ক’দিন আগে আইডিবি ভবন থেকে তালতলার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। অমনি রাস্তার দেয়ালে চোখে পড়লো একটি ছবি, ঠিকভাবে বললে গ্রাফিটি। ঢাকার রাস্তায় এমন গ্রাফিটি সচরাচর দেখা যায় না। দেখলাম আরো কয়েকজন পথচারী নিবিষ্ট হয়ে দেখছেন ছবিটি। জীর্ণ পোষাকের একজন মানুষ খাঁচায় বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে সূর্য, টকটকে লাল সে সূর্য। তার ঠিক পাশেই লেখা- “সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই“।
ব্যক্তিগত সূর্যটাকে খাঁচায় বন্দী করে সে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। সুবোধ পালিয়ে যাচ্ছে, কারণ মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে। সুবোধ পালিয়ে যাচ্ছে, কারণ মানুষের হৃদয়ে পাপের বসতি। সময় এখন পক্ষে নেই বলেই আজ পালিয়ে যাচ্ছে সুবোধ।
আচ্ছা এই সুবোধ কে? ‘HOBEKI?’ ট্যাগ লাইন নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওসহ অন্যান্য এলাকার রাস্তার দেয়ালগুলোতে আঁকা গ্রাফিটিগুলোর মূল চরিত্র সুবোধ। একজন হতাশ, দুর্দশাগ্রস্ত, হেরে যাওয়া মানুষ হিসেবেই আমরা তাকে দেখি। কিন্তু সুবোধ কি কোনো চরিত্র? নাকি সুবোধ আমাদের মাঝে হাজির হয় বিমূর্ত কোনো ধারণা নিয়ে?
সুবোধ বা ‘সু বোধ’ হয়তো আমাদের সুন্দর বোধগুলো, আমাদের সুন্দর চিন্তাগুলো কিংবা আমাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো। আমরা দ্বিধায় ভুগি, এ দ্বিধা চিরন্তন। আমরা হলফ করে বলতে পারি না চরিত্র নাকি রূপক হয়ে সুবোধের জন্ম। তবু ঠিক জানি, সুবোধের সাথে আমাদের কোথায় যেন মিল আছে। কেন যেন ওকে খুব আপন মনে হয় আমাদের।
অনেকে সুবোধের এ গ্রাফিটিগুলোকে বিলেতের বিখ্যাত দেয়াল চিত্রকর ব্যাঙ্কসির গ্রাফিটিগুলোর সাথে তুলনা করতে চান। আঁকার মাধ্যমের ক্ষেত্রে অবশ্য তা মিলে যায়। ব্যাঙ্কসির আঁকা ছবিগুলো স্টেন্সিল ব্যবহার করে, সুবোধেরও তাই। কিন্তু মূল্যবোধ আর প্রতিবাদের প্রশ্নে তারা ভিন্ন। ব্যাঙ্কসি রাষ্ট্রকে ব্যঙ্গ করে ছবিগুলো আঁকতেন। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেয়ালের পটে তিনি নিজস্ব প্রতিবাদ গড়ে তুলতেন। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার গ্রাফিটিগুলো চিৎকার করতো।
অন্যদিকে সুবোধ আমাদের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। সে সব কিছুই মেনে নেয়। নিত্যদিন শহরের বুকে মানুষের প্রতি মানুষের নির্মমতা সে মেনে নেয়। পাথর এ সমাজে সে এখনও ততটা কঠোর হয়ে যায়নি। সুবোধ সে নির্মমতা সহ্য করতে পারে না বলে নিজেকে আবদ্ধ করে জেলের অন্ধকারে। কলুষিত সিস্টেমের মাঝে টিকতে না পেরে সে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবু ঘুরে দাঁড়াবার চিন্তা করে না, তাতে যে জানের ভয়! তার শুধু আকুতি থাকে, ব্যক্তিগত সূর্যটাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবার আকাঙ্ক্ষা থাকে।
