তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে তথ্য আমাদের কাছে দিনে দিনে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। একুশ শতকের এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির দুর্বার প্রবাহ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহের কল্যাণে তথ্য বর্তমানে আমাদের হাতের মুঠোয়। তথ্য এখন আর সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির অধিকৃত নিজস্ব সস্পদ নয় বরং শ্রেণি নির্বিশেষে যে কেউই যেকোনো প্রকারের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ও প্রচার করতে পারেন। তথ্যের এই অবাধ প্রবাহ যে সমাজকে অগ্রসর করতে সাহায্য করছে তাও নয়, বরং তথাকথিত তথ্যের জোয়ারে অনেক সময়ই খেই হারাতে হচ্ছে আমাদেরকে। আর এ সমস্যার সাথে যেসব বিষয়সমূহ জড়িত, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ভুয়া সংবাদ তথা ফেইক নিউজ, তথ্যমারী বা ইনফোডেমিক, ডিপফেইক প্রযুক্তি ইত্যাদি।
ইন্টারনেটের দ্রুতি, ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা; এই দুইয়ের বৃদ্ধিই হচ্ছে তথ্যপ্রবাহের মূল চালিকাশক্তি। আর এর ফলে কেবল তথ্যই নয়, তার সাথে সাথে অপ-তথ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্তর্জাল দুনিয়ায়। ফলে সঠিক তথ্যটি খুঁজে পাওয়া ভীষণ জরুরি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে ক্রমশ। সেজন্য প্রয়োজন তথ্যের সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা ইত্যাদি যাচাই। আর এ যাচাই বা পরীক্ষার প্রক্রিয়াটিই ফ্যাক্ট-চেকিং নামে পরিচিত।
আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে যে কেউই ঘরে বসে, নিখরচায়, কিছু সহজ টুল ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সাহায্যে খুব সহজেই ফ্যাক্ট-চেকিং-এর কাজটি করতে পারেন। কিন্তু তার আগে চলুন ফেইক নিউজ, ইনফোডেমিক ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নেওয়া যাক।
ভুয়া সংবাদ যখন মাথাব্যথা
২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের পর থেকে ভুয়া সংবাদ কথাটি বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে শুরু করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বদৌলতে ফেইক নিউজ শব্দটি বারবার নিউজে স্থান পায়। ট্রাম্প টুইটারে ফেইক নিউজ নিয়ে নিয়মিতই উষ্মা প্রকাশ করতে থাকতেন।
ফেইক নিউজ হচ্ছে মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ। এসব সংবাদের কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস থাকে না এবং কখনো কখনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে, যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য এগুলো ছড়ানো হয়।
তবে ট্রাম্প নয়, হিলারি ক্লিনটনই সে সময় ফেইক নিউজ শব্দটিকে প্রথম দৃশ্যপটে আনেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেবল ট্রাম্পই নন, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসও ফেইক নিউজ সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
