Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রবার্ট ওয়াডলো: পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকায় মানব

ছেলে কিংবা মেয়ে যে-ই হোক না কেন; লম্বা মানুষের প্রতি সকলেরই একটু বাড়তি আকর্ষণ থাকে। মানুষের স্বাভবিক উচ্চতা তার দেহকোষের জিনগত বৈশিষ্ট্য, পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত ঘুম, ব্যায়াম সবকিছুর উপরই নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, মানুষের দৈহিক বৃদ্ধির ৮০ শতাংশ নির্ভর করে তার বংশগত জিনের ওপর, বাকি ২০ শতাংশ পরিবেশ বা ব্যক্তির অন্যান্য অভ্যাসের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। একজন সুস্থ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক উচ্চতা ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি, ৮ ফুট ১১.১ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকায় মানুষ হিসাবে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ এ নাম লিখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট পারসিং ওয়াডলো। সবচেয়ে বেশি উচ্চতার জন্য তিনি ‘Alton Giant‘ বা ‘Giant of Illinois‘ নামেও পরিচিত।

বাবা-মা ও চার ভাই-বোনের সাথে ওয়াডলো; Source: abadiadigital.com

বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষের খেতাবধারী ওয়াডলো মাত্র ২২ বছর বেঁচে ছিলেন। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত গ্রোথ হরমোনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে জন্মের পর থেকেই প্রতিনিয়ত তার শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে। ২২ বছর বয়সে তার উচ্চতা ৮ ফুট ১১.১ ইঞ্চি এবং ওজন ২২০ কেজি হয়ে গিয়েছিল

১৯১৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকার এলটন শহরে হার্ল্ড ওয়াডলো ও এডি জন্সনের সংসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র রবার্ট ওয়াডলো জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৩.৯ কেজি। ওয়াডলোর আরও ৪ ছোট ভাই-বোন ছিল। তবে ছোট ওয়াডলোর বেড়ে ওঠা সকলের নজর কাড়ে যখন তার বৃদ্ধি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হতে শুরু করে। প্রথম জন্মবার্ষিকীতেই তার ওজন ২০.৪ কেজি ও উচ্চতা ৩ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি হয়ে যায়! ওয়াডলোর বাবার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি, যা তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সেই অতিক্রম করেন। মাত্র ১৩ বছরেই তার উচ্চতা দাঁড়ায় ৭ ফুট ৪ ইঞ্চিতে।

Source: TheTallestMan.com

এলটন হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৩৬ সালে তিনি সার্টলেফ কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তার উচ্চতার কারণে স্কুলে আলাদাভাবে তার বসার উপযোগী বেঞ্চ তৈরি করতে হতো। তবে দুর্ভাগ্যবশত লম্বা হওয়ার সাথে সাথে তার পায়ের অনুভব ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ৮ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতায় ওয়াডলো পূর্ববর্তী বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ১৯৩৭ সালে সবচেয়ে বেশি উচ্চতাসম্পন্ন মানুষের খেতাব লাভ করেন। তখন তার ওজন ছিল ১৯৯ কেজি। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল তার ব্যবহারের জুতা তৈরির কাজ। কারণ তার পায়ের মাপ ছিল ৩৭, যার ফলে সচরাচর তার জুতা পাওয়া যেত না। বিশেষভাবে তার মাপের জুতা তৈরিতে তৎকালীন সময়ে খরচ হত ১০০ ডলার।

Source: listverse.com

১৯৩৬ সালে ‘Ringling Brothers‘ সার্কাস পার্টির সাথে আমেরিকা ভ্রমণের পর ওয়াডলো আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৩৮ সালে তিনি একটি আন্তর্জাতিক জুতার কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ফলে পরবর্তীতে ঐ কোম্পানি তাকে বিনামূল্যে জুতা সরবরাহ করতো এবং বিনিময়ে তিনি ঐ কোম্পানির প্রচারণা চালাতেন। এ সময় তার পায়ের জোর অনেক কমে যাওয়ায় তিনি পায়ে ধাতব ব্রেস পরা শুরু করেন। চলাচলে অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো হুইল চেয়ারের সাহায্য নিতে রাজি ছিলেন না।

পরিবারের সাথে খাবারের টেবিলে ওয়াডলো; Source: mashable

১৯৪০ সালের ৪ জুলাই, পেশাগত উৎসব ‘Manistee National Forest‘এ অংশগ্রহণের পূর্বে তার পায়ের একটি ব্রেস ভেঙে যাওয়ায় পায়ে মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয় এবং পরিণামে সেখানে ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়। ইনফেকশনের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, রক্তেও তার প্রভাব পড়ে। ওয়াডলো এসবের কিছুই টের পাননি, কারণ ততদিনে তার পায়ের সমস্ত অনুভব ক্ষমতাই হ্রাস পেয়েছিল। ফলে অবস্থার অবনতি ঘটলে দ্রুত ডাক্তাররা তার অপরেশনের ব্যবস্থা করেন।

