রাস্তায় ফুলবিক্রেতা, হকার কিংবা টোকাই হিসেবে কোনো শিশুকে দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কি, বড় হয়ে এই শিশুদের গন্তব্য কোথায় হবে? আজ যার কাঁধে বইয়ের ব্যাগ থাকার কথা ছিলো, সেই শিশুটিকে কেন জীবিকার প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে হলো? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই শিশুরা বড় হয়ে নিজেদের জীবিকার্জনের পথ হিসেবে কী বেছে নেবে? শত প্রশ্নের বেড়াজালে বন্দী এই শিশুরা। পিচঢালা রাজপথেই হারিয়ে যাওয়া শিশুদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমাজে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।
ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যে পথশিশুদের চোখে পড়ে, সেই শিশুরা সারা পৃথিবীর ১২০ মিলিয়ন পথশিশুদের একটি অংশ। জীবন আর জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা এই বিপুল সংখ্যক শিশুদের মৌলিক অধিকারটুকুরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে যেসব শিশু রাস্তায় দিনাতিপাত, নিজেদের কোনো স্থায়ী আবাসস্থল নেই, তাদেরকেই পথশিশু বলা যেতে পারে। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখে। এর মধ্যে আড়াই থেকে তিন লক্ষাধিক পথশিশু রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথের দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়ে গেছে।
এই শিশুদের বেশিরভাগেরই কোনো পরিবার নেই, আবার অনেকেই পরিবার থেকে পালিয়ে কিংবা পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্য পথশিশুদের দলে যোগ দেয়। চরাঞ্চল, নদী ভাঙন, বন্যা কিংবা সাইক্লোন-ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ি হারানো মানুষদের একটি বড় অংশ শহরে এসে ঠাঁই নেয় শহরের বস্তিগুলোতে। এই পরিবারগুলো যে চরম দারিদ্র্যের শিকার, তা বলাই বাহুল্য। আর এই দারিদ্র্যের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই শিশুসন্তানদের একটি বড় অংশ পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্যই রাস্তায় নেমে আসে।
তাছাড়াও বস্তি কিংবা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব সহ নানা কারণে সামাজিক এবং পারিবারিক কলহ চলতেই থাকে। বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা পারিবারিক কলহের মতো ব্যাপারগুলো শিশুদেরকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। বস্তি কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে খুব ছোট বয়সে পারিবারিক কলহ কিংবা নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের একটি বড় অংশ ঘর ছেড়ে পথশিশুদের খাতায় নাম লেখায়।
ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়ি কিংবা বাসে ফুল, আচার কিংবা রুমাল বিক্রি করে দিন গুজরান করা এই শিশুদের একটি বড় অংশের কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই। রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টপ, লঞ্চ টার্মিনাল থেকে শুরু করে ওভারব্রিজ, ফুটপাথ কিংবা পার্কের বেঞ্চে রাত কাটায় এই শিশুরা।
শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার সাথে ভাসমান এই শিশুদের থাকার জায়গা পরিবর্তন হতে থাকে, ভোগান্তিও বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, একজন শিশুর যে পরিমাণ ঘুম দরকার, দিনের পর দিন সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই শিশুরা। ফলে এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য পড়ছে সংকটের মধ্যে।
অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটানো এই শিশুদের বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত। এক থেকে দেড়শ টাকা দৈনিক আয় করা এই শিশুদের নেই নিয়মিত কোনো খাবার জায়গাও।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে যে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ দায়ী, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এদের মধ্যে চর্মরোগের হারও অনেক বেশি, চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় । ভাসমান এই শিশুদের ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলক বেশি।
রোগাক্রান্ত এই শিশুদের জন্য নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। তাদের নিয়ে সমাজ কিংবা সরকারের নেই কোনো চিন্তাভাবনা। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও মাথাব্যথা নেই কারো। পদে পদে সমাজের লাঞ্ছনা পেয়ে আসা এই শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করে, এমন সংগঠনের সংখ্যা হাতে গোনা।
শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে তারা। পথশিশুদের একটি বড় অংশের নেই অক্ষরজ্ঞান। বাকি যারা এনজিও কিংবা অন্য কোনো সহায়ক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নেয়, তাদের অবস্থাও সুখকর নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে পরবর্তী সময়ে সমাজের মূলধারায় মিশে যাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এই শিশুরা। শৈশব-কৈশোর পার করে আসার পর জীবনযুদ্ধে তারা অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। দক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিক, বাসের হেল্পার, ড্রাইভার সহ নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হয় বেশিরভাগই। মেয়ে পথশিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন ধাপে লাঞ্ছনার শিকার হয়। এমনকি যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয় এই জনগোষ্ঠী।
জীবনের একদম শুরু থেকেই নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার এই শিশুদের একটি বড় অংশই বিপথগামী হয়ে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা থাকে। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটানো এদের নেই পরিবারের ছায়াটুকুও। নৈতিক শিক্ষার আলো থেকেও এরা অনেক দূরে। পথে হারিয়ে যাওয়া এই শিশু কিশোরদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া অনেকটাই নিয়তির লিখনের মতো। ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে অনেক ছোটবেলাতেই পুলিশের খাতায় নাম লেখায় এরা। হতাশ আর স্নেহবঞ্চিত এই শিশুদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, আট থেকে দশ বছরের পথ শিশুদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ গাঁজা, সিগারেট সহ বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত। বারো থেকে আঠারো বছর বয়সের কিশোররা আসক্ত হয়ে পড়ছে ফেনসিডিল আর হিরোইনের মতো নেশাদ্রব্যে। পাশাপাশি এই মাদক সেবনের মাধ্যমে একই সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহার করায় দুরারোগ্য সব রোগ ছড়িয়ে পড়ছে এই কিশোরদের মধ্যে। এমনকি টাকার লোভে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে মাদক চোরাচালানের কাজেও। ঢাকায় থাকা পথশিশুদের সত্তর শতাংশই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাদক চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধ কাজে জড়িয়ে আছে।
তবে পথশিশুদেরকে নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ঢাকা আহসানিয়া মিশন তাদের প্রকল্পের আওতায় ছয় থেকে আট বছরের শতাধিক পথশিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এই পথশিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদেরকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রায় চল্লিশ হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার কাজ শুরু হয়েছে। স্বল্পাকারে চালু হয়েছে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচী। আট হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে স্কুলে টেনে আনতে প্রতি মাসে প্রত্যেককে প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। এমন আরো অনেক ছোট বড় এনজিও, সরকারি সংস্থার উদ্যোগে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু পথশিশুদের সংখ্যার তুলনায় তা বড়ই অপ্রতুল।
যে শিশুদের হাতে বই খাতা থাকা দরকার ছিলো, তাদের অনেকেই আজ জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। অপরিপক্ক হাতে হাল ধরতে গিয়ে জীবনের এই কঠিন রণক্ষেত্র থেকে অনেকেই ছিটকে পড়েছে। ঝড়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় শত শত প্রাণ। নেশার করাল স্রোত কেড়ে নিচ্ছে ফুটফুটে মুখগুলো।
সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরের মানুষের একটু সহানুভূতি দরকার। সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে আমার-আপনার দেখানো একটু সহানুভূতি হয়তো এই শিশুদেরকে সমাজের আর দশটা শিশুর মতো বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে পারে।
Feature image: thepages.com.bd