নিজেকে কোথায়, কীভাবে, কতখানি প্রকাশ করবেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আত্মপ্রকাশও একটি শিল্প। সবাই এই শিল্প জানে না, বোঝে না। বুঝলেও আয়ত্ত্বে আনতে পারে না। বর্তমান সময়ে অন্তর্মুখী বা চুপচাপ থেকে একটি শক্তিশালী ক্যারিয়ার গড়া প্রায় অসম্ভব।
মানুষের সাথে কথা বলতে হবে, ওঠা-বসা করতে হবে, তবেই একটি সুন্দর ক্যারিয়ার পাওয়া সম্ভব। কিন্তু কথা বলতে গেলেই সমস্যা। কোনটা বলা উচিত আর কোনটা উচিত নয়, এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে থাকেন, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেন। এতে হিতে বিপরীত হয়, ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এই ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে বিচক্ষণ ব্যক্তিরা নিজের কিছু বিষয় প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। চলুন সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
১
রাজনৈতিক মতাদর্শ বেশ স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তাই এটিকে ঢোল পিটিয়ে সবার সামনে জাহির না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একজন ব্যক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দলের পক্ষে সমর্থন করতেই পারে। তবে সবাই যে একই আদর্শের অনুসারী হবে, এমনটা ভাবা বোকামি।
আর এজন্যই নিজের রাজনৈতিক অবস্থানটা কর্মক্ষেত্রে আড়াল করে রাখা জরুরি। কারণ, প্রকাশ করলে ভিন্ন দুই মতাদর্শের সমার্থক সহকর্মীদের মধ্যে এই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা থেকে শুরু করে তর্ক, বিতর্ক এমনকি মনোমালিন্য কিংবা সম্পর্ক পর্যন্ত খারাপ হয়ে যেতে পারে। অতএব, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ রাখার জন্য নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক।
২
কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যত নামকরা হোক না কেন সেখানে কিছু ব্যক্তি থাকে, যারা সে প্রতিষ্ঠানে কাজ করার যোগ্য নয়। মজার বিষয় হলো, এটা সেখানে কর্মরত ব্যক্তিরা জানেও। এমনকি যিনি অযোগ্য তিনিও টের পান। কিন্তু একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি কখনোই এটা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কোনো আলোচনা বা মন্তব্য করবে না। ধরা যাক, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। আপনার উপরস্থ একজন অফিসার বা সহকর্মী কোম্পানির যোগ্য নন, তবুও কোনো না কোনোভাবে দিব্যি নিজের পদে বহাল রয়েছেন।
এখন আপনি যদি এ নিয়ে কোনো সহকর্মীর সাথে আলাপ করেন, তাহলে শতভাগ নিশ্চিত থাকুন আপনার কপালে শনি আছে। কর্মক্ষেত্রে কারও অযোগ্যতা নিয়ে কথা বললে আপনার নিজেরই ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং যার বা যাদের সাথে আপনি এসব নিয়ে আলোচনা করবেন, তারাই আপনাকে খারাপ চোখে দেখবে। যেটি আপনার ক্যারিয়ারের জন্য মোটেও ভাল হবে না। তাই, যদি সেই বিশেষ ব্যক্তিটিকে আপনি সহযোগিতা করতে না পারেন বা তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করার ক্ষমতা আপনার না থাকে, তাহলে তার অযোগ্যতা নিয়ে ভুলেও কিছু উচ্চারণ করবেন না।
৩
আপনি প্রতি মাসে কত টাকা উপার্জন করছেন, সেটা জেনে আপনার বাবা-মা খুশি হতে পারেন, গর্ববোধ করতে পারেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিজের উপার্জন নিয়ে কথা বললে খারাপ ছাড়া ভাল কিছু হবে না। কারণ নিজের উপার্জন নিয়ে মুখ খোলামাত্রই আপনি আপনার সহকর্মীদেরকে তুলনা করার সুযোগ করে দেবেন। এরপর আপনি যা-ই করতে যান না কেন, সহকর্মীরা সেটাকে আপনার উপার্জন প্রদর্শন বা ‘শো-অফ’ বলে ধরে নেবে। নিজের উপার্জনের পরিমাণ প্রকাশ করার পর থেকে কেউই আপনাকে আর আগের চোখে দেখবে না। অতএব এই ব্যাপারে সর্তক থাকুন।
