ফুল-ফলের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। মজার মজার নানা রকম ফল পাওয়া যায় আমাদের দেশে। একেক মৌসুমে আসে একেক রকম ফল। আম, আতা, কলা, কাঠাল, জাম, জামরুল ইত্যাদি ফল আমাদের সকলেরই পরিচিত। তবে আমাদের দেশে এমন অনেক ফল রয়েছে যা আমারা অনেকেই চিনি না। কয়েক বছর আগেও এসব ফল গুলো আমাদের গ্রামগঞ্জে পাওয়া যেত। বাংলার এসব ফলের উল্লেখ রয়েছে বহু ছড়া কবিতায়, বহু গল্প উপন্যাসে। কিন্তু বর্তমানে নগরায়ন ও জঙ্গল ধ্বংস করে ফসলের ক্ষেত তৈরির ফলে এসব ফলের গাছ আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম এসব ফলগুলো সম্পর্কে জানতে পারছে না। যা আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য একটি বড় হুমকি। তাই চলুন আজকে জেনে নিই আমাদের দেশের এমন কিছু কম প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় মজাদার ফল সম্পর্কে।
বৈঁচি
বৈজ্ঞানিক নাম: Flacourtia indica
বিলুপ্তপ্রায় ফলের কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে আসে বৈঁচির নাম। বাংলা সাহিত্যের বহু কবি, বহু লেখকের গল্প, কবিতায় উঠে এসেছে বৈঁচি ফলের কথা। কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতায়,
“খয়েরি অশ্বথপাতা
বৈঁচি শেয়ালকাটা,
আমার দেহ ভালবাসে…”
দক্ষিণাঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ফল এই বৈঁচি। বরিশাল অঞ্চলে কাঁটাবহরি নামে পরিচিত এটি। এছাড়াও অনেক স্থানে বুঁজ, ডঙ্কার ফল ইত্যাদি নামেও ডাকা হয় বৈঁচিকে। ঝোপ ঝোপ কাঁটাযুক্ত গাছ হয় বৈঁচির। ঘন ডালপালা, হালকা সবুজ গোলাকার পাতা হয় এই গাছে। গাছের গায়ের কাঁটা হয় প্রায় ৩/৪ ইঞ্চি লম্বা। কাঁটা খুব সুঁচালো ও বিষাক্ত।
সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এ গাছে ফুল ধরে। জ্যৈষ্ঠ মাসে ফল পাকে। ফল দেখতে অনেকটা বরইয়ের মতো। কাঁচা ফল হয় সবুজ রঙের তবে পাকলে তা জামের মতো রঙ ধারণ করে। খুবই মজার স্বাদ বৈঁচির। টক মিষ্টি স্বাদের এই ফলের স্বাদ পরিচিত অন্য কোনো ফলের মতো নয়। ভিন্ন স্বাদের এই ফলটি আগে গ্রামগঞ্জের শিশু-কিশোরের খুবই প্রিয় ছিল।
গ্রামগঞ্জে, ঝোঁপেঝাড়ে অবহেলায় বেড়ে উঠে বৈঁচি গাছ। আমাদের দেশের কোথাও চাষ হয় না এই গাছের। আগে নদীর ধারে কিংবা রাস্তার পাশে খুঁজলে বৈঁচি গাছের দেখা মিলতো। তবে এখন আর এই গাছ দেখা যায় না। বহু ঔষধি গুণ সম্পন্ন বৈঁচিকে আমাদের দেশে বিলুপ্তপ্রায় ঘোষণা দেওয়া হয়ছে।
বিলিম্বি
বৈজ্ঞানিক নাম: Averrhoa bilimbi
বিলিম্বি ফলটি অনেক স্থানে ‘বেলুম্বু’ কিংবা ‘বিলম্ব’ নামেও পরিচিত। টক স্বাদের এই ফলটি আগে বাংলাদেশের বহু স্থানে দেখতে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এটি নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ছাড়া তেমন দেখতে পাওয়া যায় না।