অর্থাৎ, ফেইক নিউজ সাম্প্রতিক কোনো ধারণা নয়। গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পরে সংবাদপত্রের প্রসার ঘটে আর তখন থেকেই ফেইক নিউজের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ফেইক নিউজের আধুনিক রূপের দেখা মিলেছে ২০১৬ সাল থেকেই। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে মেসিডোনিয়ার একটি শহরের কিছু তরুণ মার্কিন নির্বাচন আর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ভুয়া খবর তৈরি করে ফেইসবুকে ছড়াতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত অর্থনৈতিক; চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর প্রকাশ করে বেশি অর্থ আয় করা।
এরপর ফেইক নিউজের ভয়াবহ রূপ আমরা দেখেছি, এবং এখনো দেখে যাচ্ছি, করোনাভাইরাসের মহামারীর সময়। এ সময় ভুয়া খবর, গুজবের বন্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভেসে গিয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত পড়তে পারেন রোর বাংলা’র এই আর্টিকেলে।
ইনফোডেমিক: অধিক তথ্যে জ্ঞান নষ্ট
যেহেতু তথ্য এখন সহজলভ্য এবং যে কেউই তথ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ও প্রচার করতে পারে, সেহেতু তথ্যের পরিমাণ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তথ্যের পরিমাণ যদি এতটাই বেড়ে যায় যে খুঁজতে গিয়ে আসল তথ্য পাওয়াই মুশকিল হয়? ইনফোডেমিক-এর সমস্যা এখানে।
ইনফরমেশন (Information) আর এপিডেমিক (Epidemic) এ দুটো শব্দকে ভেঙে-গড়ে ইনফোডেমিক শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। এর মানে হলো, যখন তথ্যের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় এবং তা চারদিকে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এত এত তথ্যের মধ্য থেকে আসল ও প্রয়োজনীয় তথ্য অনেক সময় পাওয়া যায় না বা পেতে অধিক পরিশ্রম করতে হয়।
ইনফোডেমিককে এপিডেমিকের সাথে তুলনা করার কারণ হলো, এটিও একধরনের মহামারী, তথ্যের মহামারী। কারণ এক্ষেত্রেও তথ্য মহামারীর মতোই দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভুয়া তথ্য, ভুল তথ্য, বিকৃত তথ্য ইত্যাদির সংমিশ্রণে ইনফোডেমিক মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে।
২০০৩ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ সার্স ভাইরাস সম্পর্কে এক কলামে প্রথম ইনফোডেমিক শব্দটি ব্যবহার করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক ডেভিড রুথকফ।
ফ্যাক্ট-চেকিং: তথ্যের সত্যতা যাচাই
কেমব্রিজ ডিকশিনারির সংজ্ঞা অনুযায়ী ফ্যাক্ট-চেকিং বলতে বোঝায় কোনো লেখা, সংবাদ, বক্তব্য ইত্যাদিতে উপস্থাপন করা সকল তথ্যের (Fact) যথার্থতা যাচাই করার প্রক্রিয়াকে। কোনো তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে সেই তথ্যের সামগ্রিক নির্ভুলতা যাচাই করাই হচ্ছে ফ্যাক্ট-চেকিং।
ফ্যাক্ট-চেকিং মূলত সাংবাদিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও এটি করা সম্ভব এবং করা উচিত। ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের জন্য অনেক সংগঠন, সংবাদসংস্থা কাজ করে যাচ্ছে বটে কিন্তু নিজের প্রয়োজনীয়, পারিপার্শ্বিক থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ফ্যাক্ট-চেকিং কিন্তু আমাদেরকেই করতে হয়।
সম্প্রতি এএফপি ফ্যাক্ট চেক ফ্যাক্ট-চেকিং বিষয়ে একটি টিউটোরিয়াল প্রকাশ করেছে। সেখানে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের জন্য কিছু সহজলভ্য টুলের ব্যবহার দেখানো হয়েছে। আমাদের বর্তমান আর্টিকেলে পাঠকের জন্য এই টুলগুলো নিয়ো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে প্রথমে ফ্যাক্ট-চেকিং করার কিছু সাধারণ দক্ষতার কথা উল্লেখ করা হলো।
