাষায়,
“এমন একটি ভূমি, যেখানে সবার জন্যে জীবন হবে ভালো এবং সমৃদ্ধ আর পরিপূর্ণ, আর প্রত্যেকের সুযোগ নির্ধারিত হবে সক্ষমতা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে।”
জেমস ট্রুসলোর সোজাসাপ্টা বর্ণনার পরও পরবর্তী বছরগুলোতে বহু লেখক এই ধারণাটি নিয়ে বিভিন্ন রকমের ঘাঁটাঘাটি অব্যাহত রাখেন, নানামুখী আলোচনা চলতে থাকে, যেখানে জেমস ট্রুসলোর তত্ত্বটিকে আরো নানা রকমের দৃষ্টিকোণ দান করা হয়। সমস্যা হলো এসব নতুন দৃষ্টিকোণ উত্তর খোঁজার থেকে বরং নতুন নতুন প্রশ্নের উদ্ভব করে চলছিলো।
এরকম বিশ্লেষণ কেন চলছিলো, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন গণ অভিবাসন আর আঞ্চলিক বিতাড়নের শিকার মানুষেরা আমেরিকায় এসে আশ্রয় নিচ্ছিলো, তখন একটা সুনির্দিষ্ট জাতীয়তাবোধের দরকার ছিলো। সেসময়কার ইউরোপ জুড়ে মানুষের মাঝে গোত্রভিত্তিক আনুগত্য ছিলো, যা আমেরিকার ছিল না। তাই পাঁচমিশালী মানুষে ভরা আমেরিকার জন্য দরকার ছিলো একটা ‘কৃত্রিম জাতীয়তাবোধ’, যা আমেরিকাকে এক সূত্রে বেঁধে রাখবে। এমন ধারণার প্রথম উদ্ভব ঘটেছিলো ১৯১৬ সালের প্রবন্ধকার অ্যাগনেস রিপলাইয়ারের ‘Americanism’ প্রবন্ধে। তাই আমেরিকান ড্রিমের গোড়াপত্তন চাইলে এখান থেকেই ধরা যেতে পারে।
আমেরিকান ড্রিম কী?
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আমেরিকান ড্রিম এর ধারণাটি মূলত অনেক আগেই দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ‘Declaration of Independence’ এ উল্লেখ ছিলো। যার মূল বক্তব্যে রয়েছে দুটি স্পষ্ট ঘোষণা “সকল মানুষই সমান হিসেবে বিবেচিত” এবং “জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের খোঁজে সবার অধিকার সমান”।
তবে তত্ত্বজ্ঞান বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাবটা হলো কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উন্নতি করার সুযোগ, ছেলেমেয়েদেরকে কোনোপ্রকার কৃত্রিম বাধা বিপত্তি ছাড়াই ভালোভাবে শিক্ষিত করা ও চাকরির সুযোগ এবং পরিশেষে শ্রেণী, জাত-পাত, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলার সুযোগ পাওয়াই হলো আমেরিকান ড্রিমের মূল কথা।
সমাজতাত্ত্বিক এমিলি রোজেনবার্গ পাঁচটি উপাদান খুঁজে বের করেছেন, যেগুলো তিনি আমেরিকান ড্রিমের মূল কথা বলতে চেয়েছেন।
- বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রের উচিত আমেরিকাকে অনুসরণ করা- এরকম বিশ্বাস
- মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আস্থা রাখা
- মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে সহযোগিতা করা
- তথ্য ও সংস্কৃতির মুক্তভাবে প্রবাহিত হতে দেয়া
- বেসরকারি ব্যবসায় সরকারি সহযোগিতা গ্রহণ করাকে মেনে নেয়া
এখন সমস্যা হলো, এতক্ষণের আলোচনায় আমেরিকান ড্রিম জিনিসটা পুরোপুরি আদর্শিক ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় গেলো সেসব দামি গাড়ি, বাড়ি আর বিলাসবহুল জিনিসপত্র? এসব জিনিসই তো আমেরিকান ড্রিম বলে আমরা জেনে এসেছি।
