Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিম হুইন হুই: এক গুপ্তচরের নাটকীয় জীবনের গল্প

২৯ নভেম্বর, ১৯৮৭। ইরাক থেকে আবুধাবি হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার পথে কোরিয়ান এয়ার ফ্লাইট ৮৫৮ থাইল্যান্ডের ব্যাংককে দ্বিতীয় যাত্রাবিরতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা দক্ষিণ কোরিয়ান নাগরিক। পাইলটরা ব্যাংকক বিমানবন্দরে জানায়, তারা সময়মতোই পৌঁছাবে। কিন্তু আন্দামান সাগরের উপরে অবস্থান করার সময় ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যার ফলে আকাশেই বিধ্বস্ত হয় কোরিয়ান এয়ারের বোয়িং ৭০৭ মডেলের বিমানটি।

ঠিক একই দিনে বাহরাইনে একজন বয়স্ক লোক ও একজন তরুণী ধরা পড়েন নকল জাপানি পাসপোর্টসহ। ধরা পড়ার সাথে সাথেই বয়স্ক লোকটি নিজের সাথে রাখা সায়ানাইড পিল খেয়ে আত্মহত্যা করে। তার সাথে থাকা তরুণী একইভাবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেও নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে আটকে দেয়। ২৫ বছর বয়স্ক সেদিনের তরুণীর নাম ছিল কিম- হুইন হুই, যার গল্প হার মানিয়ে দিবে যেকোনো সিনেমার গল্পকেও। ধরার পড়ার গল্প জানার আগে চলুন পেছন ফিরে দেখা যাক হুইয়ের আগের জীবন।

১৯৬২ সালে উত্তর কোরিয়ায় জন্ম হুইয়ের। কূটনৈতিক বাবার চাকরির সুবাদে রাজধানী পিয়ং ইয়ংয়েই বেড়ে ওঠা তার। ছোট থেকেই পড়াশোনাতে বেশ ভালো ছিলেন তিনি। বাবার চাকরির সুবাদে কিছুদিন কিউবাতেও থাকা হয়েছিল তার। কিম ইল সং বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে তিনি জাপানি ভাষা শেখার জন্য চলে যান পিয়ং ইয়ং ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ কলেজে। তবে পড়াশোনা শুরুর আগেই উত্তর কোরিয়ার স্পাই এজেন্সি হুইকে তাদের একজন এজেন্ট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য পিয়ং ইয়ংয়ের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় সাত বছর মার্শাল আর্ট, ক্লোজ কোয়ার্টার কমব্যাট, নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়ে প্রবেশ করে কোনো নথি সংগ্রহ করার প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়াও এ সময় জাপানি ভাষার উপরেও প্রশিক্ষণ নেন হুই। তার প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন একজন অপহৃত জাপানি নাগরিক।

বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ; Photographer: Park Chang-gi Yonhap via AP

সাত বছরের মূল প্রশিক্ষণ শেষে হুইকে পাঠানো হয় ম্যাকাওতে। সেখানে তিনি ক্যান্টোনিজ ভাষা শেখেন, যাতে পরবর্তীতে নিজেকে চাইনিজ হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। এছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন- সুপারশপে বাজার করা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা এসবের উপরেও প্রশিক্ষণ নেন হুই। এরপর তাকে সত্যিকারের মিশনের উদ্দেশ্যে ইউরোপে পাঠানো হয় কিম সেউইং ইল নামের বয়স্ক একজন এজেন্টের সাথে। তাদের মিশন ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিমান উড়িয়ে দেয়া, যাতে অলিম্পিকের আগে সবাই দক্ষিণ কোরিয়াকে অনিরাপদ মনে করে।