৪
নিজের কাজটি অপছন্দ করেন, তা কখনই প্রকাশ করা যাবে না। কারণ এতে আপনি সেই কর্মক্ষেত্র থেকে নিজের অজান্তেই ছিটকে যাবেন। আপনাকে সেখানে বহিরাগত হিসেবে দেখা হবে।
ধরুন, শাফায়েত সাহেব (কাল্পনিক) তার বর্তমান চাকরি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাই তিনি তার সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন আলাপের ফাঁকে বলে ফেললেন সামনে এই কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোথাও যোগদান করবেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আলোচনাও চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল, শাফায়েত সাহেবের কলিগরা ধীরে ধীরে তার সাথে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে। খুব প্রয়োজন না পড়লে তার সাথে কেউ কথা বলছে না। উপরস্থ কর্মকর্তাদের বিষয়টি কানে যাওয়ার পর তারাও শাফায়েত সাহেবকে গুরুত্বহীনের চোখে দেখতে শুরু করেছেন। কারণ তিনি তো আর এই প্রতিষ্ঠানে থাকছেন না! শাফায়েত সাহেব এখন এই কোম্পানির জন্য অনেকটা বোঝাস্বরূপ। কিছুদিন পর শাফায়েত সাহেব দেখলেন, যেসব কোম্পানিতে যোগদান করার ব্যাপারে তিনি কথা বলেছিলেন তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একমত হতে পারছেন না। তাই বর্তমান কোম্পানিতেই তাকে থাকতে হচ্ছে। অথচ নিজের অপছন্দের কথা বলে ফেলে বর্তমান কোম্পানির কাছে ইতিমধ্যে তিনি বহিরাগত হয়ে ফেঁসে গেছেন। অতএব, উপরোক্ত ঘটনার আলোকে বোঝা যায়, নিজের কর্মক্ষেত্র বা কাজ নিয়ে কোনো নেতিবাচক কথা বলা উচিত নয়। অপছন্দ হলে সেটা মনেই চেপে রাখা ভাল। প্রকাশ করলে ক্ষতিই হবে, লাভ হবে না।
৫
আপনি ব্যক্তিগত জীবন যেভাবেই যাপন করুন না কেন, কর্মক্ষেত্রে সেটা কখনোই আলোচনা করতে যাবেন না। অনেকেই কৌতুকের ছলে বা নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের স্পর্শকাতর বহু বিষয় কর্মক্ষেত্রে কলিগদের সাথে শেয়ার করে। এসব সস্তা দরের কথা বলে আপনি হয়তো তাদের কাছে হাসির পাত্র হতে পারবেন, কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব তলানিতে চলে যাবে। আপনার সহকর্মীরা কেউই আপনাকে সেভাবে শ্রদ্ধা বা সম্মানের চোখে দেখবে না। আপনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
৬
নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি অন্য কারও ব্যক্তিজীবনে নাক না গলানোটাও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের একটি বড় গুণ। কোনো কলিগ যদি নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ভুলক্রমে আপনার সামনে কথা বলেও বসে, সেটির পরিপ্রেক্ষিতে নিজে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার চিন্তা-ভাবনা নিজের ভেতরেই রাখুন। হালকা কিছু বলে বিষয়টা এড়িয়ে যান। কর্মক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোটা কখনোই ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় না। কারণ এতে নিজের কাজের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি কাজের পরিবেশও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৭
বন্ধুদের সাথে বা নিজের কাছের মানুষদের সাথে আপনি বিভিন্ন ধরনের পাগলামি করতেই পারেন। কিন্তু সেটা কলিগদের কাছে বলে বেড়ানোতে কোনো মাহাত্ম্য নেই। কোনো ভ্রমণে গিয়ে কীভাবে মজা করেছেন, বন্ধুদের সাথে কোনো বিষয়ে বাজি ধরেছিলেন কিনা ইত্যাদি বালখিল্য বিষয়গুলো কর্মক্ষেত্রের বাইরে ঘটে, তাই সেগুলোকে বাইরেই রেখে আসবেন। অফিসে এসে সেগুলোর ফিরিস্তি দিতে শুরু করা অপরিপক্বতার পরিচায়ক। প্রকৃত বিচক্ষণ ব্যক্তিরা এই দিকগুলো খুব সর্তকতার সাথে এড়িয়ে চলেন।
ফিচার ইমেজ: Digital Dealer