উৎসের সন্ধান
আপনার প্রাপ্ত তথ্যের উৎস সম্পর্কে সজাগ থাকুন। সংবাদের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন ওই সংবাদ কোন কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। আপনি যে উৎস থেকে আপনার তথ্য জোগাড় করছেন, অতীতে ভুয়া তথ্য সরবরাহের কোনো নজির সেই উৎসের আছে কিনা তাও মাথায় রাখতে হবে। আপনার তথ্য একাধিক উৎস থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন।
ক্রসচেক
আপনার তথ্য বারবার একাধিক সোর্সের সাথে মিলিয়ে দেখুন। ইন্টারনেট থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে হলে বারবার চেক করে তারপর নিশ্চিত হোন। তথ্যের মূল উৎসের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করুন। যেমন ধরুন, একটি টুইটের স্ক্রিনশট দেখলে তার সত্যতা যাচাই করার জন্য টুইটারে গিয়ে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে তা নিশ্চিত হয়ে আসতে পারেন। অনেক পুরনো টুইট হলে টুইটারের অ্যাডভান্সড সার্চ অপশনটি ব্যবহার করতে পারেন।
কমেন্ট
কোনো পোস্ট-এর কমেন্টবক্স থেকেও অনেকসময় সহায়ক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। যেমন ভাইরাল বা জনপ্রিয় কোনো পোস্টের কমেন্টবক্সে অনেকসময়ই দেখা যায় কিছু কমেন্টে এমন সব দাবি আত্মবিশ্বাসের সাথে করা হয় যে আপনি চাইলেই সেসবের সূত্র ধরে সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেন, বা কমপক্ষে এটুকু ধারণা তো পাবেনই যে পোস্টের ক্যাপশনে বা ভেতরে যা দাবি করা হচ্ছে তা হয়তো ভুয়া।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ইউটিউবে একটি ভিডিও আছে, যার শিরোনামে লেখা আছে, “অমুক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ওপর প্যারেড চলাকালীন সময়ে আততায়ীর হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা।” ভিডিওটিতে সত্যিই সেরকম কিছুই দেখা যায়। কিন্তু কমেন্ট বক্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, একজন লিখেছেন, “আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, এটি একটি অনুশীলন ছিল।”
সুতরাং, একটি ব্যাপার নিশ্চিত। এ ভিডিওর দাবিতে কিছু একটা গোলমাল রয়েছে। এক্ষেত্রে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের জন্য আপনি একাধিক পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমত, উল্লেখিত দেশের রাষ্ট্রপতির ছবি ইন্টারনেটে গিয়ে দেখতে পারেন, যদি মিল পাওয়া যায়। তার নাম ব্যবহার করে তিনি কখনো আততায়ীর হামলার সম্মুখীন হয়েছিলেন কিনা সেটি গুগলকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। অথবা, ভিডিওটি টুল ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করতে পারেন। কীভাবে একটি ইউটিউব ভিডিও বিশ্লেষণ করবেন তা আর্টিকেল-এর পরের অংশে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ইউআরএল
কোনো ওয়েবসাইটের মূল লিংকটাকেই ইউআরএল (URL: Uniform Resource Locator) বলে। অনেকসময় দুর্বৃত্তরা পরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের ইউআরএল খানিকটা পাল্টে নকল সাইট তৈরি করে। ভালোমতো খেয়াল না করলে তা হঠাৎ চোখে পড়ে না। বিশেষত সংবাদ পড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে ইউআরএলটি কি সঠিক নাকি আপনি ভুয়া পত্রিকার সংবাদ পড়ছেন।
এবাউট আস
