গ্রামের পথে তিনি হাসিমুখে হাঁটছিলেন। এক দল শিশু তার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। কিছুটা সামনে তিনি নিজেই একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেলেন। তার মনে হলো, এই শিশুদের সাথে মেয়েটি এল না কেন? তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন, হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটির সাথে কথা বললেন আর জড়িয়ে ধরলেন। আসলে বাচ্চা মেয়েটির ছিল পোলিও। তাই সে এই শিশুদের দলে ভিড়তে পারেনি। তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলেন। আর কেউই বাচ্চাটিকে আগে খেয়াল করেনি। তিনি বাচ্চা মেয়েটিকে এবার কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। তিনি অড্রে হেপবার্ন। কোল ডজ ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে অড্রের ১৯৮৯ সালের বাংলাদেশ সফরের স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবেই।
বাংলাদেশে এসেছিলেন ইউনিসেফের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘুরে দেখতে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছেন,
“১৮ বছর বয়সী এই দেশের অর্থনীতি হয়তো এখনো যুদ্ধ, বন্যা আর দুর্ভিক্ষে জর্জরিত। কিন্তু এদেশের আছে দক্ষ জনশক্তি যারা মেধাবী, কর্মঠ আর পরোপকারী। এটিই বাংলাদেশের বড় সম্পদ।”
প্রায়ই বাচ্চাদের শরীরের সামনে মাছি ভনভন করত। তা সত্ত্বেও তিনি বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে ফেলতেন। অনেকেরই একটা সংকোচ কাজ করে এ ব্যাপারে। কিন্তু অড্রে এসবের থোড়াই পরোয়া করতেন। তিনি ছিলেন বাচ্চাদের কাছে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি দিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন তার আশেপাশের সবাইকে।
অড্রে ক্যাথলিন রাস্টন হেপবার্নের জন্ম বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের উপকণ্ঠে, ১৯২৯ সালের ৪ মে। পরিবারে সবাই তাকে ডাকত আদ্রিয়ান্তজ্যাঁ নামে। হেপবার্নের মা জমিদার পরিবারের মেয়ে আর বাবা ব্রিটিশ ব্যাংকার। হেপবার্ন তার শৈশবের শুরুর দিনগুলো সুখেই কাটিয়েছিলেন। ওলন্দাজ আর ইংরেজি ভাষা শেখেন তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। এরপর তিনি নিজ আগ্রহেই ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান ভাষা শিখে নেন। এজন্যই উচ্চারণে বিশেষ কোনো ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়নি।
তার বাবা ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে তাদের রেখে চলে যান। অড্রের মতে, এটি তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ ঘটনা ছিল। হেপবার্নের বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ১৯৩৯ সালে। অনেক বছর পর তিনি তার বাবার সাথে আবার যোগাযোগ করেছেন। হেপবার্ন আমৃত্যু তার বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন।
ব্রিটেন জার্মানির সাথে যুদ্ধ ঘোষণার পর হেপবার্নের মা তাদের পৈতৃক ভিটা নেদারল্যান্ডসের আর্নেমে হেপবার্নকে নিয়ে আসেন নিরাপদ ভেবে। অড্রে সেখানে ব্যালে নাচ শেখা শুরু করেন। তার মায়ের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় যখন জার্মানরা নেদারল্যান্ডস আক্রমণ করে। হেপবার্ন নিজের নাম পরিবর্তন করেন। কারণ ব্রিটিশ গোছের নাম তাকে বাড়তি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিত। তার নতুন নাম হয় অ্যাডা ভ্যান হেমস্ট্রা। তার এসময় যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। তার এক আত্মীয় মারা যান। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার ব্যক্তিত্বও গঠন করতে সাহায্য করেছিল। ডাচ রেজিস্ট্যান্স এর জন্য সাহায্য তুলতে গিয়ে তিনি নাচ করতেন। কিন্তু ভয়ে তটস্থ লোক তালি দিতে পারত না।
