“বোর্হেসের প্রভাব এড়িয়ে লাতিন আমেরিকায় লিখছেন, এরকম একজন লেখকও নেই।”
সাহিত্যিক কাব্রেবা ইনফান্তে কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বলেছিলেন কথাটি। কারণ, স্প্যানিশ সাহিত্যে দোন কিহোতের লেখক সের্বান্তেসের পর আর কেউ বোর্হেসের মতো বিপুল মৌলিকতা নিয়ে সামনে হাজির হননি। বস্তুত শুধু স্প্যানিশ সাহিত্যে নয়; গোটা বিশ্ব-সাহিত্যেই বোর্হেস নতুন বার্তা এনে দিয়েছেন। তার শাণিত চিন্তা ও শিল্পকৌশলের জাদু প্রভাবিত করেছিল সমালোচকদেরকেও। জার্মানির ফ্রানৎস কাফকা যেভাবে পরবর্তী অজস্র সাহিত্যিকের অদৃশ্য উস্তাদে পরিণত হয়েছেন; বোর্হেসের অবস্থানও অনেকটা তেমন।
হোর্হে লুইস বোর্হেস
হোর্হে লুইস বোর্হেসের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ আগস্ট। আর্জেন্টিনায় বুয়েনস আইরেসের পালেরমো জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা হোর্হে গিইয়ের্মো বোর্হেস ছিলেন আইনজীবী এবং স্পেনসারপন্থী দার্শনিক। অন্যদিকে মা লেওনোর আসেবেদো দে বোর্হেস ছিলেন আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে বংশদ্ভূত ধর্মপ্রাণ ক্যাথোলিক। ছোট বোন নোরা জন্ম নেয় ১৯০১ সালে। দাদী ইংরেজ হবার কারণে খুব ছোট থেকেই ইংরেজি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করেন বোর্হেস।
উত্তরাধিকার হিসেবে পান পিতার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে অসীম অধিকার। কয়েক হাজার বইয়ের মাঝে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, মার্ক টোয়েন ও ম্যারিয়াটের বইগুলো, বার্টনের ‘এ থাউজ্যান্ড নাইট এণ্ড ওয়ান নাইট’সহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু বই অন্তর্ভূক্ত ছিলো। বোর্হেস সেই জ্ঞানের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পেরেছেন শৈশব থেকেই। পরিবারে ঐতিহ্যগতভাবেই চলে আসছিলো সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। তার নিজের বক্তব্য থেকেই উদ্ধৃত করা যাক-
“আমার বাবার পরিবারে সাহিত্যের ঐতিহ্য প্রবাহমান ছিল। তাঁর বড় চাচা হুয়ান ক্রিসোসতোমো লাফিনুর ছিলেন আর্জেন্টিনার প্রথম দিকের কবিদের একজন। ১৮২০ সালে তার বন্ধু জেনারেল মানুয়েল বেলগ্রানোর মৃত্যুতে একটি শোকগাথা লিখেছিলেন। আমার বাবার এক কুটুম ভাই আলবারো মেলিয়ান লাফিনুরকে আমি শৈশব থেকেই চিনতাম। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় এক গৌণ কবি। পরে আর্জেন্টিনার একাডেমি অব লেটার্সে যোগ দেন। বাবার নানা এডওয়ার্ড ইয়ং হাশলাম আর্জেন্টিনায় প্রথম দিককার ইংরেজি পত্রিকাগুলোর একটি ‘সাউদার্ন ক্রস’ সম্পাদনা করেছেন। ঠিক মনে নেই, তিনি হাইডেলবার্গের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি বা ডক্টর অব লেটার্স করেছিলেন।” (আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৩১)
বোর্হেসের লেখার হাতেখড়ি ৬-৭ বছর বয়সে। যাত্রার শুরুটা ছিল মূলত ক্ল্যাসিক স্প্যানিশ সাহিত্যকে অনুকরণের প্রচেষ্টা মাত্র। তার প্রমাণ প্রথম লেখা পুরোনো রোমান্স ধাঁচের গল্প ‘লা বিসেরা ফাতাল’ (দ্য ফাটাল হ্যালমেট)। নয় বছর বয়সেই বুয়েন্স আইরেসের দৈনিক পত্রিকা এল পাইস-এ প্রকাশিত হয় অস্কার ওয়াইল্ডের ‘হ্যাপি প্রিন্স’-এর স্প্যানিশ অনুবাদ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু তখনো ঘটেনি। বিশেষ করে পিতা নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক ধারণার অনুসারী হবার কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক যাবতীয় উদ্যোগে আস্থাহীন ছিলেন। অবশ্য দেরিতে হলেও টমাস স্ট্রিটের এক স্কুলে যাওয়া শুরু করেন।