বিভিন্ন পেইজ, ওয়েবসাইট ইত্যাদির এবাউট আস (About Us) সেকশনটি পড়া খুবই জরুরি। যেমন ধরুন, আপনি একটি লেখাকে সংবাদ হিসেবে পড়তে শুরু করেছেন, কিন্তু সেই ওয়েবসাইটটি মূলত একটি রম্য বিষয়ক সাইট। এসব সাইটের এবাউট আস সেকশনে স্পষ্টভাবে তা জানিয়ে দেওয়া থাকে। তাই, যেকোনো ওয়েবসাইট, পেইজের নিজেদের সম্পর্কিত পাতাসমূহ ঘেঁটে দেখা জরুরি।
হেডলাইনেই সন্তুষ্টি নয়
অনেক সময়ই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ক্লিকবেইট শিরোনাম দেওয়া হয়। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে পুরো সংবাদটি পড়লে দেখা যায় সংবাদের মূল নির্যাস শিরোনামের সাথে যথেষ্ট দ্বন্দ্বমূলক। তাই শুধু শিরোনাম পড়েই পুরোটা বিশ্বাস করা উচিত নয়। আর কেবল শিরোনাম পড়ে, ভেতরে বিস্তারিত না পড়ে কোনোকিছু শেয়ার করা তো মহাগর্হিত একটি কাজ।
ব্যক্তিগত বিশ্বাস
অনেক সময় আমরা যা বিশ্বাস করি, করতে চাই বা যা আমাদের আদর্শিক অবস্থানের সাথে যায়, কেবল সেসব তথ্য পেতেই পছন্দ করি। একে কনফার্মেশন বায়াস বলে। ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের সময় এ ব্যাপারটির কথা খেয়াল রাখতে হবে। নিজের বিশ্বাসের কারণে সত্যের সাথে যেন কোনোপ্রকার আপস না হয়, সেদিকটা স্মরণে রাখতে হবে।
ফ্রি ফ্যাক্ট-চেকিং টুলস
আমাদের বর্তমান আলোচনায় গুগলকে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তবে আপনি চাইলে যেকোনো সার্চ ইঞ্জিনই ব্যবহার করতে পারেন। এখানে উল্লেখ করা ফ্যাক্ট-চেকিং টুলসমূহ শতভাগ বিনামূল্যে এবং সহজেই ব্যবহার করা যায়।
গুগল সার্চ ইঞ্জিন
স্রেফ গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করেই আপনি অনেক তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারবেন। গুগলে সার্চ করার বেশ কিছু বিশেষ কমান্ড রয়েছে যা ব্যবহার করে আপনি ইনফোডেমিককে না ডুবে আপনার ঈপ্সিত তথ্য খুব সহজেই খুঁজে বের করতে পারবেন। গুগলে সাফল্যের সাথে কীভাবে তথ্য খোঁজা যায় তা জানতে পড়তে পারেন এ আর্টিকেলটি।
ভুয়া সংবাদ ছড়াতে ছবির জুড়ি নেই। কখনো আসল ছবি ব্যবহার করেও ভুল তথ্য ছড়ানো সম্ভব, আর ভুয়া ছবির কথা তো বলাই বাহুল্য। ছবির ভেতরে থাকা অনেক তথ্য আপনি গুগলে সার্চ করে ওই ছবির সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেন। যেমন, কোনো মিছিলের ছবিতে যদি কোনো পতাকার ছবি থাকে তাহলে সেই পতাকার বিবরণ লিখে গুগল করলেই বোঝা যাবে ছবিটিতে যে দেশের মিছিল বা যে বিষয় নিয়ে মিছিলের কথা বলা হয়েছে, তার সাথে ওই পতাকার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা।
তারপর ধরা যাক, একটি ছবিতে কোনো স্থানের নাম উল্লেখ করে ছবিটি সেই স্থানের বলে দাবি করা হয়েছে। এখন আপনি চাইলেই সেই স্থানের নাম গুগল করে স্থানটি দেখতে কেমন তা নিয়ে পরিস্কার ধারণা পেতে পারেন। এতে করে আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে ছবিতে যা দাবি করা হয়েছে তা সত্য কিনা।
গুগল ম্যাপ, গুগল স্ট্রিটভিউ
কোনো ছবিতে কোনো দোকানের নামসম্বলিত বোর্ড, বিলবোর্ড, রাস্তার নাম দেখলে আপনি সেগুলো গুগল ম্যাপে চেক করে দেখতে পারেন। তবে প্রথমে আপনাকে গুগলে ওই নামগুলো সার্চ করতে হবে। তারপর গুগল থেকে পাওয়া লোকেশনের তথ্য অনুযায়ী আপনি ম্যাপে সে জায়গাটি খুঁজে বের করতে পারবেন।
