Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রকৃতির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ফিবোনাচ্চি ক্রম ও তার উদ্ভাবকের গল্প

মনে করুন, একটি ঘরে এক জোড়া খরগোশ আছে। এই খরগোশ জোড়া প্রতি মাসে নতুন এক জোড়া খরগোশের জন্ম দিতে পারে। নতুন জন্ম নেয়া প্রতি জোড়া খরগোশই আবার জন্মের দ্বিতীয় মাস থেকে এক জোড়া করে খরগোশের জন্ম দেয়। তাহলে বলুন দেখি, এরূপ বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বছর শেষে কত জোড়া খরগোশ জন্ম নেবে? মাথা চুলকে লাভ নেই, অত গভীর চিন্তাভাবনারও দরকার নেই। এই জটিল হিসেবের সহজ সমাধান হচ্ছে ‘ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স’ বা ফিবোনাচ্চি ক্রম।

খরগোশের অংকের সমাধান; source: mathscareers.org

ফিবোনাচ্চি সংখ্যার ক্রমে, পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যাকে যোগ করে পরবর্তী সংখ্যা পাওয়া যায়। গণিতে এই সংখ্যাক্রমের বিবিধ ব্যবহার তো রয়েছেই, পাশাপাশি প্রকৃতিতে ফিবোনাচ্চি ক্রম বিরাজ করছে বিস্ময়করভাবে। সূর্যমুখী ফুল, পাইনশঙ্কুর মঞ্জরি কিংবা আনারসের শল্কতে খুঁজে পাওয়া যায় ফিবোনাচ্চি ক্রম। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, গোল্ডেন রেশিওর (গোল্ডেন রেশিওর মান = ১.৬১৮০৩৩…, যা ফাই φ চিহ্ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়) সাথে একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এই ফিবোনাচ্চি ক্রমের। গোল্ডেন রেশিও কী সেটা জানেন তো?

প্রকৃতিতে ফিবোনাচ্চি ক্রমের উদাহরণ; source: sciencevibe.com

একটি সরলরেখাকে এমনভাবে ভাগ করুন যেন, এক অংশের চেয়ে আরেক অংশের দৈর্ঘ্য বড় হয়। এবং বড় অংশকে ছোট অংশ দ্বারা ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যাবে, পুরো সরলরেখার দৈর্ঘ্যকে বড় অংশের দৈর্ঘ্য দ্বারা ভাগ করলেও একই অনুপাত পাওয়া যাবে! এই বিস্ময়কর অনুপাতটিই হচ্ছে গোল্ডেন রেশিও। মজার ব্যাপার হলো, ফিবোনাচ্চি ক্রমের পাশাপাশি দুটি সংখ্যার বড়টিকে ছোটটি দ্বারা ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যায়, তা গোল্ডেন রেশিওর খুব কাছাকাছি। বিষয়টি আরো মজাদার হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় যে, ক্রমের যত বড় সংখ্যার অনুপাত নির্ণয় করা যায়, অনুপাত ততই গোল্ডেন রেশিওর দিকে এগোয়!

গোল্ডেন রেশিও; source: gizemligercekler.com

এই বিস্ময়কর সংখ্যাক্রম আবিষ্কার করেছেন যিনি, তার নাম ফিবোনাচ্চি। তাকে নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। মধ্যযুগে, ১১৭০-১১৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইতালির পিসা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে যা জানলে আপনি অবাক হবেন, তা হলো এই যে, ফিবোনাচ্চির নাম আসলে ফিবোনাচ্চিই নয়! তার বাবা গুগলিয়েলমো বোনাচ্চি তার নাম রেখেছিলেন লিওনার্দো বোনাচ্চি। তিনি জীবিত থাকতেই পরিচিত হন ‘লিওনার্দো অব পিসা’ নামে। ফিবোনাচ্চির উৎপত্তি কীভাবে এবং কখন হয়েছিল তা জানা যায় না। অন্তত, তিনি জীবিত থাকতে তাকে কেউ ‘ফিবোনাচ্চি’ বলে ডাকেনি! তথাপি, আধুনিককালে তিনি ফিবোনাচ্চি নামেই সমধিক পরিচিত।

