[চতুর্থ পর্ব পড়ুন]
স্ট্যালিন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। এ সময় জার্মানিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী নাৎসিরা ক্ষমতায় চলে আসে। উগ্র জাতীয়তাবাদী নাৎসিরা ছিল চরম কমিউনিস্ট বিরোধী। হিটলার প্রায়ই তার বক্তব্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্ট্যালিন বিরোধী কথাবার্তা বলতেন। নাৎসিদের উত্থানে স্ট্যালিন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। এদিকে পূর্বাঞ্চলে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক বৃহৎ শত্রু ছিল জাপান।
পশ্চিম ও পূর্বে এমন শত্রু দ্বারা বেষ্টিত সোভিয়েত ইউনিয়ন খুবই সচেতনভাবে তাদের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করতে থাকে। স্ট্যালিন প্রথমে ইউরোপের দেশগুলোর সাথে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। ১৯৩৩ সালে ইতালির সাথে, ১৯৩৫ সালে ফ্রান্সের সাথে এবং একই বছর চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে সহযোগিতা চুক্তি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
পশ্চিমা দেশগুলোর মতোই জাপানও ছিল কমিউনিজমের চরম বিরোধী। জাপানও ইউরোপের সোভিয়েতবিরোধী দেশগুলোর সাথে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের বিস্তার রোধে ১৯৩৬ সালের ২৫ নভেম্বর জার্মানি ও জাপান সোভিয়েত বিরোধী ‘এন্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট’ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ইতালিসহ আরো কয়েকটি দেশ এই চুক্তিতে যুক্ত হয়।
এই সময় ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন রিপাবলিকসদের সহযোগিতা দিতে শুরু করে। রিপাবলিকসদের সহযোগিতার জন্য স্ট্যালিন স্পেনে অস্ত্র ও কিছু সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করেন। পরবর্তী বছর ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় চীনা-জাপানি যুদ্ধ শুরু হলে সেখানে চীনাদের সহযোগিতা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন একটি অনাক্রমণ চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে। এভাবে ক্রমশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ শক্তিশালী খেলোয়াড়ে পরিণত হতে থাকেন স্ট্যালিন।
একদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জটিল আকার ধারণ করছে, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। অনেকদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকলেও জিনোভিয়েভ ও কামেনেভসহ স্ট্যালিন বিরোধী জোট আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে স্ট্যালিনবিরোধী শক্তি ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। স্ট্যালিন তাই স্বভাবসুলভ কারণে তার বিরোধীদের ডানা ছেঁটে ফেলার ছক কষতে থাকেন।
এমতাবস্থায়, ১৯৩৪ সালে স্ট্যালিনের বিশ্বস্ত সহচর সের্গেই কিরভকে, লিওনিদ নিকোলায়েভ নামক এক ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে। সের্গেই কিরভ ছিলেন স্ট্যালিনের অত্যন্ত অনুগত। অনেকদিন ধরেই স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরোধীমত দমন করতে চেয়েছিলেন। কিরভের হত্যাকাণ্ড তার সামনে এক বিরাট সুযোগ এনে দেয়। সের্গেই কিরভের মৃত্যুকে কমিউনিস্ট-বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন স্ট্যালিন। তার নির্দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে শুরু হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম শুদ্ধি অভিযান। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে এই কুখ্যাত অধ্যায়কে ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বা ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ নামে অভিহিত করা হয়।
পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে স্ট্যালিনবিরোধীদের খোঁজ শুরু হয়। তার নির্দেশে সোভিয়েত গোপন পুলিশ বাহিনী, যা এনকেভিডি নামে পরিচিত, ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে, পার্টির অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতকতা, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ব্যাপক খোঁজ চালায়। যারা স্ট্যালিনের আস্থাভাজন নয়, যারা কোনো একসময় স্ট্যালিনের বিরোধিতা করেছেন, এমন মানুষদের তালিকা তৈরি করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে সরকারি আমলা, সামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের উপর শুরু হয় অভিযান।
অনেকের মতে, সের্গেই কিরভের হত্যাকাণ্ড ছিল আসলে সাজানো ঘটনা, যাতে এই অজুহাতে স্ট্যালিন তার বিরোধীদের সরিয়ে দিতে পারেন। বিরোধীমত দমনকে বৈধতা দিতেই মূলত কিরভকে হত্যা করা হয়। এছাড়া, স্ট্যালিন কিরভের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নিয়েও ভয়ে ছিলেন। তাই তার নির্দেশেই কিরভকে হত্যা করা হয়। তবে অনেক ঐতিহাসিক এই দাবিকে সঠিক বলে মনে করেন না।
তবে গ্রেট পার্জের পেছনে যে শুধুমাত্র স্ট্যালিনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থই ছিল তা নয়। গ্রেট টেররের পেছনে বৈদেশিক শত্রুদের হাত থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষার চেষ্টাও ছিল। স্ট্যালিন বিশ্বাস করতেন যে একটি বড় যুদ্ধ আসন্ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমে জার্মানি ও ইঙ্গ-ফরাসি জোট এবং পূর্বে জাপান থেকে আক্রমণের হুমকিতে ছিল। ধনতান্ত্রিক এই দেশগুলো কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু ছিল।
