গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (GlaxoSmithKline), বিশ্বের বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি জায়গা দখল করে আছে। ১৭১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই কোম্পানিটি ওষুধশিল্পে এখনও এক উজ্জ্বল নাম। এটি একটি ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, যার সদর দপ্তর লন্ডনের ব্রেন্টফোর্ডে অবস্থিত। কোম্পানিটি তিনটি মহাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে একত্রিত হওয়া আর অন্য কোম্পানিকে অধিগ্রহণের মাধ্যমে এটি আজকের অবস্থানে এসেছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃত।
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন, যা জিএসকে (GSK) নামেও পরিচিত, তাদের নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি ও সরবরাহ করে আসছে। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই আসলেও কোম্পানিটি কখনোই তার মূল নীতি থেকে সরে আসেনি। বিশ্বের ৪১টিরও বেশি দেশে ১৬০টিরও বেশি কারখানা রয়েছে তাদের। বিশ্বব্যাপী ১৪০টিরও বেশি ওষুধের বাজারে জিএসকের ওষুধ বিক্রি হয়। তাদের ওয়েবসাইট অনুসারে, জিএসকে প্রতি সেকেন্ডে ৩০টিরও বেশি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করে, প্রতি মিনিটে জিএসকের ওষুধের ১,১০০টি প্রেসক্রিপশন লেখা হয়, এবং প্রতি ঘন্টায় জিএসকে নতুন পণ্য তৈরি করতে ৪,৫০,০০০ ডলারের বেশি অর্থ খরচ করে।
২০১৮ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক কী কারণে জিএসকে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিল? আজকের লেখায় সেই বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে।
বাংলাদেশে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের যাত্রা
বাংলাদেশে জিএসকে কার্যক্রম শুরু করে ১৯৪৯ সালে। শুরুতে আমদানির মাধ্যমে ওষুধ আনা হতো। প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবে ব্যবসা করার পর কোম্পানিটি ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে নিজস্ব কারখানা স্থাপন করে। ১৯৮৬ সালে জিএসকে বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯৫ সালে গ্লাক্সো থেকে গ্লাক্সো ওয়েলকাম নামে এবং ২০০০ সালে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ নামে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জিএসকের ব্যবসায়িক বিভাজন
জিএসকে মূলত দুটি বিভাগে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করত- ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধশিল্প, এবং কনজিউমার হেলথ কেয়ার বা ভোক্তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। শুরু থেকেই জিএসকে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে অনেক বিভাগে ব্যবসা করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল গুণগতমান বজায় রেখে গবেষণাভিত্তিক ওষুধ বিক্রি করে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করা। তারা ভ্যাকসিনসহ ১৩টি সেক্টরে ৫৭ ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রি করত। আর কনজিউমার হেলথ কেয়ার সেক্টরে জিএসকের পোর্টফোলিও হলো হরলিক্স, সেনসোডাইন, বুস্ট, মাল্টোভা, গ্ল্যাক্সোজ-ডির মতো ব্র্যান্ডগুলো।
ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে টিকে থাকার লড়াই করা সত্ত্বেও কোম্পানিটি কনজিউমার হেলথ কেয়ার সেক্টরে লাভজনকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছিল। জিএসকে ২০১৮ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা বন্ধ করার আগের বছরে এই বিভাগ থেকে ২১৪ কোটি টাকা আয় এসেছিল, যা ২০১৫ সালে ছিল ২২১ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ২০১৭ সালে ভোক্তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে আয় ছিল ৪৬৫ কোটি টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে কোম্পানির মোট লাভ ছিল ৬৭ কোটি, যা ২০১৬ সালে ছিল ৮৩ কোটি। প্রতি বছর ভোক্তা স্বাস্থ্যসেবায় লাভ হতে থাকলেও ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসার ক্ষতির কারণে পুরো ব্যবসাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশে জিএসকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পেছনে কারণসমূহ
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রচুর বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ছিল, এবং তারা লাভজনক ব্যবসা করছিল। কিন্তু দেশি ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প চাঙ্গা করার জন্য ১৯৮২ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের প্রেক্ষিতে বিদেশি কোম্পানির কাঁচামাল এবং উত্পাদিত ওষুধ আমদানিতে বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ব্যবসা করে আসছে। মূলত, জিএসকের ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল দেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা। বাংলাদেশের বাজারের জন্য উপযুক্ত ওষুধ তারা আনতে ব্যর্থ ছিল।
বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ওষুধের কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদন, প্যাকেজিং, বিপণন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই একটি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন ও নীতিমালা মেনে চলে, যার কারণে দাম বেশিই হয়। কিন্তু দাম বেশি হলেও এ প্রক্রিয়ায় ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- এখানে সেভাবে গবেষণাভিত্তিক ও উন্নয়ন নির্ভর কোনো ওষুধ নেই। এককথায়, বাংলাদেশের ওষুধের বাজার হলো জেনেরিক বাজার। জেনেরিক ওষুধের বাজার বলতে বোঝায়- যেখানে বেশিরভাগ ওষুধই জেনেরিক, অর্থাৎ পূর্বের ওষুধের একটি অনুলিপি। এর উপাদান, পদ্ধতি, ব্যবহারের পদ্ধতি, প্রভাব, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি পূর্বের ব্র্যান্ডেড ওষুধের সাথে পুরোপুরি মিল থাকে। জেনেরিক ওষুধটি শুধুমাত্র ব্র্যান্ডেড ওষুধের (যেখান থেকে কপি করা হয়) পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো গবেষণাভিত্তিক ওষুধ তৈরি করে। জিএসকেও এই নিয়ম অনুসরণ করে। গবেষণাভিত্তিক ওষুধ তৈরির খরচ স্বাভাবিকভাবেই জেনেরিক ওষুধ তৈরির চেয়ে বেশি। জিএসকেও তার কোম্পানির নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে গবেষণাভিত্তিক ওষুধের উৎপাদন চালিয়ে যায়, যার কারণে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ছিল, এবং এই বিভাগ থেকে লোকসান হচ্ছিল। আরেকদিকে, বিধিনিষেধের কারণে কোম্পানি তার আমদানিনির্ভর ওষুধ ও ভ্যাকসিনের ব্যবসা হারাচ্ছিল।
বাংলাদেশে জেনেরিক ওষুধের প্রাচুর্য এবং প্রাপ্যতার কারণে জিএসকের গবেষণানির্ভর ওষুধের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়া, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা ওষুধের দাম কম হওয়ার কারণে জিএসকে তার ব্যবসা হারাচ্ছিল। উপরন্তু, দেশীয় কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন ও বিতরণের সাথে জিএসকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রাসীভাবে ওষুধ বিপণন বা প্রমোশনে চিকিৎসক, ওষুধ বিক্রেতা এবং ড্রাগ স্টোরগুলোর পেছনে যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে, তা বিদেশি কোম্পানিগুলো কখনোই করে না। কারণ এটি তাদের নীতিবহির্ভূত। জিএসকের ওষুধ বিক্রি করতে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণও এটি। যার কারণে জিএসকে বাজারে তার শেয়ার এবং চাহিদা উভয়ই হারাচ্ছিল। তবে কিছু নতুন ওষুধ শ্বাসতন্ত্র এবং অনকোলজি (টিউমার চিকিৎসাবিদ্যা) বিভাগে চালু করা হয়েছিল, যদিও সেগুলোর চাহিদা এত বেশি ছিল না। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালের বাজারে জিএসকের শেয়ার ছিল ২ শতাংশেরও কম।
এছাড়া, চাহিদানুযায়ী ওষুধ বাজারে সরবরাহ করতে না পারা, বাজারে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা, গ্রাহকদের চাহিদার সঙ্গে জিএসকের পণ্যতালিকার বিশাল ব্যবধান ছিল। অবশেষে ৫৬ বছর কার্যক্রম চালানোর পর ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ফৌজদারহাটে তার কারখানা বন্ধ করে দেয়। তবে ইউনিসেফসহ আরো অনেক কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে তারা শুধুমাত্র ভ্যাকসিন সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশের ওষুধ খাত থেকে অতীতেও বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফাইজার, সানোফি, আইসিআই পিএলসি, নুভিস্তা (অর্গানন বাংলাদেশ) প্রভৃতি।
জিএসকে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসার বন্ধ করলেও কনজিউমার হেলথ কেয়ার ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কারণ লোকসানের এই ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে জিএসকের লাভ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে জিএসকের ব্যবসার ৭০ শতাংশ হলো কনজিউমার হেলথকেয়ার ইউনিটের, এবং বাকি ৩০ শতাংশ ফার্মাসিউটিক্যালসের। ২০১৯ সালে কোম্পানির আয়ের উপর মোট মুনাফার হার ছিল ৫৫%, যা আগের বছরগুলোতে ছিল ৩৫%-৪৫%। ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা বন্ধসহ অন্যান্য খরচের কারণে ২০১৬ সালে কোম্পানিটি ৬৪ কোটি টাকা লোকসান করে, কিন্তু ২০১৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ৯৯ কোটি টাকা লাভ করে।
বাংলাদেশে জিএসকের বর্তমান অবস্থা
জিএসকে তাদের ব্যবসা বন্ধের ঘোষণার পর ইউনিলিভার ওভারসিজ ২০১৮ সালে এর অবশিষ্ট ভোক্তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৮২% অংশীদারিত্ব কিনে নেয়। যেহেতু জিএসকের ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা এর মধ্যে বন্ধই হয়ে গেছে, তাই বলাই যায়- ইউনিলিভার প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে জিএসকের সমগ্র ব্যবসার একক শেয়ারহোল্ডার। এছাড়া, ইউনিলিভার ভারত এবং এশিয়ার অন্য ২০টি দেশেও জিএসকের সমগ্র সহযোগী সংস্থার স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবসা কিনে নিয়েছে। এ খাতে ইউনিলিভার প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের জিএসকে অধিগ্রহণের পর ‘জিএসকে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার’ নামে নতুন নামকরণ করা হয়েছে। যদিও এর ফলে জিএসকের মূল পণ্যগুলোতে কোনো পরিবর্তন হবে না, তবে কোম্পানির কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হবে।
বাংলাদেশে জিএসকে বা এর মতো বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধশিল্প বিকাশ লাভ করুক সেটা সকলেরই প্রত্যাশা। তবে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখার দিকে তাদের মনোযোগ দেয়া জরুরি। বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মতো ব্যবস্থা দেশীয় ওষুধশিল্পগুলোর নেই বললেই চলে। তবে আশা রাখা যায়- বাংলাদেশের ওষুধশিল্পগুলোও গবেষণাভিত্তিক ওষুধ তৈরি করবে।