ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ওয়েবসাইটে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে দক্ষ নৌ সেনাপতি হিসেবে। ব্রিটিশ ‘বিদ্রোহী কবি’ লর্ড বায়রনের ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন ‘ব্রিটানিয়ার যুদ্ধের দেবতা’ (Britannia’s God of War)। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে সমুদ্রপথে ব্রিটেনের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেটি নিশ্চিত করে গিয়েছিলেন তিনিই। এই ব্যক্তিটি হলেন অ্যাডমিরাল লর্ড হোরেশিও নেলসন। নেলসনের জীবনের প্রাথমিক পর্যায় এই লেখার প্রথম পর্বে আলোচিত হয়েছে।
১৭৯৭ সালে হোরেশিও নেলসন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ‘রিয়ার অ্যাডমিরাল অফ দ্য ব্লু’ পদ লাভ করেন এবং এরপর ‘এইচএমএস থিসিয়াস’ নামক একটি যুদ্ধজাহাজ নেলসনের ফ্ল্যাগশিপে পরিণত হয়। তিনি স্পেনের কাদিজ বন্দরের কাছে স্প্যানিশ নৌবহরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকে স্প্যানিশ ট্রেজার শিপগুলোর আগমনের অপেক্ষা করছিলেন। উল্লেখ্য, দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের বিরাট এক ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ছিল এবং স্প্যানিশরা নিয়মিতভাবে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জাহাজে করে স্পেনে নিয়ে আসত। ব্রিটিশরা কাদিজ অবরোধ করে রাখে এবং ১৭৯৭ সালের জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে সৈন্য অবতরণের মাধ্যমে কাদিজ দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশ্য আরো কয়েক বছর ধরে ব্রিটিশরা বন্দরটি সমুদ্রপথে অবরোধ করে রাখে।
১৭৯৭ সালের ২২ থেকে ২৫ জুলাই নেলসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত সান্তা ক্রুজ দে তেনেরিফে শহরের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেখানে অবস্থানরত একটি ‘ট্রেজার শিপ’ দখল করে নেয়া। কিন্তু এই অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। অভিযানটিতে ব্রিটিশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং নেলসন নিজেও গুরুতর আহত হন। তার ডান হাতের অংশবিশেষ কেটে ফেলতে হয়। এই পরাজয়ের দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং ব্রিটিশ যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ভুল পরিকল্পনাকে এই পরাজয়ের জন্য দায়ী করা হয়। নেলসন ব্রিটেনে ফিরলে তাকে বিজয়ী বীরের মতো সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
এরপর ‘এইচএমএস ভ্যানগার্ড’ নামক একটি যুদ্ধজাহাজকে নেলসনের ফ্ল্যাগশিপ নিযুক্ত করা হয়। এ সময় উদীয়মান ফরাসি সমরনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দক্ষিণ ফ্রান্সে সৈন্য সমাবেশ করছিলেন, কিন্তু তিনি কোথায় আক্রমণ চালাতে যাচ্ছেন, সেটি ব্রিটিশদের জানা ছিল না। নেপোলিয়নের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য নেলসনকে আবার ভূমধ্যসাগরে প্রেরণ করা হয়। ১৭৯৮ সালের ২৮ মার্চ নেলসন একটি নৌবহর নিয়ে তুলোঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং ১৭ মে বন্দরটির নিকটে পৌঁছান, কিন্তু এ সময় তীব্র ঝড়ের কারণে তার নৌবহরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে নেপোলিয়ন তার নৌ বহর নিয়ে ব্রিটিশ নৌবহরকে ফাঁকি দিয়ে তার গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
নীলনদের যুদ্ধে নেলসন: নেপোলিয়নের প্রাচ্য জয়ের স্বপ্নভঙ্গ
নেলসন নেপোলিয়নের সন্ধানে ইতালির দক্ষিণ উপকূলে তল্লাশি চালান, কিন্তু সেখানে ফরাসি নৌবহরকে খুঁজে পাননি। ইতোমধ্যে ফরাসিরা মাল্টা আক্রমণ করে এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। নেলসন এই সংবাদ পেয়ে তার নৌবহর নিয়ে মাল্টায় পৌঁছান, কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখতে পান যে, ফরাসিরা ইতোমধ্যে তাদের নৌবহর নিয়ে সরে পড়েছে। নেলসনের ধারণা হয় যে, নেপোলিয়ন মিসরের (সেসময় আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ) আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের দিকে রওনা হয়েছেন। এজন্য নেলসনও আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে যাত্রা করেন এবং ২৮ জুন বন্দরটিতে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে ফরাসিদের কোনো সন্ধান না পেয়ে তিনি নেপলসের দিকে যাত্রা করেন। এদিকে এর ঠিক দুই দিন পর ১ জুলাই নেপোলিয়ন সসৈন্যে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান এবং বিনা বাধায় বন্দরটি দখল করে নেন। ফরাসি নৌবহর নিকটবর্তী আবুকির উপসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে।