ভূমধ্যসাগরীয় বুজিয়া শহরে পড়ালেখা করেন ফিবোনাচ্চি। বাল্যকালেই গণিতের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সংখ্যা নিয়ে খেলতে অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি। তিনি পুলকিত হয়েছিলেন যখন জানতে পারেন যে, আরব গণিতবিদরা ঝামেলাপূর্ণ রোমান সংখ্যা ব্যবহার করে না। রোমান সংখ্যায় শূন্যের অনুপস্থিতি এবং বড় সংখ্যা লেখার জন্য অধিক পরিমাণ অঙ্ক ব্যবহার করতে হতো বলে, বড় গুণ-ভাগের হিসাবে জটিলতা সৃষ্টি হতো। আর গ্রিকদের ক্ষেত্রে তো তা আরো জটিল। গ্রিক গণিত বেশ উন্নত হলেও তা একটা নির্দিষ্ট জায়াগায় আটকে ছিল এর সংখ্যা পদ্ধতির জন্যই। কারণ, গ্রিক সংখ্যা গ্রিক বর্ণমালা দ্বারাই লেখা হতো। ভাবুন তো একবার, ৫ × ৬ = ৩০, এই সহজ হিসাবটাকে যখন ঙ × চ (ঙ বর্ণমালার পঞ্চম বর্ণ এবং চ ষষ্ঠ বর্ণ) আকারে লেখা হবে তখন উত্তর কি দেবেন?

গ্রিক বর্ণমালা এবং সংখ্যা পদ্ধতি; source: omniglot.com

বুজিয়াতে ফিবোনাচ্চি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, আরবরা যে সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করে, তা গ্রিক বা রোমানদের চেয়ে বেশ উন্নত। তিনি নতুন সংখ্যাপদ্ধতির মাঝে ডুব দিলেন এবং আরো বিস্তারিত জানতে শুরু করলেন দীর্ঘ এক ভ্রমণ। মিশর থেকে শুরু করে গ্রিস, সিসিলি, ফ্রান্স হয়ে সিরিয়ায় শেষ হয় তার এই ভ্রমণ। ভারতবর্ষে না গিয়েও, সিরিয়াতেই তিনি খোঁজ পান ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতির। ০-৯ পর্যন্ত অঙ্কবিশিষ্ট এই সংখ্যাপদ্ধতির প্রেমে পড়ে যান ফিবোনাচ্চি। এই সংখ্যাপদ্ধতিকে তিনি ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে নিয়ে আসেন। তিনিই প্রথম ইউরোপে, ঝামেলাপূর্ণ রোমান সংখ্যাপদ্ধতি, আধুনিক সংখ্যাপদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন।

 “আমি এই বইয়ের তথ্যগুলো জড়ো করেছি ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতি এবং ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সাথে যথাসম্ভব আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনা যোগ করে।”

– নিজের বই ‘দ্য বুক অব ক্যালকুলেশন’ সম্বন্ধে ফিবোনাচ্চি

১২০২ সালে ফিবোনাচ্চি তার অসাধারণ কাজ ‘লাইবার অ্যাবাচি’ বা ‘দ্য বুক অব ক্যালকুলেশন’ প্রকাশ করেন। ১২২৮ সালে তিনি এই বইয়ের পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই বইয়ের মাধ্যমেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতির পরিচয় করিয়ে দেন ফিবোনাচ্চি। তিনি বইয়ে যথার্থ যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করেন যে, ইউরোপীয়রা যদি রোমান সংখ্যাপদ্ধতির সাথে লেগে থাকে তাহলে গণিত কোনোদিনই এগোতে পারবে না। এই বইয়ে তিনি দেখান, কীভাবে গণিত, বাণিজ্যিক হিসাব, অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলো নতুন সংখ্যাপদ্ধতি দিয়ে সহজে সমাধান করা সম্ভব।

ফিবোনাচ্চি ক্রম; source: mike.works

যদিও ফিবোনাচ্চির বইটি সংখ্যাপদ্ধতির আধুনিকায়নের প্রারম্ভিক কাজটা করে দেয়, তথাপি তা সহজে মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। ধীরে ধীরে এর অগ্রগতি হতে থাকে। তবে অগ্রগতির গতি বাড়াতে দুটি ঘটনা প্রভাবকে মতো কাজ করে। প্রথমত, গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কার। দ্বিতীয়ত, কনস্টান্টিনোপোলের পতন। এই ঐতিহাসিক শহরের পতনের ফলে সেখানকার অসংখ্য মানুষ শরণার্থী হয়ে ইতালিতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীরা তাদের সাথে অনেক পুরনো গ্রিক বই ও পুঁথি নিয়ে যায় ইতালিতে, যেগুলো কনস্টান্টিনোপোলে দীর্ঘদিন আটকে ছিল। এই মহামূল্যবান গ্রিক বইগুলোই ইতালিতে রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখে।