এরপর গুগল স্ট্রিটভিউ ব্যবহার করলে আপনি সেই জায়গার ছবিও দেখতে পারবেন। তখন মূল ছবিতে দেখানো স্থানের সাথে স্ট্রিটভিউ’র ছবি মিলিয়ে দেখতে পারেন। যদি রাস্তার নাম থাকে তাহলে তা অপরিবর্তিতই থাকবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানে দোকানের নাম পাল্টে যেতে পারে বা দোকানটি সেখানে নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে গুগল স্ট্রিটভিউ’র আরেকটি সুবিধা ব্যবহার করা যেতে পারে। স্ট্রিটভিউতে পুরনো ছবি জমা করে রাখা হয়। টাইমলাইন পিছিয়ে নিয়ে আপনি পুরনো ছবিগুলো দেখতে পারবেন।
গুগল ট্রান্সলেটর
কোনো ছবিতে দাবি করা হলো সেটি আরব বসন্তের ছবি। প্ল্যাকার্ডে আরবি লেখা দেখা যাচ্ছে বলেই যে সেই দাবিই সত্য হবে তাও কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে ওই লেখা অনুবাদ করে এর অর্থ পড়তে পারলেই মূল ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
কিছু বিদেশি ভাষা ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করে লেখা হয়। সেগুলো খুব সহজেই আপনি টাইপ করে ট্রান্সলেটর দিয়ে অনুবাদ করতে পারবেন। কিন্তু যদি পুরোপুরি অন্যভাষার বর্ণ হয়? গুগল ট্রান্সলেটরের একটি সুবিধা হলো এর একটি ট্রান্সলেশন-লেন্স আছে। অর্থাৎ, আপনি ক্যামেরা ওপেন করে কোনো বিদেশি ভাষার ওপর ধরলেই এটি তা স্ক্যান করে অনুবাদ করে দেবে। এক্ষেত্রে আপনি কোনো ছবির বিদেশি লেখা অনুবাদের জন্য দুটো ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন। একটাতে ছবিটি ওপেন করা থাকবে, আরেকটি দিয়ে স্ক্যান করে তার লেখা অনুবাদ করা যাবে।
গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ
ছবির সত্যতা যাচাইয়ে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। লেখার বদলে ছবি ব্যবহার করে গুগলে সার্চ করার প্রক্রিয়াকে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ বলে।
images.google.com থেকে সরাসরি ছবি আপলোড করা যায়। ডেস্কটপের ক্রোম ব্রাউজারের ডানদিকের ওপরের অংশে একটি ‘ইমেজ‘ আইকন থাকে। সেখানে ক্লিক করলে ইমেজ সার্চের পেইজটি ওপেন হয়। সার্চ বক্সে ছবি আপলোড করে সার্চ করলে একই ছবিটি আর কোথায় কোথায় রয়েছে তা দেখায় গুগল।
কিন্তু রিভার্স ইমেজ সার্চ ব্যবহার করে কীভাবে ফ্যাক্ট চেক করবেন? কোনো ছবির ক্যাপশনের লেখা পড়ে আপনার যদি সন্দেহ হয়, তাহলে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছবিটি গুগলে সার্চ করলে আপনি সঠিক তথ্যটি পেতে পারেন। দেখা গেল একই ছবি সম্পর্কে অন্য কোনো ওয়েবসাইটে ভিন্ন কথা লিখা হয়েছে। তখন আপনি ক্রসচেক করে সঠিক তথ্য পেতে পারেন। মূলত গুগল সার্চ করে কোনো তথ্য সম্পর্কে যেমন নিশ্চিত ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়, ছবির ক্ষেত্রে তার জন্য রিভার্স ইমেজ সার্চ ব্যবহার করা হয়।
টিনআই
টিনআই সহজে ব্যবহারযোগ্য আরেকটি রিভার্স ইমেজ সার্চ টুল। এটি রিভার্স ইমেজ সার্চ-এর পাশাপাশি কোনো ছবি এডিট করে বদলানো হয়েছে কিনা তাও বুঝতে পারে। এই টুলটি কম্পিউটার ভিশন, প্যাটার্ন রেকগনিশন, নিউরাল নেটওয়ার্ক, ও মেশিন লার্নিং বিষয়ে দক্ষ।
ইন-ভিড উইভেরিফাই
ছবি বা তথ্য তো খুব সহজেই যাচাই করা যায়, কিন্তু ভিডিওর ক্ষেত্রে তা কীভাবে সম্ভব? চিন্তার কারণ নেই, ভিডিও ভেরিফিকেশন আপাতত কঠিন শোনালেও এর জন্য সহজে ব্যবহারযোগ্য একটি টুল রয়েছ।
ইন-ভিড উইভেরিফাই হচ্ছে একটি ব্রাউজার প্লাগইন। আপনাকে এক্সটেনশন হিসেবে এটি আপনার ব্রাউজারে সেট করতে হবে। মাত্র চার থেকে পাঁচ মেগাবাইটের এই টুলটি দিয়ে ভিডিও ভেরিফিকেশনের পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করা যায়।
