ছোটবেলায় দুষ্টুমি বেশি করলে দাদী- নানীদের বকা দিতে শোনা যেত এমনভাবে, “এত দস্যিপনা করিস না” অথবা বিরক্তির সুরে বলতে শোনা যেত, “কী দস্যু মেয়ে রে বাবা!” বিশেষ করে মেয়েশিশুদের দুরন্তপনায় বাঁধ সাধতেন মুরুব্বীরা। বর্তমান যুগ আধুনিকতার হাল ফ্যাশানে তুঙ্গে হলেও আপনি কি জানেন সেই প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষ জলদস্যুদের পাশাপাশি সমস্ত বাঁধা বিপত্তি, সামাজিক নিয়ম সত্ত্বেও কিছু কিছু জায়গাতে মহিলা জলদস্যুদের উপস্থিতিও বেশ আপত্তিকর এবং ত্রাসমূলকই ছিল বটে।
ভাবুন তো গৃহপ্রকোষ্ঠে থাকা নারীই কিনা পরিণত হয়ে উঠে জলদস্যুতে! কিন্তু কেন? কীভাবে? কেউ কেউ অর্থনৈতিক দৈন্যতায়, আবার কেউ দস্যু স্বামীর প্ররোচনায় জলদস্যু হয়ে উঠার ইতিহাসের সন্ধান মেলে। একেকজনের পেছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। দাদী- নানীদের নাতনীদেরকে দস্যু বলে শাসন করার পেছনে হয়তোবা প্রাচীন মহিলা জলদস্যুদের প্রতিকৃতিই ফুটে ওঠে।
সেই মহিলা জলদস্যুদের জীবন ইতিহাসও খুব একটা মসৃণ ছিল না। কী? খুব নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে কীভাবে মাঝ সমুদ্রে জীবন কাটাতেন সেই মহিলা জলদস্যুরা অথবা কীভাবে এলেন তারা দস্যুপনায়?
অ্যানি বনি
মহিলা জলদস্যুদের মাঝে নাম বলতে যার কথা উঠে আসে প্রথমেই তিনি হলেন অ্যানি বনি। তার সম্পর্কে খুব বেশি একটা তথ্য পাওয়া যায় না। তথ্য প্রযুক্তির বর্তমান যুগের প্রচলন যদি আদিমকাল থেকেই হয়ে আসতো, তবে হয়তো কোনো না কোনোভাবে এসব মহিলা জলদস্যুদের সম্পূর্ণ খবর উদ্ধার করা সম্ভব হতো।
অ্যানি বনি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে তার বেশির ভাগই চার্লস জনসনের, “অ্যা জেনারেল হিস্টোরি অফ দ্য পাইরেটস” গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। তাছাড়া সে সময়ের সরকারি নথি ও সমসাময়িক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে খুব জোরালো কোনো তথ্য সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে এক্ষেত্রে চার্লস জনসনের বইটির প্রথম সংস্করণ যথেষ্ট গোছানো এবং সমসাময়িক জলদস্যুদের জীবনী নিয়ে লিখিত।
বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে অনেকটা গবেষণামূলক ভাবে। তাতে মূলত জীবনীর উক্তি দেওয়ার তথ্যই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। বইটি থেকে যতদূর তথ্য মেলে তা হলো- অ্যানি বনি ছিলেন একজন আইরিশ মহিলা। মনে করা হয় তিনি ১৭০২ সালের ৮ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে বটে। বনির বয়স যখন খুবই কম, তখন থেকেই তিনি পরিবারের সাথেই নতুন বাসস্থানের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ শুরু করেন। জীবনের প্রথম দিকে কিছুতেই তার পিতা স্থায়ী আবাসস্থল নির্ধারণ করতে পারছিলেন না।
পরবর্তীতে উত্তর আমেরিকার দিকে ছুটে চলেন পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে। বনির পিতা ছিলেন আইনজীবী। মূলত আইন পেশায় সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে পরিবার সমেত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। মাঝে পরিবারের উপরে বয়ে গেলো আরেক ঝড়। উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার পর পরই বনির মা মৃত্যুবরণ করেন। আঁধারের পর আবার আলোর মুখ দেখতে পায় বনির পরিবার। তার পিতা অধিক লাভজনক বণিক ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতেই পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে।
