Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শমী কায়সার: জনম জনম মুগ্ধতা

আশির দশকের শেষের দিক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক ছিল বিটিভির জন্য স্বর্ণযুগ। সেই সময় সপ্তাহে দুটো নাটক দেখানো হতো; মঙ্গলবার ধারাবাহিক নাটক আর বৃহষ্পতিবার সাপ্তাহিক নাটক। এখনকার মতো তখন এত এত চ্যানেল ছিল না, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তখন নাটক দেখার জন্য উদগ্রীব থাকতো। শুধু দর্শক নন, কলাকুশলীরাও চেষ্টা করতেন নিজেদের সেরাটা দেবার জন্য।

এরই মাঝে ১৯৮৯ সালের দিকে তিন পর্বের একটি খণ্ড নাটক ‘যত দূরে যাই’ দর্শক মহলে বেশ আলোড়ন জাগালো। নাটকের কলাকুশলীরা অবশ্যই আলোড়ন তোলার মতোই ছিলেন। রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, তারানা হালিম; তাদের সাথে ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নাটকে মাদকাসক্ত তরুণের ভুমিকায় অভিনয় করেন ক্রেজ সৃষ্টি করা তৌকির আহমেদ। কিন্তু এতসব কলাকুশলীর মাঝে নতুন একটি মেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। অসম্ভব রোমান্টিক এই নাটকে ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সেই সময়ে সাধারণ দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন শমী কায়সার নামের নতুন এক অভিনেত্রী।

দর্শক হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন তিনি; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, একটা সময় এই মেয়ে আলোড়ন জাগাবে বাংলাদেশের শোবিজে। অনুমান ভুল হয়নি। পুরো নব্বইয়ের দশক জুড়ে যে ক’জন অভিনেত্রী বাংলাদেশের দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদের মাঝে শমী কায়সার একজন।

সেই শমী কায়সারের জানা-অজানা জীবন নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখা।

ছোটবেলায় বাবার কোলেই ঘুমুতেন তিনি। ছোট বাচ্চাদের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তবে শমী এই স্বাভাবিক ঘটনাটি খুব বেশি দিন উপভোগ করতে পারেননি। উপভোগের সেই সময়ের ছোটবেলাটা এতটাই ছোট ছিল যে, তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো স্মৃতি ধরে রাখার মতো পরিণত হয়ে ওঠেনি। মাত্র দুই বছর বয়সেই যে তার বাবা জীবন দিয়েছিলেন দেশের তরে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস, পাকিস্তানিরা বুঝতে পারছিল যে, পরাজয় ঘনিয়ে আসছে। হার নিশ্চিত জেনে খুঁজে খুঁজে তারা জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের হত্যা করতে শুরু করল, যাতে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়।

বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ঘরে ঘরে গিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর আল বদর-রাজাকারেরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে, এই তালিকায় শমীর বাবাও ছিলেন। বাংলার এক সূর্য সন্তান শহীদুল্লা কায়সার, শমীর বাবা, সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোপাশে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে লিখে গিয়েছিলেন,

“প্রিয়তমা সুপান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।”

‘বিশেষ’ যারা, তারা সাধারণত সময়ের চেয়ে একটু এগিয়েই থাকেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এগিয়ে থাকার শুরুটা শমী করেছিলেন জন্মের সময় থেকেই। যে তারিখে তার পৃথিবীতে আসার কথা, তার দেড় মাস আগেই হুট করে এসে পড়েন। তবে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল টিকে থাকতে। যে সময় জন্মেছিলেন সেসময় ছিল প্রচণ্ড শীত। ফলাফল, ইনকিউবেটরে তাকে কাটিয়ে আসতে হয়েছে দুই সপ্তাহ। তার মায়ের কথা থেকে জানা যায়, শমী হাঁটা শুরু করেছিলেন মাত্র নয় মাস বয়সেই।

মায়ের সাথে; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

তিন বছর বয়সে শমী কায়সার ভর্তি হন গ্রিন হ্যারল্ড স্কুলে, সেখান থেকে চলে যান উদয়ন স্কুলে। উদয়নে বেশি দিন ছিলেন না, ১৯৭৭ সালে ভর্তি হন হলিক্রস স্কুলে। সেখান থেকেই এসএসসি পাশ করেন। এরপর লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে বি.কম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন শমী।

