Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাজাধিরাজ শশাঙ্ক: হর্ষবর্ধনের ছায়ায় চাপা পড়া স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টার গল্প

বাঙালি রাজাদের মধ্যে প্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসেবে বহুল পরিচিত শশাঙ্ক। বাংলার ইতিহাসে তিনি একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। আর্যাবর্তে বাঙালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা ব্যক্তির নাম রাজাধিরাজ শশাঙ্ক। ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলায় রাজত্ব করেন বলে জানা যায়। গৌড়াধিপতি শশাঙ্ককে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

শশাঙ্কের বংশ কিংবা শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। কারো কারো মতে, শশাঙ্কের পূর্বনাম নরেন্দ্রগুপ্ত এবং তিনি গুপ্ত রাজপরিবারের সদস্য। কিন্তু এই মতটিকে সবচেয়ে ভিত্তিহীন বলে মনে করেন ঐতিহাসিকগণ। প্রাচীন রোহিতাশ্বের বা রোহতাসগড়ের পাহাড়ের গায়ে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ নামটি খোদাই করা আছে। যদি এই শশাঙ্ক আর গৌড়রাজ শশাঙ্ককে একই ব্যক্তি বলে ধরে নেয়া হয়, তবে বোঝাই যাচ্ছে শশাঙ্ক ছিলেন কেবল মাত্র একজন মহাসামন্ত। সে কারণে এখানে দ্বিতীয় একটি মত প্রতিষ্ঠা পায়, যার মূলকথা হলো শশাঙ্ক রোহতাসগড় রাজ্যের সামন্ত রাজা ছিলেন। ইতিহাস বলে, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে গুপ্তরাজ মহাসেন গুপ্ত মগধ ও গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। সুতরাং শশাঙ্ক এই মহাসেন গুপ্তের অধীনে গৌড়ের মহাসামন্ত ছিলেন, এটিই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মত।

রাজা শশাঙ্কের সময়কার বৌদ্ধমূর্তি; Source: historyfiles.co.uk

৬০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সীলের ছাঁচ, বাণভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাংয়ের বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শশাঙ্ক দক্ষিণে দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), উৎকল ও গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন। পশ্চিমে মগধ রাজ্যও জয় করেন তিনি। দক্ষিণবঙ্গে তৎকালীন বঙ্গদেশও শশাঙ্কের কাছে অধীনতা স্বীকার করে বলে জানা গেছে। শশাঙ্কের আগে আর কোনো বাঙালি রাজা এভাবে বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন কোনো নজির নেই।

কিন্তু এই প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরিদেরকে দমন করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন তিনি। কান্যকুঞ্জের মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা থানেশ্বরের রাজা প্রভাবর্ধনের মেয়ে রাজ্যশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন। এই দুই মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে সন্ধি করেন শশাঙ্ক। সমসাময়িক ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থ অনুযায়ী, মালবের রাজা গ্রহবর্মাকে যুদ্ধে হারিয়ে, তাকে মেরে ফেলে রানী রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করেন। এই খবর পেয়ে রাজ্যবর্ধন ছোট ভাই হর্ষবর্ধনের উপর রাজ্যসভার ভার ছেড়ে দিয়ে অবিলম্বে মাত্র দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বোনকে উদ্ধার করতে রওনা দেন। পথিমধ্যে মালবরাজের সাথে দেখা হয় তার। মালবরাজকে পরাজিত করে, তার বহু সৈন্যকে বন্দী করে থানেশ্বরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কান্যকুঞ্জে পৌঁছানোর আগেই শশাঙ্কের হাতে তার মৃত্যু হয়।

শশাঙ্কের সময়কার মুদ্রা; Source: slidesharecdn.com

অধিকাংশ পণ্ডিত গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য বলে ধরে নিলেও শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অভিযোগ এড়িয়ে যান। বাণভট্টের মতে, রাজ্যবর্ধন খুব সহজেই মালবের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন এবং তিনি গৌড়ের রাজার মিথ্যা আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র ও একাকী অবস্থায় শত্রুশিবিরে নিহত হন। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনায়ও একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। শশাঙ্কের শত্রুর মৃত্যুর প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব রয়েছে। তাই রাজ্যবর্ধনের প্রতি শশাঙ্কের আচরণ বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। নিজের পৃষ্ঠপোষকের ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত বাণভট্ট এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হর্ষবর্ধনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ হিউয়েন সাং উভয়েই তাদের মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। সম্ভবত এ কারণেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত বিবরণ দানে আবেগ দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন দুজন।

কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, রাজ্যবর্ধন খুব সম্ভবত শশাঙ্কের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি নিজে শত্রুশিবিরে আগমন করেন। হর্ষচরিতের চতুর্দশ শতাব্দীর ব্যাখ্যাকার শঙ্কর উল্লেখ করেন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে আমন্ত্রণ জানান রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। বিষয়টি কতটুকু সত্য তা নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন, কেননা শঙ্করের প্রদত্ত এ তথ্যের উৎস সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। হর্ষবর্ধনের লিপি উৎস বাঁশখেরা তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত তথ্য পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু বাণভট্ট ও হিউয়েন সাংয়ের বিবরণের মাধ্যমে সৃষ্ট দ্বিধা উপশমিত হয় তখন, যখন বাঁশখেরা তাম্রশাসন থেকে একটি তথ্য উদ্ধার করা হয় যেখানে বলা হয়েছে, হর্ষবর্ধনের ভাই রাজ্যবর্ধন ‘সত্যানুরোধে’ শত্রুর বাসভবনে প্রাণ ত্যাগ করেন। অবশ্য এখানেও শত্রুর নাম প্রকাশ করা হয়নি। এ থেকে মনে হয় যে, অসমাপ্ত শান্তি আলোচনার জের ধরেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এ দুর্ঘটনার জন্য শশাঙ্কের ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা যায় না।

এ ঘটনার পর রাজ্যবর্ধনের ছোট ভাই থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণকারী হর্ষবর্ধন বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে শশাঙ্ককে তার উপযুক্ত সাজা দিতে অগ্রসর হন এবং শশাঙ্কের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মনের (বাণভট্ট উল্লিখিত কুমার) সঙ্গে মৈত্রী জোট গড়ে তোলেন। বাণভট্ট সূত্রে জানা যায়, হর্ষবর্ধন ভাণ্ডির ওপর সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে নিজে বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে তার বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বোনকে উদ্ধারের পর তিনি নিজ সৈন্যদলের সাথে দেখা করেন। এরপর হর্ষবর্ধন বোন রাজ্যশ্রীর অনুমতি নিয়ে কান্যকুঞ্জর সিংহাসনে আরোহন করেন।

শশাঙ্কের সময়কার রৌপ্যমুদ্রা; Source: wikimedia.org

ভাণ্ডির সৈন্যবাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শশাঙ্ক শৌর্য-বীর্যের সঙ্গেই তার রাজ্য শাসন অব্যাহত রাখেন। শশাঙ্ক উত্তর উড়িষ্যা এবং বাংলা ব-দ্বীপাঞ্চলের দক্ষিণাংশও তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। হর্ষবর্ধন তার শাসনের শেষ দিকে অর্থাৎ ৬৪০-৪৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব বিহার ও উড়িষ্যায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং একই সময়ে ভাস্করবর্মন রাজধানী নগর কর্ণসুবর্ণ জয় করেন বলেও মনে করা হয়। এসব ঘটনা সম্ভবত শশাঙ্কের মৃত্যুর পরই ঘটেছিল, কেননা ততদিনে গৌড়শক্তির পতন হয়েছে এবং শশাঙ্ক সম্পর্কেও তেমন কিছু শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং শশাঙ্কের ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সমসাময়িক অপর কোনো উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। বরং সম্প্রতি দক্ষিণ মেদিনীপুর থেকে আবিষ্কৃত শশাঙ্কের শিলালিপিতে দণ্ডভুক্তি জনপদের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে, যা মেদিনীপুর ও উড়িষ্যার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল।

হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন মহান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। বৌদ্ধ ধর্মের একজন একান্ত অনুরাগী হিসেবে তিনি মহাযান মতবাদ প্রচারে কণৌজে এক বিশাল সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। হর্ষবর্ধন ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন বলে শোনা যায়। কণৌজের পর তিনি প্রয়াগেও একইভাবে বিশাল বৌদ্ধ সংগীতির আয়োজন করেন। কণৌজ ও প্রয়াগের বৌদ্ধ সমাবেশে হিউয়েন সাং এবং সীমান্তবর্তী সকল রাজ্যের রাজা, মন্ত্রী, অভিজাত প্রমুখ অংশ নেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন শশাঙ্ককে শায়েস্তা করার জন্যই বোধিসত্ত্বের নির্দেশে হর্ষের জন্ম হয়েছে বলে হিউয়েন সাং বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি শশাঙ্কের কয়েকটি বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী কাজকর্মের উদাহরণও তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে-

