কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষিজমির বিশাল অংশ ব্যবহৃত হয় ধান চাষে। ফসলি জমির ধান নানা স্তর পার হয়ে চাল হিসেবে বাজারে আসে। ধানের এই ফলনের পেছনে রয়েছে অজস্র কৃষক এবং কৃষি গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রম। কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের সময়ানুক্রমিক প্রচেষ্টায় আজ ব্রি (Bangladesh Rice Research Institute বা BRRI) এর হাত ধরে এসেছে এমন ৫টি ধান, যা শুধু নানান আঙ্গিক থেকে কৃষির জন্য আশীর্বাদই নয়, পাশাপাশি কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতেও সহায়ক হবে। আজকের আয়োজন ব্রি এর উদ্ভাবিত এই পাঁচটি ধানকে নিয়েই, যার একটিতে (ব্রি ধান-৮৬) ব্যবহার করা হয়েছে জীবপ্রযুক্তি।
ধান থেকে পাওয়া চাল বাংলাদেশের প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন মানুষের প্রধান খাদ্য। গ্রাম্য কর্মসংস্থানের প্রায় শতকরা ৪৮ ভাগ ধানের ওপর নির্ভরশীল। একজন গড়পড়তা বাংলাদেশি লোকের ক্যালরির চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ এবং প্রোটিনের চাহিদার অর্ধাংশ ধানের ওপর নির্ভরশীল। কৃষিজ জিডিপির অর্ধেক এবং বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের এক ষষ্ঠাংশ ধানের ওপরই নির্ভরশীল। বর্তমানে বাংলাদেশের ৭৮.৪ লক্ষ হেক্টর চাষযোগ্য জমির প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগই ধান চাষে ব্যবহৃত হয়। দেশের ১৩ মিলিয়ন কৃষিজীবী পরিবার ধান চাষ করে থাকে। সেচ দেওয়া হয় এমন জমির শতকরা ৮০ ভাগের বেশি এবং ফসলি জমির প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগেই ধানচাষ হয়ে থাকে। এভাবেই ধান বাংলাদেশের মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
এই বিপুল পরিমাণ মানুষের মুখে খাবার জোগানোর জন্য বাংলাদেশ বর্তমানে ২৫ মিলিয়ন টন ধান উত্পাদন করে। ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২৭.২৬ মিলিয়ন টন ধান দরকার হবে, যেখানে বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার সাথে সাথে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাবে। কাজেই হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন বাড়াতে হবে অন্তত ২.৭৪-৩.৭৪ পর্যন্ত। তাই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে ধানের ফলন বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার, উচ্চ মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার এবং যান্ত্রিক উপায়ে ফসল তোলার মতো আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার সমাধান বয়ে আনতে পারে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট বা ব্রি-এর বিজ্ঞানীরা তাদের নিরন্তর প্রয়াসের ফলস্বরূপ ধানের নতুন ধরনের পাঁচটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন। এই ধানগুলো হলো ব্রি ধান-৮২, ব্রি ধান-৮৩, ব্রি ধান-৮৪, ব্রি ধান-৮৫ এবং ব্রি ধান-৮৬।
২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর এই ধানগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এই ধানের জাত উদ্ভাবন সম্পর্কে ব্রি এর মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেছেন, “উদ্ভাবিত নতুন পাঁচটি জাতের মধ্যে তিনটি আউশ মৌসুমের ও দুটি বোরো মৌসুমের। আউশ মৌসুমকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্য আছে সরকারের। সেজন্যই আমরা এবার আউশের ওপর জোর দিয়েছি।”
অনুমোদনপ্রাপ্ত ধানগুলোর মধ্যে ব্রি ধান-৮২, ৮৩ ও ৮৪ আউশ ধানের প্রকরণ এবং ব্রি ধান-৮৫ এর রয়েছে বদ্ধ জলে টিকে থাকার ক্ষমতা। এই পাঁচটি সদ্য অনুমোদিত ধানসহ ব্রি এর উদ্ভাবিত ধানের সংখ্যা বর্তমানে ৯১টি। এর মধ্যে একটি জীবপ্রযুক্তিজাত, ৬টি হাইব্রিড বা সংকর এবং বাকিগুলো উচ্চ ফলনশীল পারস্পরিক জননক্রমে প্রাপ্ত প্রকরণ। দেশের ধান উত্পাদনের কৃষিজমির শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকায় ব্রি-উদ্ভাবিত ধানের চাষ হয়। এটি দেশে উত্পাদিত চালের শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ।
ব্রি ধান-৮৬
সদ্য অনুমোদন পাওয়া ব্রি ধান-৮৬ এর কাণ্ড বেশ শক্ত ও মোটা এবং যান্ত্রিক ফসলকাটা যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই একে কাটা যায়। ফসল তোলার মজুরের কমতি এবং যান্ত্রিক ফসল তোলার যন্ত্র ব্যবহারের জটিলতা যেসকল কৃষকের দুশ্চিন্তার কারণ, তাদের জন্য এই ধান সুবিধাজনক হিসেবে প্রমাণিত হবেন বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।