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিল খুব ছোটবেলা থেকেই; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিল খুব ছোটবেলা থেকেই। মাত্র ৭ বছর বয়সেই পত্রিকার পাতায় তার হাতে আঁকা ছবি ছাপা হয়, ডায়েরিতে গল্প লিখেন সেই ছোটবেলাতেই। বাবাকে নিয়ে লিখেছেন আট বছর বয়সেই। সেই বছরেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চে খেলাঘরের হয়ে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ নাটকে অংশ নেন। পটুয়া কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নেন মাত্র ১১ বছর বয়সেই। কৈশোরেই পত্রিকার পাতায় তার ছোট গল্প ছাপা হয়।

কিশোর বয়সের লেখা পত্রিকায়; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

তখনও তার মনে অভিনেত্রী হবার কোনো চিন্তা আসেনি।

অভিনয়ের সূচনা

পরিবার থেকে ইচ্ছে ছিল শমী গায়িকা হবেন। খুব ছোটবেলাতেই এজন্য তাকে তার মা তানপুরা কিনে দিয়েছিলেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গোপাল চন্দ্র দে আর ভারতী মাসী।

গানেরই কোনো এক অনুষ্ঠানে মায়ের সাথে গিয়ে তার দেখা হয় বিটিভির প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরীর সাথে। প্রথম দেখাতেই শমীকে নাটক করার প্রস্তাব দেন তিনি। তবে লেখাপড়ার ক্ষতির কথা চিন্তা করে তার মা তাকে বারণ করে দিলেন। কিন্তু রক্তে যার অভিনয়, তাকে কি আর বেঁধে রাখা যায়? এইচএসসি পরীক্ষার আগ দিয়ে হুট করে সেই আতিকুল হকের কাছ থেকেই নাটক করার প্রস্তাব পান। আতিকুল হক সেই সময় তার নাটকের জন্য এমন এক মেয়ে খুঁজছিলেন, যে কিনা নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতে পারবে। শমী রাজি, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তার মা। পরীক্ষার আগে এই ঝামেলা তার পছন্দ ছিল না। কিন্তু শখের বশে কাজটা ছাড়তে চাইলেন না শমী। করলেন প্রথম নাটক ‘কেবা আপন কেবা পর’, দর্শকরাও পছন্দ করলো।

শখের বশে কাজ করতে এসেই মাতিয়েছেন শোবিজ; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

এরই মাঝে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল এলো। দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল শমীর। বুয়েটে স্থাপত্যকলায় পড়ারও একটা সূক্ষ্ম ইচ্ছে ছিল মনে। এরই মাঝে আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি ফোন তার জীবনের মোড় পাল্টে দিল। ইমদাদুল হক মিলনের লেখা একটি নাটকের জন্য তাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো, যে নাটকের অন্য শিল্পীরা ছিলেন সেসময়ের তারকারা। প্রস্তাব পেয়ে শমী স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এর চেয়েও বেশি স্তব্ধ হলেন, যখন দর্শক নাটকটি গ্রহণ করলেন। ‘যত দূরে যাই’ নাটকটি সফল হবার পরেই তিনি অভিনয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু করলেন। স্থাপত্যকলায় পরীক্ষা দিয়ে টেকা হলো না, বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছেটাও চলে যেতে থাকলো। শুরু হলো একজন দুর্দান্ত শিল্পীর তুমুল জনপ্রিয়তার সূচনা।

শুরু হলো একজন দুর্দান্ত শিল্পীর তুমুল জনপ্রিয়তার সূচনা; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

সেই যে সূচনা হলো, পুরো নব্বইয়ের দশকটা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন তিনি দর্শকদের। একটা সময় আফজাল হোসেনের প্রস্তাবে মঞ্চেও কাজ করেন। অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার পরামর্শে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন, সেখানে ছিলেন দীর্ঘ এক যুগ। তবে মঞ্চের চেয়ে টিভি মাধ্যমকেই বেশি সময় দিয়েছেন।

সিনেমার রূপালী জগত

শমীর ক্যারিয়ারের সিনেমার সংখ্যা অল্প। তবে প্রথাগত সিনেমায় তিনি অভিনয় করেননি। প্রথম চলচ্চিত্র অনুপ সিংয়ের পরিচালনায় ‘নেম অব দ্য রিভার’। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্মিক ঘটকের জীবনের উপর নির্ভর করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সিনেমাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখানো হলেও বাংলাদেশে মুক্তি পায়নি। পরবর্তীতে ‘হাসন রাজা’ এবং ‘লালন’ নামের দুটো সিনেমাতেও অভিনয় করেন। তবে ২০০১ সালের পর পুনরায় শমীর সিনেমায় অভিনয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। কথাসাহিত্যিক মাসুদ হোসেনের উপন্যাস ‘রৌদ্রবেলা ও ঝরাফুল’ অবলম্বনে নির্মিত ‘যুদ্ধশিশু’ সিনেমাতে তার অভিনয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিনেমার পরিচালক শহিদুল হক খান।

বিপাশার সাথে লাক্সের এক বিজ্ঞাপনচিত্রে; Source: pinterest.com

পরিচালনা প্রযোজনা

শমী কায়সার পরিচালনা জীবনের শুরুটা করেন বিজ্ঞাপনচিত্র দিয়ে। তার নিজের ভাষায়, এই বিভাগেও তার আসা হয়েছে হুট করেই, কোনো পরিকল্পনা করে নয়। তবে পরিচালনার চেয়ে প্রযোজনাতেই তার আগ্রহ বেশি ছিল। ১৯৯৭ সালে ‘ধানসিঁড়ি’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এর প্রথম নাটক ছিল ‘মুক্তি’।  এরপর একে একে তৈরি করেন ‘অন্তরে নিরন্তর’, ‘দূরে কোথাও’, ‘স্বপ্ন’, ‘আরিয়ানা’ এবং আরো কয়েকটি নাটক। পরবর্তীতে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য বিজ্ঞাপনচিত্রও নির্মিত হয়েছে।

পরিচালনায় তার আসা হয়েছে হুট করেই; Source: The Daily Star

২০০১ সালের দিকে হঠাৎ করে শমী কায়সার বিটিভিতে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তার নিজের ভাষায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি চ্যানেল তাকে নিতে ভয় পেত। সেই সময়ে এনটিভি তাকে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তবে এই সময় থেকে ধীরে ধীরে তিনি অভিনয় কমিয়ে দিয়ে কর্পোরেট সেক্টরের দিকে মনোযোগী হন।

অর্জন

২০০১ সালের দিকে দিল্লীতে ‘হিউম্যান রাইটস ইন সাউথ এশিয়া’ সংগঠনের সাধারণ সদস্যদের একটি সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন, পাকিস্তানের সেই সময়ের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নোবেল বিজয়ী আসমা জাহাঙ্গীরের মতো মানুষের সাথে শমী কায়সারও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ঘটনাটিকে নিজের জীবনের একটি অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছেন শমী। ২০০২ সালে জার্মানিতে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ ইন মিডিয়া’ শিরোনামে একটি সম্মেলন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রবন্ধ পড়েছিলেন ড. আনিসুজ্জামান এবং শমী কায়সার। এটিকেও নিজের ক্যারিয়ারের একটি বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি।

দিল্লীতে এক কনফারেন্সে; Source: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম

পুরস্কার

খুব ছোটবেলাতেই ছবি আঁকার জন্য ভারত থেকে শঙ্কর পুরষ্কার পান, সালটা ছিল ১৯৭৭। ১৯৮০ সালে পান শিশু একাডেমী পুরষ্কার। অভিনয়ের জন্য বড় হয়ে প্রথম পুরস্কার পান ১৯৯৪ সালে, মেরিল-যায়যায়দিন এর পক্ষ থেকে। ভোরের কাগজ, বাচসাস, মেরিল-প্রথম আলো, ইমপ্রেস-অন্যদিন থেকেও পুরস্কৃত হয়েছিন তিনি। এছাড়াও জার্নালিস্ট রিপোর্টস অ্যাওয়ার্ড ও সিজেএফবি সহ আরো কিছু পুরস্কার তার ঘরে গিয়েছে।

শমীর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছেন তার মা। এছাড়া একমাত্র ভাই অমিতাভ কায়সারের সাথেও সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বর্তমানে শমী কায়সার যুক্ত আছেন দেশীয় উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সাথে। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মিডিয়াতে কিছুটা অনিয়মিত থাকলেও শমীর ইচ্ছে আছে, তার বাবা শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার।

বর্তমানে শমী কায়সার কাজ করছেন উদ্যোক্তাদের নিয়ে; Source: thedailynewnation.com

একান্নবর্তী পরিবার আর সেই পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় শমীর বেড়ে ওঠাটা হয়েছে অনেক আদরেই। পরবর্তীতে পুরো দেশের মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন তিনি। আশা করা যায়, চলচ্চিত্র পরিচালনায় এলে সেখানেও তিনি দর্শকপ্রিয়তা পাবেন।

তথ্যসূত্র: আনন্দধারা তারকা অ্যালবাম, ৪ আগস্ট, ২০০৩।

ফিচার ইমেজ: হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘নক্ষত্রের রাত’ ধারাবাহিক থেকে।

Related Articles