ডেনিস ডিডেরো ছিলেন ১৮ শতকের বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক। সেসময়কার নামকরা ও বিশাল বিশ্বকোষ ‘Encyclopédie’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং লেখকও ছিলেন তিনি। তবে বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও তার জীবনের অধিকাংশ সময়টা কেটেছে দরিদ্রাবস্থায়। তবে ১৭৬৫ সালে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়।
নিজের ৫২ বছর বয়সে অন্য সকল পিতার মতো তিনিও চেয়েছিলেন নিজের মেয়েকে ভালো কোনো পাত্রের হাতে তুলে দিবেন। কিন্তু তিনি এতটাই গরিব ছিলেন যে তখনকার ‘প্রথা’রূপ যৌতুক দেওয়ার মতো অবস্থাও তার ছিলো না। তাই মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাও করতে পারছিলেন না।
সেসময় রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট, ডিডেরোর এই অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা জানতে পারেন। ডিডেরোর ছিলো নিজস্ব এক বিশাল গ্রন্থাগার। সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন ডিডেরোর সেই গ্রন্থাগার তৎকালীন £১,০০০ GBP (যা ৫০,০০০ মার্কিন ডলারের সমতুল্য) দিয়ে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব প্রদান করেন। ডিডেরো সে প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। আর এভাবে ডিডেরোর অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায়।
এই বিশাল বিক্রয়ের পর পরই ডিডেরো একটি লাল পোশাক পান। কথিত আছে, পোশাকটি তাকে তার কোনো বন্ধু উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পোশাকটি পাওয়ার পরই ডিডেরোর জীবনে শুরু হয়ে যায় নতুন এক সমস্যার!
পোশাকটি ছিলো অত্যন্ত চমৎকার এবং আকর্ষণীয়। এতটাই সুন্দর ছিলো যে ডিডেরো খেয়াল করলেন পোশাকের সাথে তার ঘরের আশেপাশের আসবাবপত্রের কোনো মানানই হচ্ছে না। পোশাকটির সৌন্দর্যের কাছে বাকি সবকিছু যেন বড্ড বেমানান। তার নিজের কথায় সেখানে ছিলো না “no more coordination, no more unity, no more beauty”, অর্থাৎ ছিলো না কোনো সমন্বয়, ঐক্য এবং সৌন্দর্য। তাই ডিডেরোর মনে চাহিদা জাগে পুরনো সেই আসবাবপত্রগুলোর জায়গায় নতুন আসবাবপত্র ও ঘরের জিনিসপত্র কিনে আনা; যেগুলোর সাথে পোশাকটি মানানসই হবে।
এজন্য তিনি দামেস্ক থেকে নতুন কম্বল কিনে নিয়ে আসলেন। তার পুরো বাড়ি বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য দিয়ে সাজালেন। রান্নাঘরের জন্য নতুন টেবিল আনালেন। বিশাল আয়না কিনলেন, এমনকি তার খড়ের চেয়ারটি পাল্টিয়ে নিজের জন্য একটি চামড়ার চেয়ারও কিনলেন।
শুধু একটি লাল পোশাক তাকে আরো কিছু জিনিস ক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ করলো। অর্থাৎ যেগুলোর, তার সেই পোশাকটি পাওয়ার আগে কোনো দরকারই ছিলো না সেগুলোই তাকে কেনা লাগলো। এটিই ‘দ্য ডিডেরো ইফেক্ট’ নামে পরিচিত।
ডিডেরোর এ সম্পর্কে যে বিখ্যাত উক্তিটি রয়েছে তা হলো,
“I was absolute master of my old dressing gown, but I have become a slave to my new one.”!