এ সময় নেলসন নেপলস থেকে ফরাসিদের খোঁজে সাইপ্রাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, কিন্তু পথিমধ্যে শেষবারের মতো আলেকজান্দ্রিয়ায় তল্লাশি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয় বারেও তিনি সেখানে ফরাসি নৌবহরের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হন, কিন্তু ফেরার পথে একটি ফরাসি বাণিজ্য জাহাজের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে, ফরাসি নৌবহর আবুকির উপসাগরে অবস্থান করছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সেদিকে যাত্রা করেন। ১৭৯৮ সালের ১ আগস্ট আবুকির উপসাগরে ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবহরদ্বয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয় এবং ৩ আগস্ট পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। ‘নীলনদের যুদ্ধ’ (Battle of the Nile) নামে পরিচিত এই যুদ্ধে ফরাসিরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং তাদের ৪টি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ২,০০০ থেকে ৫,০০০ সৈন্য নিহত হয়। তদুপরি, ৯টি ফরাসি যুদ্ধজাহাজ এবং ৩,০০০ থেকে ৩,৯০০ ফরাসি যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা এই যুদ্ধে কোনো যুদ্ধজাহাজ হারায়নি। এই যুদ্ধে তাদের ২১৮ জন সৈন্য নিহত ও ৬৭৭ জন সৈন্য আহত হয়।
নেলসনের রণনৈপুণ্যে এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা বিজয়ী হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নেলসন যুদ্ধ চলাকালে পুনরায় গুরুতরভাবে আহত হন। এই যুদ্ধের পর নেলসনকে ‘ব্যারন’ উপাধি প্রদান করা হয়। নীলনদের যুদ্ধে অর্জিত বিজয়কে নেলসনের সবচেয়ে বড় বিজয়গুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এই যুদ্ধের কৌশলগত তাৎপর্য ছিল ব্যাপক। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে প্রাচ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের ফরাসি উচ্চাকাঙ্ক্ষা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল, মিসর জয়ের পর তিনি প্রাচ্যে অভিযান পরিচালনা করবেন এবং ভারতবর্ষে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মহীশূরের সুলতান টিপু সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য, টিপু সুলতান ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশরা তাকে ভারতবর্ষে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করত।
ব্রিটিশদের জন্য ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম এবং এজন্য ভারতবর্ষে ফরাসি আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল তাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। কিন্তু মিসরের উপকূলে মোতায়েনকৃত ফরাসি নৌবহর নেলসনের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে মিসরে অবস্থানরত ফরাসি সৈন্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর নেপোলিয়ন উত্তর দিকে ভূমধ্যসাগরের উপকূল বরাবর আক্রমণ চালান, কিন্তু ক্যাপ্টেন স্যার সিডনি স্মিথের নেতৃত্বাধীন একটি ব্রিটিশ সৈন্যদলের সহায়তায় ওসমানীয় সৈন্যরা ফরাসিদের পরাজিত করে। এর ফলে নেপোলিয়ন প্রাচ্য অভিযান স্থগিত করে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন এবং তার ভারতবর্ষ অভিযানের পরিকল্পনাও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এভাবে নীলনদের যুদ্ধে লর্ড নেলসন নেপোলিয়নের প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনাকে নির্মূল করে দেন।
নেপলসে নেলসন: বীরত্ব, প্রেম এবং নিষ্ঠুরতা
নীলনদের যুদ্ধের পর নেলসন তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত মিসর অবরোধের দায়িত্ব প্রদান করে নেপলসে ফিরে যান এবং সেখানে রাজকীয় অভ্যর্থনা লাভ করেন। এ সময় তিনি নেপলসে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার উইলিয়াম হ্যামিল্টনের স্ত্রী এম্মা হ্যামিল্টনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাদের একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। এর ফলে ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তনের পর নেলসনের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক মারাত্মক তিক্ত হয়ে উঠেছিল।
