Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডিরোজিও: ভারতবর্ষের প্রথম বহিষ্কৃত শিক্ষক

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও(১৮০৯-১৮৩১),
dainik azadi

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, উনিশ শতকের একজন শিক্ষক, যিনি পাশ্চাত্যের ছোঁয়ায় এ দেশের তরুণদের মেধা ও মননকে জাগানোর পথ বের করে দিয়ে গেছেন। ভারতে যখন পাশ্চাত্যের হাওয়া লাগি লাগি করছে, সেসময় একটা তরুণের দল ‘ডিরোজিওর শিষ্য’ বলে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। বহুদিনের আঁকড়ে থাকা সংস্কার, গোঁড়ামি, যাকে কিনা নিজেদের ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি বলে জীবনযাপন করছিলেন ভারতবর্ষের বাসিন্দারা, সেই সময়ের ভারতবর্ষ যখন বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান বলে কোনো দেশ আসেনি।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমল শেষ হবার সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এরপর কিছুদিন ইংরেজদের প্রায় অধীনেই নবাবি করলেন পর মীর কাশিম। তারপরেই ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনে চলে এলো বাঙালিরা, তখনকার ভারতবাসীরা। আর ইংরেজরা প্রবেশ করতে লাগলো ভারতের সর্বক্ষেত্রে। প্রায় সব ইংরেজই যখন কোনো না কোনোভাবে বাঙালিকে হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে, এর মধ্যে পশ্চিমা কিছু মানুষ ব্যতিক্রম ছিলেন, যারা বাঙালির উন্নতিই চেয়েছিল। এরই মধ্যে অন্যতম হলেন এই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।

ডিরোজিওর জন্ম ও শৈশব

হেনরির জন্ম ১৮০৯-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতার মৌলালি অঞ্চলে এক ইউরেশীয় পরিবারে। তার বাবার নাম ফ্রান্সিস, মা সোফিয়া। মাত্র ছ’বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন হেনরি। পরে তার বাবা আনা মারিয়া নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিবাহ করেন। আনার নিজের সন্তানাদি না থাকায় সতীনের সন্তানদের নিজের ছেলে মেয়ের মতোই দেখতেন। বেশ আদরের সাথে ও স্বচ্ছলতার মাঝেই বড় হয়েছিলেন তিনি, সবসময় পরিপাটি সাজে থাকতেন। চুলের মাঝখানে কাটা সিঁথি, সচরাচর টুপি না পরা- এই তো ডিরোজিও। ছোটবেলা বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন, ঘোড়ায় চড়ারও শখ ছিল।

তার স্মরণে রাজারহাটে কলেজ, bengali samachar

বৈষম্যের মুখোমুখি ডিরোজিও, তবে কখনো না মেনে নেওয়া

তখন ইউরেশীয়দের দেখা হতো নিপীড়িতের দৃষ্টিতে। সকল ধরনের পেশায়ও তাদের প্রবেশে বেশ নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি সরাসরি স্কুল-কলেজে পড়া নিয়েও তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু ডিরোজিও কখনোই সেসব বৈষম্যকে তার ওপর প্রভাব ফেলতে দেননি, তিনি তার সম্প্রদায়ের মুক্তি আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দেন। সংখ্যালঘু হয়েও সংখ্যালঘুতাকে মেনে নেননি ডিরোজিও। সবসময়ই প্রশ্ন তোলার, অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবার একটা আর্তি কাজ করতো তার মধ্যে। পরবর্তী জীবনে এই আর্তি হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও তিনি ছুঁড়ে দিতে পেরেছিলেন যাতে তারা রক্ষণশীলতার বাইরে আসতে পারে।

ডেভিড ড্রামন্ড ও ধর্মতলা অ্যাকাডেমি

ডিরোজিওর মধ্যে যুক্তির যে বৃক্ষ ডালপালা ছড়ায় তার বীজ বপন করেছিলেন ডেভিড ড্রামন্ড, ডিরোজিওর শিক্ষক। ডিরোজিও যখন ছোট, তখন ইংরেজি শিক্ষার জন্য কলকাতায় তেমন ভাল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা আছে সব জগাখিচুড়ি অবস্থা! এমন সময় ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন ড্রামন্ড। তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মতলা আকাডেমির শিক্ষক ও আংশিক স্বত্ত্বাধিকারী। ১৮১৫ থেকে ১৮২৩ সাল, এই আট বছর ডিরোজিও দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে। এখানেই তার জীবনদর্শনের আদর্শ গড়ে উঠেছিল। ড্রামন্ড একটা দেবশিশুর মধ্যে এঁকে দিয়েছিলেন পূর্ণ মানুষের ছবি, বুকের ভেতর গেঁথে দিয়েছিলেন সত্যের জন্যে বাসনা।

শিল্প-সাহিত্য,ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুর জন্য একটা আবেদন সৃষ্টি হয়েছিল ডিরোজিওর মধ্যে, এখানেই এই ধর্মতলা আকাডেমিতে, ড্রামন্ডের কাছ থেকে। কীভাবে সত্যকে অর্জন করতে হয়, কীভাবে তর্কের মাধ্যমে সত্যকে স্থাপন করতে হয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কী করে মানুষকে মানুষ হয়ে ভালবাসতে হয়- ডিরোজিও এ শিক্ষা ড্রামন্ডের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কোনোকিছুই গ্রহণ করা যাবে না যুক্তির কষ্টিপাথরে না ঘষে, বললেন স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্নের জন্যে বাঁচতে-মরতে। চিন্তাশীলতা, যৌক্তিকতা, মননশীলতার স্বরূপ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিলেন। পড়ালেন হিউম, স্মিথ, রবার্টসন, রীড, স্টুয়ার্ট, বেকন, পেইনসহ অনেকের দর্শন; বার্নসের ক্যাম্পবেলের কবিতার দ্রোহের কথা বুকে ভরে দিয়ে দেখতে বললেন বিশ্বকে ড্রামন্ড একজন কবি ছিলেন, এ প্রভাবও ডিরোজিওর মধ্যে পড়ে।

ঝড়ের পাখি ডিরোজিও, www.eng.literature.com

হিন্দু কলেজে আসার আগে ও পরে

ড্রামন্ডের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, আর উচ্চশিক্ষার পথে না গিয়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। হয়তো উচ্চশিক্ষার চেয়েও উঁচু কোনো এক শিক্ষাকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, তাই এবার কর্মের মধ্য দিয়ে শিক্ষা নিতে পা বাড়ালেন। তবে শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়নি। প্রথমে তার বাবা যে কোম্পানিতে কাজ করতেন সেখানে যোগ দেন। কিন্তু এ কাজ তাঁর বেশি দিন ভাল লাগেনি। এর পর তিনি ভাগলপুরের নীল দফতরে যোগদান করেন। এখানেই শুরু হয় তাঁর কাব্য চর্চা। তার কবিতা রচনায় প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেটে’-এর সম্পাদক ডক্টর জন গ্রান্ট। ডিরোজিও ‘জুভেনিস’ ছদ্মনামে লিখতেন। ১৮২৮-য় প্রকাশিত হয় ‘দ্য ফকির অফ জঙ্ঘীরা, এ মেট্রিকাল টেল; অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। এর পাশাপাশি চলতে লাগল তার নিজের পড়াশুনা। ক্রমেই তিনি নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

ডাকটিকিটে ডিরোজিও, istampgallery

এর পরে ডিরোজিও ভাগলপুর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মূলত ডক্টর গ্রান্টের সহায়তায়। ১৮২৬ নাগাদ, তিনি কলকাতায় দু’টি চাকরি পেয়েছিলেন। প্রথমটি ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেট’-এর সহ সম্পাদক হিসেবে, দ্বিতীয়টি হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার। কারও কারও মতে তিনি দু’টি চাকরি এক সঙ্গে কিছুদিন করেছিলেন। ডিরোজিও যে সময় হিন্দু কলেজে যোগদান করেন, সেই সময়টা ছিল কলেজের সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার সময়। তার পাণ্ডিত্য ও মেধার জন্যই কলেজের খ্যাতি ও গৌরব বেড়েছিল। কোনো কোনো গবেষকের মতে ডিরোজিওর এই জনপ্রিয়তাই তার পতনের কারণ। সাংবাদিক রূপেও ডিরোজিয়োর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সাথে ডিরোজিও

মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে আসেন শিক্ষক হয়ে। তার পড়ানোর বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস। এত কমবয়সেই তিনি যুক্তিকে বুদ্ধিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন এবং শুধু তাই নয় ছাত্রদের কীভাবে তার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত করতে হয় তাও ডিরোজিওর অজানা ছিল না। আর তাই তো গড়ে উঠেছিলো পাশ্চাত্যচিন্তায় আধুনিক একটি তরূণ সমাজ। গতানুগতিকতাকে কী করে যুক্তির হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে হয়, কী করে তথাকথিত প্রথা-রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলতে হয়, কীভাবে জীবনের প্রতিটি অংশে অন্ধ বিশ্বাসকে অতিক্রম করতে হয়- ডিরোজিও হিন্দু কলেজের সেই কিছু ছাত্রের মর্মে তা প্রবেশ করাতে পেরেছিলেন।

তার পড়ানোর বিষয় ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস হলেও আলোচনার গন্ডি এগুলোতেই আটকে থাকতো না। আলোচনা অতিক্রম করতো বিজ্ঞান ও দর্শনের বিস্ময়কর পথও। ক্লাসভরা ছাত্র মুগ্ধ হয়ে দেখতো প্রায় তাদেরই বয়সী একটি ছেলের জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার, তাদের মধ্যেও জানার ইচ্ছা বোঝার ইচ্ছা, তথাকথিত গন্ডি পেরিয়ে আসার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠতো। ডিরোজিও তাদেরকে যতটা শিখিয়েছেন তার চেয়ে বেশি প্রবল করে দিয়েছিলেন তাদের জ্ঞানতৃষ্ণাকে। এই জ্ঞানতৃষ্ণার তাগিদেই তিনি ও তার ছাত্ররা শ্রেণীকক্ষের বাইরেও, এমনকি ডিরোজিওর বাসায়ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন।

সেই হিন্দু কলেজ, jansatta.com

রক্ষণশীলতায় কঠোর আঘাত হানলেন ডিরোজিও

তার প্রতিষ্ঠিত ‘অ্যাকাডেমিক এসোসিয়েশন’, ‘সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা যেমন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘দ্য এনকোয়ারার’ ও দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদনায় ‘জ্ঞানান্বেষণ’ রক্ষণশীল সমাজকে একের পর এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।

নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল

ডিরোজিওর দ্বারা প্রচন্ডরূপে প্রভাবিত ছাত্ররাই একত্রে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নাম ধারণ করে। এরা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন সংস্কার ও রীতিনীতিকে এক কথায় মেনে না নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ধর্মে নিষিদ্ধ খাবার-দাবার গ্রহণ শুরু করেন, গর্বভরে প্রচারও করেন। এসব করার জন্য অনেকের পরিবারের সাথে বিচ্ছেদও ঘটে যায়। শুধু রক্তের সম্পর্কের বাইরেও এই নব্যবঙ্গের সদস্যরা গড়ে তোলেন গভীর বন্ধুত্ব। এদের মধ্যে কেশব সেন, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গৌরদাস বসাক, ভূদেব মুখোপাধায়, বঙ্কুবিহারী দত্ত, শ্যামাচরণ লাহা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের সবাই ডিরোজিওর সরাসরি শিষ্য নন, কয়েকজন তার ভাবধারায় তার মৃত্যুর পরও দীক্ষিত হয়েছেন এবং কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদেরই একজন।

ডিরোজিওর ভাবধারায় দীক্ষিত কবি মধুসূদন দত্ত, sangbad24.net

বহিষ্কার, অতঃপর মৃত্যু

সমাজ সংস্কার বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব ৬-১ ভোটে অনুমোদিত হয়। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বহিষ্কৃত শিক্ষক। বহিস্কৃত হবার পরে ডিরোজিও অর্থকষ্টে পড়েন। তখন তিনি ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পড়াতে যান এবং কলেরায় আক্রান্ত হন। ১৮৩১ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর তিনি মারা যান। গির্জা ও খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিমতের কারণে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করতে বাধা দেওয়া হয়। গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাকে সমাহিত করা হয়।

ডিরোজিওর সমাধি, wikipedia

তথ্যসূত্র

১) বাংলার নবজাগরনের অন্যতম পথিকৎ ডিরোজিও

 

২) bn.wikipedia.org/wiki/ইয়ং_বেঙ্গল

 

৩) হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

 

 

 

Related Articles