দ্য ডিডেরো ইফেক্ট
সহজভাবে বললে বলা যায়, দ্য ডিডেরো ইফেক্ট হলো যখন নতুন কোনো জিনিস নতুন আরো কিছু জিনিস পেতে বা ক্রয় করতে প্রলুব্ধ করে। অর্থাৎ নতুন পণ্য মানুষের মনে নতুন চাহিদার সৃষ্টি করে। সেগুলো এমন কিছু জিনিস যেগুলোর পূর্বে আপনার হয়তো কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। এক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
ধরুন, আপনি একটি শার্ট কিনলেন। কেনার পর আপনার মনে হলো নতুন কেনা এই শার্টটির সাথে আপনার পুরনো প্যান্টটি মানাচ্ছে না। তাই আপনি আরেকটি প্যান্টও কিনে নিলেন। দেখা গেলো প্যান্টটির সাথে মানানসই এক জোড়া জুতোও কিনে ফেললেন সেই সাথে। আপনি কিন্তু সেই শার্টটি কেনার আগে আপনার পুরনো পোষাকেই সন্তুষ্ট ছিলেন বা নতুন করে প্যান্ট, জুতো কেনার কথা ভাবেননি!
একটি নতুন স্মার্টফোন কিনলেন। এখন স্মার্টফোনটির জন্য সেই সাথে একটি কভার, গ্লাস, ইয়ারফোন, মেমোরি কার্ড ইত্যাদি কিনলেন। এগুলোর কিন্তু ফোনটি কেনার আগে আপনার কোনো দরকারই ছিলো না।
ঘরের জন্য নতুন সোফা কেনার পর দেখলেন পাশের পুরনো টেবিলটি একদমই ভালো লাগছে না। আপনার মাথায় প্রথমে যে ভাবনাটি কাজ করবে তা হলো সেই টেবিলটি বদলিয়ে নতুন, মানানসই একটি আনার।
বিছানার জন্য একটি চাদর কিনলেন। দেখা গেলো চাদরের সাথে আপনার বালিশগুলোর কভার মেলে না। কার্পেটের রঙ মেলে না। অর্থাৎ আপনি শুধু চাদরের সাথে মানানসই হবার জন্য আলাদা করে কার্পেট এবং দরজা-জানালার পর্দাও কিনে ফেললেন।
কম্পিউটারের কথাও বলা যেতে পারে। কম্পিউটার কেনার পাশাপাশি অনেকেই আলাদা করে সাউন্ড সিস্টেম, ইয়ারফোন, ওয়েব ক্যাম, উপযুক্ত চেয়ার এবং কম্পিউটার টেবিলও কিনে থাকেন।
অর্থাৎ একটি নতুন ক্রয় বা খরচ অতিরিক্ত খরচের সৃষ্টি করে। এটি অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। মানুষ সবসময়েই নতুন কিছুতে আকৃষ্ট হয় এবং চায় নতুন জিনিস দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করতে। সেক্ষেত্রে নতুন একটি বস্তু তার সাথে সংলগ্ন অপর নতুন কোনো বস্তুর দিকে মানুষকে পরিচালনা করলে সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে মানুষ সেটি পেতে আগ্রহী হয়। আর এভাবে একজন মানুষের যে জিনিসগুলোর আপাতদৃষ্টিতে কোনো প্রয়োজনই ছিলো না, ঠিক সেই জিনিসগুলোই তিনি কিনে ফেলেন। একেই বলা হয় দ্য ডিডেরো ইফেক্ট।
তাহলে এই ইফেক্ট থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়? চলুন কিছু উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
চিত্তাকর্ষক জিনিস থেকে নিজেকে বিরত রাখা
দিদরেট ইফেক্ট তখনই তৈরি হয়, যখন আমরা নতুন কোনো জিনিস কিনি। অর্থাৎ বাজারে এমন কিছু চমকপ্রদ জিনিস দেখলাম, যা আমাদের সেই জিনিসটি কিনতে প্রলুব্ধ করলো। এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
নিজের যা আছে তা ব্যবহারযোগ্য থাকা অবধি নতুন কিছু কেনাটা যে অতিরঞ্জন তা নিজের মনকে বোঝাতে হবে। এককথায় নিজের মনের সাথে লড়াই করতে হবে, যাতে নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতীত কোনো কিছু কিনে সেটার জন্য অতিরিক্ত কিছু কেনার ফাঁদে না পড়তে হয়।