এক্সটেনশন সংযুক্ত করার পর এটি ওপেন করলে এর হোমপেইজে অনেকগুলো টুল পাশাপাশি দেখতে পাবেন। তার মধ্য থেকে ‘কিফ্রেইমস’ (Keyframes) টুলটির ওপর ক্লিক করুন। এরপর একটি সার্চবক্স হাজির হবে। সেখানে আপনার নির্বাচিত ভিডিওটির লিংক পেস্ট করে এন্টার চাপুন। অথবা চাইলে সরাসরিই আপলোড করতে পারবেন। এরপর টুলটি ভিডিওটি থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব ফ্রেইম, থাম্বনেইলের ইমেজ আপনাকে সরবরাহ করবে। সেগুলো দিয়ে খুব সহজেই রিভার্স ইমেজ সার্চ করে আপনি ভিডিওর সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।
মেটাডেটা এক্সট্রাকশন টুলস
মেটাডেটা বলতে কোনো ডেটার ডেটাকে বোঝায়। যেমন একটি ছবি কোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হলো, পিক্সেল ঘনত্ব কত, রেজল্যুশন, অ্যাপারচার ইত্যাদি তথ্য হচ্ছে ওই ছবির মেটাডেটা।
কোনো ছবির মেটাডেটা জানতে পারলে ওই ছবির সত্যতা যাচাই সহজ হয়ে যায়। একটি ছবি তোলার পর এর মেটাডেটা হিসেবে ছবি তোলার তারিখ, ও সময়, ডিভাইসের মডেল, অ্যাসপেক্ট রেশিও, শাটার স্পিড, ছবিটি তোলার সময় ফ্ল্যাশলাইট অন করা ছিল নাকি অফ করা, ডিভাইসের লোকেশন অন করা থাকলে জিপিএস কোঅর্ডিনেটস, রেজল্যুশন ইত্যাদি আরও কিছু তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই ছবিতে এনকোডেড হয়ে যায়।
কিন্তু এসব তথ্যের সাথে ফ্যাক্ট-চেকিং-এর সম্পর্ক কী? ধরা যাক একটি ছবিতে দাবি করা হলো এটি ২০১৯ সালে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনার ছবি। কিন্তু মেটাডেটা উদ্ধার করার পর যদি দেখা যায় ছবিটি আইফোনের সর্বশেষ মডেল দিয়ে তোলা, তাহলে ছবিটির দাবি করা তথ্য যে ভুয়া তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
ডিভাইসের লোকেশন সিস্টেম অন করা থাকলে জিপিএস কো-অর্ডিনেটস উল্লেখ করা থাকে মেটাডেটায়। যেকোনো জিপিএস কনভার্টার দিয়ে ওই কো-অর্ডিনেটসকে স্থানে রূপান্তর করা সম্ভব। সুতরাং মেটাডেটা থেকে ছবির উৎস সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
ইন-ভিড উইভেরিফাই টুলটির হোমপেইজ থেকে মেটাডাটা বের করার সুবিধা রয়েছে। এছাড়া মেটাপিক্জ বা জেফরি’স ইমেজ মেটাডেটা ভিউয়ার ইত্যাদি টুল ব্যবহার করেও মেটাডেটা দেখা যেতে পারে।
এ পদ্ধতিটির একটি সীমাবদ্ধতা হলো, মেটাডেটা দেখার জন্য আপনার অরিজিনাল ছবির দরকার হবে। সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করার পর মেটাডেটা বদলে যায়। তাই ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা কোনো ছবি থেকে মেটাডেটা উদ্ধার করে কৃতকার্য নাও হতে পারেন।
ইউটিউব ডেটাভিউয়ার
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর এ টুলটি দিয়ে যেকোনো ইউটিউব ভিডিও থেকে ছবি বের করে তা রিভার্স ইমেজ সার্চ করা যায়।
ফেইসবুক ও টুইটারে অ্যাডভান্সড সার্চ
সাধারণ যেকোনো একটি কিওয়ার্ডের ওপর নির্ভর না করে আরও সুনির্দিষ্টভাবে সার্চ করাই হচ্ছে অ্যাডভান্সড সার্চ। ফেইসবুকে সার্চ অপশনে কোনো টপিক লিখে সার্চ করার পর সেই সার্চ রেজাল্টকে বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া যেমন সময়, তারিখ, নতুন-থেকে-পুরানো ইত্যাদি অনুযায়ী সার্চ করা যায়। একইভাবে টুইটারের সার্চ অপশন থেকেও অ্যাডভান্সড সার্চ করা সম্ভব।
