নোবেল পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯০১ সালে। শুরুতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি- এই পাঁচটি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হতো। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এর সাথে যুক্ত হয় অর্থনীতি। ফলে বর্তমানে মোট ছয়টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এটি এখন তর্কাতীতভাবে সত্য যে, সারা বিশ্বে নোবেলের চেয়ে মর্যাদাবান আর কোনো পুরস্কার নেই। ফলে প্রতি বছর যারা এই পুরস্কার পান, তারা কোনো না কোনোভাবে ওই বিশেষ বিষয়ে সমসাময়িক বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। আর যারা প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার পেয়েছিলেন, তারা তো বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান। হ্যাঁ, আজকে আমরা তেমনই একজন সৌভাগ্যবান মানুষকে নিয়ে আলোচনা করবো, যিনি ১৯০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক সুলি প্রুদোম।
১৮৩৯ সালের ১৬ মার্চ প্যারিসের এক সাধারণ দোকানীর ঘরে সুলি প্রুদোমের জন্ম। বাল্যকাল থেকে স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হওয়ার। সেই অনুসারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু তার চোখ অপথ্যালমিয়া নামক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে তিনি সেখানে পড়ার যোগ্যতা হারান। ফলে তখনই তিনি নিজের জীবন থেকে পড়ালেখার ইতি টেনে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং একটি কারখানার করণিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন সারাদিন অফিস করতেন আর গভীর রাত পর্যন্ত কবিতা লিখতেন।
কিন্তু এভাবে আর তার বেশিদিন ভালো লাগলো না। যেসব কবিতা লিখতেন তা-ও ছিল সাহিত্যের মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ। ফলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে চাইলেন। এজন্য পরিবার তাকে তার এক খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তিনি প্রথমে সাহিত্যে ও পরে আইনশাস্ত্রে ভর্তি হন। সফলতার সাথে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তিনি কিছুদিন সিনিয়র আইনজীবীদের সহকারী হিসেবে কাজও করেন। কিন্তু এই খালার বাসায় ঘটে যায় আরেক ঘটনা।
খালার একজন সুন্দরী কন্যা ছিল, নাম লিওন। লিওনের সাথেই সুলি প্রুদোমের সার্বক্ষণিক চলাফেরা ও সময় বিনিময় হতো। একপর্যায়ে সুলি প্রুদোম লিওনের প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু সুলি যখন এই কথা লিওনকে জানান, তখন লিওন এই ভালোবাসায় অস্বীকৃতি জানান। এতে সুলি প্রুদোম অত্যন্ত ভেঙে পড়েন এবং জীবনে কখনো বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও মন গলেনি লিওনের। উল্টো তিনি তখন আরেক ছেলেকে বিয়ে করে বসেন। সুলি প্রুদোম তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। জীবনে আর কোনোদিন তিনি বিয়ে করার কথা ভাবেননি।
কথায় আছে, কবিদের জন্য অপ্রাপ্তিও আশীর্বাদস্বরূপ। লিওনকে না পাওয়ার বেদনাও তেমনি সুলি প্রুদোমের জন্য আশীর্বাদের ন্যায় কাজ করলো। সুলি প্রুদোম মনের সকল দুঃখ-কষ্ট কলমের মাধ্যমে কাব্যে রূপান্তরিত করতে থাকলেন। যে সুলি প্রুদোম ‘কবিতা না হওয়ার’ কারণে হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার কলম থেকেই একের পর এক মহান মহান প্রেমকাব্য বের হতে থাকলো।ফলে সেই না পাওয়া প্রেমের প্রভাব তার প্রথমদিকের প্রায় সকল কাব্যগ্রন্থে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ যৌবনে রচিত তার সকল কাব্যই প্রেমপ্রধান।
১৮৬৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্টানসান অ্যাট পোয়েমস’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি দিয়েই তিনি তদানীন্তন সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। বিশেষত ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সাঁতে বোভ তরুণ কবি প্রুদোমকে কাব্য জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে অভিহিত করেন এবং সাহিত্যাঙ্গনের সবার সাথে তাকে পরিচিত করে তোলেন। তার প্রথমদিকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ‘লেস ইপরিউভিস’ (১৮৬৬) এবং ‘লেস সলিটিউড’ (১৮৬৯) কাব্যগ্রন্থ দুটিও প্রেম ও প্রেমের করুণ পরিণতিকে উপজীব্য করে রচিত।
সুলি প্রুদোমের সাহিত্যচর্চার দিক পরিবর্তন হয় চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে। এ সময় তিনি মানব-মানবীর স্বাভাবিক প্রেম বা অতৃপ্ত বাসনার জগত ছেড়ে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করা ও সাহিত্যচর্চাকেই একান্ত আপন করে নেন। আবেগপ্রবণ প্রেম ও কল্পনা জগত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার পর বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ক বিতর্কই তার কাছে প্রধান পাঠ ও রচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। তবে তিনি এ সময় দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের উপরেও অনেক বই রচনা করেন।
