আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে মুদ্রিত বা ছাপা বই পড়ার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি মানুষের পাঠের অভ্যাসকে যতই আধুনিক করে তুলুক, নতুন বই হাতে নেওয়ার অনুভূতিই আলাদা। বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য সেই মজার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিখ্যাত কোনো লেখক নন; তিনি একজন সম্পাদক ও প্রকাশক।
প্রকাশনা পূর্ববর্তী জীবনকাল
১৯৪৪ সালে ফেনির পরশুরামে মহিউদ্দিন আহমেদের জন্ম। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান পোস্টাল সার্ভিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নটর ডেম কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ‘ব্লু এণ্ড গোল্ড’ নামক কলেজ ম্যাগাজিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে হলি ক্রস কলেজ থেকে প্রকাশিত ‘স্ক্রাইব‘ ম্যাগাজিনটির সাথে এই ম্যাগাজিনের দুর্দান্ত কিন্তু বন্ধুসুলভ প্রতিযোগিতা চলতো।
সে সময় থেকেই সম্পাদনা ও প্রকাশনার প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। কিন্তু সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিষয়ে কেবলমাত্র ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করতো বিধায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রভাষক তাকে এই বিষয় নিয়ে অন্যত্র উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়া শেষ করে, পাকিস্তান কাউন্সিল স্কলারশিপ নিয়ে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সেসময়ে তিনি পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্রনিকলের সম্পাদক ছিলেন। একইসাথে তিনি একজন ছাত্রনেতাও ছিলেন।
আমি বরাবরই একজন সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম, আর তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কমিউনিকেশন ও জার্নালিজম বিভাগে ভর্তি হই।
এমএ পড়া শেষে তিনি পাকিস্তান টাইমসে একজন শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। পাকিস্তান টাইমসের তৎকালীন সম্পাদক এ ডি চৌধুরি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার ছিলেন। চাকরিতে যোগদানের প্রথম দুই মাসের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংবাদ সংগ্রহে মহিউদ্দিনের সফলতা দেখে তিনি তাকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ‘মাস কমিউনিকেশন ও পাবলিক রিলেশন্স‘ বিষয়ের সহকারি প্রভাষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব করেন।
প্রকাশনার হাতেখড়ি ও ইউপিএল প্রতিষ্ঠা
শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেও, তার মন পড়ে থাকে প্রকাশনায়। কিন্তু ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি অনুধাবণ করেন, পাকিস্তানে আর বেশি দিন থাকা ঠিক হবে না। তাই তিনি ‘স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’-এ পিএইচডি করার আবেদন করেন এবং উঁচু মানের আর্থিক সহায়তা তথা বৃত্তি সহকারে তা গৃহীত হয়। অন্যদিকে একই সময়ে, ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস’ (ওইউপি) এর পাকিস্তান শাখায় সম্পাদক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি সেখানেও আবেদন করেন।
বলাই বাহুল্য, তার সেই আবেদনও গৃহীত হয়। এটা ছিল তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। আর তাই স্ট্যানফোর্ডের আর্থিক স্বচ্ছলতাকে খুব সহজেই বিদায় জানিয়ে তিনি ওইউপি এর পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করার পরে ঐ বছরই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পরে তিনি দুই বছর যাবৎ ওইউপি-এর ঢাকা শাখার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে ওইউপি-এর ঢাকার কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে তাকে করাচী শাখায় ‘এডিটর-অ্যাট-লার্জ’ বা রোভিং এডিটর হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু করাচীতে একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। আর এই সিদ্ধান্তই তাকে ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ (ইউপিএল) নামে নিজের প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রেরণা ও সুযোগ এনে দেয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে অন্যতম, ইউপিএল- প্রধানত পাঠ্যবই ও পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় বই-ই প্রকাশ করে থাকে। এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটিকে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,
পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে আমার বরাবরই ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল, আর আমার মনে হয়েছিল, শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সহায়তা (প্রয়োজনীয় বই প্রকাশের মাধ্যমে) করা প্রয়োজন। অন্যান্যরাও এই সকল বই থেকে নিজেদের গবেষণার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।
– মহিউদ্দিন আহমেদ, ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার
বাংলাদেশি লেখক ছাড়াও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদদের রচিত বিভিন্ন বই তিনি প্রকাশ করেছেন। এসকল বিদেশি লেখক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে আইরিক জি জেনসেন, বেথ রয়, বেটসি হার্টম্যান, ক্ল্যারেন্স ম্যালোনি, থেরিজ ব্ল্যানশ্টে, কার্স্টেন ওয়েস্টার্গার্ড, ম্যারি ফ্রান্সিস ডারহ্যাম, রব গ্যালাঘার, এলেন ব্যাল ও ইয়াসুহিরো তাকিমি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে প্রকাশিত বই যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করার মাধ্যমে এই দুই দেশের মধ্যে সেসময় পর্যন্ত বিদ্যমান একমুখী এই ব্যবসায়কে তিনি বিপরীত দিকে চালনা করতে শুরু করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিকৃত পাঠ্যবইয়ের একটি বড় অংশ প্রকাশিত হয় ইউপিএল থেকে।
রোড টু বাংলাদেশ ও অন্যান্য
১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে, দেশের ইতিহাস সঠিক ও পর্যাপ্তরূপে সংরক্ষণের অভাব অনুধাবন করে তিনি ‘রোড টু বাংলাদেশ’ নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশনার সূচনা করেন। এই ধারাবাহিকের অধীনে প্রকাশিত বইয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের স্বাধীনতায় ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী ছাত্র ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য এই ধারাবাহিকটি অত্যন্ত উপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৯৮ সালে তার নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ২৮ জন পাকিস্তানি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে এই সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ‘পাকিস্তানের দৃষ্টিতে ১৯৭১’ নামে ভলিউম আকারে বই প্রকাশ করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুনতাসির মামুন যৌথভাবে এই ভলিউমটির সম্পাদনা করেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রিবিউনাল (আইসিটি), তার প্রকাশিত বেশ কিছু বই সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে বিবেচনা ও ব্যবহার করে।
২০১২ সালে মহিউদ্দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ করেন। ১৯৬৬-৬৯ সময়কালে করাগারে বন্দীদশায় বঙ্গবন্ধু দিনলিপি আকারে এই আত্মজীবনী লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় প্রকাশনার পাশাপাশি, এই বইটি একইসাথে ভারত (পেঙ্গুইন) ও পাকিস্তানে (ওইউপি) ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রকাশ করার ব্যবস্থাও তিনি করেন। বিশ্বমানের মানদণ্ডে পর্যাপ্তরূপে পাণ্ডুলিপির যথার্থতা যাচাই করেই এই বইটি প্রকাশ করা হয়। ২০১০ সালে মূলত নোট তৈরি করার মাধ্যমেই এই বইটির সম্পাদনার কাজ শুরু করা হয়, তবে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ভাবপ্রকাশকে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রকাশনার ক্ষেত্রে খুব বেশি সম্পাদনা করা হয়নি।
ইতিহাসবিদ প্রফেসর এনায়েতুর রহিম-এর কাছে এই পাণ্ডুলিপিটি ছিল। সেসময় অত্যন্ত অসুস্থ থাকার কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমি বোস্টনে পড়ালেখা করছিলাম, আর মহিউদ্দিন আহমেদ আমার সাথে দেখা করতে আসেন। সেই সময়ে প্রফেসর তাকে দেখা করতে বলেন এবং ঐ পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বেবি মওদুদ, সমগ্র প্রকাশনা প্রক্রিয়া সমন্বয় করেন।
– মাহরুখ মহিউদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইউপিএল) ও মহিউদ্দিন আহমেদ-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা
এছাড়াও ‘রিপোর্ট অফ দ্য টাস্ক ফোর্সেস অন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস ফর দ্য ১৯৯০স’- ছিল ইউপিএল এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা, যা মহিউদ্দিনের কথা অনুযায়ী- এরশাদ সরকারের পতনের পর পরই ২৯টি টাস্ক ফোর্স গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি চিত্র হিসেবে তৈরি করা হয়।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
তার নেতৃত্বে ১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার ইউপিএল, ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার’ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯১ সালে তিনি স্বর্ণপদক-এ ভূষিত হন। পরিবেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী, সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৭ জন প্রকাশককে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মহিউদ্দিন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। অ্যারিজোনার বেনসন-এ অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র আন্তর্জাতিক কার্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে তাকে ‘পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট’ (প্রকাশনা ব্যবস্থাপনা) বিষয়ে ‘কালচারাল ডক্টোরেট’ ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
তবে তার কীর্তির জন্য প্রাপ্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্মাননা হলো, ২০১৪ সালে ‘বাংলাদেশ অ্যাকাডেমিক এণ্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক প্রদত্ত ‘এমেরিটাস পাবলিশার’ পদবি লাভ। একজন সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদ সৃজনশীল যেকোনো কাজের ক্ষেত্রেই মূল রচয়িতা ও শিল্পীর স্বত্ত্বাধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার।