রাস্তা ধরে পাইক-পেয়াদা, উজির-সভাসদ সদর্পে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন রাজা। তার পরনে এমন এক পোশাক যা কিনা কোনো বোকা লোকের দৃষ্টিগোচর হবে না। কেউই রাজার পোশাক দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু বোকা প্রমাণিত হবার ভয়ে কারোরই মুখে রা নেই।
এই নীরবতা ভেদ করে হঠাৎ শোনা গেল এক শিশুর কণ্ঠ, “আরে, রাজার গায়ে তো কোনো কাপড়ই নেই!” মুহূর্তেই সকলে অনুধাবন করল বোকা সাজতে না চেয়েই বরং তারা আরো বেশি বোকা বনেছে।
উপরোক্ত বর্ণনাটি ‘দ্য এম্পেরর’স নিউ ক্লথস’ নামের এক গল্প থেকে নেয়া। আমরা ছোটবেলায় কোনো না কোনো সময় হয়তো গল্পটি পড়েছি বা শুনেছি। এই গল্প বাদ দিলেও ‘দ্য লিটল মারমেইড’ বা ‘আগলি ডাকলিং‘ তো ডিজনির কল্যাণে সবারই জানা। যদিও মূল গল্পের থেকে ডিজনির ‘লিটল মারমেইড’-এর শেষাংশ যথেষ্ট পরিবর্তিত, কিন্তু তাতে সেসব কাহিনীর আবেদন বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। এসব গল্প ছাড়াও আরো বহু জনপ্রিয় রূপকথার রচয়িতা একজন ড্যানিশ, তার নাম হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন (Hans Christian Andersen, ড্যানিশ ভাষাতে তাকে ডাকা হয় H C Andersen)।
অ্যান্ডারসেনের ছেলেবেলা
কোপেনহেগেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ডেনমার্কের এক শহর অডেন্স (Odense)। এখানেই ১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল অ্যান মেরি অ্যান্ডার্সড্যাটি আর হ্যান্স অ্যান্ডারসেনের ঘরে জন্ম নিল তাদের সন্তান হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন। মা করতেন ধোপার কাজ, আর বাবা বানাতেন জুতো। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। ১৮০৭ সালে তারা অডেন্সের মাঙ্কমলেস্ট্রেডা এলাকায় ঘর বাধলেন। দারিদ্র্য সত্ত্বেও বাবার উৎসাহে অ্যান্ডারসেনের মনে শিল্পসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়। বাবা প্রায়ই তাকে ঘরে থাকা অ্যারাবিয়ান নাইটস আর বাইবেল পড়ে শোনাতেন। ১৮১০ সালে অ্যান্ডারসেন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হন, পরের বছর তাকে গরিব শিশুদের আলাদা স্কুলে পাঠানো হয়। পাশাপাশি বাসায় বাবার তত্ত্বাবধানে অ্যান্ডারসেনের সৃজনশীল সত্ত্বার বিকাশ অব্যাহত থাকে।
১৮১২ সালে অ্যান্ডারসেনের মা থিয়েটারে কাজ পান। এই সুযোগে ছোট্ট অ্যান্ডারসেন মাঝে মাঝেই থিয়েটারে যাবার অবকাশ পেলেন, যেখানে অধিকাংশ সময়েই চলত ড্যানিশ নাট্যকার লুডভিগ হলবার্গের নাটক। ফলে থিয়েটারের প্রতি অ্যান্ডারসেনের আকর্ষণ তৈরি হলো। বাবা তাকে বাসাতেই খেলনা একটি থিয়েটার বানিয়ে দেন, যেখানে শিশু অ্যান্ডারসেন নিজ হাতে গড়া পুতুল দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। বলা হয়, শেক্সপিয়ারের নাটকের প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ছিল।
অ্যান্ডারসেনের বয়স যখন চৌদ্দ, তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। উপার্জনক্ষম একজন সদস্য হারিয়ে তার পরিবার পড়ে গেল অকূল পাথারে। বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে অ্যান্ডারসেন কাজে নামলেন। প্রথমে তিনি কচ অ্যান্ড হার্সফেল্ডট টেক্সটাইলে তাঁতির কাজ নিলেন। কিছুদিন পরে সেই কাজ ছেড়ে তামাকের কোম্পানি লরিডস অহনট্রাপপ্সে ঢুকলেন। অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভাল হলে অ্যান্ডারসেন পুনরায় স্কুলে ফিরে যান।
