অহংকার পতনের মূল এবং ভালো মানুষের দাম নেই, এই দুটো সাংঘর্ষিক কথা আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত। যারা সবসময় অহংকার করে কথা বলে, তাদের যেমন আমরা খুব একটা পছন্দ করি না, আবার যারা সবসময় আমাদের সাথে ভদ্রতা দেখিয়ে কথা বলে তাদেরকেও আমরা তেমন হিসেবে রাখতে চাই না। কিন্তু তাই বলে কি একেবারেই অহংকার করা যাবে না, আবার একেবারেই বিনয়ী হওয়া যাবে না? তাহলে হবেনটা কী? সমাজ আপনাকে কীভাবে দেখছে সেটা জানার চেয়ে জরুরি হলো নিজেকে যেভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করছেন সেই ব্যাপারে আপনি সম্পূর্ণ অবগত কি না।
শিরোনাম এবং লেখার প্রথম অনুচ্ছেদ পড়েই আশা করি বুঝতে পারছেন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু কী। এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরা হবে একজন অহংকারী ব্যক্তি এবং একজন বিনয়ী ব্যক্তিকে সমাজ কীভাবে দেখে থাকে এবং অহংকার বা বিনয় কীভাবে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত।
ভালোর দিকটি দিয়ে আগে শুরু করা যাক। অর্থাৎ প্রথমেই আসা যাক বিনয়ীদের ব্যাপারে। বিনয়ী হওয়া ভালো। সবাই এমন ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করে, তাদেরকে বিশ্বাস করে, তাদের সাথে মিশতে চায়। সমাজের আদর্শ ব্যক্তির রোল মডেল হলেন তারাই। এই কথাগুলো যেমন সত্য, তেমনই এই কথাও সত্য যে, অতিরিক্ত বিনয়ী ব্যক্তিরা সমাজের অনেকক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়ে থাকেন, অথবা তাদের তেমন কোনো গুরুত্ব থাকে না কারো কাছে। তারা আবার নিজেদেরই অনেক সময় গুরুত্বহীন মনে করে থাকেন। একজন ব্যক্তি কতটুকু বিনয়ী সেটি তার সাথে কথা বলতে গেলেই বোঝা যায়।
এখন আপনাদের সামনে দুটো কথোপকথন তুলে ধরছি। এ ধরনের কথা আপনি হয়তো আগে খেয়াল করেছেন, কিন্তু কখনও আলাদা করে চিন্তা করেননি।
১ম কথোপকথন
> তুমি তো বেশ ভালো কাজ করেছো। তোমার কাজে আমরা বেশ খুশি।
>> বিষয়টি জেনে খুব ভালো লাগলো। আপনাদের সাথে কাজ করতে পেরেও আমার বেশ ভাল লেগেছে।
> তোমার সহকর্মীরাও কিন্তু তোমার ব্যাপারে বেশ ভালো কথা বলেছে।
>> তাই নাকি? বিষয়টি সত্যিই বেশ সম্মানজনক।
এবার ২য় কথোপকথনটি তুলে ধরি।
> তোমার কাজ কিন্তু বেশ ভালো হয়েছে। তোমার সহকর্মীরাও তোমার সাথে কাজ করে বেশ খুশি।
>> ধন্যবাদ। কিন্তু আমি মনে করি আমি বেশ বদমেজাজি। তারা বিষয়টি স্বীকার করতে চাচ্ছে না হয়তো।
> না, না। তারা সত্যিই তোমার সাথে কাজ করতে পেরে বেশ খুশি। তারা তোমার সাথে ভবিষ্যতেও কাজ করতে চায়।
>> আমি নিশ্চিত এর পরেরবার তারা বাধ্য হয়েই কাজ ছেড়ে দেবে। আমি নিজে অতটাও ভালো না।
দুটো কথা থেকে স্পষ্ট পার্থক্য ধরতে পারছেন নিশ্চয়ই। প্রথম ব্যক্তিকে যখন তার কাজের জন্য প্রশংসা করা হলো, তখন সে সাদরেই তা গ্রহণ করে নিলো। তার কাজের প্রাপ্য সে বুঝে নিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির বেলায় আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। অতিরিক্ত বিনয়ী হতে গিয়ে সে বারবার নিজের কৃতিত্বকে অস্বীকার করে নিচ্ছে। এখানে আমাদের দ্বিতীয় ব্যক্তি হলো অতিরিক্ত বিনয়ী। আমাদের সমাজে সাধারণত দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বিনয়ী হওয়ার জন্য পরবর্তীতে পস্তাতে হয়। আপনি যদি নিজেই নিজেকে গুরুত্ব না দিয়ে থাকেন, তাহলে অন্যরা আপনাকে গুরুত্ব দিতে যাবে কেন? আপনার অবশ্যই নিজের ব্যাপারে একটি আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিত।
