
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে একটু দূরে কাস্পিয়ান সাগরের ধার ঘেঁষে অবস্থিত সুবিশাল আলবার্জ পর্বতমালা। এই পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশের একটি শহরের নাম রে। এই শহরে ৮৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের দিকপাল আবু বকর আল রাযি।

আল রাযির জন্মস্থান ইরানের রে শহর; source: picdn.com
তার পুরো নাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাযি। তার নামের আল রাযি অংশটি এসেছে তার জন্মস্থল থেকে। এর অর্থ ‘রে এর অধিবাসী’। ইউরোপে অবশ্য তিনি আল রাজেস নামে পরিচিত।
চিকিৎবিজ্ঞানে আল রাযির অবদান অবিস্মরণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা বলতে গেলে প্রথমেই তার কথা বলতে হয়। তবে তিনি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, রসায়নবিদ এবং দার্শনিক।

আল রাযি; source: wp.com
ভীষণ মেধাবী এই মানুষটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছেন, যা ছড়িয়ে আছে তার রচিত দু’শরও বেশি বইয়ের পাতায়। তবে তিনি তার আবিস্কার এবং পর্যবেক্ষণ দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে অসামান্য অগ্রগতি সাধন করে গেছেন, সেজন্যই তাকে বেশি স্মরণ করা হয়।
আল রাযি প্রথম জীবনে সঙ্গীত ও শিল্পকলায় আগ্রহী ছিলেন। তারপর রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানার্জন করেন। তিনি ঠিক কখন চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তার বয়স যখন ত্রিশ বা চল্লিশের কোঠায় ছিল তখন তিনি মেডিসিনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ নিতে তখন তিনি বাগদাদে চলে যান এবং সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। তারপর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এরপর রে এর গভর্নর মানসুর ইবনে ইসহাক তাকে রে শহরে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং রে হাসপাতালের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। আল রাযি মানসুর ইবনে ইসহাককে দুটি বই উৎসর্গ করেন- ‘দ্য স্পিরিচুয়্যাল ফিজিক’ এবং ‘কিতাব আল- মানসুরী’। নতুন চিকিৎসক হিসেবে বেশ ভালই সুনাম কুড়িয়েছিলেন আল রাযি। ফলে বাগদাদ থেকে আব্বাসীয় খলিফা আল মু’তাদিদ তাকে ডেকে পাঠান এবং নতুন স্থাপিত একটি হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্ব প্রদান করেন। আল মু’তাদিদের পুত্রের শাসনামলে আল রাযি আব্বাসীয় খেলাফতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব পান। হাসপাতাল কোথায় নির্মাণ করা হবে, সেই স্থান নির্বাচন করতে তিনি এক অভিনব প্রক্রিয়ার সাহায্য নেন। পুরো শহরজুড়ে নানা জায়গায় তিনি কিছু মাংসের টুকরা রেখে আসেন। যে স্থানের মাংস সবচেয়ে পরে পঁচতে শুরু করেছিল সেই স্থানটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করেন তিনি। শিক্ষক হিসেবেও আল রাযির খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার লেকচারের আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসে তার ক্লাসে ভিড় জমাত। মানুষ হিসেবে আল রাযি মহৎ এবং উদারমনা ছিলেন। তিনি দরিদ্র রোগীদের থেকে টাকা নিতেন না।
মুসলিম এই মনীষীর জ্ঞানচর্চা বিস্তৃত ছিল নানা বিষয়ে এবং প্রত্যেকটি বিষয়েই তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান সম্পর্কে চলুন জানা যাক।
চিকিৎসাবিজ্ঞান
চিকিৎসক হিসেবে আল রাযি অতুলনীয় নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার অবদান বিবেচনা করলে তাকে তুলনা করা যায় শুধু তার এক শতাব্দী পর জন্ম নেয়া চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনার সাথে। অনেক বিশেষজ্ঞ আল রাযিকে মধ্যযুগের সেরা চিকিৎসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাকে সেসময়ের সবচেয়ে সৃজনশীল লেখক বলেও মানা হয়। তিনি পেডিয়াট্রিকস, অপথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি, সংক্রামক রোগ সহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অনেকগুলো ভলিউমের ১০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদের বদৌলতে তার চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী এবং ধ্যানধারণা মধ্যযুগের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদ্যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল ।

ভিয়েনায় জাতিসংঘ অফিসের সামনে আল রাযির ভাস্কর্য; source: licdn.com
তার রচিত বেশ কিছু বই পাশ্চাত্যের চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। আল রাযির রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- ‘আল কিতাব আল হাওয়ি’, ‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’, ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’, ‘আল মানসুরি’ প্রভৃতি। ২৩টি ভলিউমে রচিত ‘আল কিতাব আল হাওয়ি’ গাইনোকলজি, অবেস্ট্রিকস এবং অপথ্যালমিক সার্জারির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। নয়টি ভলিউমে রচিত ‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’ বইটিতে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এবং প্লেটোর কাজ সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টিশীল ধারণা দেন। এই বইটিতে আল রাযি তার বিভিন্ন বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান, নানারকম রোগ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, তার রাখা সমস্ত নোটকে একত্রিত করেছেন। শুধুমাত্র এই বইটির জন্য অনেক পণ্ডিত তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিবেচনা করেন। বইটি ইউরোপে ‘The large comprehensive’ বা ‘Continens Liber’ নামে পরিচিত।