১৮১৮ সালে অ্যান্ডারসেনের মা নতুন করে বিয়ে করলে কিশোর অ্যান্ডারসেন এবার ঘর ছেড়ে ডেনমার্কের থিয়েটার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। ১৮১৯ সালে সেন্ট ক্যানুট’স ক্যাথেড্রালে তার কনফার্মেশন (ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পবিত্র একটি আচার) হয়। এই সেই ক্যাথেড্রাল যেখানে অ্যান্ডারসেনের বাবা-মায়ের বিয়ে এবং বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে অ্যান্ডারসেন এই ক্যাথেড্রালের সাথে তার আত্মিক যোগাযোগের কথা অনেকবারই বলেছেন। যা-ই হোক, কনফার্মেশনের অব্যবহিত পরেই চিথিপত্র বিলির গাড়িতে চেপে কিশোর অ্যান্ডারসেন অডেন্স ত্যাগ করলেন। তার গন্তব্য কোপেনহেগেন শহর।
কোপেনহেগেনে অ্যান্ডারসেন
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অ্যান্ডারসেন এসেছেন স্বপ্নের পসরা সাজিয়ে। তার হৃদয়ে নামযশ কুড়ানোর অদম্য আকাঙ্খা। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগল না। রয়্যাল থিয়েটারে পরিচালক সিবোনিসের গানের একটি অনুষ্ঠানে তিনি পারফর্ম করে কিছু অর্থ পেলেন। সিবোনিস তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার। তিনি অ্যান্ডারসেনকে গান আর জার্মান ভাষা শেখানোর কথাও দিলেন। পাশাপাশি রয়্যাল থিয়েটারের বালকদের গানের দলে তিন বছরের জন্য তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলো।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বয়ঃসন্ধিকালে অ্যান্ডারসেনের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হলে তা আর বালকদের দলে গাইবার উপযুক্ত রইল না। ফলে একরকম বাধ্য হয়েই এক বছর পরেই সিবোনিস তাকে গানের দল থেকে খারিজ করে দেন। অনন্যোপায় অ্যান্ডারসেন এবার নৃত্য শিক্ষক ডাহ্লেনের শরণাপন্ন হন, যিনি তাকে রয়্যাল কোর্ট স্কুল অফ ড্যান্সে ভর্তি করে নিলেন।
বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ীর সহায়তায় অ্যান্ডারসেন কাজকর্ম চালাবার মতো অর্থ জোগাড় করতে সমর্থ হন। তার সাথে এসময় লেখক ওগ-গোল্ডবার্গের (Høegh-Guldberg) পরিচয় হয়। তিনি অ্যান্ডারসেনকে লেখালেখির প্রশিক্ষণ দেবার আশ্বাস দেন। কিন্তু ১৮২১ সালে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। হতাশ অ্যান্ডারসেন এবার অভিনয় শিখবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
অ্যান্ডারসেন লেখালেখির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি একবার একটি নাটক লিখে থিয়েটারে জমা দেন, কিন্তু সিলেকশন কমিটি সেই নাটক মঞ্চস্থ করবার যোগ্য মনে করেনি। পরবর্তীতে প্রকাশিত একটি বইয়ে সেই নাটকের একটি দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত হলে রয়্যাল থিয়েটারের পরিচালক পরিষদ তাকে ডেকে পাঠাল। ১৮২২ সালে অ্যান্ডারসেন মুখোমুখি হলেন পরিষদের, যেখানে ছিলেন জোনাস কলিন্স নামে এক ভদ্রলোক। কলিন্স ছিলেন রয়্যাল থিয়েটারের একজন পরিচালক এবং ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডেরিকের ঘনিষ্ঠ। অ্যান্ডারসেনের ছাইচাপা প্রতিভা তার জহুরি চোখ চিনতে ভুল করেনি। তখনকার দিনে রাজার পক্ষ থেকে বিশেষ বিশেষ ছাত্রদের জন্য বৃত্তির (Ad Usus Publicos) ব্যবস্থা ছিল। কলিন্স ফ্রেডেরিকের সাথে কথা বলে অ্যান্ডারসেনের জন্য সেই ব্যবস্থা করলেন। তিন বছরের জন্য ৩৫০ ড্যানিশ মুদ্রা তার জন্য বরাদ্দ হয়, যা পরে ১৮২৯ সাল অবধি বর্ধিত হলো। অ্যান্ডারসেন দুঃসময়ে তাকে সহায়তা করার জন্যে কলিন্স পরিবারের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ ছিলেন।
