বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরকারি চিনিকল শ্রমিকের কান্না, চিনিকলের লোকসানে বেতন পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা। শুধু চিনিকল শ্রমিকই না, আছেন আখচাষীরাও। তারা চিনিকলকে চুক্তিভিত্তিতে আখ সরবরাহ করেছে, কিন্তু একই বিক্রি না হওয়ার কারণে আখ বিক্রির টাকা পাচ্ছেন না। অথচ, বাংলাদেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা প্রায় আঠারো লাখ মেট্রিক টন। প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির সাথে সাথে চিনির চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু আমাদের চিনিকলগুলোর চিনি রয়ে যাচ্ছে অবিক্রিত। চিনি উৎপাদনের সাথে জড়িত প্রধান দুই গোষ্ঠী আখচাষী এবং চিনিকলের কর্মচারীরা তাদের প্রাপ্য টাকা আদায় করতে পারছেন না।
বাংলাদেশের সরকারি ১৫টি চিনি কলের দায়িত্ব চিনি এবং খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) কাঁধে। এগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি সব চিনিকল লোকসান গুনছে। বিএসএফআইসি-র খাতাপত্রের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৭০ কোটি টাকা। পেছনে হেঁটে গত পাঁচ বছরের লোকসান হিসেব করলে যা দাঁড়াবে ৩,৯৭৬ কোটি টাকা। ক্রমাগত লোকসানের মুখে এ বোঝা কমিয়ে আনতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ছ’টি সরকারি চিনি কলে উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘোষণায় প্রতিক্রিয়াও হয়েছে ব্যাপক, কোথাও চাষিরা ক্ষেতেই আখ পুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, এই ছয়টি কল দিয়ে শুরু মাত্র বাকি কলগুলোও একই পথে হাঁটবে। কিন্তু বাজারে চাহিদা থাকার পরেও কেন চিনি বিক্রি হচ্ছে না এবং চিনিকল কেন বছরের পর বছর লোকসান গুনে যাচ্ছে?
একনজরে বাংলাদেশের চিনিকল
আখ রোপণ এবং আখ থেকে চিনি সংগ্রহের প্রক্রিয়াটির সাথে ব্যাপক শারীরিক শ্রম জড়িত, তাই বিশ্বজুড়ে চিনি উৎপাদন, ভোগ এবং এর বিস্তারের সাথে দাসত্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপনের পর সেই এলাকার সস্তা শ্রম ব্যবহার করে কৃষিজ পণ্য উৎপাদন শুরু করে এবং বেশিরভাগ পণ্যের মূল ভোক্তা ইউরোপীয় ক্রেতা ব্রিটিশ বণিকেরা ভারত থেকে নীল, লবণ, মসলা, কাপড়ের পাশাপাশি ভারতে উৎপাদিত চিনি এবং কৃষিজ বিভিন্ন কাঁচামাল ব্রিটেনে পাঠাতে থাকে। বৃহত্তর বাংলার কৃষিজমিতে ব্রিটিশরা আসার আগেও আখের চাষ হয়েছে, তবে এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল না। প্রয়োজনের ভিত্তিতে সীমিত আকারে চাষাবাদ ছিল আখের। তবে মূল্যবান ফসল হিসেবে এর চাষ শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে এবং সেই সাথে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য চিনির ছোট আকারের কলের প্রথম ইতিহাসও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের বর্তমানের একমাত্র লাভজনক চিনিকল এবং ডিস্টিলারি ‘কেরু এ্যান্ড কোং’ স্থাপিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। পরে তা স্থানান্তরিত হয়ে আসে দর্শনাতে। এটি প্রথম ১৮০৫ সালে জন ম্যাক্সওয়েল নামক এক ইংরেজ, ডিস্টিলারি হিসেবে ভারতের কানপুরে চালু করেন। কয়েকবার মালিকানা ও স্থান পরিবর্তন হয়েছে এ কোম্পানির। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৮ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার দর্শনাতে একটি শাখা খোলা হয় এই ডিস্টিলারির। চিনির পাশাপাশি এ কলের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল স্পিরিট তৈরি করা।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর বেশিরভাগ গড়ে উঠেছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। পঞ্চগড়, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙাসহ আশেপাশের প্রায় সব জেলাতেই আখচাষের দীর্ঘ সংস্কৃতি আছে। চিনি উৎপাদনের কলগুলোকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে একটি আবহ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আখের বীজ সংগ্রহ, নির্দিষ্ট মৌসুমে আখ তোলা, কলে নিয়ে যাওয়া, মাড়াই করা এবং সবশেষে আখ থেকে চিনি তৈরি, চিনি তৈরির পর রয়ে যাওয়া মোলাসেস প্রক্রিয়াজাত করার এ চক্র চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