এদিকে ফরাসিদের পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে নেপলস ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ১৭৯৮ সালের নভেম্বরে নেলসনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ নৌবহরের সহায়তায় নেপলসের সৈন্যরা রোম দখল করে নেয়। কিন্তু ফরাসিরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে রোম পুনর্দখল করে এবং নেপলসের দিকে অগ্রসর হয়। নেলসনের সহায়তায় নেপলসের রাজপরিবার সেখান থেকে পালের্মোয় পশ্চাৎপসরণ করে এবং ফরাসিরা নেপলস দখল করে নিয়ে সেখানে স্থানীয় বিপ্লবীদের সহায়তায় একটি প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে। ইতোমধ্যে ১৭৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নেলসন পদোন্নতি পেয়ে ‘রিয়ার অ্যাডমিরাল অফ দ্য রেড’ পদে উন্নীত হন।
এ সময় নেলসন নৌপথে ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত নেপলস অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এদিকে ১৭৯৯ সালের জুনে কার্ডিনাল ফাব্রিজিও রুফোর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিবিপ্লবী সৈন্যদল নেপলসে প্রবেশ করে এবং ফরাসি ও স্থানীয় প্রজাতন্ত্রী সৈন্যদের কোণঠাসা করে ফেলে, কিন্তু নেপলসের সৈন্যদের নিষ্ঠুরতায় বিরক্ত হয়ে রুফো ফরাসিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফরাসিরা আত্মসমর্পণকারীদের জাহাজে চড়ে ফ্রান্সে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়, কিন্তু ২৪ জুন নেলসন নেপলস পুনর্দখল করে নেন এবং আত্মসমর্পণকারীরা জাহাজে পৌঁছানোর পরপরই সেগুলোকে দখল করে নেন। এদের মধ্যে অধিকাংশকে তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এটি ছিল নেলসনের জীবনের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়, কিন্তু এজন্য তাকে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়নি। নেপলসের রাজা তার রাজত্ব রক্ষায় নেলসনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘ডিউক অফ ব্রোন্তে’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং অন্যান্য পুরস্কার প্রদান করেন। ১৭৯৯ সালের ৯ নভেম্বর নেলসন ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তন করেন।
কোপেনগেহেনের যুদ্ধে নেলসন: বাল্টিক অঞ্চলে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তার
১৮০১ সালের ১ জানুয়ারি নেলসন পদোন্নতি পেয়ে ‘ভাইস অ্যাডমিরাল অফ দ্য ব্লু’ পদে উন্নীত হন। এ সময় ফ্রান্সের ওপর প্রলম্বিত ব্রিটিশ অবরোধের কারণে অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ফ্রান্সের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছিল না। তদুপরি, অবরোধ কার্যকর করার জন্য ব্রিটিশরা তাদের নৌশক্তির বলে সমুদ্রে চলমান সকল রাষ্ট্রের জাহাজ তল্লাশি করছিল, যাতে কোনো রাষ্ট্র গোপনে ফ্রান্সের সঙ্গে ব্যবসা করতে না পারে। এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় রাশিয়া, প্রাশিয়া, ডেনমার্ক–নরওয়ে (ডেনমার্ক ও নরওয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র) এবং সুইডেন মিলে এই অবরোধ মোকাবেলা করার জন্য ‘সশস্ত্র নিরপেক্ষতা চুক্তি’তে (Pact of Armed Neutrality) স্বাক্ষর করে।
এসময় ব্রিটেন আশঙ্কা করছিল যে, শক্তিশালী নৌবহরের অধিকারী ডেনমার্ক–নরওয়ে ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। এই আশঙ্কায় তারা ডেনমার্ক–নরওয়ের রাজধানী কোপেনহেগেনে অবস্থানরত ড্যানিশ–নরউইজীয় নৌবহরকে আগেভাগেই ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নেলসনের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
নেলসন তার নৌবহর নিয়ে বাল্টিক সাগরে পৌঁছান এবং ১৮০১ সালের ২ এপ্রিল অতর্কিতে কোপেনহেগেনে অবস্থানরত ড্যানিশ–নরউইজীয় নৌবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। নেলসনের মতে, এটি ছিল তখন পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে তীব্র যুদ্ধ। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধের ফলে ড্যানিশ–নরউইজীয় নৌবহরের ৩টি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয় ও ১২টি যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশদের হস্তগত হয়, এবং প্রায় ১,৬০০ ড্যানিশ–নরউইজীয় সৈন্য হতাহত হয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা এ যুদ্ধে কোনো যুদ্ধজাহাজ হারায়নি, এবং তাদের ১,২০০ সৈন্য এই যুদ্ধে হতাহত হয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা ড্যানিশ–নরউইজীয় নৌবহর নিয়ে যে শঙ্কায় ছিল সেটি দূরীভূত হয়।