বর্তমান অবস্থার সাথে মানানসই কিছু কিনুন
ডিডেরো ইফেক্টে দেখা যায়, মানুষ নতুন পাওয়া কোনো কিছুর সাথে মিলিয়ে অতিরিক্ত কিছু কেনে বা পুরনো জিনিস বদলে ফেলে। এক্ষেত্রে আপনি যা করতে পারেন তা হলো, আপনার নতুন কিছু কেনার প্রয়োজন পড়লে, তা এমনভাবে কিনুন যেটি আপনার আগে থেকে থাকা জিনিসপত্রের সাথে মানানসই। যাতে নতুন কেনা জিনিসটির জন্য আপনাকে আশেপাশের জিনিসগুলোর মানানোর কথাটি ভাবা না লাগে। অর্থাৎ আপনি আপনার ঘর এবং মনের শূন্যস্থান পূরণ করবেন, তা অতিরিক্ত বোঝাই করবেন না।
নিজস্ব সীমা আরোপ
নিজের খরচের উপর একটি মাসিক বা বার্ষিক বাজেট তৈরি করতে পারেন এবং একটি সীমা আরোপ করতে পারেন তার উপর। বাজেটটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন পোশাকের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিলেন, আপনি মাসে একটি শার্টের বেশি কিছু কিনবেন না এবং তার বাজেট থাকবে ধরুন ৫০০ টাকা। আবার এমন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নিজের কাছে থাকা ফোনটি কমপক্ষে দু’বছর ব্যবহার করবেন। এবং নতুন ফোনের পেছনে ২০,০০০ টাকার বেশি খরচ করবেন না। এভাবে অতিরিক্ত খরচ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন।
একটি কিনুন আরেকটি দান করুন
যখনই নতুন কিছু কিনবেন, চেষ্টা করবেন পুরনো কিছু কাউকে দিয়ে দেওয়ার। নতুন টেলিভিশন কিনেছেন? পুরনোটা পাশের রুমে ফেলে রাখার পরিবর্তে কাউকে দান করে দিন যার টেলিভিশন প্রয়োজন। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এর পেছনে যে উদ্দেশ্যটি রয়েছে তা হলো- আপনার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের বৃদ্ধি থামানো। নিজেকে যতটা সম্ভব ন্যূনতম সেই জিনিসপত্রের মাঝে আবদ্ধ রাখা, যেগুলো আপনার জন্য সুখ এবং আনন্দ প্রদান করতে যথেষ্ট।
নতুন কিছু চাওয়া থেকে নিজেকে নিরুৎসাহিত করুন
জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই, যখন মানুষ নতুন কিছু চায় না। কারণ দেখা যায়, বর্তমানে নিজের কাছে যা রয়েছে তার থেকে উন্নত কিছু না কিছু বাজারে আছে বা সৃষ্টি হচ্ছে। আপনি নতুন মোটরসাইকেল কিনেছেন? দেখবেন বাজারে তার থেকেও উন্নত আরেকটি মোটরসাইকেল আছে। খুব শখ করে একটি গাড়ি কিনলেন? দেখবেন তার থেকেও উন্নত গাড়ি রয়েছে! সেটা কেনার পর দেখবেন অন্য আরেকটি এর থেকে আরো উন্নত। সেটাও কিনলেন? মনে হবে এর থেকে নিজস্ব একটি জেটপ্লেন থাকলে মন্দ হতো না! অর্থাৎ কোনোকিছুই আপনাকে পরিপূর্ণ মানসিক তৃপ্তি দিতে পারবে না। সবকিছুরই কোনো না কোনো উন্নত পর্যায় রয়েছেই, যা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।
তাই হয়তো বুঝতেই পারছেন এই ‘চাওয়া’টা শুধু একটি মতামত, যা আপনার মন আপনাকে দিয়ে থাকে। এটি এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, যা আপনাকে অনুসরণ করতেই হবে।
ফিচার ইমেজ: Romies Studio