কলিন্সের উৎসাহে অ্যান্ডারসেন শিক্ষা সমাপ্তের জন্য স্লিগেলস (Slagelse) শহরের ল্যাটিন স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এখানে তিনি প্রচণ্ড ধাক্কা খান। স্কুলের কঠোর নিয়মকানুন তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। মাঝে মাঝে তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইমন মেসলিং এর বাসাতে থাকতে হত। বলা হয়, সেখানে তিনি দুর্ব্যবহারের সম্মুখিন হন। তার বানানের অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। তাই লেখালেখি করতে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। মোটকথা স্লিগেলস স্কুল অ্যান্ডারসেনের লেখক সত্ত্বাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করবার পাকাপাকি আয়োজন করে। তবে তার অসুখিভাব কলিন্সের নজর এড়ায়নি। তিনি অ্যান্ডারসেনকে স্কুল থেকে সরিয়ে তার জন্য আলাদা গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেন। সেই শিক্ষক ছিলেন নামকরা ঐতিহাসিক এবং ধর্মবিষয়ক পণ্ডিত লুদভিগ ক্রিস্টেনসেন। ১৮২৯ সালে অ্যান্ডারসেন স্কুল সমাপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করলেন।
স্কুল থেকে অ্যান্ডারসেন গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা পেয়ে যান। তৎকালীন গল্প-উপন্যাসের ভাষা ছিল কাঠখোট্টা ধরনের, সাধারণ জনগণের কথ্য ভাষার সাথে তার ছিল বিস্তর ফারাক। কাঠখোট্টা লেখার ভাষায় দুর্বলতার দরুন অ্যান্ডারসেনের লেখা ছিল সহজ সাধারণ, যার সাথে সাধারণ মানুষ একাত্ম হতে পারত। আমাদের বাংলাদেশে প্রমথ চৌধুরী যেমন সহজপাঠ্য গদ্যরীতিতে লেখা জনপ্রিয় করেছিলেন, অ্যান্ডারসেন তেমনি গল্পের ভাষাকে কঠিন ব্যাকরণের বেষ্টনী থেকে বের করে আনেন।
লেখক অ্যান্ডারসেনের সূচনা
১৮২৯ সাল অ্যান্ডারসেনের জন্য ছিল একটি মাইলফলক। আগের বছর লেখা ছোটগল্প ‘অ্যা জার্নি অন ফুট ফ্রম হলম্যান’স ক্যানাল তো দ্য ইস্ট পয়েন্ট অফ অ্যামাজার’ (A Journey on Foot from Holmen’s Canal to the East Point of Amager) এই বছর প্রকাশিত হয়। গল্পের বিষয়বস্তু ছিল যাত্রাপথে মূল চরিত্রের সাথে বর্ণিল অন্যান্য চরিত্রের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন, যাদের মধ্যে ছিল সেন্ট পিটার থেকে শুরু করে কথা বলা বেড়াল। এর সাফল্যে উৎসাহিত অ্যান্ডারসেন এবার লিখে ফেলেন ‘লাভ অন সেন্ট নিকোলাসে’স চার্চ টাওয়ার” (Love on St. Nicholas Church Tower) নামে এক নাটক। একই সময়ে তিনি হাত দেন কবিতা রচনায় এবং তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় কিছুদিন পরেই। জনশ্রুতি আছে, একটি কবিতা উৎসর্গিত ছিল তার পরিচিত এক ছাত্রের বোন, রিবর্গ ভিউযিটির (Riborg Voigt) প্রতি, যাকে তিনি ভালবাসতেন এবং যার উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিরকুট মৃত্যুর পরে তার লকেটের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল।
লেখালেখি থেকে একটু বিরতি নিয়ে অ্যান্ডারসেন এবার ভ্রমণে বের হলেন। জার্মানি ঘুরে এসে ১৮৩১ সালে লিখলেন তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, শ্যাডো পিকচার্স অফ অ্যা জার্নি টু দ্য হার্জ মাউন্টেইনস অ্যান্ড স্যাক্সোনি। জার্মানিতে থাকার সময় তিনি সেখানকার সাহিত্যে অনুপ্রাণিত হন, বিশেষ করে গ্রিম ভাইদের গল্পগুলো তাকে নাড়া দেয়। দেশে ফিরে আসবার পরে রাজার তরফ থেকে তাকে আরো কিছু অর্থ অনুমোদন দেয়া হলো। এর সদ্ব্যবহার করতে অ্যান্ডারসেন ইউরোপে পাড়ি জমালেন। জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ঘুরে ১৮৩৪ সালের অক্টোবরে তিনি ইতালিতে এসে পৌঁছেন। এখানকার মানুষ আর প্রকৃতি তাকে অভিভূত করে। তিনি লিখে ফেলেন আত্মজৈবনিক আকারে রচিত গল্পগ্রন্থ দ্য ইম্প্রোভাইসেটর (The Improvisatore ), যা প্রকাশিত হয় ১৮৩৫ সালে। ১৮৩৬ সালে তিনি বেশ কিছু গীতিনাট্যও রচনা করেন। ইউরোপ ভ্রমণের সময় তার সাথে দেখা হয় কিংবদন্তী কিছু সাহিত্যিকের- ভিক্টর হুগো, হাইনরিখ হাইন, বালজাক আর অ্যালেক্সান্ডার দ্যুমা। তাদের সাথে কথা বলে অ্যান্ডারসেন যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হন।
রূপকথার রাজ্যে
দ্য ইম্প্রোভাইসেটর যেবছর প্রকাশিত হয় সেই বছরেই আবির্ভাব হলো সেই অ্যান্ডারসেনের, যাকে মানুষ মনে রেখেছে তার ভ্রমণকাহিনী বা উপন্যাসের জন্য নয়, তার কলম থেকে উঠে আসা জাদুকরি রূপকথার জন্য। তার রূপকথার গল্পের প্রথম সংকলন বের হয় দুই খন্ডে এভেন্ট্যার (eventyrs/fantastic tales) নামে। এর মধ্যে ছিল টিন্ডার বক্স, লিটল ক্লস অ্যান্ড বিগ ক্লস, লিটল আইডা’স ফ্লাওয়ারস আর থাম্বেলিনার মতো বিখ্যাত কাহিনী। শেষ দুটি কাহিনী সম্পূর্ণই অ্যান্ডারসেনের মস্তিষ্কপ্রসূত, আর অন্যান্য গল্পগুলো ছোটবেলায় নানা উৎস থেকে শোনা কাহিনীর চিত্রায়ন।
অ্যান্ডারসেনের গল্প-উপন্যাস তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। বিভিন্ন ভাষায় তার লেখা অনূদিত হতে থাকে। তবে নিজ দেশে প্রথমে তিনি সমালোচকদের রোষানলে পড়েন তার লেখায় কথ্য ভাষার বাহুল্যের কারণে। তবে ধীরে ধীরে জনগণের মন জয় করতে অ্যান্ডারসেন সক্ষম হন। এর মধ্যেই তিনি ১৮৪০-৪১ সালে অ্যাথেন্স, নেপাল, কন্সট্যান্টিনোপোল আর প্রাগ শহর ভ্রমণ করেন। ১৮৪৩-৪৪ সালে তিনি আবার ইউরোপে পাড়ি জমান।
১৮৪৫ সালে বেন্টলি’স মিসসেল্যানি (Bentley’s Miscellany) ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় অ্যান্ডারসেনের মৌলিক গল্প দ্য লিটল মারমেইড, যার বিয়োগান্তক পরিণতিতে মৎস্যকুমারী অ্যারিয়েল ভালবাসার মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে। অ্যান্ডারসেনের এই গল্প তুমুল জনপ্রিয় হয়। সমালোচকেরা এই গল্পের প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন। আরো গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় ওয়ান্ডারফুল স্টোরি’স ফর চিলড্রেন, অ্যা ড্যানিশ স্টোরি বুক, ড্যানিশ ফেয়ারি টেলস অ্যান্ড লিজেন্ডস। সব মিলিয়ে অ্যান্ডারসেন লিখেছেন ১৬৮টি রূপকথার গল্প। এর মাঝে সর্বাধিক পরিচিত কয়েকটি হলো এম্পেরর’স নিউ ক্লথস, লিটল আগলি ডাকলিং, টিন্ডারবক্স, লিটল মারমেইড, নাইটিংগেল, প্রিন্সেন অ্যান্ড দ্য পি, থাম্বেলিনা, স্নো কুইন, লিটল ম্যাচ গার্ল, ওয়াইল্ড সোয়ানস, ফার ট্রি ইত্যাদি। তার অনেক লেখা যুগ যুগ ধরে লোকমুখে চলে আসা গল্পের পরিশীলিত রূপ, আর কিছু কিছু রচনা অন্যান্য উৎস থেকে অনুপ্রাণিত হলেও কাহিনী মৌলিক।
১৮৭২ সাল পর্যন্ত অ্যান্ডারসেন রূপকথার গল্প লেখা চালিয়ে যান। এর মধ্যেই তিনি অন্যান্য ঘরানার লেখাও লিখেছিলেন। ১৮৫৫ সালে তার নিজ হাতে লেখা আত্মজীবনী দ্য ফেইরি টেইল অফ মাই লাইফ বের হয়।