সঙ্গীতপ্রিয় ওয়াডলো; Source: spiegel.de

রক্তশূন্যতা পূরণে ডাক্তারগণ নতুন করে রক্ত দেওয়া শুরু করেন তাকে এবং অপারেশনের মাধ্যমে ক্ষতস্থান সারিয়ে তুলতে যথাযথ প্রয়াস চালান। তবে তাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ওয়াডলোকে কিছুতেই সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। বরং দিনে দিনে তার জ্বরের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শারীরিক অবস্থারও কোনো উন্নতি ঘটেনি। অবশেষে ১৯৪০ সালের ১৫ জুলাই ঘুমের মাঝেই মারা যান পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকায় এ মানুষটি। ইলিনয়ের এলিটন শহরেই ১৯ জুলাই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

মৃত্যুর ১৮ দিন পূর্বে ডাক্তারগণ তার উচ্চতা পরিমাপ করেন ৮ ফুট ১১.১ ইঞ্চি। তার বহনকৃত কফিনটির দৈর্ঘ্য ছিল ১০ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩২ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৩০ ইঞ্চি। ১২ জন বাহক ও ৮ জন সাহায্যকারীর সহায়তায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়। ওয়াডলোর স্মরণে ১৯৮৬ সালে এলিটন কলেজ চত্বরে তার সমান উচ্চতার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ভাস্কর জেমস বাটলার তৈরি ওয়াডলোর আরো ৬টি মূর্তি বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে।

Source: Enjoy.Illinois

ফারমিংটন হিল, মিশিগানে তার একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে যার সামনে আকারে ছোট একটি টেলিভিশনে ওয়াডলোর সংক্ষিপ্ত জীবনের অসাধারণ কর্মের দৃষ্টান্ত তথ্যচিত্র আকারে দেখানো হয়। ১৯৯৮ সালে ওয়াডলোর স্মরণে  ‘The Handsome Family’ , ‘The Giant of Illinois‘ গানটি রচনা করেন, যা পরবর্তিতে আন্ড্রু বার্ডের কণ্ঠে শোনা যায়। এছাড়া ২০০৫ সালে সাফজান স্টিভেনের কণ্ঠে ‘The Tallest Man, The Broadest Shoulders‘ গানটির জন্ম হয়েছিল ওয়াডলোর সম্মানে।

২২ বছর (বাম) ও ৬ মাস (ডান) বয়সী ওয়াডলো; Source:tallsome,Digging HIstory

মানুষ লম্বা বা বেঁটে হওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পিতামাতার জিনগত ও বংশগত কারণে হয়ে থাকে। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, যেমন ৮-৯ ফুট দীর্ঘকায় মানুষের উচ্চতার জন্য দায়ী গ্রোথ হরমোনের প্রভাব। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যানুযায়ী, তার এই অস্বাভাবিক উচ্চতার জন্য দায়ী বৃহৎ পিটুইটারি গ্লান্ড থেকে নিঃসৃত গ্রোথ হরমোন। বংশগতি বিদ্যানুযায়ী, গ্রোথ হরমোন মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি না হয় তাহলে উচ্চতা হ্রাস পায়।

তদ্রুপ এই হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ মানুষের উচ্চতা অত্যধিক করেও দিতে পারে। হরমোন গ্রোথের হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষের শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তার হাড় ও দাঁতের গঠনে পরিপূর্ণতা বিলম্বিত হয়। এছাড়া রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা কিনা রক্তনালী বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে হৃদরোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়। শরীরে ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা, রোগ প্রতিরোধে অক্ষমতা ব্যক্তিকে অল্প সময়েই শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে তাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভবনাও দেখা যায়। ফলে তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে খুব কমই সঞ্চালিত হতে দেখা যায়।

ইনফেকশন সংক্রমণের কারণে ওয়াডলোর ব্যবহৃত অধিকাংশ জিনিসপত্রই মৃত্যুর পর তার পরিবার আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। ফলে তার ব্যবহৃত কোনো কিছুই সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হয়তো ওয়াডলোকে আরও কিছুদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখতে পারতো আমাদের মাঝে। তবে তৎকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থা আর রোগের সংক্রমণ সঠিক সময়ে চিহ্নিত করতে না পারায় দুর্ভাগ্যক্রমে খুব অল্প সময়েই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ওয়াডলোর পরে দ্বিতীয় স্থানে নাম লিখিয়েছিলেন জন রোগান, যার উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৮ ইঞ্চি। তবে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু বা লম্বা মানুষ হিসাবে ওয়াডলোর খেতাব কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

ফিচার ইমেজ- WordPress.com, tallsome

Related Articles