এবার আসি অহংকারীদের নিয়ে। আগে জেনে নিই অহংকার বলতে আমরা কী বুঝি। ধরুন, আপনি কোনো একটি কাজে বড় রকমের সাফল্য লাভ করলেন, কিংবা আপনার কাছের কেউ আপনার সহযোগীতায় কোনো কাজে সাফল্য পেলো। এর ফলে আপনাকে সবাই বাহবা দিচ্ছে। এখানে আপনার মধ্যে একটি ভালো লাগা বা নিজেকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেখার মতো অনুভূতি কাজ করতে পারে। এই অনুভূতির কাজটিই হলো অহংকার।
এখন কথা হলো অহংকারের অনুভূতি থেকে কী হয়? অহংকার করা ভালো, নাকি খারাপ? অহংকার দুই রকমের হতে পারে। একটি ধরণ হলো যেটি আপনার নিজের বা দলগত বড় কোনো সাফল্যের ফলে নিজের মধ্যে সাময়িক ভালো লাগা তৈরি করবে। হতে পারে এটি কোনো পরীক্ষায় আপনার ভালো ফলাফল কিংবা দেশের জন্য দলগতভাবে বড় কোনো কাজ করলেন। এর ফলে আপনার মধ্যে যে অহংকার কাজ করবে তা স্বল্পস্থায়ী। ক্ষণিক পরেই সেই অহংকার চলে যায়। এই অহংকার সাধারণত কেউ মুখে প্রকাশ করে না। আরেকটি ধরন হলো নিজের কাজ গর্ব করে সবাইকে বলে বেড়ানো। আপনার সাফল্যের কথা সবাই জেনে থাকলেও নিজে গিয়ে তাদের সামনে অহংকার করা। অহংকারের দ্বিতীয় উদাহরণের ব্যক্তিকে নিয়েই যত সমস্যা।
কোনো ব্যক্তি যদি অধিক পরিমাণে অহংকারী হয়ে থাকে, তাহলে তার বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন- সবসময় সবার থেকে সম্মান আশা করা, যেকোনো প্রকার উপদেশ ফিরিয়ে দেওয়া, সবার সাথে জোর গলায় কথা বলা, কেউ কোনো উপদেশ দিলেই বদমেজাজি হয়ে ওঠা, অন্যদের নীচ চোখে দেখা ইত্যাদি। এ ধরনের অহংকারী ব্যক্তি আমরা সবাই কম-বেশি দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অহংকার হলো একধরনের রোগ, যা আপনাকে সত্যকে মেনে নিতে বাঁধা দেয়। আপনি হয়তো জানেন কোনো একটি কাজ ভুল হয়েছে। কিন্তু নিজের অহংকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেটি মেনে নিতে চাচ্ছেন না। এ ধরনের অহংকারী ব্যক্তিকে আমরা কেউই সাধারণত পছন্দ করি না।
তবে অহংকার করাকে অনেকে নিজের সাফল্যের প্রচারণা হিসেবে দেখেন। আপনি কী সাফল্য পেয়েছেন তা যদি প্রচার না-ই করেন, তাহলে এত কষ্ট করে সাফল্য অর্জন করছেন কীসের জন্য? মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিয়েল স্নাইসারের মতে, “আপনি যদি আপনার সাফল্য নিয়ে অহংকার না করতেন, তাহলে আপনার সাফল্য আমি দেখতে পেতাম না।” অপরদিকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেডা কসমেডিসের মতে, অহংকার হলো সমাজ গড়ার একটি উপাদান। মানুষের মাঝে অহংকার কাজ না করলে এই আধুনিক সমাজব্যবস্থা আমরা পেতাম না। একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই এখানে মূখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানে একবার উদাহরণ টেনে বললাম বিনয়ী হওয়া যাবে না, এরপর আবার বললাম অহংকার করা যাবে না। তাহলে আসলে হবেনটা কী? সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হলো মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। আপনি বিনয়ী হতে পারেন, কিন্তু বিনয়ী হতে গিয়ে নিজের সম্মান বিক্রি করে আসবেন না। নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখুন, নিজের যা প্রাপ্য সেটি ঠিকমতো বুঝে নিন। আর অহংকারের বেলায় নিজেকে সামলিয়ে চলুন। আপনার সাফল্য সবার সামনে তুলে ধরুন। তবে সেটা যাতে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। নিজেকে সবার সামনে ভালো উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে অবশ্যই অন্যকে সম্মান দিতে শিখতে হবে। আপনি নিজে যদি অন্যের থেকে সম্মান পেতে চান, তাহলে অন্যকে সম্মান করাও আপনার দায়িত্বের মধ্যে পরে। তাই অহংকার এবং বিনয়ের সংঘর্ষে না জড়িয়ে নিজেকে সঠিকভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করুন এবং অন্যের মতামতকে সম্মান করুন।