স্ট্যালিন শত্রু দেশগুলো থেকে গুপ্তচরবৃত্তির ভয়ে ছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল, সাম্রাজ্যবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট বিপ্লবকে নাকচ করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। তাই যারা বিদেশী শক্তিকে সহযোগিতা করছে, তাদের গ্রেট পার্জের মাধ্যমে নির্মূলের প্রচেষ্টা চালান তিনি। এর মাধ্যমে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন।
এমন পরিস্থিতিতে স্ট্যালিন ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। একে স্ট্যালিন সংবিধান নামে অভিহিত করা হয়। এই সংবিধানের মাধ্যমে সোভিয়েত সরকারকে নতুনভাবে সাজানো হয়। সকল ধরনের নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়, যদিও বাস্তবে তা পূরণ করা হয়নি। কংগ্রেস অফ সোভিয়েতকে সুপ্রিম সোভিয়েতে পরিণত করা হয়। এই সংবিধান দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্ট্যালিনের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করে। প্রকৃতপক্ষে, এটি স্ট্যালিনকে সর্বাত্মকবাদী হয়ে ওঠার বৈধতা দেয়।
মস্কোতে পর পর তিনটি ট্রায়ালের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির অভিযুক্তদের বিচার করা হয়। এর মাধ্যমে স্ট্যালিন তার অনেক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সমালোচকদের সফলভাবে মুছে ফেলেন। লেভ কামেনেভ, গ্রিগোরি জিনোভিয়েভ, নিকোলাই বুখারিন এবং অ্যালেক্সেই রাইকভসহ বেশ কয়েকজন সাবেক উচ্চপদস্থ কমিউনিস্টের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। মস্কো ট্রায়ালসের মাধ্যমে অভিযুক্তরা বিশ্বাসঘাতকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ স্বীকার করেন। তবে এই স্বীকারোক্তি হুমকি ও নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছিল।
প্রথম ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৬ সালের আগস্টে। এই ট্রায়ালে কামেনেভ ও জিনোভিয়েভসহ মোট ষোলোজন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় ট্রায়াল শুরু হয় ১৯৩৭ সালের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় ট্রায়ালে মোট সতেরোজন নেতাকে সোভিয়েত বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয়।
১৯৩৮ সালের মার্চে তৃতীয় ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। সেবার নিকোলাই বুখারিন, অ্যালেক্সেই রাইকভসহ মোট একুশজনের বিচার করা হয়। মস্কো ট্রায়ালসের মাধ্যমে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তা কার্যকর করা হয়। গ্রেট টেররের সময় লিয়ন ট্রটস্কিকেও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু ট্রটস্কি বিদেশে পলাতক থাকায় তার বিচার কার্যকর করা যায়নি। তবে পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে মেক্সিকোতে আততায়ীর হাতে নিহত হন ট্রটস্কি। স্ট্যালিনের নির্দেশেই তাকে হত্যা করা হয়।
গ্রেট পার্জের মাধ্যমে রেড আর্মির অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও হত্যা করা হয়। শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি আমলা কিংবা সামরিক কর্মকর্তা নয়, স্ট্যালিনের সমালোচনা করা লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, কুলাকসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষের উপর নিষ্পেষণ চালানো হয়। এককথায়, গ্রেট পার্জের মাধ্যমে স্ট্যালিন তার সমালোচকদের চিরতরে মুছে দেন।
গ্রেট পার্জ চলাকালে, ১৯৩৭ সালে, স্ট্যালিনের মা একাতেরিন গেলাদজে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছেলের এত ক্ষমতা পছন্দ করতেন না এবং মস্কোতেও থাকতে চাইতেন না। স্ট্যালিন মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে জর্জিয়াতে যেতেন এবং প্রায়ই মাকেও মস্কো নিয়ে আসতেন। স্ট্যালিনের মেয়ে স্বেতলানা অলিলুয়েভা একবার বলেন, তার বাবা নিজের মা ছাড়া কাউকে ভয় পেতেন না। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য স্ট্যালিন তার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তবে তিনি ল্যাভরেন্টি বেরিয়াকে দূত হিসেবে জর্জিয়াতে পাঠান।
এই সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করে। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা শুরু করে। এ সময় জার্মানি তার সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৮ সালের মার্চে জার্মানি অস্ট্রিয়াকে সংযুক্ত করে নেয়। জার্মানির ক্রমবর্ধমান উত্থান ও আগ্রাসী আচরণে স্ট্যালিন আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন।
ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি কর্তৃক অস্ট্রিয়াকে সংযুক্তিকরণ অবৈধ হলেও ইঙ্গ-ফরাসি জোট বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ইঙ্গ-ফরাসি জোটের নীরবতায় জার্মানি আরো সাহসী হয়ে ওঠে। এরপর জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চল সুডেনল্যান্ডকে দাবি করে। জার্মানির এই দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির নেতারা জার্মানিতে একত্রিত হয়ে ১৯৩৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ‘মিউনিখ চুক্তি’ স্বাক্ষর করে।