তবে অ্যাডভান্সড সার্চ-এর জন্য টুইটারের আরেকটি টুল রয়েছে। টুইটডেক নামের এ টুলটির ইন্টারফেস টুইটার থেকে ভিন্ন। এটি অনেকগুলো কলামে ভাগ করা থাকে। এক কলামে ফিড, একটিতে বার্তাসমূহ, এভাবে নোটিফিকেশন, ট্রেন্ডিং ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা কলাম করা থাকে। আপনি যদি কোনো কিছু সার্চ করেন তাহলে আরেকটি নতুন কলাম খুলে গিয়ে সেখানে সার্চ রেজাল্ট দেখাবে। এ পদ্ধতিতে একসাথে অনেকগুলো সার্চ রেজাল্ট পাশাপাশি একই সময়ে দেখা যায়। এ সার্চ রেজাল্টবারগুলো, ওই সার্চ সম্পর্কিত প্রতিটি নতুন টুইটের সাপেক্ষে রিফ্রেশড হতে থাকে।
ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড
এ টুলটি ব্যবহার করে অতীতে যেকোনো সময়ে কোনো স্থানের আবহাওয়া জানা যায়। স্থান ও তারিখ লিখে সার্চ করলে ওই স্থানের জন্য ওই তারিখের রেকর্ডকৃত আবহাওয়া প্রদর্শন করে টুলটি।
কোনো ছবির দাবিকৃত স্থান আর সময়ের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এ টুলটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ছবির স্থানে দাবিকৃত সময়ের আবাহাওয়ার সাথে ছবিতে ফুটে উঠা আবহাওয়া মিলিয়ে নিলেই হলো। যেমন আপনার হাতে থাকা ছবিতে বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে কিন্তু আপনি টুলটি ব্যবহার করে জানতে পারলেন সে সময়ে ওইস্থানে কোনো বৃষ্টি হয়নি, তাহলে আপনি নিশ্চিত হয়ে যাবেন ছবিটির দাবি ভুয়া।
ওয়েব্যাক মেশিন
কোনো ওয়েবসাইটের পুরনো ভার্সনের ছবি দেখা যায় এ টুল দিয়ে। ইন্টারনেট আর্কাইভের তৈরি করা এই ব্রাউজার এক্সটেনশনটিতে পুরনো ভার্সন খোঁজার পাশাপাশি আপনি ইচ্ছে করলে যেকোনো ওয়েবপেইজের কপিও আপলোড করে রাখতে পারবেন। কোনো সাইট বা পেইজের কোনো পোস্ট যদি পরে কখনো সরিয়ে নেওয়া হতে পারে বলে মনে হয়, তাহলে তা আপনি আগে থেকেই এ টুলটিতে সংগ্রহ করে রাখতে পারবেন। একইরকম আরেকটি টুল হচ্ছে আর্কাইভ.টুডে।
বিশেষায়িত ওয়েবসাইট
ধরুন একটি ছবিতে কোনো শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা কোন শহরের বা দেশের তা উল্লেখ নাই অথবা যা উল্লেখ করা আছে তা নিয়ে আপনি সন্দিহান। এক্ষেত্রে ছবির স্থানিক উৎস কীভাবে বের করবেন? গাড়ির নাম্বারপ্লেট ব্যবহার করে। নাম্বারপ্লেটটি কোন দেশের তা জানতে পারলেই ছবির শহরের নাম জানা যাবে। লাইসেন্স প্লেটস অভ দ্য ওয়ার্ল্ড সাইটে গিয়ে আপনি বিশ্বের সব দেশের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের নমুনা দেখতে পারবেন। এটি একটি বিশেষায়িত ওয়েবসাইট। এরকম অনেক জিনিস নিয়েই বিশেষ ওয়েবসাইট বানানো হয়, এই সাইটগুলো শুধু ওই একটি নির্দিষ্ট জিনিস নিয়েই কাজ করে। এরকম আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ইন্টারনেট মুভি ফায়ারআর্মস ডেটাবেইজ। এই সাইটিটিতে কোন সিনেমায় কোন কোন মডেলের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তা জানানো হয়।
ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের কাজের জন্য চাই প্রখর সন্ধানী চোখ, ও স্মার্টনেস। কোনো টুল কখন ব্যবহার করতে হবে তা জানতে হবে। সুনির্দিষ্ট টুল ব্যবহারের কথা প্রয়োজনের সময় যেন মাথায় আসে তা খেয়াল রাখতে হবে। গুগল সার্চের বিষয়ে ধারণা রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেটকে ভুয়া তথ্য থেকে মুক্ত করতে আপনার ব্যক্তিগত ফ্যাক্ট-চেকিংও কিন্তু বড় রকমের ভূমিকা রাখতে পারে।