বিলিম্বি গাছ খুব বেশি বড় হয় না। গাছের পাতাগুলো হয় কামরাঙা গাছের মতো। বিলিম্বি ফলের আকার কিছুটা লম্বাটে, অনেকটা পটলের মতো। গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল হয়। গাছের ডাল, এমনকি কান্ডেও ফল হয়। গাছ থেকে প্রায় সারা বছরই ফল পাওয়া যায়। বিলিম্বি ফল স্বাদে খুবই টক। এ ফল কাঁচা খাওয়া যায়। তবে এটি বিভিন্ন রান্নাতেই বেশি ব্যবহৃত হয়। রান্না করলে এর টকের পরিমাণ কমে যায়। কাঁচা ফল লবণ ও মরিচ সহযোগে খেলে বেশ ভালো লাগে। আর রান্নার ক্ষেত্রে ডাল কিংবা মাংসে বিলিম্বি ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও বিলিম্বি দিয়ে আচার তৈরি করা হয়। বিলিম্বিতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। বিলিম্বি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। বিদেশে বিলিম্বি দিয়ে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় তৈরি করা হয়।
চালতা
বৈজ্ঞানিক নাম: Dillenia indica
চালতা গ্রাম বাংলার অবহেলিত একটি গাছ। সাধারণত বনে জঙ্গলে কিংবা দু-একটি গ্রাম্য বাড়ির উঠানে চালতা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। চালতা গাছ দেখতে অনেক সুন্দর। পাতাগুলো সবুজ। পাতার ধারগুলো সুন্দর খাঁজকাটা। এই গাছ উচ্চতায় ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
চালতা গাছের সবচেয়ে সুন্দর অংশ হলো এর ফুল। সুন্দর সাদা রঙের এই ফুলের ৫টি করে পাপড়ি থাকে। ফুল বেশ বড় ও সুগন্ধযুক্ত হয়। চালতা ফল হয় গোলগাল, সবুজ রঙের। ফল বলে পরিচিত হলেও চালতার ব্যবহৃত অংশটি আসলে ফুলের বৃতি। ফুলের মাংসল বৃতিই ফল হিসেবে খাওয়া হয়।
টক-মিষ্টি স্বাদের চালতা দিয়ে সাধারণত আচার, চাটনি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এককালে চালতার আচার বাঙালী মেয়েদের জনপ্রিয় একটি খাবার ছিল। আচার ছাড়াও ডালের সাথেও চালতা রান্না করা হয়। পাঁকা ফল লবণ-মরিচ দিয়েও খাওয়া যায়।
সর্দি-কাশি, জ্বর, বাতের ব্যথা প্রভৃতি নানা রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে চালতার। কচি চালতা পাতার রস রক্ত আমাশয় দূর করে বলে জানা যায়।
কাউফল
বৈজ্ঞানিক নাম: Garcinia cowa Roxb
কাউফল বাংলাদেশের অপ্রচলিত একটি ফল। বাংলাদেশের খুব কম এলাকায় এটি দেখতে পাওয়া যায়। এটি কাউ, কাউয়া, কাগলিচু, তাহগালা নামেও বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত। কাউফলের গাছ সাধারণত মাঝারী আকারের হয়ে থাকে। বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে এই গাছ জন্মে। কুমিল্লা, সিলেট, মৌলভীবাজার, বাগেরহাট প্রভৃতি জেলায় এই গাছ বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
কাউফল আকারে গোলাকার, টেবিল টেনিস বলের মতো। তবে কিছু প্রজাতির গায়ে খাঁজযুক্ত হয়ে থাকে। কাঁচা ফল গাঢ় সবুজ রঙের হয়। পাকলে কমলা রং ধারণ করে। ফলের ভিতর ৪/৫টি দানা থাকে। এগুলো চুষে খাওয়া যায়। স্বাদ খুবই টক, তবে মজাদার।
কাউফল দিয়ে নানা আচার, জ্যাম-জেলি প্রস্তুত করা যায়। এছাড়াও ঠান্ডা ও সর্দিকাশির উপশম হয় এই ফল খেলে।
কেয়া ফল
বৈজ্ঞানিক নাম: Pandanus tectorius
কেয়া ফল, অনেকে আবার বলে হালা ফল। এটিও বাংলাদেশের একটি অপ্রচলিত ফল। দেখতে সুন্দর এই ফলটিকে অনেকে আনারস ভেবে ভুল করেন।