সরকারি নথি পত্র মারফত জানা যায়, লাল চুলের অধিকারিণী বনি ছিলেন অত্যন্ত উগ্র মেজাজের। বনির বয়স তখন ১৩ বছর, সামান্য কারণেই রাগের বশে পরিচারিকাকে টেবিল ছুরি দিয়েই আঘাত করে বসেছিলেন। ভাগ্য ভালো ছিল বলেই সেদিনের সেই কাজের মহিলাটি বেঁচে গিয়েছিল।
তার ক্রোধের আরও একটি ঘটনা খুব প্রচলিত। অ্যানি বনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন জেমস বনি নামের এক দরিদ্র নাবিককে। জেমস অল্প কিছুদিন জলদস্যুতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। মূলত তখনই ঘটে অ্যানির জলদস্যুতা পেশায় হাতে খড়ি। অভাবের সংসারে জেমস বনি তার শ্বশুরের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার আশা করতেন। কিন্তু অ্যানির পিতা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন অ্যানিকে। তখন ক্রোধ বশত প্রতিশোধ নেওয়ার ছলে অ্যানি তার পিতার বাগানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আসেন।
১৭১৪ থেকে ১৭১৮ সালের মাঝে অ্যানি বনি ও তার স্বামী নাসাউ এ বসবাস শুরু করেন। ঐ স্থানটি তখন জলদস্যুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তখনকার রাজা অনেককেই সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনেছিলেন, আবার অনেককে শাস্তিও দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এটাও জানা যায় যে, ১৭১৮ সালে তৎকালীন গভর্নর ওউডস রজার সেখানে পৌঁছালে অ্যানি বনিকে সরকারি সংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্ত করেন।
উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অ্যানি বনির জীবনচরিত নিয়ে মতভেদ রয়েছে যথেষ্ট। কোনো কোনো গবেষক, গল্পকার, উপন্যাসিক অ্যানি বনির জীবনের শেষভাগের অন্য চিত্রও অঙ্কন করেছেন। তাদের মতে অ্যানি বনির স্বামী জেমস বনির উপযুক্ত সাহসের যথেষ্ট অভাব ছিল। সে কারণে অ্যানি তার স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন পুরুষের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এই পুরুষদের মধ্যে যার কথা বিশেষভাবে উল্লেখিত, তার নাম হলো ‘ক্যালিকো জ্যাক র্যাকম’।
তিনি ছিলেন একটি জলদস্যু জাহাজের অধিনায়ক। পরবর্তীতে অ্যানি জ্যাক র্যাকমের জাহাজেই দস্যুপনায় যুক্ত হয়েছিলেন এবং সে জাহাজেই তার সাথে পরিচয় হয় আরেক মহিলা জলদস্যু যার নাম ছিল মেরী রিড। অ্যানি বনি আর মেরী রিড দুজনের সহায়তায় জ্যাক র্যাকম ক্রুকে আরও রক্তাক্ত ও সহিংসতার দিকে আহ্বান জানান এবং একটি শক্তিশালী জলদস্যু বাহিনীতে পরিণত করেন। পরবর্তীতে জ্যাক র্যাকম ক্রু ধরা পড়ে এবং জ্যাক র্যাকম বন্দী ও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হয়।
কিন্তু অ্যানি ও মেরী অন্তঃস্বত্ত্বা প্রমাণিত হওয়ায় তাদের কারাগারেই রাখা হয়। দুর্ভাগ্যবশত মেরী রিড কারাগারেই মারা যান। অ্যানির কারাগারের শেষ জীবন নিয়েও মতভেদ প্রচলিত। কারো মতে অ্যানির পিতা তাকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার অনেক ইতিহাসবিদ বিখ্যাত মহিলা জলদস্যু অ্যানি বনির মারা যাওয়া বা তার স্বামী অথবা তার পিতার সাথে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন কিনা সেই সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেন নি। অ্যানির জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে এ কথা স্পষ্ট যে, প্রথম দিকের ঘটনাগুলো পর পর একই রকম থাকলেও শেষ পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট মত পার্থক্য লক্ষ্যণীয়।
মেরী রিড