স্যোশাল মিডিয়ার নিজেকে জাহির করার এ যুগে কে বা কারা নিভৃতে সুবোধকে দেয়ালের পটে এঁকে যাচ্ছেন, তার খোঁজ জানেন না কেউ। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই হয়তো মানুষের জন্য কথা বলতে ভালোবাসেন সুবোধের কারিগর। জনসম্মুখে এমন কাজ হয়তো তাকে সময়ের নিয়ন্ত্রকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। তাই অগোচরে থেকে তার এ প্রতিবাদ সাধারণের কাছে আরো ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গুণকীর্তনে ঢেকে থাকা আমাদের দেয়ালগুলোতে সুবোধের আগমন ব্যতিক্রম, তবে প্রথম নয়। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি, আইজুদ্দিন’ দেয়াল লেখাটি সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছিলো খুব। এখনও সে প্রজন্মের মানুষেরা দুঃখ-দুর্দশায় পড়লে সেই কষ্টের ফেরিওয়ালা আইজুদ্দিনের কথা স্মরণ করেন। সময়ের সাথে দেয়ালের বয়স বাড়ে, মুছে যায় আইজুদ্দিনের কষ্টের বয়ান। পরের দশকে আমরা দেখি ‘অপেক্ষায় নজির’। নজির হয়তো কোনো ভালো সময়ের অপেক্ষা করতে করতে মলীন হয়ে গেছেন, কিন্তু হারিয়ে যাননি। তিনি ঠাঁই পেয়েছেন আইজুদ্দিন, সুবোধদের তালিকায়। সুবোধ সিরিজের নতুনত্ব হলো দেয়াল লেখার সাথে সাথে আমাদের নায়ক সুবোধের ছবি আর তার সূর্য।
সুুবোধ সিরিজের ছবিগুলোকে যদি একনজরে দেখে যাই তবে দেখবো, বেশ কিছু জায়গায় একই স্টেন্সিল ব্যবহার করা হয়েছে। আবার যে কথাগুলো লেখা আছে সুবোধের পাশে পাশে, সেগুলোও স্টেন্সিল ব্যবহার করে লেখা। অর্থাৎ আঁকিয়ের কাছে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ দেখে ফেলুক কিংবা তার পরিচয় জানুক, তিনি তা চাননি। তার কাছে তার কাজ মুখ্য, মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া কথাগুলো মুখ্য। সুবোধের আবেদন তাই আমাদের কাছে দিনকে দিন জোরালো হয়ে ওঠে।
সুবোধ হয়তো ঠিক পালিয়ে যাবে, এই নষ্ট সমাজ থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই তার মুক্তি। কিন্তু পালাবার কোনো পথ কি আদৌ খোলা আছে? তা আমাদের জানা নেই, তবে সুবোধকে শেষবার আমরা যখন আগারগাঁও-এ দেখি, সুবোধের মন খারাপ। তার মন খারাপ দেখে আমাদের মনও ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার হাতে খাঁচাটা আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তার পোষা সূর্যটা নেই। আশেপাশে কোনো কথাও নেই। সে খুব একা, পালিয়ে হয়তো যাবে ঠিকই, কিন্তু সে হেরে গেছে, তার সূ্র্যটা চুরি হয়ে গেছে।
সুবোধের গল্প কি শেষ হয়ে গেছে? সে কি পালিয়ে গেছে আমাদের ফেলে? আমরা সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি। সুবোধের আঁকিয়ে হয়তো ফিরে আসবেন পরবর্তী সময়ে সুবোধের কী হলো তা জানাতে। কিংবা তার বা তাদের আঁকায় নতুন কোনো সুবোধ হয়ে উঠবে আমাদের প্রতিনিধি। এতকাল পরে হলেও আমাদের দেয়ালগুলোতে আমরা যে শৈল্পিক প্রতিবাদের সূচনা পেলাম, তা বারেবারে ফিরে আসুক। আমরা তার অপেক্ষা করি। আশা করি সুবোধের সুনীতির আহবান ছড়িয়ে পড়ুক রাজধানী থেকে সারাদেশে। সে আহবানে আমরা ফের মানুষ হয়ে উঠবো একদিন।
সংযুক্তি:
[১] স্টেন্সিল হলো ছবি আঁকার এক ধরনের উপায়। প্রথমে কাগজ, কাপড় বা পলিথিনকে মাপমতো কেটে নেওয়া হয়, তারপর যার উপর আঁকা হবে, সেখানে কাগজ, কাপড় বা পলিথিনটি বসিয়ে রঙ টেনে দিলেই আঁকা হয়ে যায়। দ্রুততার সাথে আঁকার জন্য শিল্পীরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
[২] কষ্টে আছে আইজুদ্দিন নামে লেখক আন্দালিব রাশদীর যে গল্পটি সংযুক্ত করা হয়েছে, তা শুধুমাত্রই গল্প এবং লেখকের নিজস্ব কল্পনা। বাস্তবের সেই আইজুদ্দিনের সাথে তার কোনো মিল নেই।
[৩] শিরোনামের শব্দবন্ধতে বিখ্যাত ব্যান্ড শিরোনামহীনের গান ‘সূর্য’ এর ট্যাগ লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।