চিনি বদলে গেছে আমূলে
তবে ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোতে খাদ্য রসায়ন শিল্পের অদ্ভুত বিস্ফোরণ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। কম খরচে চিনি উৎপাদন করতে চলেছে নানা চেষ্টা। এ বিস্ফোরণ চিনিযুক্ত প্রায় সব খাদ্যই ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে সময়ের সাথে, বাজারে এসেছে ‘হাই ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ’, যা তরল পানীয়সহ চিনিজাত খাদ্যের বাজার থেকে আখের চিনিকে প্রতিস্থাপিত করতে শুরু করে দিয়েছে। ‘কর্ন সিরাপ’ ছাড়াও চিনির বাজার আমূলে ওলটপালট করেছে ‘বিট’ থেকে আসা চিনি। এছাড়া দেশে দেশে আখ, বিট, ভুট্টা উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে, কাঁচামাল সংরক্ষণ এবং চিনি উৎপাদন এবং চিনি রিফাইনে খরচ কমে এসেছে বহুলাংশে।
বদলের ছোঁয়া লাগেনি বাংলাদেশের চিনিকলে
অন্যদিকে বাংলাদেশের মিলগুলোতে আখ থেকে তৈরি চিনির প্রক্রিয়াতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি গত কয়েক দশকে, ক্ষেত থেকে আখ সংগ্রহ এবং মাড়াইয়ে এখনো প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক শ্রমের উপর নির্ভর করছে মিলগুলো। এখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন খরচ। আমাদের সরকারি চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনি তুলনামূলক কম পরিশোধিত, দেখতে খানিকটা লালচে ধরনের। এর বিপরীতে আছে বিদেশ থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে পরিশোধিত সাদা চিনি। পরিশোধিত বলে ভোক্তার নিত্যদিনের ব্যবহারে এর পরিমাণে কম লাগে। তাই ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব জুড়ে লাল চিনিকে হটিয়ে সাদা চিনি জায়গা দখল করে নিয়েছে সব দেশেই। বিশ্বের বৃহৎ চিনি উৎপাদনকারী দেশ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও এই পরিশোধিত সাদা চিনির দিকে সরে এসেছে, এ খাতে গবেষণা বেড়েছে। উৎপাদন খরচ কমে এসেছে, চিনি পরিশোধন করে মূল্যবান সহ-উৎপাদ পাওয়া যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ‘কাঁচা চিনি’ আমদানি করে এবং তা পরিশোধন করে বাজারজাত করে। বাংলাদেশের বাজারে চিনির যে বিপুল চাহিদা, সেটি আক্ষরিক অর্থে দখল করে নিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন এবং এর মধ্যে কর্পোরেশনের ছাউনির নিচে থাকা ১৫টি চিনিকল থেকে উৎপাদন হয় মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন। বাকি ১৭ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টনের বিপুল চাহিদা মেটায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর চিনি যেখানে রিফাইনারি থেকে সাদা চিনি সর্বোচ্চ ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে বাজারে ছাড়তে পারছে, সেখানে সরকারি কলের চিনির উৎপাদন খরচই পড়ছে কেজিপ্রতি ২৫০-৩০০ টাকা।
অর্থাৎ, বাস্তবতা বিবেচনা করে বাজারে সরকারি চিনিকলের উচ্চদামের চিনি টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য। আবার চিনির দাম বাড়িয়ে সরকারি কলের চিনির সাথে সমন্বয় করা হলে সাধারণ মানুষ পড়বে বিপাকে। সরকারি চিনিকল যেহেতু বাজারের মাত্র চার-পাঁচ শতাংশ সরবরাহ করতে পারে, তাই বাংলাদেশের চিনিকলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার সময় চলে এসেছে।
কেন পিছিয়ে বাংলাদেশের চিনিকল?