আদর্শ থেকে কীভাবে পুরো জিনিসটা ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে বস্তু আর ভোগবাদের দিকে চলে গেল, তার দিকে যাওয়া যাক এখন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজমের উত্থান ঠেকানোর জন্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা নাগরিকদেরকে আর্থিক এবং জাগতিক নানা সুযোগ সুবিধা প্রদানের দিকে মনোযোগী হন। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছিলেন,
“আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে সত্যিকারের ব্যক্তি স্বাধীনতা আর্থিক নিরাপত্তা ব্যতীত সম্ভব নয়… ক্ষুধার্ত মানুষ, কর্মহীন জনগোষ্ঠী- এসব উপাদানই দেশকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়”
ফলে গত শতকের পুরোটা জুড়ে বস্তুগত নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু হলে একপর্যায়ে মানুষের মাঝে আমেরিকান ড্রিমের একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এখনো পর্যন্ত আমেরিকান ড্রিম বলতে মানুষের মাঝে যে স্বপ্ন আসে তা অনেকটা এরকম- একটা বাড়ির মালিক হওয়া, নিজের গাড়ি থাকা, ক্ষেত্র বিশেষে একটি নয় বরং দুটি গাড়ি থাকা। একটি কাজে যাওয়ার জন্যে, আরেকটি পরিবার নিয়ে ঘুরতে বেরোনোর জন্যে, ছেলেমেয়েদেরকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো, নিজের পোষা কুকুর বা বিড়াল থাকা, বিখ্যাত হওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে নিজের ব্যবসা থাকা ইত্যাদি।
আমেরিকান ড্রিম অর্জনের প্রতিকূলতা
অর্থনৈতিক স্থবিরতা আর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি আমেরিকান ড্রিম অর্জনকে কঠিন করে তুলেছে। তার থেকেও বড় কথা, এই লোভ-লিপ্সা তাড়িত স্বপ্ন কখনোই পুরোপুরি পূরণ হওয়ার ছিলো না। ফলে লাগামহীন খরচ আর এটা চাই ওটা চাই এই মানসিকতা আমেরিকানদের মাথার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর ব্যাপক কর্মহীনতা, সঞ্চয়ের মতো অর্থ না থাকা, করের বোঝা ইত্যাদি নানা কারণ এই স্বপ্নের পথে বড় বাধা।
বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে মানুষের স্বপ্নের গণ্ডি আবার ছোট হয়ে এসেছে, গুছিয়ে আনা হয়েছে। যেমন ক্রেডিট ডটকম পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ২৮ শতাংশ আমেরিকানের আকাঙ্ক্ষা পর্যাপ্ত সঞ্চয় দিয়ে অবসরে যাওয়া, ২৩ শতাংশের স্বপ্ন ধার-দেনা মুক্ত জীবন কাটানো। একটা সময় বাড়ির মালিক হতে পারাটাই আমেরিকান ড্রিমের মূল কথা হিসেবে ধরা হতো, কিন্তু বাড়ি কেনার জন্যে সহজ শর্তে ঋণও এখন আর পাওয়া যায় না। ফলে এখন সেটা পরিবর্তিত হয়ে ভালো মূল্যে বাসা ভাড়া নিতে পারাটাই আমেরিকান ড্রিমের রূপ পেয়েছে!
ধনী ও বিখ্যাত হতে পারা তরুণদের মধ্যে আমেরিকান ড্রিমের একটা বড় অংশ। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া মাত্রই প্রত্যেকের মাথায় গড়ে ২৭ হাজার ডলার ব্যাংক ঋণ চেপে বসে। বেকারত্বের হারও বেশি, যে চাকরি একজন ব্যক্তি ঘৃণা করেন, সেই চাকরিও চাইলে জুটছে না। এরকম পরিস্থিতিতে আমেরিকান ড্রিম বিশাল সংখ্যক নাগরিকের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। অবশ্য পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মই হচ্ছে এখানে দুটি দলের উদ্ভব হয়- জয়ী এবং পরাজিত।
ফিচার ছবি- Christina Lee (flag), Bill Owens (picture)