তিনি খবরের কাগজও বিলি করতেন। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের, বিশেষ করে, বাচ্চাদের দুরবস্থা তার মনে দাগ কেটে যায়। তাই তাকে পরবর্তী জীবনে পরহিতৈষী কাজে বেশি দেখা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অড্রে আহত যোদ্ধাদের সেবিকার দায়িত্বও পালন করেছেন। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন তরুণ ব্রিটিশ সেনা, টেরেন্স ইয়াং, যিনি পরবর্তী জীবনে চিত্রনির্মাতা হন। অড্রে ২০ বছর পর, ১৯৬৭ সালে ইয়াংয়েরই পরিচালিত ওয়েট আনটিল ডার্ক ছবিতে অভিনয় করেন।
একদম ছোটবেলা থেকেই অড্রে চেয়েছিলেন ব্যালে নৃত্যশিল্পী হতে৷ পোল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পী মারি র্যাম্বার্টের কাছে লন্ডনে ব্যালে শিখেছিলেনও। ব্যালে নাচের জন্য তখন সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। কিন্তু তার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। তার উচ্চতা তার স্বপ্নের পথে বাঁধ সেধে বসলো। আর বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া অপুষ্টি আর অসুস্থতার জন্য তিনি শেষমেশ ব্যালে থেকে অভিনয়ের দিকে চলে আসেন।
তিনি প্রথমে লন্ডনের থিয়েটারে অভিনয় শুরু করলেন। ফরাসি সাহিত্যিক কোলেটের নজরেও আসেন তিনি। জিজি নামক মঞ্চনাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে অনেকের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন। এই নাটকেই ২০০ বারের বেশি অভিনয় করেছেন। এরপর ১৯৫৩ সালে রোমান হলিডে ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দেন। এখানে তিনি অভিনয় করেছেন প্রিন্সেস অ্যান চরিত্রে। তার পরিচয় হয় মার্কিন সাংবাদিক জো ব্রাডলির (গ্রেগরি পেক) সাথে। প্রযোজকেরা প্রথমে এলিজাবেথ টেলরকে নিতে চাইলেও পরিচালক উইলিয়াম উইলারের অড্রেকে স্ক্রিন টেস্টে ভালো লেগে যাওয়ায় তাকেই নিলেন। বাকিটা ইতিহাস।
গ্রেগরি পেক আগেই বলে রেখেছিলেন, অড্রে তার এই অভিনয়ের জন্য অস্কার পেতে যাচ্ছে। শেষে তার কথা ঠিকই ফলেছিল। অড্রে ১৯৫৪ সালে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার, বাফটা এবং ড্রামায় গোল্ডেন গ্লোব পান। মুভিটি একইসাথে বক্স অফিসে সফল হয় আর সমালোচকদের প্রশংসাও পায়। উইলারও হেপবার্নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। রোমান হলিডের সাফল্যের পরই আরেকটি রোমান্টিক কমেডি, সাবরিনাতে অভিনয় করেন। এখানে তিনি সহ অভিনেতা হিসেবে পান হামফ্রে বোগার্ট আর উইলিয়াম হোল্ডেনকে। সেবারও সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার আর বাফটার মনোনয়ন পান।
মঞ্চে ফিরে আবার অভিনয় করেন ফ্যান্টাসিধর্মী অন্ডিনে। তার অভিনয় আবারও সমালোচকদের প্রশংসা পায়৷ এরই হাত ধরে ১৯৫৪ সালে নাটকে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে টনি অ্যাওয়ার্ড পান। শুধু তিনজন অভিনেত্রী এই অর্জনের অধিকারী ছিলেন, যারা একই বছর অস্কার ও টনি অ্যাওয়ার্ড দুটিই পেয়েছেন। অড্রে তাদেরই একজন। ১৯৫০ এর দশকের বাকিটুকু সময় তার জন্য বেশ ভালো ছিল। ততদিনে তিনি বক্স অফিসের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে গেছেন। লিও টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস এ তিনি অভিনয় করেন হেনরি ফন্ডা আর মেল ফেরারের সাথে।