ইউরোপ জীবন
১৯১৪ সালের দিকে সপরিবারে বোর্হেসের পরিবার রওনা দেন ইউরোপে। ইতোমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কয়েক সপ্তাহ প্যারিসে কাটিয়ে থিতু হন সুইটজারল্যান্ডের জেনেভাতে। সেখানে জন ক্যালভিনের প্রতিষ্ঠিত কলেজ অব জেনেভাতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়াশোনা শুরু হয়। ব্যক্তিগত পড়াশোনা চলতো ইংরেজিতে, বাসায় ব্যবহৃত হতো স্প্যানিশ, স্কুলের জন্য শেখা হয়ে ফরাসি এবং লাতিন, আবার সবকিছুর বাইরে নিজের উদ্যোগে রপ্ত করেন জার্মান। এভাবে কেবল ভাষা শিক্ষার ভেতরেই সমাপ্ত থাকলো না পথচলা; সে ভাষার সাহিত্য ও দার্শনিক রচনাবলিও গিলতে থাকলেন গোগ্রাসে।
১৯১৭ সালের ঘটনা। বোর্হেস আস্তে আস্তে আগ্রহী হয়ে উঠলেন জার্মান এক্সপ্রেশনিজমে। ইমেজিজম, ক্যুবিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজম প্রভৃতির মতো সমকালীন অন্যসব মতবাদের চেয়ে এক্সপ্রেশনিজম তার কাছে পৃথক রূপ নিয়ে ধরা দেয়। এজন্য কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মান কয়েকজন এক্সপ্রেশনিস্ট কবির কবিতা স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেন তিনি।
১৯১৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন জেনেভায়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্পেনের বেশ কিছু শহরে সপরিবারে ভ্রমণ করেন। ১৯১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেবিইয়াতে ‘গ্রেসিয়া’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ‘সমুদ্রের জন্য প্রস্তুতি’। এখানেও নতুন সংস্কৃতি ও চিন্তাদর্শনের প্রভাব তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারি করে। কান্সিনোসের মতো বন্ধুদের সাথে যুক্ত হয়ে ‘উলত্রাইসমো’ সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেন। পুরোনো স্থবিরতা থেকে বের হয়ে আধুনিক সাহিত্য গড়ে তোলার চেতনা। স্পেনে তার লেখা বই ছিলো দুটি। ‘লোস নাইপেস দেল তাউর’ নামে সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং ‘দি রেড রিদমস্’- কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু দুটি গ্রন্থই স্পেন ত্যাগের আগেই নষ্ট করে ফেলেন। খুব সম্ভবত বোর্হেস জীবনের আরো গভীর অনুভূতির খোঁজ করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন আরো বড় কিছুর।
ফিরে দেখা বুয়েনস আইরেস
১৯২১ সালের মার্চ মাস। ‘রেইনা ভিক্তোরিয়া এউহেনিয়া’ জাহাজে চেপে বুয়েনস আইরেস ফিরে এলেন বোর্হেস। মনের ভেতরে তখন জেনেভা, জুরিখ, নিমস, কর্ডোবা এবং লিসবনের অজস্র স্মৃতি। সম্পূর্ণ নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন চিরচেনা মাতৃভূমিকে। আর সেই মুগ্ধতা ও আবেদন পরিণত হলো কবিতায়। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হলো প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফের্বোর দে বুয়েন্স আইরেস’। স্পেনে যে ‘উলত্রাইজম’ সাহিত্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তা এখানে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তবে আস্তে আস্তে নিজস্বতা ও মৌলিকতা নিয়ে সামনে আসেন বোর্হেস। এজন্য তাকে আর্জেন্টাইন উলত্রাইজমের জনক বলা হয়। এই ঘরানার কবিতা ‘প্লেইননেস’-এর কয়েকটি লাইন নিম্নরূপ-
“বহুবার উল্টানো বইয়ের পৃষ্ঠার মতো অনায়াসে খুলে যায়
বাগানের গ্রিল করা গেটখানি।
আর একবার ভেতরে ঢুকে গেলে কী-ই বা প্রয়োজন
সে সকল দৃশ্য ঘুরে দেখার; যা সবই চেনা আর স্মৃতিতে গ্রন্থিত?