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি দক্ষিণ কোরিয়াকে ১৯৮৮ সালের অলিম্পিকের আয়োজনের অনুমতি দেয়ার পর থেকেই সেটি উত্তর কোরিয়ার অহংয়ে আঘাত লাগে। ফলে তারা প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়া ও অলিম্পিক কমিটির কাছে আবেদন করে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ভাগাভাগি করে অলিম্পিক আয়োজন করার ব্যাপারে। পুরো ব্যাপারটি অদ্ভুত হলেঅ উত্তর কোরিয়াকে অখুশি করলে চীন ও সোভিয়েত অলিম্পিকে অংশ নেবে না এই চিন্তা করে দক্ষিণ কোরিয়া কিছু ছাড় দিতে রাজি হয়। ফুটবলসহ কিছু খেলার আয়োজনের দায়িত্ব উত্তর কোরিয়াকে দিতে রাজি হয় দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এতে খুশি ছিল না। তারা ৫০-৫০ ভাগ চাচ্ছিল। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া এত বেশি ভাগ দিতে রাজি ছিল না। দুই পক্ষের আচরণেই ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, উত্তর কোরিয়া আসলে কিছুই পাচ্ছে না। আর এর প্রতিশোধ নিতেই দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে উত্তরের সরকার।

১৯৮৮ সালের অলিম্পিক; Image Source: Asia Society

পরিকল্পনা সফল করতে দুই এজেন্ট প্রথমে পিয়ং ইয়ং থেকে মস্কো যান, এরপরে যান বুদাপেস্ট। সেখানে উত্তর কোরিয়ার স্পাই এজেন্সির অন্য সদস্যরা তাদের নকল জাপানি পাসপোর্ট দেয়। নকল পাসপোর্ট অনুযায়ী ইলের নাম হয় মায়ুমি হাচিয়া ও ইলের নাম হয় সিনিচি হাচিয়া। তাদের মধ্যে সম্পর্ক দেখানো হয় বাবা-মেয়ে। বুদাপেস্ট থেকে নিজেদের নকল পরিচয় নিয়ে ইরাকে যান হুই ও ইল। ইরাকে যাবার আগে বুদাপেস্টেই তারা তাদের প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক পেয়ে জোগাড় করে ফেলেছিলেন। রেডিও ট্রান্সমিটারের ভেতরে বোমা আর পানির মতো দেখতে তরল বিস্ফোরক নিয়ে তারা ইরাকে অপেক্ষা করতে থাকেন ফ্লাইট ৮৫৮ এর। সেসময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বর্তমানের মতো কড়াকড়ি ছিল না বলে সহজে পার পেয়ে যান দুজনই। প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক নিয়ে টার্গেট বিমানে চড়তে কোনো বাঁধাই পেতে হয়নি দুই এজেন্টকে।

বিমানে উঠে সতর্কতার সাথে বিস্ফোরকগুলো জায়গামতো স্থাপন করে দেন দুই এজেন্ট। ইরাক থেকে বিমানটির প্রথমে যায় আবুধাবিতে। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে সিউল- এটি ছিল বিমানের ফ্লাইট রুট। বিমানে বিস্ফোরক লাগিয়ে আবুধাবিতেই নেমে যান দুই স্পাই। আর তাদের লাগানো বিস্ফোরক নিয়ে বিমানটি রওনা দেয় থাইল্যান্ডের দিকে। আবুধাবি থেকে দুই এজেন্টের যাবার কথা ছিল জর্ডানে। কিন্তু তাদের ভিসাতে সমস্যা থাকার কারণে তারা জর্ডান যেতে পারেননি, বরং তাদের যেতে হয় বাহরাইনে। আর সেখানে ধরা পড়েন দুজনই, প্রথমে যেমন বলা হয়েছে আর সেখান থেকেই শুরু হয় হুইয়ের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

ধরার পড়ার পর হুই; Photographer: Kim Chon-Kil AP news

বাহরাইন কর্তৃপক্ষ প্রথমে হুই ও ইল দুজনকেই হাসাপাতালে নেয়, কিন্তু হাসপাতালে নেবার আগেই ইলের মৃত্যু ঘটে। তবে হুইকে বাঁচাতে সক্ষম হন ডাক্তাররা। হুই প্রথমে নিজের নাম জানান পাই চুই হুই আর তিনি উত্তর চীনের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেন নিজেকে। কিন্তু তার কথা বলার ধরন থেকেই সহজেই তার মিথ্যা ধরা পড়ে যায়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর তার উত্তর কোরিয়ান পরিচয় প্রকাশ পায়। আর উত্তর কোরিয়ান পরিচয় পাবার পর পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে বাহরাইন কর্তৃপক্ষ হুইকে দক্ষিণ কোরিয়ান সরকারের হাতে তুলে দেয়। এরপর শুরু হয় হুইকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বিচার। প্রায় দেড় বছর জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচারের পর ১৯৮৯ সালে হুইকে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেয় দক্ষিণ কোরিয়ার আদালত।