প্রাথমিকভাবে নতুন সংখ্যাপদ্ধতি কেবল বিজ্ঞানী এবং গণিতজ্ঞরা গ্রহণ করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পুরাতন পদ্ধতিই চলছিল। তবে ফিবোনাচ্চি তার বইয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে লাভ-ক্ষতি হিসাবের ক্ষেত্রে নতুন সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহারের সুবিধা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। নতুন সংখ্যাপদ্ধতি ছাড়াও তিনি এই বইয়ে নতুন পদ্ধতিতে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, দশমিক, দ্বিঘাত সমীকরণ, বীজগণিতের নিয়মাবলী, বহুপদী, অনুপাতসহ গণিতের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেন। বইটিতে আলোচিত বীজগণিত ছিল প্রবলভাবে মূসা আল খারিজমি প্রভাবিত।

ফিবোনাচ্চির লাইবার অ্যাবাচির একটি পৃষ্ঠা; source: fibonicci.com

ফিবোনাচ্চির অধিকাংশ কাজেরই আদি উৎস হচ্ছে গ্রিক, আরব এবং ভারতীয়। এজন্য অনেকে মনে করে থাকেন, তার কাজগুলো শুধুই অনুকরণ। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। ফিবোনাচ্চি একজন অসাধারণ গণিতবিদ ছিলেন। প্রাচীন যে সব উৎস থেকে তিনি তথ্য নিয়েছেন, সেগুলোর সাথে তার নিজের মৌলিক জ্ঞান যোগ করার ফলেই তার কাজগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আর সেজন্যই তার খ্যাতি পৌঁছে যায় রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের কাছেও। সে সময় ফ্রেডরিকের গণিতবিদরা কিছু গাণিতিক সমস্যার সমাধানে ভজকট পাকিয়ে ফেলছিলেন। ফ্রেডরিক তাই ফিবোনাচ্চিকে ডেকে পাঠান এবং সেগুলো সমাধানের আহ্বান জানান। ফিবোনাচ্চি সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং ১২২৫ সালে সেই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে তার বই ‘ফ্লোস’ (ফ্লাওয়ার) প্রকাশ করেন।

ফিবোনাচ্চি ফর্মূলা; source: jwilson.coe.uga.edu

ফিবোনাচ্চির জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজই ছিল তার বই ‘লাইবার অ্যাবাচি’ বা ‘বুক অব ক্যালকুলেশন’। যদিও এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমা বিশ্বে রোমান সংখ্যাপদ্ধতিকে ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা, তথাপি এটি একটি উন্নত গণিতের বই। এছাড়াও তিনি বিশুদ্ধ গণিত নিয়েও বেশ কিছু বই লিখেছেন। সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া যাক।

  • প্যাট্রিশিয়া জিওম্যাত্রি- প্র্যাকটিক্যাল জিওমেট্রি
  • ইপিস্টোলা ডি ম্যাজিস্ট্রাম থিওডোরাম- অ্যা লেটার টু মাস্টার থিওডোর
  • ফ্লোস- ফ্লাওয়ার
  • লাইবার কোয়াড্রেট্রাম- দ্য বুক অব স্কয়ারস
  • ডি মাইনর গাইজা- আ স্মলার ম্যানার
  • কমেন্ট্রি অন বুক ইলেভেন অব ইউক্লিড’স এলিমেন্টস

ফিবোনাচ্চি (১১৭০- ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ); source: jwilson.coe.uga.edu

মধ্যযুগের আরো অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতের মতো ফিবোনাচ্চির ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধেও খুব বেশি জানা যায় না। তার পারিবারিক জীবন এবং দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধেও সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। এমনকি তিনি কবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তা-ও সুনিশ্চিতভাবে জানা নেই আমাদের। আমরা শুধু এতটুকুই জানি যে, এই মহান গণিতবিদ ১২৪০ খ্রিস্টাব্দেও জীবিত ছিলেন। তারপর তার সম্পর্কিত আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সেজন্য ধরে নেয়া হয়েছে, ১২৪০ খ্রিস্টাব্দেই তার জীবনাবসান হয়েছে।

ফিচার ছবি: gohighbrow.com

Related Articles