ব্রি ধান-৮৬ তে ব্যবহার করা হয়েছে জীবপ্রযুক্তি। এন্থার কালচার নামক জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ইরানি ধানের জাত নিয়ামাত থেকে তৈরি করা হয়েছে এটি। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ উত্পাদিত ব্রি ধান-২৮ এর মতোই এ ধানটি জনপ্রিয়তা পাবে এবং এর তুলনায় হেক্টরপ্রতি প্রায় আধা টন বেশি ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এন্থার তথা পরাগধানীর কালচার (কৃত্রিম খাদ্যের জোগান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বৃদ্ধি করানো) বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো ধানে ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে অপরিপক্ব পরাগরেণুকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কৃত্রিম উপায়ে খাদ্যের জোগান দিয়ে বিভাজিত হতে দেওয়া হয় এবং এভাবেই এটি আকারে বৃদ্ধি পেয়ে কোষকলায় পরিণত হয়। এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়া শক্ত কিংবা তরল উভয় মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তরুণ ধানবিজ্ঞানী মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্রি এর গবেষকদের একটি সম্ভাবনাময় ধানের জাত উদ্ভাবনে সক্ষম করেছে, যা কিনা গতানুগতিক প্রজনন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে পেতে আরো অনেক বেশি সময় নিতো।
ব্রি ধান-৮৬ এর ফলন গড়ে ৬-৬.৫ টন এবং উপযুক্ত পরিবেশে তা ৮ টন পর্যন্ত তোলা সম্ভব। ব্রি ধান-৮৬ হতে প্রাপ্ত চালে এমাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ। ঝরঝরে ও সুস্বাদু ভাতের যোগান দেওয়া এই ধানের চাল লম্বা, চিকন ও সাদা। চালের দানায় প্রোটিন প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। এর জীবনের মেয়াদ ১৪০-১৪২ দিন। গাছপ্রতি গুছির সংখ্যা ৯-১০টি এবং এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৩.২৩ গ্রাম।
ব্রি ধান-৮২
ব্রি ধান-৮২ রোপা আউশ মৌসুমের স্বল্পমেয়াদি একটি ধান। হেক্টরপ্রতি গড়ে ৪.৫-৫.৫ টন ফলনের এই ধানের জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। এই ধান থেকে প্রাপ্ত চালে এমাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৮ ভাগ। সাদা রঙের মাঝারি মোটা এ চালের ভাত হবে ঝরঝরে এবং প্রতিটি দানায় প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৭.৬ ভাগ। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন ২৩.৮৪ গ্রাম। আউশ মৌসুমের প্রচলিত ধান ব্রি ধান-৪৮ এর থেকেও ব্রি ধান-৮২ এর আয়ুষ্কাল ৪-৫ দিন কম। ফলে রোপা আউশ মৌসুমে এই ধান চাষের পরেও আমন ধান চাষাবাদের সুযোগ পাওয়া যাবে, যার ফলস্বরূপ ধানের উত্পাদনও বৃদ্ধি পাবে।
ব্রি ধান-৮৩
ব্রি ধান-৮৩ আউশ মৌসুমের একটি ধানের জাত, যার জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। এই ধানের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৪-৫.৫ টন পর্যন্ত হতে পারে, যা প্রচলিত ব্রি ধান-৪৩ এর চেয়ে ১ টন বেশি। ১০৫ সে.মি. উচ্চতার ধানগাছের চাল মাঝারি, মোটা ও সাদা রঙের এবং এই চালের ভাত হবে ঝরঝরে। যথাক্রমে শতকরা ২৬ ভাগ ও শতকরা ৭ ভাগ এমাইলোজ ও প্রোটিন রয়েছে এই চালে।
ব্রি ধান-৮৪
ব্রি ধান-৮৪ বোরো মৌসুমের একটি জাত, যা উচ্চফলনশীল, জিংক সমৃদ্ধ এবং স্বল্পস্থায়ী। হেক্টরপ্রতি গড়ে ৬-৬.৫ টন ফলনের এই ধানের গাছের উচ্চতা ৯৬ সে.মি. এবং জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন। লম্বা, চিকন ও লালচে-বাদামী এই ধানের চালের ভাতও হয় ঝরঝরে এবং এই চালে এমাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৫.৫ ভাগ। এছাড়াও এতে জিংক এর পরিমাণ দানাপ্রতি শতকরা ২৭.৬ ভাগ এবং প্রোটিন শতকরা ৮.৩ ভাগ। এর জীবনকাল বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় ব্রি ধান-২৮ এর মতোই স্বল্প হওয়ায় এ ধান বোরো মৌসুমে আবাদের পরেও পাট চাষের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত জিংকযুক্ত ধানের ছয়টি জাতের মধ্যে এই ধানেই সর্বোচ্চ পরিমাণ জিংক রয়েছে। এছাড়াও ব্রি ধান-৮৪ তে কিছু পরিমাণে আয়রনও রয়েছে।
ব্রি ধান-৮৫
রোপা আউশ মৌসুমের নতুন এই জাতের ধানটি থেকে লম্বা, মাঝারি, চিকন ও সাদা রঙের চাল পাওয়া যায়। এ চালের ভাতও ঝরঝরে হয়ে থাকে। দানাপ্রতি প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.১ ভাগ, এমাইলোজ শতকরা ২৫.২ ভাগ এবং এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.৩ গ্রাম। এই ধানের জীবনকাল ১০৬-১১০ দিন, গাছের উচ্চতা ১১০ সে.মি. এবং গড় ফলন ৪.৫-৫.৫ টন পর্যন্ত।
বাংলার মাটির প্রতিটি রন্ধ্রে মিশে আছে কৃষি ও কৃষিজ পণ্যের নাম। কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন ধানের এই পাঁচটি জাত কৃষির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, এমনটাই আশা ধান গবেষকদের।
ফিচার ছবিসূত্র: shutterstock.com