কেয়া গাছ লম্বায় ১০-১২ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণ সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও লবণাক্ত অঞ্চলে কেয়া গাছ বেশি জন্মে। এই গাছ একে অন্যের সাথে জড়াজড়ি করে বড় হয়। গাছে ৫-২০টি পর্যন্ত ফল হয়।
কেয়া ফল পাকলে লালচে রঙ ধারণ করে। দেখতে তখন আনারসের মতো মনে হয়। ফল কাঁচা কিংবা রান্না করে খাওয়া যায়। বিদেশে এই ফল দিয়ে সালাদ তৈরি করা হয়। ফুল থেকে সুগন্ধি তৈরি করা হয়। এছাড়াও বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে এই ফলের।
কেওড়া
বৈজ্ঞানিক নাম: Sonneratia apetala
কেওড়া সাধারণ লবণাক্ত অঞ্চলের উদ্ভিদ। সুন্দরবনের অন্যতম ফল এটি। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে এই গাছ বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
কেওড়া গাছ সাধারণ বৃক্ষ প্রজাতির হয়ে থাকে। গাছের শ্বাসমূল মাটির উপরে উঠে আসে। প্রচুর ফল হয় গাছে। কেওড়া ফল দেখতে অনেকটা ডুমুরের মতো। ভিতরে বড় বিচি থাকে। টক স্বাদের এই ফলটি বহু কাল আগে থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয় খাদ্য। কাঁচা ফল লবণ সহকারে খাওয়া যায়। এই ফল থেকে কেওড়াজল তৈরি করা হয় যা বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ফল দিয়ে টক রান্না করা হয়। জনপ্রিয়তার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয় এই ফল।
ডেউয়া
বৈজ্ঞানিক নাম: Artocarpus lacucha
বাংলাদেশের আরেকটি অপ্রচলিত ফল হলো ডেউয়া। অনেক স্থানে এটিকে ডেউফল, ডেলোমাদার, ঢেউয়া নামেও ডাকা হয়। সাধারণ গ্রামাঞ্চলে এই ফল বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আগে গ্রামাঞ্চলে এই ফলের চাষ হলেও বর্তমানে এর চাষ অনেক কমে গেছে।
ডেউয়া গাছ চিরসবুজ বৃক্ষ প্রজাতির হয়ে থাকে। গাছ ২০-২৫ ফুট উঁচু হয়। ডেউয়া ফল কাঁঠালের মতো একটি গুচ্ছ ফল। এ ফলের বাইরের দিক অসমান। ভেতরে কাঁঠালের মতো কোয়া থাকে। কাঁচা ফল সবুজ, তবে পাঁকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
পাকা ডেউয়া ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি। খেতে দারুণ মজাদার এই ফল। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে এই ফলে। এছাড়াও নানা ঔষধি গুণ রয়েছে ডেউয়ার।
পানিফল
বৈজ্ঞানিক নাম: Trapa natans
সবশেষে আপনাদেরকে যে ফলের কথা বলা হবে তা হয়তো অনেকেই চেনেন। পানিফল বা শিংড়া নামে পরিচিত এটি। প্রায় ৩,০০০ বছর আগে চীনে এই ফলের চাষ হতো। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই ফল বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
পানিফলের গাছ একটি জলজ উদ্ভিদ। পানিতে জন্মায় এই উদ্ভিদ এবং পানির নিচেই এই ফল হয়। ফলের গায়ে শিংয়ের মতো কাটা থাকে। তাই একে শিংড়া নামেও ডাকা হয়। কাঁচা ফল পানসে মিষ্টি স্বাদের। ফলের ভিতরের শাঁসটি খেতে হয়। কাঁচা, সিদ্ধ দু-ভাবেই খাওয়া যায় এই ফল। নানা ঔষধি গুণ রয়েছে এই ফলের।
ফিচার ইমেজ – Tawfiqur Rahman