আফগানিস্তানকে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ভৌগলিকভাবে মধ্য এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই মাঝারি আকৃতির রাষ্ট্রটিতে গৃহযুদ্ধ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপ চলছে। এর ফলে বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রটি আর্থ–সামাজিক বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিশেষ কোনো অবকাশ লাভ করেনি। অথচ এর মধ্যেই একজন আফগান নাগরিক মহাশূন্যে গমন করেছেন! তিনি ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র আফগান নভোচারী। এই ব্যক্তিটি হলেন আব্দুল আহাদ মোহমান্দ।
আব্দুল আহাদ মোহমান্দ ১৯৫৯ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের গজনী প্রদেশের আন্দার জেলার সারদেহ বান্দ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। সেসময় আফগানিস্তানের অধিকাংশ জনসাধারণই নিজেদের সন্তানদের জন্মের তারিখ লিপিবদ্ধ করে রাখত না। ফলে সরকারি নথিপত্রে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারিকে মোহমান্দের জন্ম তারিখ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। তার পরিবারটি ছিল জাতিগতভাবে পশতুন এবং ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম। তার পরিবার ছিল পশতুনদের ‘মোহমান্দ’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, এজন্য তার পারিবারিক নাম হচ্ছে মোহমান্দ।
ছোটবেলায় আকাশে বিমান উড়তে দেখে তিনি স্বপ্ন দেখতেন বৈমানিক হওয়ার। কিন্তু তার পরিবারের আর্থ–সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সুযোগ ছিল না। ১৯৭৬ সালে ১৭ বছর বয়সে তিনি কাবুল পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং এক বছর পর ১৯৭৭ সালে সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আফগানিস্তানে সেসময় সকল পুরুষ নাগরিকের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন বাধ্যতামূলক ছিল। এর ফলে ১৯৭৮ সালে মোহমান্দকে আফগান সশস্ত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয় এবং আফগান বিমানবাহিনীতে বৈমানিক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই মোহমান্দের ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মোহমান্দকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আফগান সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রেরণ করা হতো, এবং ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে আফগান কমিউনিস্ট দল ‘পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’ (পিডিপিএ) কর্তৃক দেশটির শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়ার পর এই প্রক্রিয়া আরো বিস্তৃত হয়। মোহমান্দ তিন বছর সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থান করেন এবং প্রথমে ‘ক্রাসনোদার হায়ার এয়ার ফোর্স স্কুল’ ও পরবর্তীতে ‘কিয়েভ হায়ার এয়ার ফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে’ অধ্যয়ন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৮১ সালে তিনি আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আফগান বিমানবাহিনীতে একজন বৈমানিক হিসেবে যোগদান করেন।
এদিকে ১৯৭৫ সাল থেকেই আফগান সরকারের সঙ্গে দেশটির ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব চলছিল, এবং ১৯৭৮ সালে পিডিপিএ কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর এই দ্বন্দ্ব একটি পূর্ণ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। পিডিপিএ কর্তৃক গৃহীত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি আফগান জনসাধারণের একটি বড় অংশের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। তদুপরি, সেসময় চলমান স্নায়ুযুদ্ধে পিডিপিএ সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল, ফলে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন প্রভৃতি সোভিয়েতবিরোধী রাষ্ট্র আফগান মিলিট্যান্টদের ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে শুরু করে। এর ফলে আফগান সরকার ক্রমশ দেশটির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে, এবং অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিকট সহায়তা প্রার্থনা করে।
১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানে প্রবেশ করে, কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর চীনের সমভূমিতে সম্মুখযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বল্পসংখ্যক সোভিয়েত সৈন্য আফগানিস্তানের পার্বত্য ভূমিতে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধরত মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। ফলে তারা দেশটিতে ৯ বছর মেয়াদী এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হয়। মোহমান্দ এসময় আফগান বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিমান হামলা পরিচালনা করেন। তার কৃতিত্বের জন্য তিনি পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে উইং কমান্ডার ও পরবর্তীতে ফ্লাইট নেভিগেটর পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৮৪ সালে তাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রেরণ করা হয়। এসময় তিনি প্রথমে ‘গ্যাগারিন এয়ার ফোর্স অ্যাকাডেমি’তে অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফের অধীনস্থ ‘ভরোশিলভ অ্যাকাডেমি’তে ভর্তি হন। ১৯৮৭ সালে তিনি সেখান থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। এসময় তার পদমর্যাদা ছিল ক্যাপ্টেন।
এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ‘ইন্টারকসমস’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে একজন আফগান নাগরিককে মহাকাশে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য, ‘ইন্টারকসমস’ প্রকল্পটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর নভোচারীদের মহাকাশে প্রেরণের উদ্দেশ্যে গৃহীত একটি সোভিয়েত প্রকল্প। ৪০০ জন আফগান প্রার্থীর মধ্য থেকে মোহমান্দ এবং অপর একজন আফগান বৈমানিককে এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত করা হয়। অপর প্রার্থী ছিলেন আফগান বিমানবাহিনীর কর্নেল মুহাম্মাদ দাওরান গুলাম মাসুম। দাওরান ছিলেন জাতিগতভাবে তাজিক এবং মিগ–২১ যুদ্ধবিমানের চালক। পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি ছিলেন মোহমান্দের সিনিয়র, এবং তার রাজনৈতিক প্রভাবও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিনি অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন, এবং এর ফলে এই প্রকল্পের জন্য শেষ পর্যন্ত মোহমান্দকে বাছাই করা হয়। দাওরানকে অবশ্য ব্যাকআপ টিমে রাখা হয়, যাতে মোহমান্দের টিম ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে আরেকজন আফগানকে মহাকাশে প্রেরণ করা সম্ভব হয়।
বিস্তৃত প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১৯৮৮ সালের ২৯ আগস্ট কমান্ডার ভ্লাদিমির লিয়াখভ, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ভালেরি পলিয়াকভ এবং ক্যাপ্টেন আব্দুল আহাদ মোহমান্দ ‘সয়ুজ টিএম–৬’ রকেটে করে মহাশূন্যে গমন করেন। তারা সোভিয়েত মহাকাশ স্টেশন ‘মির’–এ অবতরণ করেন এবং ৯ দিন সেখানে অবস্থান করেন। মোহমান্দ সেখানে পবিত্র কুরআনের দুইটি কপি ও আফগানিস্তানের জাতীয় পতাকা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম (ও শেষ) বারের মতো আফগানিস্তানের পতাকা মহাশূন্যে পৌঁছে। সেখানে অবস্থানকালে মোহমান্দ মহাকাশ থেকে আফগানিস্তানের প্রচুর ছবি তোলেন এবং বিভিন্ন নভোপদার্থবিদ্যাগত, চিকিৎসাজনিত ও জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা–নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, ইতোঃপূর্বের মহাকাশ অভিযানগুলো চলাকালে বেশ কয়েকটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এবং এজন্য মোহমান্দের পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত তার মা তার নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় আফগান রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ নাজিবুল্লাহ মোহমান্দের মাকে নিজের কার্যালয়ে ডেকে পাঠান এবং তার ছেলে যে নিরাপদ আছে এটি বোঝানোর জন্য মোহমান্দের সঙ্গে একটি অডিও/ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মহাকাশে পশতু ভাষা ব্যবহৃত হয়। অবশেষে ১৯৮৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘সয়ুজ টিএম–৫’ রকেটে চড়ে মোহমান্দ ও লিয়াখভ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন, এবং তদানীন্তন কাজাখ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের ঝেজকাজগানে রকেটটি অবতরণ করেন।
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের ইতিহাসে আব্দুল আহাদ মোহমান্দই প্রথম ও একমাত্র নভোচারী। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত যে অল্প কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তি মহাকাশে গমন করেছেন, তাদের মধ্যে ক্রম অনুযায়ী মোহমান্দ ছিলেন চতুর্থ। একজন আফগান নাগরিককে মহাকাশে প্রেরণের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমগ্র বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল যে, তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশি সহানুভূতিশীল। তদুপরি, আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছিল, এবং একজন আফগান নাগরিককে সোভিয়েত সহায়তায় মহাকাশে প্রেরণের মাধ্যমে এই নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে অপসারণ করাও ছিল মস্কোর উদ্দেশ্য। এর প্রতীকী তাৎপর্য ছিল অপরিসীম, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মিত্র রাষ্ট্র আফগানিস্তানের একজন নাগরিককে মহাশূন্যে প্রেরণ করেছে, কিন্তু আফগানিস্তানের চেয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বেশি শক্তিশালী পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন মিত্র হওয়া সত্ত্বেও মার্কিনিরা কোনো পাকিস্তানি নাগরিককে মহাশূন্যে প্রেরণ করেনি।
মহাশূন্য থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মোহমান্দ রাতারাতি আফগানিস্তানের একজন জাতীয় বীরে পরিণত হন। তার প্রত্যাবর্তনের পরের দিনই অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত সরকার মোহমান্দকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ প্রদান করে। এর পাশাপাশি তারা মোহমান্দকে অত্যন্ত সম্মানসূচক ‘অর্ডার অফ লেনিন’ এবং ‘গোল্ড স্টার’ মেডালে ভূষিত করে। আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তনের পর মোহমান্দ সেখানে বীরোচিত সংবর্ধনা লাভ করেন। আফগান সরকার তাকে আফগানিস্তানের তৎকালীন সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক ‘হিরো অফ দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান’ প্রদান করে। এর পাশাপাশি তিনি আফগান সরকারের ‘অর্ডার অফ দ্য সান অফ ফ্রিডম’ এবং ‘গোল্ড স্টার’ মেডালে ভূষিত হন।