ফ্রান্সের আলোচিত সাহিত্য আন্দোলন ‘পার্নাসাস’ এর তিনি ছিলেন অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’-এই মতবাদ মেনে নেয়া। এবং শিল্প সাহিত্যে এই বিশ্বাস পুরোপুরি অনুসরণ করে মানুষের উপযোগী শিল্প সৃষ্টি করা। সুলি প্রুদোমের বিশ্বাস ছিল, কাব্যচর্চা থেকে রোমান্টিকতার আধিক্য বিসর্জন দিয়ে সেখানে মানুষের সাধারণ দর্শন প্রতিস্থাপন করা। মানুষের জন্য একটি সুস্থ ও মঙ্গলজনক শৈল্পিক পরিসর বিনির্মাণ করা।
সুলি প্রুদোম তার সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ফরাসি সাহিত্য একাডেমি কর্তৃক স্থায়ী সদস্যপদ এবং ১৮৮১ সালে ফরাসি একাডেমির পরিচালক নির্বাচিত হন। তিনি আমৃত্যু এই একাডেমির সদস্য ছিলেন। এই সাহিত্য সাধক মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বের অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে তিনি ফ্রান্সের চাতেনয়-মালাব্রাই শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচেছিলেন মোট ৬৭ বছর।
নোবেল কমিটি তার নোবেল প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন,
তার নোবেল প্রাপ্তির কারণ হলো তার কবিতার অসাধারণ বাক্য গঠন রীতি, যা আমাদের উচ্চ আদর্শবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এছাড়া, তার লেখার যথার্থ শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ, অনুভূতির মননশীল বিকাশ এবং বুদ্ধিদীপ্ততার অপূর্ব মিলন আমাদের মন ও চিন্তার জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯০১ তার নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদানকালে সুইডিশ একাডেমির তৎকালীন স্থায়ী সচিব সি ডি আফ ওয়্যারসন বলেন,
সুইডিশ একাডেমির কাছে এই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের জন্য অসংখ্য উচ্চ পর্যায়ের সুপারিশ এসেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আরও যত সমমানের সাহিত্যিক আছেন তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে বিচার বিশ্লেষণ করে সুলি প্রুদোমকেই এই সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মানের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। কবি, দার্শনিক ও ফরাসি একাডেমির সদস্য সুলি প্রুদোমই হলেন বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম নোবেল বিজয়ী গৌরবদীপ্ত সৌভাগ্যবান।
সুলি প্রুদোমের অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি আরও বলেন,
সুলি প্রুদোম ১৮৬৫ সালে তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্টানসান অ্যাট পোয়েমস’ দিয়েই ভবিষ্যতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কে নিজেকে প্রবেশ করান। এই কাব্যগ্রন্থটি বিশ্বের বহু সংখ্যক কবি, সাহিত্যিক ও কবিতা প্রেমিক ও দার্শনিকদের দ্বারা পঠিত ও সমাদৃত হয়েছে। সুলি প্রুদোম আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি; তার বহুসংখ্যক কবিতা মণিমুক্তোর চাইতেও অমর-অক্ষয় হিসেবে যুগ যুগ টিকে থাকবে। পরিশেষে আমি উল্লেখ করব, সুলি প্রুদোমকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে মূলত আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। কেননা, আলফ্রেড নোবেল নিজেও এই আদর্শবাদের ঐকান্তিক পূজারী ছিলেন। সুলি প্রুদোম এই পুরস্কারের মাধ্যমে সারা বিশ্বে অমর হয়ে থাকবেন, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অসুস্থতার কারণে এই সাহিত্যসাধক তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি নোবেল পুরস্কার ও সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। ১৮৭০ সালেই চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার কারণে তিনি চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়ে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুইডিশ একাডেমি কমিটির অনুরোধে কবির পক্ষ থেকে একজন ফরাসি মন্ত্রী নোবেল পুরস্কার ও সনদ গ্রহণ করেছিলেন।
সুলি প্রুদোম দুনিয়া থেকে চলে গেলেও রেখে গেছেন অসংখ্য অমর কীর্তি। সেসবের মধ্যে রয়েছে ‘লেস ডিসটাইন’ (১৮৭২), ‘লে ফ্রান্স’ (১৮৭৪), ‘লেস ভেইনস ট্রেন্ডরেসস’ (১৮৭৫), ‘লে জিনিথ’ (১৯৭৬), ‘লে জাস্টিস’ (১৯৭৮), ‘পোয়েসার’ (১৯৮৮), ‘লে প্রিজম’ (১৯৮৬), ‘লে বনহিউর’ (১৮৮৮), ‘ইপাভস’ (১৯০৮) প্রভৃতি গ্রন্থ। এছাড়াও তার কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ রয়েছে।