সংবাদপত্রের পাতায় হুইয়ের খবর; Image Source: roknews.net

হুইয়ের গল্পটা হয়তো সেখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোহ তায়ে-উ হুইকে ক্ষমা করে দেন। তার ভাষ্যমতে, পুরো ব্যাপারটিতে হুইয়ের কিছুই করার ছিল না, বরং উত্তর কোরিয়ার মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে হুই এই হত্যাকান্ডে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট রোহ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করেন উত্তর কোরিয়ার সরকারকে। প্রেসিডেন্টের মানবিকতায় নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াইয়ে নামেন হুই। উত্তর কোরিয়ার এজেন্ট থেকে রূপান্তরিত হন দক্ষিণ কোরিয়ার এজেন্টে। তবে নিরাপত্তার খাতিরে তার সত্যিকারের পরিচয় ও অবস্থান সব সময় গোপন রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার।

নতুনভাবে সবকিছু শুরু করলেও ১১৫ জনের মৃত্যুর দায়ভার থেকে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি হুই। ১৯৯৩ সালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন ‘Tears of my soul’ গ্রন্থে। বই থেকে পাওয়া রয়ালিটি তিনি দান করেন ১৯৮৭ সালের হত্যাকান্ডে নিহত পরিবারদের। বইটিতে তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে উত্তর কোরিয়া মগজ ধোলাই করে উত্তরের নাগরিকদের, কীভাবে তাদের শেখানো হয় দক্ষিণের লোকদের উপরে হামলা করা আসলে কোরিয়ার একত্রীকরণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৯ সালে হুই জাপানে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের সময় তার জাপানি প্রশিক্ষকের পরিবারের সাথে দেখা করতে। এছাড়া ২০১১ সালে সুনামি বিধ্বস্ত জাপানকে আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন হুই।

হুই;Photographer: Mac William Bishop for NBC News
হুই; Photographer: Mac William Bishop for NBC News

গল্পের মতো হুইয়ের জীবনে রয়েছে আরো একটি গল্প। ১৯৯৭ সালে তিনি বিয়ে করেন এক দক্ষিণ কোরিয়ান এজেন্টকে, যিনি ছিলেন হুইয়ের বডিগার্ড। এই দম্পতির দুই সন্তানও রয়েছে। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে বেশ ভালোই আছেন তিনি বর্তমানে। কিন্তু সত্যিকারের সুখ কি রয়েছে তার মনে? সিএনএন, বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে এসেছে ১৯৮৭ সালের হত্যাকান্ডের জন্য হুইয়ের অনুতপ্তের কথা। সম্পূর্ণ নতুন করে জীবন শুরু করার পরেও প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনার জন্য কেঁদে ওঠে তার মন। সেই সাথে তার মন খারাপ হয় উত্তর কোরিয়ায় ফেলে আসা তার পরিবারের জন্য। ১৯৮৯ সালে যখন নিজের মৃত্যুদন্ড মাফের কথা জানতে পারেন তখন খুশি হবার বদলে তিনি উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন তার পরিবারের জন্য। উত্তর কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী তাদের হয়তো লেবার ক্যাম্প কিংবা কোনো খনিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নিজের পরিবারের দুর্দশার জন্যও নিজেকে দায়ী করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১১৫ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর বোঝা বয়ে বেড়াতেই হবে হুইকে। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা তাকে ক্ষমা করলেও নিজেকে কি কখনো ক্ষমা করতে পারবেন হুই?

ফিচার ইমেজ- Mac William Bishop for NBC News

Related Articles