(বোর্হেসের আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৪৯)
তার উপস্থাপনার ভঙ্গিও ছিল অসাধারণ। বন্দুক কাঁধের লোককে ভেবেছি ট্রলি কার, সূর্যোদয়ের মধ্যে দেখেছি চিৎকার, দেখেছি সূর্যাস্তকে পশ্চিমে ক্রুশবিদ্ধ হতে– প্রভৃতির মতো দিনকে দিন পরিণত হতে থাকে তার প্রকাশ শক্তি। ইতোমধ্যে পরিচয় ঘটেছে সাহিত্যগুরু মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের সাথে; যার প্রভাব তাকে অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত করে তুলেছে।
তারুণ্যের উদ্যম
১৯২১ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়টা ছিল স্বর্ণ ফলানোর। চারটি প্রবন্ধ এবং তিনটি কবিতার বই রচনা ও প্রকাশ করেন এই সময়ে। পাশাপাশি বের করেন তিনটি ম্যাগাজিন। তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লা প্রেন্সা, নোসোত্রোস, ইনিসিয়াল, ক্রিতেরিও এবং সিন্থেসিস প্রভৃতির জন্য প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘লুনা দে এনফ্রেন্তে’ নামে দ্বিতীয় কাব্য সংকলনটি একেবারে স্থানিক রূপ-রস-গন্ধে ভরা। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটির শিরোনাম ‘কুয়াদের্নো সান মার্তিন’; যা আর্জেন্টিনায় বেশ সাড়া ফেলে দেয়। পরবর্তীতে অবশ্য নানা বিয়োজন ও সংশোধন করে আরো পরিপক্ব রূপ দেয়া হয়েছে। ১৯২৯ সালে বোর্হেসের তৃতীয় প্রবন্ধ সংকলন দ্বিতীয় মিউনিসিপ্যাল পুরস্কারে ভূষিত হয়; যার মূল্যমান ছিল তিন হাজার পেসো। নেহায়েত কম না; এক সেট এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা কেনার পরেও এক বছর নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং মাত্র দুটি সংখ্যা টিকে থাকা ‘প্রিজম’ ছিল বোর্হেসের সম্পাদনায় প্রথম ম্যাগাজিন। বন্ধুদের সাথে ‘উলত্রাইজম’ আন্দোলন তখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তায় ঝোলানো বিল বিলবোর্ড দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুরূপ পদ্ধতিতে দেয়াল ম্যাগাজিন বের করা হয়। এক খণ্ড বড় কাগজে আন্দোলনের ইশতেহার, সাত-আটটা ছোট কবিতা এবং ফাঁকা স্থানে কাঠখোদাই চিত্র। মাইলের পর মাইল আঠাভর্তি বালতি আর ব্রাশ হাতে ঘুরে দেয়ালে লাগাতে হয়েছে। পরিণামও বৃথা যায়নি। সেই দেয়াল লেখা দেখে ‘নোসোত্রোস’ ম্যাগাজিনের আলফ্রেদো বিয়াঞ্চি তাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিনের পাতায় একগুচ্ছ উলত্রাইস্ত রচনা লেখার আহবান জানান। মাত্র চারটি সংখ্যা বের হবার পর বন্ধ হয়ে যায় প্রোআ; দ্বিতীয় দফায় বের হয় ১৯২৪ সালে।
১৯২৪ সালের দিকে বোর্হেসের জীবন পর্যালোচনা করলে অন্তত দুটো সাহিত্য গোষ্ঠীর সাথে তার পরিচয়ের আভাস মেলে। রিকার্ডো গুইরালদেসদের ধারা আর ‘মার্তিন ফিয়েররো’ ম্যাগাজিনের ধারা। প্রথমটি বোর্হেসকে উল্লসিত করলেও দ্বিতীয়টি তাকে দিতো অনুশোচনা। আস্তে আস্তে দুটি ধারায় রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। তবে বন্ধুত্ব আর আদর্শিক উত্তেজনায় তারুণ্যই বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে। এসেছিল একপাক্ষিক না হয়ে উপর থেকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা।