মিউনিখ চুক্তি অনুযায়ী সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। মিউনিখ চুক্তির ফলে স্ট্যালিন হতাশ হন এবং তিনি এর কড়া সমালোচনা করেন। মিউনিখ চুক্তির ফলে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের উপর থেকে স্ট্যালিনের বিশ্বাস উঠে যায়। স্ট্যালিন বুঝতে পারেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলায় ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানিকে ব্যবহার করবে। মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানিকে বেপরোয়া করে তুলেছে। ১৯৩৯ সালের মার্চে জার্মানি পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয়। স্ট্যালিন অনুভব করেন, যুদ্ধ খুবই নিকটে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুত ছিল না। স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখতে চান। তিনি এটাও বুঝতে পারেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কিছুদিন আগে বা পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হবেই। তবে তিনি আক্রান্তের সময়সীমাকে বিলম্বিত করতে চেয়েছিলেন, যেন এই সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল জার্মানি থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দৌড়ঝাঁপ করেও ইঙ্গ-ফরাসি বলয়ের সাথে চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে জার্মানির সাথে চুক্তি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট মস্কোতে সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের উপস্থিতিতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাচিস্লাভ মলোটভ ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াছিম ভন রিবেনট্রপের মধ্যে দশ বছর মেয়াদি এক ঐতিহাসিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একে ‘মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি’ বলা হয়। এই চুক্তিকে অনেক সময় ‘হিটলার-স্ট্যালিন চুক্তি’ নামেও অভিহিত করা হয়। ইঙ্গ-ফরাসি জোটের কাছে এটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ছিল। এই চুক্তি গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়, কারণ পুরো বিশ্ব তখন জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছিল।
সেদিন মূলত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ছিল প্রকাশ্য, অন্যটি ছিল গোপন। গোপন চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। চুক্তির প্রকাশ্য শর্তানুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি একে অপরকে আক্রমণ করবে না বলে অঙ্গীকার করে।
মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি স্ট্যালিনের ভূরাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেয়। তিনি এর মাধ্যমে জার্মানির কাছ থেকে আক্রান্ত হওয়ার সময়সীমা দীর্ঘায়িত করেন এবং এই সময়ের মধ্যে রেড আর্মিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তিকে অনেক ঐতিহাসিক স্ট্যালিনের জন্য বড় বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেননা, এই চুক্তির মাধ্যমে স্ট্যালিন কমিউনিজমবিরোধী পশ্চিমা জোটকে ভাঙতে সক্ষম হন এবং জার্মানিকে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দেন। সেই সঙ্গে বিনা বাধায় পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নেন।
এই চুক্তি তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। চুক্তির এক সপ্তাহ পরই ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি তার প্রতিবেশী পোল্যান্ডকে আক্রমণ করে। ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরই সাথে শুরু হয়ে যায় আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের। স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নও পূর্ব ইউরোপে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি দেশ দখল করে নেয়।
জার্মানি, জাপান ও ইতালির সমন্বয়ে অক্ষশক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিভিন্ন দেশ দখল করতে থাকে। এমতাবস্থায়, স্ট্যালিন প্রথমে অক্ষশক্তিতে যোগদানের জন্য চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্ষশক্তিতে যোগ দেয়নি। নাৎসি আগ্রাসন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করতে স্ট্যালিন এবার নতুন পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।
গোয়েন্দাদের মাধ্যমে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পেরে স্ট্যালিন রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করেন এবং নিজে সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে এর নেতৃত্ব দেন। সেই সঙ্গে, স্ট্যালিন গিওর্গি ঝুকভকে প্রধান সামরিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ সময় অক্ষশক্তিতে যোগ না দিয়ে স্ট্যালিন জাপানের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
স্ট্যালিন চেয়েছিলেন পূর্বাঞ্চলে তার প্রধান শত্রু জাপানকে সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে। তিনি জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে না জড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে জার্মানির আগ্রাসন রুখতে চেয়েছিলেন। ১৯৪১ সালের ১৩ এপ্রিল মস্কোতে স্ট্যালিনের উপস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জাপান এক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর ফলে জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশই একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ এড়াতে পেরেছিল।
বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। এমতাবস্থায়, কিছু আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের জন্য স্ট্যালিনের দাপ্তরিকভাবে সরকার প্রধান হওয়ার প্রয়োজন। যদিও প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার প্রধান ছিলেন স্ট্যালিন, তবুও দাপ্তরিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভ্যাচিস্লাভ মলোটভ। ফলে, ১৯৪১ সালের ৬ মে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মলোটভের স্থলাভিষিক্ত হন স্ট্যালিন।