কোপেনহেগেনের যুদ্ধের পর নেলসন বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী রুশ বন্দর রেভালে (বর্তমান এস্তোনিয়ার তাল্লিন) পৌঁছান। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে, রাশিয়ায় সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে এবং নতুন রুশ সরকার ‘সশস্ত্র নিরপেক্ষতার চুক্তি’ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে নেলসনের বাল্টিক অভিযান ছিল সফল। এরপর তিনি ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং ১৮০১ সালের ১ জুলাই লন্ডনে পৌঁছান।
১৮০১ সালের ২২ অক্টোবর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ‘অ্যামিয়েন্স চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৮০৩ সালে নেলসনকে ব্রিটিশ ভূমধ্যসাগরীয় নৌবহরের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় এবং ‘এইচএমএস ভিক্টোরি’ যুদ্ধজাহাজটি তার ফ্ল্যাগশিপে পরিণত হয়। ফ্রান্সের তুলোঁ বন্দর অবরোধ করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৮০৩ সালের জুলাইয়ে নেলসন তার নৌবহর নিয়ে তুলোঁর নিকটে পৌঁছান এবং বন্দরটি অবরোধ করেন। পরবর্তী প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি এই অবরোধ পরিচালনা করেন। ১৮০৪ সালের ২৩ এপ্রিল তাকে পদোন্নতি দিয়ে ‘ভাইস অ্যাডমিরাল অফ দ্য হোয়াইট’ পদে ভূষিত করা হয়।
১৮০৫ সালের জানুয়ারিতে একটি ফরাসি নৌবহর ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে খোলা সমুদ্রে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নেলসন নৌবহরটির পশ্চাদ্ধাবন করেন, কিন্তু ফরাসি নৌবহরটি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে তারা বন্দরটিতে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। এপ্রিলে আরেকটি ফরাসি নৌবহর ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে খোলা সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ে এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দিকে যাত্রা করে। যথারীতি নেলসন তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু ফরাসি নৌবহরটি নেপোলিয়নের নির্দেশ অমান্য করে ফিরে আসার চেষ্টা করে এবং পথিমধ্যে অন্য একটি ব্রিটিশ নৌবহরের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হলেও তারা তুলোঁয় ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এই ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে নেলসন ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তন করেন, কিন্তু সেখানে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করা হয় এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোকে সম্ভাব্য ফরাসি আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কৃতিত্ব প্রদান করা হয়, যদিও বাস্তবতা ছিল অনেকটাই ভিন্ন।
ট্রাফালগারের যুদ্ধে নেলসন: অন্তিম লড়াই
এদিকে এ সময় ফ্রান্স ও স্পেন ব্রিটেনের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য একজোট হয় এবং স্পেনের কাদিজ বন্দরে তাদের সম্মিলিত নৌবহর সমবেত হয়। নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল, ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত নৌবহর ব্রিটিশ নৌবহরকে পরাজিত করে ইংলিশ চ্যানেলের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করবে এবং এরপর নেপোলিয়নের ‘গ্র্যান্ড আর্মি’ ব্রিটেন আক্রমণ করবে। এমতাবস্থায় ফরাসি–স্প্যানিশ নৌবহরকে প্রতিহত করার জন্য নেলসনের অধীনে একটি ব্রিটিশ নৌবহর স্প্যানিশ উপকূল অভিমুখে যাত্রা করে।
এই অভিযানের ওপর ব্রিটেনের ভাগ্য নির্ভর করছিল। যদি এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা পরাজিত হতো, সেক্ষেত্রে নেপোলিয়নের জন্য ব্রিটেনে স্থল আক্রমণ পরিচালনার পথ উন্মুক্ত হয়ে যেত এবং ব্রিটেনের পতন ঘটত। নেলসনের জন্য সৌভাগ্যক্রমে, ফরাসি–স্প্যানিশ নৌবহরটির অধিনায়করক ব্রিটিশদের সঙ্গে সরাসরি নৌযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন এবং তারা যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। এমতাবস্থায় ১৮০৫ সালের ২১ অক্টোবর স্পেনের কাদিজ বন্দরের নিকটবর্তী ট্রাফালগার অন্তরীপে উভয় নৌবহর পরস্পরের মুখোমুখি হয়।