  • কুশীনগর বৌদ্ধবিহার থেকে বৌদ্ধদেরকে তাড়িয়ে সমূলে বৌদ্ধধর্মের বিনাশ ঘটানো।
  • পাটলিপুত্রে বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত এক খণ্ড পাথর গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করা।
  • গয়ার বোধিবৃক্ষ কেটে মাটি খুঁড়ে এর শিকড়গুলো কেটে ফেলে বাকি যা ছিল সব আগুনে পোড়ানো।

বর্তমান সময়ের গৌড়; Source: wikimedia.org

কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের (নালন্দা মহাবিহার) উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যেখানে হিউয়েন সাং নিজেও বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন এবং শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের কাছেই রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারসহ বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্ব থেকে হিউয়েন সাংয়ের দেয়া তথ্য সঠিক নয় বলে মনে হয়। অন্যদিকে হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং তার পৃষ্ঠপোষকের শত্রু শশাঙ্ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে হর্ষের প্রতি গভীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলেও মনে করেন ঐতিহাসিকগণ। গৌড়াধিপতির (শশাঙ্কের নাম উল্লিখিত হয়নি; শশাঙ্ক অর্থ ‘শিব’, আর সম্ভবত বাণভট্ট নিজেও শৈব মতাবলম্বী ছিলেন) বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট কটূক্তিপূর্ণ ভাষা যেমন ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ বা ‘গৌড়াধম’ ইত্যাদি ব্যবহার করে শশাঙ্কের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এটি সত্য যে, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক এবং শৈব ধর্মের প্রতি একান্ত অনুরাগী। ধনী বণিক শ্রেণী এবং তাঁর জাতশত্রু হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার কোনো সহানুভূতি ছিল না। কাজেই তৎকালীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনুভূতি এতে আহত হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

অপরপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি হর্ষবর্ধনের অনুরাগ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব (এ প্রসঙ্গে কণৌজ সমাবেশের সময় বিপুল সংখ্যক ব্রাহ্মণকে নৃশংসভাবে দমন করার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে) হিন্দুধর্মের অনুসারীদেরকে হতাশ করে এবং তারা বিপুল সংখ্যায় পূর্ব ভারতের দিকে অভিবাসন করে। হিউয়েন সাং কামরূপে বেশ কিছু শিক্ষিত ব্রাহ্মণের চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। বেশ কিছু ব্রাহ্মণ কামরূপে বসবাসের জন্য ভাস্করবর্মনের কাছ থেকে জায়গা লাভ করেন। কুলজি গ্রন্থে কণৌজের বেশ কিছু ব্রাহ্মণের বাংলায় অভিবাসনের উল্লেখ রয়েছে।

শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ; Source: historyofbengal.com

সরযূ (উত্তর প্রদেশ) তীরবর্তী অঞ্চল থেকে বাংলার দিকে গ্রহবিপ্রগণের অভিবাসনের গল্প, সম্ভবত শশাঙ্কের আমন্ত্রণে, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ও কামরূপে সাদরে গৃহীত হলেও এই বিপুল অভিবাসন শেষ পর্যন্ত এই দু’দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসনকালে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মেলামেশা, আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা তেমন একটা ছিল না; কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের গোঁড়া সমর্থক সেন রাজাদের সময় প্রবলভাবে এ সকল বাধা বিদ্যমান ছিল। এর ফলে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। সমাজে নিম্ন অস্পৃশ্য ও প্রান্তিক শ্রেণীর উত্থান ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে।

আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প মতে শশাঙ্কের রাজত্বকাল মাত্র ১৭ বছর। কিন্তু এটি যে ভুল তা প্রমাণিত হয় হিউয়েন সাংয়েরই দেয়া তথ্য থেকে। তার তথ্যানুযায়ী, ৬৩৭ সালের দিকেও তিনি রাজত্ব করেছেন এবং তার কিছুকাল পরেই মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বলেন, বুদ্ধমূর্তি নষ্ট করায় তার শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং সে কারণেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যথারীতি এ কথারও কোনো সত্যতা নেই। তৎকালীন সময়ের তিনটি লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শশাঙ্ক বেশ ভালো রাজা ছিলেন। বাণভট্টের মতো চরিত লেখক কিংবা হিউয়েন সাংয়ের মতো সুহৃদ থাকলে হয়তো হর্ষবর্ধনের মতো তার খ্যাতিও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নিজ দেশে অখ্যাত ও অজ্ঞাত শত্রুর কলঙ্ক-কালিমাই তাকে জগতে কুখ্যাতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: মজুমদার, রমেশ্চন্দ্র, বাংলা দেশের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ), জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স (১৯৯৮), পৃষ্ঠা নং- ৩১-৩৭

ফিচার ইমেজ- sirimunasiha.com

Related Articles