এছাড়াও ফানি ফেস-এ তার নজরকাড়া অভিনয় আর নাচের দক্ষতার জন্য বেশ প্রশংসিত হন। হেপবার্ন লাভ ইন দ্য আফটারনুন এ গ্যারি কুপার আর মরিস শেফালিয়েরের সাথে অভিনয় করেন। দ্য নান স্টোরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন কনভেন্ট আর চার্চে কাটিয়েছেন, সিস্টারদের সাথে মিশেছেন। এরপর তার গ্রিন ম্যানশনস আর দ্য আনফরগিভেন তেমন প্রশংসিত হয়নি।
তার সাফল্য আবার ফিরে আসে ১৯৬১ সালে ব্লেক অ্যাডওয়ার্ডের ক্লাসিক ট্রুম্যান ক্যাপোটের ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানি‘স-এ হলি গোলাইটলির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। ক্যাপোট যদিও প্রথমে মনরোকে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে বলেছেন যে হেপবার্ন এতে অসাধারণ ছিলেন। মার্কিন সিনেমার মুলুকে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। এ কথা অনেকেই মানেন যে রোমান হলিডে অড্রেকে তারকা বানালেও, ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানি‘স তাকে আইকন বানিয়েছিল। ছবির শুরুতেই দেখা যায়, অড্রেকে যিনি ইটালিয়ান কালো স্যাটিনের পোশাক আর সুন্দর গহনা পরে সকালের নাস্তা করছেন টিফ্যানি’স এর সামনে।
জিভানশির ডিজাইন করা সেই বিখ্যাত কালো পোশাকটি মোটামুটিভাবে বিংশ শতাব্দীর আইকনে পরিণত হয়েছিল। এরপর তিনি ক্যারি গ্রান্টের সাথে কমিক থ্রিলার শ্যারেড এ অভিনয় করেন। প্রায় সিকি শতাব্দীর ব্যবধান ছিল তাদের বয়সে। তাই অড্রের সাথে অভিনয় করতে কিছুটা বিব্রতবোধই করছিলেন তিনি। হেপবার্ন তার তৃতীয় ও শেষ বাফটা পান শ্যারেডের এই চরিত্রের জন্য।
সাবরিনার সহ অভিনেতা উইলিয়াম হোল্ডেনের সাথে অড্রে আবার অভিনয় করেন প্যারিস হোয়েন ইট সিজলস এ। ছবিটির প্রোডাকশনে বেশ সমস্যা হয়েছিল কারণ হোল্ডেন হেপবার্নের সাবেক প্রেমিক ছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা কাহিনী নিয়ে নির্মিত মাই ফেয়ার লেডি ছবিতে হেপবার্নের অভিনয় সমালোচকের কাছে প্রশংসিত হয়। জুলি অ্যান্ড্রুসের এতে অভিনয় করার কথা থাকলেও, শেষমেশ প্রযোজকদের ইচ্ছায় হেপবার্ন তা পান। অনেকের মতে, তিনি তার ক্যারিয়ারের সেরাটা দিয়েছেন এই ছবিতে। ছবিটি আটটি অস্কার পেলেও হেপবার্ন সেবার অস্কারের মনোনয়নও পাননি। আবার এই ছবির সংলাপে কণ্ঠ দিয়েছেন অন্যরা, তাই হেপবার্ন নাখোশও ছিলেন কিছুটা। মজার ব্যাপার হলো, জুলি অ্যান্ড্রুস ম্যারি পপিনসের জন্য অস্কার পান সেবার।
হেপবার্নকে এরপর হাও টু স্টিল আ মিলিয়ন আর ওয়েট আনটিল ডার্ক ছবিতে দেখা গেছে। দ্বিতীয়টায় অভিনয়ের সময় তাকে এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তার প্রথম স্বামী মেল ফেরারের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু তবু তিনি তার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আনা ফ্রাঙ্কের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও তিনি অভিনয় করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তার মনে হয়েছিল, তিনি এই চরিত্রের জন্য বেশি বয়স্ক।