সেযুগে নৌযুদ্ধের তদানীন্তন প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, যুদ্ধের সময় যুদ্ধজাহাজগুলোকে একটি একক সমান্তরাল রেখা বরাবর সজ্জিত করা হতো। নেলসন এই প্রথা ভঙ্গ করে তার যুদ্ধজাহাজগুলোকে সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত করেন এবং এর ফলে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা বিশেষ সুবিধা লাভ করে। ব্রিটিশ নৌবহরে মোট ২৭টি যুদ্ধজাহাজ ছিল, অন্যদিকে ফরাসি–স্প্যানিশ নৌবহরে ছিল মোট ৩৩টি যুদ্ধজাহাজ। অবশ্য দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে ব্রিটিশ নাবিকরা ছিল তুলনামূলকভাবে অগ্রগামী। যুদ্ধের শুরুতে নেলসন ব্রিটিশ জাহাজগুলোর উদ্দেশ্যে যে সিগন্যাল প্রেরণ করেন, সেটিতে বলা হয়েছিল, “ইংল্যান্ড আশা করে, প্রতিটি ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করবে” (England expects that every man will do his duty)। এই উক্তিটি পরবর্তীতে ব্রিটেনে প্রচলিত একটি বিখ্যাত উক্তিতে পরিণত হয়েছে। নেলসনের সিগন্যাল প্রদানের পরপরই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
উভয় পক্ষই সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধ করে, এবং ব্রিটিশ জাহাজগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নেলসনের ফ্ল্যাগশিপ ‘এইচএমএস ভিক্টোরি’ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ নৌবহরই এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। ফরাসি–স্প্যানিশ সম্মিলিত নৌবহরের ১টি যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায় ও ২১টি যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশদের হস্তগত হয়, এবং তাদের ৪,৩৯৫ জন সৈন্য নিহত, ২,৫৪১ জন সৈন্য আহত ও ৭,০০০ থেকে ৮,০০০ সৈন্য বন্দি হয়। অন্যদিকে, এই যুদ্ধে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা কোনো যুদ্ধজাহাজ হারায়নি, এবং যুদ্ধে তাদের ৪৫৮ জন সৈন্য নিহত ও ১,২০৮ জন সৈন্য আহত হয়।
ট্রাফালগারের যুদ্ধ ছিল ব্রিটেনের ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এই যুদ্ধে বিজয়ের ফলে সমুদ্রে ব্রিটেনের আধিপত্য নিশ্চিত হয় এবং নেপোলিয়নের ব্রিটেন আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নীলনদের যুদ্ধে যেমন নেপোলিয়নের প্রাচ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছিল, ট্রাফালগারের যুদ্ধে তেমনিভাবে তার পাশ্চাত্যে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপনের স্বপ্নও ব্যর্থ হয়ে যায়। এই যুদ্ধের পর ফ্রান্স আর কখনো সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ব্রিটেনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের পর সমুদ্রে ব্রিটেনের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তাদের এই আধিপত্য বজায় ছিল।
এই বিজয় ছিল নেলসনের জীবনের চূড়ান্ত বিজয়, এবং এটিই ছিল তার শেষ লড়াই। যুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে এইচএমএস ভিক্টোরির ৫০ ফুট দূরে অবস্থানরত একটি ফরাসি যুদ্ধজাহাজ থেকে নিক্ষিপ্ত একটি গুলির আঘাতে নেলসন মারাত্মকভাবে আহত হন। তাকে জাহাজের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৭ বছর। তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জ মন্তব্য করেছিলেন, “এই যুদ্ধে আমরা যা পেয়েছি, তারচেয়ে বেশি হারিয়েছি।” নেলসনের মৃতদেহকে ১৮০৬ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে পুরোদস্তুর সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। ৩২ জন অ্যাডমিরাল, ১০০ জনের বেশি ক্যাপ্টেন এবং ১০,০০০ সৈন্য নেলসনের শবযাত্রায় অংশ নেন।
ট্রাফালগারের যুদ্ধে ব্রিটেনের গৌরবময় বিজয় উপলক্ষে লন্ডনে ‘ট্রাফালগার স্কয়্যার’ নির্মিত হয়, এবং এই স্কয়্যারটির কেন্দ্রে অবস্থিত কলামটির নামকরণ করা হয়েছে ‘নেলসন কলাম’। এছাড়া নেলসনের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত অ্যাডমিরাল লর্ড হোরেশিও নেলসন ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতিমান নৌসেনাপতি হিসেবে পরিচিত।