পরিণত এক পুরোধা
লম্বা সময় খাটিয়ে বোর্হেস ছদ্মনামে ‘ওমব্রে দে লা এসকিনো রোসাদা’ ছোট গল্পটি লেখেন। পাঠক মহলে অভাবিত সাড়া ফেললেও নিজে তাকে গ্রহণ করেছিলেন অপরিপক্ব সৃষ্টি বলেই। পেশাদার গল্প লেখক হিসেবে তার আবির্ভাব ১৯৩৩ ও ১৯৩৪ সালে। ‘ক্রিটিকা’ পত্রিকায় কলামের তাগিদে লেখা টুকরো টুকরো আখ্যান পরে একগুচ্ছ গল্প হিসেবে ‘ইস্তোরিয়া উনিবের্সাল দে লা ইনফামিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ সালে লেখা হয় গল্প ‘দি অ্যাপ্রোচ দু আল মুতাসিম’, যা কিপলিং এবং মধ্যযুগের মুসলিম সুফি ফরিদ উদ্দিন আত্তারের থেকে প্রভাবিত। ১৯৪২ সালে বাস্তবিকভাবেই তার প্রথম ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয় ‘এল হার্দিন দে লোস সেন্দেরোস কে সে বিফুর্কান’ নামে। সেখানে ঠাঁই পায় ‘দি অ্যাপ্রোচ টু আল মুতাসিম’। আলাদাভাবে প্রকাশিত না হলেও বোর্হেসের মতে,
“আমার মনে হয় পরবর্তীতে লেখা গল্পগুলো যা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল; তাদের পূর্বমেঘ লক্ষিত হয়েছে ‘দি অ্যাপ্রোচ টু আল মুতাসিম’ গল্পে। এমনকি পরবর্তী গল্পগুলোর ধরনও ঠিক করে দিয়েছিল, যে গল্পগুলোর জন্য গল্পকথক বলে আমার খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত।” (আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা- ৬৩)
১৯৩৭ সাল থেকেই পূর্ণকালীন চাকরিতে আত্মনিয়োগ করেন বোর্হেস। ক্রিটিকা ছাড়াও এল ওগার, উর্বে পত্রিকার সাথে জড়িয়ে যান। বন্ধুদের মাধ্যমে মিউনিসিপাল লাইব্রেরির মিগেল কানে শাখার সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে চাকরিও জুটিয়ে নেন আর্থিক বিষয়টা মাথায় রেখে। প্রায় নয় বছর লাইব্রেরিতে কাটানোটা সবার জন্যই বিরক্তিকর। তবে একটা মজার গল্প বর্ণনা করেছেন বোর্হেস নিজে,
“এক সহকর্মী একবার বিশ্বকোষে জনৈক হোর্হে লুইস বোর্হেসের নাম পেলেন। খোঁজাখুঁজি করে দেখতে পেলেন ঐ ব্যক্তির নাম ও জন্ম তারিখের সাথে আমার নাম ও জন্ম তারিখ হুবহু মিলে যাচ্ছে। ভদ্রলোক ভাবনায় পড়ে গেলেন।” (আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা- ৬৫)
১৯৩৮ সালে ক্রিসমাসের আগের দিন সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ওঠার সময় মারাত্মকভাবে মাথায় আহত হন। প্রথমে মারাত্মক জ্বর এবং তারপর সেপ্টিসিমিয়া। মাসখানেক যুদ্ধ হলো মৃত্যুর সাথে। পুরো ঘটনাটা পরে ‘দি সাউথ’ গল্পে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে বেশ লম্বা সময় কোনো কিছু লিখতে পারলেন না। অবশেষে ‘পিরের মেনার্দ, দোন কিহোতের লেখক’ গল্পের মধ্য দিয়ে বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটলো। সেই উদ্দীপনাতেই লিখে ফেলেন ‘তলন, আকবার, অর্বিস, টের্টিয়াস’ এবং ‘দি লাইব্রেরি অব বাবেল’। দি লটারি ইন ব্যাবিলন, ডেথ এন্ড দি কম্পাস এবং দি সার্কুলার রুইনস গল্পগুলো শুরু করা হয়েছিল লাইব্রেরিতে চাকরি থাকাকালেই। সেগুলো ঘষামাজা করে ১৯৪৪ সালে পরিবর্ধন করা হয় আগের বইটি। নতুনভাবে প্রকাশিত হয় ফিক্সিওনেস নামে। বোর্হেসের সিদ্ধান্ত-