ভ্রমণ এবং শেষ জীবন
অ্যান্ডারসেন সারাজীবনই ভ্রমণ করে গেছেন। ১৮৪৭ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি চার্লস ডিকেন্সের সাথে তার বাড়িতে দেখা করেন। ১৮৫৩-তে প্রকাশিত অ্যা পোয়েট’স ডে ড্রিম গল্পগ্রন্থ তিনি উৎসর্গ করেন ডিকেন্সকে। ১৮৬২ সাল আসতে আসতে তিনি আরেকবার ইতালি, জার্মানি আর সুইজারল্যান্ডে যান। পাশাপাশি লেখালেখিও চলছিল সমান তালে। ভ্রমণে গেলে তার সাথে অনেক নামকরা লেখক আসতেন সাক্ষাৎ করতে। ১৮৬৩ সালে প্রথিতযশা নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের সাথে তার দেখা হয়।
ডিকেন্সের সাথে অ্যান্ডারসেনের সম্পর্ক শেষদিকে ভাল ছিল না। বলা হয়, দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি অনির্দিষ্টকাল ডিকেন্সের বাড়িতে অবস্থান করলে তাদের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। ডিকেন্সের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি লেখককে সহ্য করতে রাজি হয়নি। তাদের চাপে অ্যান্ডারসেন ইংল্যান্ড থেকে চলে আসেন, পরে তিনি ডিকেন্সকে চিঠি লিখলেও কোনো জবাব পাননি।
১৮৭১ সাল থেকে অ্যান্ডারসেন কোপেনহেগেনের ধনবান মেলকিয়র পরিবারের বাড়ি রোলায়েদ (Rolighed) হাউজে বাস করছিলেন। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ডেনমার্কের যুবরাজ ফ্রেডারিক তাকে দেখতে আসেন। দুর্বল শরীর নিয়েই ১৮৭৩ এ অ্যান্ডারসেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড আর ইতালি পাড়ি দেন। কিন্তু তার অসুস্থতা তাকে ছেড়ে যায়নি, শরীরও আর এত ধকল সইতে পারছিল না।
১৮৭৫ সালের ৪ আগস্ট জীবনাবসান হয় কিংবদন্তীতুল্য এই লেখকের। তিনি ছিলেন চিরকুমার। কোপেনহেগেন ক্যাথেড্রালে তার শেষকৃত্য হয়। তাকে কবর দেয়া হয় অ্যাসিস্টেন্স গোরস্থানে, জোনাস কলিন্সের ছেলে এলভাটের (Edvard Collin) পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি করা বিশেষ কবরে। পরবর্তীতে জন্মস্থান অডেন্স শহরে তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় মিউজিয়াম, যা ডেনমার্কে ঘুরতে আসা অনেক পর্যটকের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় থাকে।
প্রভাব
অ্যান্ডারসেনের লেখা আজও মানুষকে আনন্দ বিলিয়ে যাচ্ছে। তার রচনার মধ্যে ছেলেবুড়ো সবার জন্যই কিছু না কিছু তিনি রেখে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা একমত যে অ্যান্ডারসেনের রূপকথার তাৎপর্য আরও গভীরে নিহিত, মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় গল্পের পরতে পরতে লেখক প্রচ্ছন্নভাবে ছড়িয়ে রেখেছেন পাঠকের চিন্তার খোরাক। তার লেখা বহু লেখককেই প্রভাবিত করেছে, চার্লস ডিকেন্স তাদের একজন। ওয়াল্ট ডিজনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন অ্যান্ডারসেন তার কাছে এক প্রেরণার নাম। অ্যান্ডারসেনের অনেক গল্পই ডিজনি চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন।
কাগজের শিল্পী অ্যান্ডারসেন
অ্যান্ডারসেনের লেখালেখির আড়ালে আরেক প্রতিভা চাপা পড়ে গেছে। তিনি কাগজ কেটে নানারকম আকার-আকৃতি তৈরি করতে পারতেন। এই কাজ করতে করতে তিনি মাঝে মাঝেই উপস্থিত দর্শকদের গল্প বলতে থাকতেন, যার শেষ হত অ্যান্ডারসেনের কাজ প্রদর্শনের মাধ্যমে। আজও তার এরকম প্রায় এক হাজার কাজ টিকে আছে।