দেড় দশকের মতো অভিনয় করার পর অনেকটা হুট করেই তিনি আধো-অবসরে চলে যান। পরিবারমুখী হন এসময়৷ পরিবারকেই বেশি করে সময় দেওয়া শুরু করলেন। খুব কম সময় বড়পর্দায় আসতেন। রবিন অ্যান্ড ম্যারিয়ান শন কনারির সাথে জুটি বাঁধেন। রজার এবার্ট পর্দায় তাদের রসায়নের প্রশংসা করেন। এরপর আর হেপবার্নকে বড় পর্দায় তেমন দেখা যায়নি। শেষ এসেছিলেন ১৯৮৯ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের অলওয়েজ ছবিতে; তা-ও স্বল্প সময়ের জন্য। তিনি স্পিলবার্গের ই.টি. এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে কাজ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। এরপর ১৯৯৩ সালে মরণোত্তর এমি অ্যাওয়ার্ড আর মরণোত্তর গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পান ১৯৯৪ সালে। আর এরই মাধ্যমে ঢুকে যান চলচ্চিত্র, নাটক আর সংগীতের এলিট ক্লাবে।
১৯৫০ সালেই হেপবার্ন ইউনিসেফের হয়ে দু’টি রেডিও অনুষ্ঠান করেছিলেন বাচ্চাদের জন্য। ১৯৮৯ এ তিনি ইউনিসেফের একজন শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ শুরু করেন। নাৎসি অধিকৃত নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেয়ে তিনি চিরকৃতজ্ঞ। ইউনিসেফের হয়ে তার প্রথম সফর ছিল ইথিওপিয়ায়। সেখানে খাদ্যসঙ্কটে ভোগা মানুষের, বিশেষত, শিশুদের দুরবস্থা তাকে নাড়া দিয়েছিল। এরপর তিনি তুরস্ক আর মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, সুদানে গিয়েছিলেন।
তাদের গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি বলেছিলেন, এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; বরং এগুলো মনুষ্যঘটিত কর্মকাণ্ডের ফল। আর একমাত্র মানুষই এর সমাধান করতে পারে। আর সমাধানটি হচ্ছে শান্তি। তারপর ভিয়েতনাম আর সোমালিয়ায়ও সফর করেন তিনি। ইউনিসেফের একজন হয়ে তার এমন মানবতাবাদী কাজের জন্য তিনি প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম পদক পান।
অড্রে আলোর ঝলকানি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের। ১৯৫২ সালে তিনি জেমস হ্যানসনের বাগদত্তা ছিলেন। কিন্তু তার বিয়ের তারিখ ঠিক করে বিয়ের পোশাক বানানোর পর আর বিয়ে করেননি। বন্ধু গ্রেগরি পেকের সুবাদে অড্রের সাথে তার প্রথম স্বামী অভিনেতা মেল ফেরারের পরিচয় হয়৷ অনডিন/অনজিনায় একসাথে কাজ করার পরই তাদের সম্পর্কের সূচনা, যা বিয়েতে গড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া অপুষ্টি আর অবিরত কাজের চাপ তার মা হওয়ায় বাঁধ সাধে৷
দ্যা আনফরগিভেন এর শ্যুটিংয়ের সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তার গর্ভপাত হয়েছিল। এজন্য ক্যারিয়ার থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন। তার বড় ছেলে শান হেপবার্ন ফেরারের জন্ম হয় ১৯৬০ সালে। মেল ফেরারের সাথে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ১৯৬৮ সালে। তিনি ইতালীয় মনস্তত্ত্ববিদ আন্দ্রে ডটিকে বিয়ে করেন ১৯৬৯ সালে। এক বছর পরই তার আরেক পুত্রসন্তান, লুকা ডটির জন্ম হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে আর শেষে তা বিচ্ছেদে গড়ায়। ১৯৮০ থেকে আমৃত্যু হেপবার্ন ওলন্দাজ অভিনেতা রবার্ট ওয়াল্ডার্সের সাথেই ছিলেন। তিনি বলেছেন, তার জীবনে কাটানো সেরা সময় ছিল এটি।