মোহমান্দকে যখন আফগানিস্তান তাদের জাতীয় বীর হিসেবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল, সেসময় আফগান যুদ্ধ ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছিল। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিদ্বয়ের মধ্যেকার উত্তেজনা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে এবং আফগান মিলিট্যান্টদের দমনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন নেতা মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন, এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্যদল আফগানিস্তান ত্যাগ করে। ধারণা করা হচ্ছিল, সোভিয়েত সামরিক সুরক্ষা ছাড়া আফগান সরকার বড়জোর কয়েক মাস টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে আফগান কমিউনিস্ট সরকার আরো তিন বছর টিকে থাকতে সক্ষম হয়।
মোহমান্দ পিডিপিএর একজন সদস্য ছিলেন, এবং আফগান কমিউনিস্ট সরকারের জাতীয় বীর হিসেবে তার ভাগ্য ছিল আফগান সরকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৯১ সালের শেষদিকে মোহমান্দ আফগানিস্তানের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন বিষয়ক উপমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এটি ছিল তার জীবনের শীর্ষ মুহূর্ত, যদিও সকলেরই জানা ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফগান সরকারের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে, এবং তাদের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১৯৯২ সালের এপ্রিলে মোহমান্দ রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে ছিলেন। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন আফগানিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা ‘আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইন্সে’র বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করতে। ভারতে অবস্থানকালেই তিনি জানতে পারেন যে, আফগান সরকারের পতন ঘটেছে এবং আফগান মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই খবর জানার পর তার আর আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তনের কোনো কারণ ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, আফগানিস্তানের নতুন সরকার পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
স্বভাবতই মোহমান্দ সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র রাশিয়ায় আশ্রয় লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেন যে, মাত্র ৪ বছর আগে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর’ খেতাবপ্রাপ্ত এই আফগান আর নতুন রাশিয়ায় স্বাগত নন। তার ভিসার আবেদন রুশ দূতাবাস প্রত্যাখ্যান করে। নিরূপায় হয়ে মোহমান্দ ভরোশিলভ অ্যাকাডেমি থেকে তার অর্জিত ডিপ্লোমার একটি সনদপত্র সংগ্রহ করে দেয়ার জন্য রুশ দূতাবাসের কাছে অনুরোধ করেন, কারণ তার সনদপত্রগুলো আফগানিস্তানে রয়ে গিয়েছিল। রুশ দূতাবাস এককালীন সোভিয়েত বীরের জন্য এইটুকু করতেও অস্বীকৃতি জানায়। রুশদের এই আচরণের কারণ ছিল– তদানীন্তন বোরিস ইয়েলৎসিনের উগ্র পশ্চিমাপন্থী রুশ সরকার প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কিছু থেকে নিজেদের দূরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, এবং মোহমান্দ ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত–সমর্থিত আফগানিস্তানের ‘মাসকট’ স্বরূপ।
বাধ্য হয়ে মোহমান্দ জার্মানিতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং একজন শরণার্থীতে পরিণত হন। সেখানে তিনি একটি ছাপাখানার শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি একটি নিজস্ব ছোট্ট কোম্পানি খুলেছেন, কিন্তু তার পূর্ববর্তী অবস্থানের তুলনায় এটি নিতান্তই নগণ্য। ২০০৩ সালে তিনি জার্মানির নাগরিকত্ব লাভ করেন। বর্তমানে তিনি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ের সঙ্গে বসবাস করছেন। ২০১১ সালে রুশ সরকার মোহমান্দকে ‘মেডাল ফর মেরিট ইন স্পেস এক্সপ্লোরেশন’ প্রদান করেছে। ১৯৯০–এর দশকে পশ্চিমাপন্থী বোরিস ইয়েলৎসিনের সরকার প্রাক্তন এই ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরে’র প্রতি যে অসম্মান প্রদর্শন করেছিল, এই মেডাল প্রদানের মাধ্যমে ভ্লাদিমির পুতিনের নতুন রাশিয়া হয়ত সেটিকে লাঘব করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
২০১৪ সালে মোহমান্দ দীর্ঘ ২২ বছর পর তার মাতৃভূমি আফগানিস্তান সফর করেন। তদানীন্তন আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই মোহমান্দকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান, কিন্তু মোহমান্দ আফগানিস্তানে স্থায়ীভাবে ফিরতে ইচ্ছুক নন। আফগানিস্তানের চলমান অস্থিতিশীলতায় তিনি হতাশ, এবং তার আশঙ্কা যে, আফগানিস্তানে ফিরলে অনেকেই প্রাক্তন কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তার ওপর আক্রমণ চালানো হতে পারে। সামগ্রিকভাবে, আফগানিস্তানের একমাত্র নভোচারী ও এককালীন জাতীয় বীর আব্দুল আহাদ মোহমান্দ এখন সুদূর জার্মানিতে একজন অনুল্লেখ্য ব্যক্তি মাত্র।