“ফিক্সিওনেস এবং এল আলেফ সম্ভবত আমার সেরা দুটি গ্রন্থ।”
এক বন্ধুর মাধ্যমে ‘আসোসিয়অসিওন আর্জেন্টিনা দে কুলতুরা ইংলেসা’তে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বোর্হেস। সেই সাথে আমন্ত্রণ এলো ‘কোলেহিও লিব্রে দে এস্তুদিওস সুপেরিওরেস’-এ ক্লাসিক আমেরিকান সাহিত্যে ক্লাস নেবার জন্য। আস্তে আস্তে আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের বিভিন্ন শহরে গিয়ে সুইডেনবার্গ, ব্লেইক, ফার্সি ও চীনা মরমী লেখকগণ, বুদ্ধের মতবাদ, গাউচো কবিতা, মার্টিন বুবের, কাবালা, আরব্য রজনী, দান্তে এবং সার্ভেন্তেসের উপর বক্তৃতা দেয়া হলো। বন্ধুত্ব হলো অন্যতম সাহিত্যগুরু আদোলফো বিওই কাসারেস এবং শক্তিমান লেখক ওনোরিয়ো বুস্তোস দুমেকের সাথে। যৌথভাবে কাজও হলো বেশ কিছু। জীবন এখন যুৎসই না কেবল; উপভোগ্যও।
বিপ্লব এবং অন্যান্য
আর্জেন্টাইন সোসাইটি অফ রাইটার্সের সভাপতি নির্বাচিত হন বোর্হেস ১৯৫০ সালে। কিন্তু লেখকদের সংঘের উপর চোখ পড়লো পেরোনের। বিশেষ করে একনায়কতন্ত্র বিরোধী মনোভাবের দরুণ। সংঘকে বন্ধ করে দেয়া হলো। বোর্হেসের বৃদ্ধ মা ছিলেন গৃহবন্দি আর বোন-ভাগ্নে জেলবাস করলেন একমাস। নিজেও ছুটে বেরিয়েছেন গোয়েন্দাদের নজরবন্দি হয়ে। ১৯৫৫ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পেরোনের পতন ঘটার পরেই কেবল মুক্ত হলেন। নতুন উদ্যমে ফের গঠিত হয় লেখক সংঘ। বোর্হেসকে করা হয় ন্যাশনাল লাইব্রেরির পরিচালক। কিন্তু চমকের বাকি এখনো অনেক। পরের বছরই নিয়োগ দেয়া হলো বুয়েন্স আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও আমেরিকান সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। টিকে ছিলেন পরবর্তী বারো বছরের জন্য।
সবকিছুর পরেও নিয়তিকে অতিক্রম করা যায় না। অন্ধত্ব ছিলো বোর্হেসের পারিবারিক সমস্যা। ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৫০-এর দশকের মধ্যে আটবার বোর্হেসের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ‘পোয়েম অব দ্য গিফটস্’ লেখার সময় তিনি চোখে কিছুই দেখতে পাননি। বস্তুত এই অন্ধত্বই বোর্হেসকে আবার কবিতার জগতে ফিরিয়ে আনলো। স্মৃতিতে ভর করেই লিখতে থাকলেন সনেট এবং অন্যান্য ঘরানার পদ্য। কবিতার বিষয়বস্তুও বিচিত্র- এমার্সন ও মদ, আমার মাতামহের মৃত্যু ও রাজা প্রথম চার্লসের শিরচ্ছেদ প্রভৃতি। পুরোনো বেশি কিছু লেখা গুছিয়ে প্রকাশ করেন ‘এল আসেদোর’ গ্রন্থটি। বোর্হেসের মতে, এই লেখাটা তার জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি
১৯৫০ এর দশকেই নেস্তোর ইবাররা এবং রজার কাইওয়া ফরাসিতে অনুবাদ করলেন বোর্হেসের লেখা। ১৯৬১ সালে স্যামুয়েল বেকেটের সাথে যৌথভাবে লাভ করেন ফোর্মেন্তোর পুরস্কার। ফলে রাতারাতি পাশ্চাত্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো বোর্হেসের নাম। একই বছর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে। আমেরিকাতে যাওয়াটা তার জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় দফায় ১৯৬৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস এলিয়ট নর্টন চেয়ার অব পোয়েট্রি করা হলো। ক্যামব্রিজসহ গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ালেন বিভিন্ন বক্তৃতার জন্য। ১৯৬৯ সালে নভেম্বরে তৃতীয়বারের মতো যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ইসরাইলি সরকারের নিমন্ত্রণে তেল আবিব ও জেরুজালেমেও সফর করেন।
বয়স একাত্তর পার হয়ে যাচ্ছে। বের করলেন নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘এলোহিও দে লা সোমব্রা’। সেখানে অন্ধকারকে দেখানো হয়েছে অন্ধত্ব এবং মৃত্যু উভয় হিসেবেই। ১৯৭১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনারারি ডিগ্রি এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনরিস কাউসা প্রদান করা হয় বোর্হেসকে। পান সিনসিনাতি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও অনারিস কাউসা এবং অর্দেন দে বের্নার্দো অহিগিস তকমা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বোর্হেস তখন বিশেষভাবে সম্মানিত। ১৯৭৯ সালে আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে আর্জেন্টিনার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। পরের বছর দেয়া হয় স্প্যানিশ সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কার মিগেল দে সের্বান্তেস। ১৯৮৫ সাল অব্দি অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বোর্হেসের বিস্তার চলতে থাকে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনেভার হসপিটাল কান্টোনানতে ভর্তি করানো হয়; কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। অনেক যুদ্ধ করেও ১৪ জুন মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন বোর্হেস।
শেষের আগে
১৯৬৭ সালে বোর্হেস একসময়ের বন্ধু এলসা আসতেতে মিলানকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের সহযোগী মারিয়া কোদামাকে ১৯৮৬ সালে। বিয়েটা মাত্র কয়েক মাস টিকেছিল মৃত্যুর কারণে। কোনো সন্তান ছিলো না তার।
বোর্হেস সারাটা জীবন ধরে অসংখ্য গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতা লিখে গেছেন। শুধু লাতিন আমেরিকায় না; বিশ্বসাহিত্যে স্থাপন করে যান নতুন ভিত্তি; যেখানে কল্পনা ও দর্শন একীভূত হয়ে গেছে। অন্ধত্ব তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি, উল্টো দিয়েছে নতুন পথ। আজ অব্দি বহু সাহিত্যস্রষ্টার অদৃশ্য শিক্ষকের নাম হোর্হে লুইস বোর্হেস।
সাহিত্য জগতের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/