আল রাযি রচিত গ্রন্থের কিছু পৃষ্ঠা; source: muslimheritage
তিনিই প্রথম চিকিৎসক, যিনি হাম এবং গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর আগে দুটো রোগকে একই ভাবা হতো। হাম এবং গুটিবসন্ত সম্পর্কিত তার পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে তার ‘আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ’ গ্রন্থে। আল রাযি রচিত আরেকটি যুগান্তকারী গ্রন্থ হচ্ছে ‘Doubts about Galen’। এই বইটিতে তিনি গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের অনেক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তার পর্যবেক্ষণের সাথে গ্যালেনের অনেক দাবীই সাংঘর্ষিক ছিল। এমনকি গ্যালেন জ্বরের যে লক্ষণের কথা উল্লেখ করে গেছেন, আল রাযি জ্বরের রোগীর সাথে তারও কোনো মিল পাননি। আল রাযির ‘The Diseases of Children’ বইটি পেডিয়াট্রিকসকে চিকিৎসাবিদ্যার স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আল রাযী চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈতিকতা নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি সেসময়ে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুয়া ডাক্তারদের দমন করেন। একইসাথে তিনি এটাও বলে গেছেন যে, উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের কাছেও সব রোগের নিরাময় নাও থাকতে পারে, এটা এক কথায় অসম্ভব। তবে তিনি চিকিৎসকদের আধুনিক জ্ঞান এবং নতুন নতুন তথ্যে সমৃদ্ধ হতে বলেছেন। তিনি গরীব, অসহায় লোকজন, মুসাফিরদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তিকা রচনা করেন, যাতে করে তারা ডাক্তার কাছে না থাকলেও নিজেদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।

চিকিৎসা সেবায় রত আল রাযি; source: desdomesetdesminarates.fr
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবশ্য তার ধারণা সমসাময়িক চিকিৎসকদের মতোই ছিল। তিনি মনে করতেন, শয়তানের প্রভাবেই মানসিক রোগ হয়ে থাকে। তবে তিনি এও বলেছেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দোষ, তাই রোগী চিকিৎসা ও যত্নের দাবী রাখে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুবিধ মূল্যবান অবদানের জন্য তাকে ‘চিকিৎসকদের চিকিৎসক’ বলা হয়।
রসায়ন
আল রাযি ছিলেন বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী। চিকিৎসাশাস্ত্রের পাশাপাশি রসায়নশাস্ত্রেও তিনি তার পাণ্ডিত্যের ছাপ রেখেছেন। তিনি একইসাথে জৈব ও অজৈব রসায়ন নিয়ে কাজ করেছেন।

রসায়ন ল্যাবে আল রাযি; source: fineartmerica.com
প্রথম সালফিউরিক এসিডও তিনিই তৈরি করেন। এছাড়া অসংখ্য লবণ, অ্যালাম প্রভৃতি তৈরি করেছেন তিনি। নানারকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং যন্ত্রপাতিও তিনি উদ্ভাবন করে গেছেন। কেরোসিন ল্যাম্প তার অন্যতম। আল রাযি ধাতুর রুপান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন। মধ্যযুগের অন্যান্য রসায়নবিদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন,পরশ পাথরের সাহায্যে সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে রুপান্তর করা সম্ভব। পরশ পাথরের সন্ধানে তিনি বেশ ভালোই মাথা ঘামিয়েছেন এবং দুটো বইও লিখেছেন- ‘The Secrets’ এবং ‘The secrets of Secrets’। তার সমসাময়িক পণ্ডিতদের ধারণা, তিনি নাকি কপারকে স্বর্ণে রুপান্তরিত করতে পেরেছিলেন! উল্লিখিত বই দুটি ছাড়াও আল রাযি রসায়নে আরও কিছু বই লিখেছেন। আল রাযি দর্শন সম্পর্কেও লিখেছেন, ভেবেছেন, যদিও তিনি দার্শনিক হিসেবে বিতর্কিত ছিলেন।
আল রাযির জীবনের শেষ দিনগুলো খুব দুর্দশায় কেটেছে। তার চোখে প্রথমে ছানি পড়ে, তারপর তিনি গ্লুকোমায় আক্রান্ত হন। তার চোখের অসুস্থতাজনিত বিপর্যয়ের শেষ হয় অন্ধত্বে। তার অন্ধত্বের কারণটি ধোঁয়াশাতেই রয়ে গেছে। কেউ বলেন, তার চোখে কোনো রাসায়নিক পদার্থ পড়েছিল বলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। আবার কেউ বলেন, তিনি অন্ধ হননি, তাকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য দায়ী করা হয় তার এককালের পৃষ্ঠপোষক মানসুর ইবনে ইসহাককে। আল রাযি নাকি রাসায়নিক কোনো এক পরীক্ষা প্রমাণ করতে পারেননি- এই অপরাধে ইবনে ইসহাক তাকে এই নির্মম শাস্তি দেন। মহান এই মনীষী ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মস্থান রে শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার খ্যাতি দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময়ে জন্ম নেওয়া আরেক খ্যাতিমান মুসলিম মনীষী আল বিরুনী প্রথম আল রাযির জীবনী লিখেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গৌরবময় অবদানের জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।