বাংলাদেশ চিনি এবং খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবক’টি চিনিকলের কলকব্জা অকেজো হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সরকারি পনেরটি চিনিকলের মাঝে একমাত্র লাভজনক চিনিকল ‘কেরু এ্যান্ড কোং’। এই কলটি চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি ডিস্টিলারি পরিচালনা করে, যেখান থেকে তৈরি হয় অ্যালকোহল, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এছাড়াও আখ মাড়াইয়ের অবশিষ্টাংশ থেকে তৈরি করা হয় জৈবসার। এখানেও চিনি উৎপাদনে লোকসান ৭৫ কোটি টাকা। তবে বাকি পণ্য থেকে লাভ হওয়ায় লোকসান মিটিয়ে মোটমাট মুনাফা ১৪ কোটি টাকা।
বেশিরভাগ চিনিকলের যন্ত্রপাতি বেশ পুরনো, কিছুর মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো ৩০-৪০ বছর আগেই। এখানে প্রায় প্রাচীন পদ্ধতিতে আখ সংগ্রহ, বাছাই, মাড়াই করা হয়। সময় এবং জনবল লাগে বেশি, সে তুলনায় উৎপাদন কম। বিশাল শারীরিক শ্রমের দরকার বলে লাগে বিপুল কর্মচারী, তাদের বেতন, যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণেই চলে যায় বিপুল অংকের অর্থ। বেড়ে যাচ্ছে কেজিপ্রতি চিনির খরচ, বাজারে বেসরকারি খাত থেকে আসা চিনির থেকে কেজিপ্রতি গড়ে দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়েও উৎপাদন খরচ তুলে আনা যাচ্ছে না। ফলে বাজারে এ উচ্চদামের চিনির গ্রহণযোগ্যতা কমে আসছে। আগে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে কলগুলো চিনি সরবরাহ করত ডিলারের মাধ্যমে। কিন্তু সেখানে এখন বাজার দখল করে নিচ্ছে পরিশোধিত সাদা চিনি কিংবা কর্ন সিরাপ।
যেহেতু বাজারে এই উচ্চদামে চিনি বিক্রি করা যাচ্ছে না, সেহেতু কোনো কোনো চিনিকলে বছরের পর বছর অবিক্রিত রয়ে যাচ্ছে চিনি। মিলগেটে কিংবা ডিলারের মাধ্যমে বিক্রিত হলেও তা উৎপাদন খরচের তুলনায় অর্ধেক। বছরের পর বছর ধরে লোকসানের ঘানি কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের একসময়ের সম্ভাবনার চিনিকলগুলো। যেখানে বছরের পর বছর দেশে চিনির ব্যবহার বাড়ছে, সেখানে চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়নের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লোকসান কমিয়ে আনতে উন্নত জাতের আখ, নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে ভাবার কথা, সেখানে প্রাচীন ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে।
আখচাষের জন্য দরকার বিপুল শারীরিক শ্রম, একই অবস্থা আখ সংগ্রহ থেকে মাড়াই প্রতিটি ধাপে। বাংলাদেশের কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার এবং আধুনিকায়নের বিকাশ ঘটেছে সামান্যই। ফলে বিদেশ থেকে চিনির আমদানি করে, সকল প্রকার শুল্ক দিয়েও বাজারে আমদানিকৃত চিনি কম দামে বিক্রি করা যাচ্ছে আর বাংলাদেশের দেশীয় চিনি যোজন যোজন দূরে ছিটকে পড়েছে এবং ক্রমাগত এই শিল্প সম্ভাবনা হারাচ্ছে।
চিনির পাশাপাশি চিনিকলগুলো থেকে বাণিজ্যিকভাবে অ্যালকোহল, ভিনেগার, জৈব দ্রাবক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহ রাসায়নিক সামগ্রী সহ-উৎপাদ হিসেবে পাওয়া সম্ভব। আখ মাড়াইয়ের পর সেখানের অবশিষ্টাংশ থেকে তৈরি করা সম্ভব জৈব সার। বাংলাদেশের একটি চিনিকল বাদে বাকি একটিকেও লাভজনক করার জন্য পণ্যের বহুমুখীকরণের উপর জোর দেওয়া হয়নি।
প্রতিটি চিনিকলের আয়ত্ত্বে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি এবং দুর্বল অবকাঠামো। একই ছাতার নিচে থাকা সব চিনিকল এবং এদের স্থাপনায় জমি আছে ১৯,০৮৯ একরের কাছাকাছি। জমি, অবকাঠামো এবং আনুষঙ্গিক হিসেব করলে মোট সম্পদ ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। তাই সম্পদ এবং অবকাঠামোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জরুরি, ভোক্তাদের প্রয়োজন বিবেচনা করে পণ্যের আধুনিকায়ন এবং শিল্পকে ঢেলে সাজাতে না পারলে দেনার দায়েই ভেঙে পড়তে যাচ্ছে পুরো খাত।
অবকাঠামোগুলোকে আধুনিকায়ন এবং শক্তিশালী করে চিনিকলের দুর্বলতা চিহ্নিত করা জরুরি এবং এর মাধ্যমে সবার আগে কমিয়ে আনা দরকার উৎপাদন খরচ। সাময়িকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চিনিকলের দরকার কম খরচে উচ্চফলনশীল জাতের আখ, দরকার উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা এবং পণ্যের বহুমুখীকরণ। বাংলাদেশের চিনিকলের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে এসবের পাশাপাশি দরকার প্রতিটি চিনিকলের একটি দক্ষ প্রশাসন এবং সকল অর্থনৈতিক কাজে স্বচ্ছতা। আর নয়তো দেশীয় আরেকটি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে, এই শিল্পের সাথে যুক্ত শত শত মানুষকে খুঁজতে হবে নতুন গন্তব্য।