মেরী রিড এর জীবন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপ অ্যান বনির মাধ্যমেই জানা যায়। এছাড়া মেরী রিডের প্রথম জীবনের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, মেরী ছিলেন জন্মসূত্রে একজন ইংরেজ। ঐতিহাসিকদের মতে তার জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ধারণা করা হয় তিনি ১৬৭০-১৬৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে এক ক্যাপ্টেনের বিধবা স্ত্রীর গর্ভে অবৈধভাবে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। এ তথ্যও মূলত জলদস্যু ইতিহাসবিদ চার্লস জনসন-এর ‘অ্যা জেনারেল হিস্টোরি অফ দ্য পাইরেটস’ গ্রন্থ থেকেই পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু কিছু ইতিহাসবিদ চার্লস জনসনের তথ্যকে ভুল বলে মনে করেন।
জনসনের তথ্য অনুযায়ী, রিডের মা তার অবৈধ সন্তান ধারণকে লোকজনের কাছ থেকে লুকানোর জন্য রিডের জন্মের পর তাকে ছেলেদের পোশাক পরাতেন। ছেলে বেশধারী রিড কিশোর বয়সে একটি জাহাজে কাজ পায়। পরবর্তীতে রিড ব্রিটিশ মিলিটারিতে যোগদান করে। ফরাসিদের সাথে যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশ মিলিটারি ও ডাচরা একত্রিত হয়েছিল। রিড ছেলেদের মতোই যুদ্ধে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু তিনি সেসময় একজন ফ্লেমিশ সৈনের প্রেমে পরেন। তারা তখন বিয়ে করেন। কিন্তু অভাগী রিডের ভাগ্যে বেশিদিন সুখের ছায়া জোটেনি। খুব অল্প সময়েই রিডের স্বামী অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
তারপর রিড পুনরায় পুরুষদের বেশভূষা ধারণ শুরু করেন। কোনো স্থানেই শান্তি খুঁজে না পেয়ে তিনি ক্রু দলের একজন হিসেবে অবশেষে একটি ডাচ জাহাজের মাধ্যমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে ডাচ জাহাজ ইংরেজ জলদস্যু জাহাজ চার্লস ভেইনের কবলে পড়ে। তখন ডাচ জাহাজের সমস্ত ইংরেজদের মাঝ থেকে একমাত্র রিডকেই জলদস্যু জাহাজে ক্রু হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
দিশেহারা মেরী রিড তখন জলদস্যুপনার সে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সমুদ্রে জলদস্যু জীবন যাপন অনেকটাই নৃশংস। তার মাঝে মেরী রিড তার পুরুষ বৈশিষ্ট্য গোপন রাখতে অনেক ধূর্ততার সাথেই কাজ করতেন। মেরী তার জলদস্যু জীবন বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন। ১৭১৮ সালে রাজা জর্জ জলদস্যুদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে মেরী রিড সরকারি পাইরেটস হিসেবে যোগদান করেন বলে জানা যায়।
কিন্তু ইতিহাসবিদ চার্লস জনসন-এর বই বলে অন্য কথা। সেখানে উল্লেখ আছে রিডের জাহাজ ‘ক্যালিকো’ জ্যাক র্যাকমের জলদস্যু জাহাজ কতৃক আটক হওয়ার পরেই তিনি অ্যানি এবং র্যাকমের সাথে দস্যুপনায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৭২০ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটিশ নেভাল ক্যাপ্টেন জনাথন ব্যারনেট কর্তৃক র্যাকম জলদস্যু জাহাজ আটক হয়। পরবর্তীতে মেরী রিড গর্ভবতী থাকায় তার মৃত্যুদন্ড স্থগিত করে কারাগারেই রাখা হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং গর্ভধারণজনিত সমস্যার কারণে ১৭২১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রচন্ড জ্বর নিয়েই মেরী রিড মারা যান।
অ্যানি বনি এবং মেরী রিডের সময়কে বলা হত জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ। তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই অনেকটা মহিলা জলদস্যুদের প্রতাপ কমে আসে।