সোমালিয়া থেকে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরই তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। পরে জানা গেল, তার এক বিরল ধরনের ক্যান্সার ছিল। কেমোও নিয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিভানশি তার জন্য প্রাইভেট জেট বিমান পাঠান, কারণ অসুস্থতার জন্য হেপবার্ন তখন বাণিজ্যিক বিমানে যাতায়াত করতে পারছিলেন না। শেষ সময়টা তিনি শয্যাশায়ী হয়েই কাটান। ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঘুমের মধ্যে চিরদিনের জন্য এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। মৃত্যুতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গ্রেগরি পেক অশ্রুসিক্ত হয়ে অড্রের প্রিয় কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা অশেষ ভালোবাসা আবৃত্তি করেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন জিভানশিসহ তার পরিবারের সদস্যরা।
অড্রে হেপবার্ন মৃত্যুর পরও ঠিক আগের মতোই জনপ্রিয়; কিংবা আরো বেশি। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি তৃতীয় অবস্থানে আছেন। শুধু ১৫ জন EGOT (Emmy, Golden Globe, Oscar, Tony) অধিকারীর মধ্যে অড্রে হেপবার্ন একজন। তিনবার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব জয় করার রেকর্ডও আছে তার। তাকে নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক বায়োগ্রাফি হয়েছে। মাদাম তুসোর জাদুঘরে তার মোমের মূর্তিও রয়েছে৷ হেপবার্ন তার অঙ্গসৌষ্ঠব, জাদুকর মুখশ্রী, চুলের অন্যরকম স্টাইলের জন্য আলাদা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিলেন।
যেখানে তার সমসাময়িক অনেক অভিনেত্রী যেমন এলিজাবেথ টেলর, গ্রেস কেলি যৌনতার জন্য পরিচিত ছিলেন, সেখানে হেপবার্ন হয়ে উঠলেন আরো অভিজাত, রুচিশীল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। পোশাকের নতুনত্বের জন্য তার জুড়ি মেলা ভার। এতে অবশ্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিভানশির অবদানও অনেক। সাবরিনা ছবির মাধ্যমে তাদের পরিচয়। শুরুতে জিভানশি হেপবার্নকে ক্যাথরিন হেপবার্ন ভেবে ভুল করে বসেন। কিন্তু এরপর শুরু হয় আজীবনের বন্ধুত্ব।
অড্রের বড় পর্দায় এবং বড় পর্দার বাইরেও অনেক পোশাক জিভানশির ডিজাইন করা। সাদাকালো সাদামাটা পোশাকেও অড্রে ছিলেন সুন্দর। এখনো হেপবার্নের পোশাকের স্টাইল হারিয়ে যায়নি। একটি টিউলিপ, লিলি, গোলাপ আর লাস ভেগাসের একটি রাস্তার নাম তার নামে হয়। টাইমস, বাজারসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি।
অড্রে হেপবার্ন হলিউডের স্বর্ণালি যুগের সেরা অভিনেত্রীদের একজন, বিশুদ্ধ প্রতিমা আর তিনি একজন ফ্যাশন আইকন– এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর চেয়েও তার বড়ো পরিচয় আর পুঁজি হলো তার মানবতাবাদী জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড। এজন্য তিনি মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন। সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়ে তাদেরকে আপন করতে হয়তো আর কোনো অভিনেত্রীই এভাবে পারেননি। এটিই তাকে অনন্যসাধারণ করেছে।
তাকে বলা যায় ইউনিসেফের ‘Hardworking fairy godmother’। আকর্ষণীয় মুখশ্রী আর ছিপছিপে শরীর থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে কখনো ‘সুন্দরী’ ভাবেননি। বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়েও মনের ভেতরকার সৌন্দর্যের কথাই বলেছেন বেশি। এমনটি ক’জনই বা পারে! তার মনের সৌন্দর্য তাকে অনন্য করে তুলেছিল। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে মারা গেলেও এত বিচিত্র জীবনযাপন করে গেছেন, তা যেন রূপকথাকেও হার মানায়।