খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা কে হর তাকদির ছে পেহলে
খোদা বান্দেছে খোদ পুঁছে বাতা তেরি রাজা কিয়া হ্যায়!অর্থাৎ খুদিকে ততটাই উপরে তুলো; যেন প্রতি বার ভাগ্য লেখার আগে খোদা তোমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার অভিপ্রায় কী?’
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হলো। ব্রিটিশ রাজের সন্দেহের আঙুল গিয়ে পড়লো মুসলিমদের উপর। শুরু হলো নিপীড়নের নয়া ইতিহাস। বস্তুত তখন পৃথিবীতেই জাতিগতভাবে মুসলিমদের অবস্থা ভয়াবহ। বাইরে থেকে সাম্রাজ্যবাদের আঘাত আর ভেতর থেকে কুসংস্কারের দৌরাত্ম। এমন সিদ্ধান্তমূলক সময়েই ভারত ভূমিতে আগমন করলেন তিনি।
আল্লামা ইকবাল। ইউরোপে পরিচিত Poet of The East হিসেবে। তার লেখা পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয়ে দিয়েছে বিপ্লবের শক্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় দিয়েছে নতুন মাত্রা। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইসলাম চিন্তকদের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার পেছনে তার বাক্য অনুপ্রেরণার মতো। পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক পিতা। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পেছনেও তার চিন্তা। খোদ সৈয়দ আলি খোমেনি ১৯৮৬ সালে ঘোষণা করেন,
“ইরান ইকবালের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আমরা তার দেখানো পথে হাঁটছি।”
জীবন
নুর মুহম্মদ একজন ধর্মপ্রাণ সুফি। পূর্বপুরুষেরা কাশ্মিরী সাপ্রু বংশীয় ব্রাহ্মণ থেকে ইসলামে প্রবেশ করেছে। তাও তিন শতাব্দী আগের কথা। আরো পরে ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে থিতু হয়েছিল কোনো পূর্বপুরুষ। নুর মুহম্মদ সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। বিয়ে করেছেন ইমাম বিবিকে। ১৮৭৭ সালের ৯ই নভেম্বর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিলো ফুটফুটে পুত্র। সৌভাগ্যের কথা ভেবেই নাম রাখলেন ইকবাল। সেই ছেলেটা বড় হতে থাকে। বাল্যকাল অতিবাহিত হয় বিখ্যাত পণ্ডিত মীর হাসানের সাহচার্যে। উর্দু, আরবি ও ফারসিতে দক্ষতা আসে। বসতে শুরু করে কবিতার বৈঠকে।
শিয়ালকোট থেকে এফ.এ পাশ করে ১৮৯৫ সালে লাহোর গেলেন তরুণ ইকবাল। লাহোর সরকারি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৯৯ সালে দর্শনে এম.এ ডিগ্রি লাভ নিলেন। চলতে থাকে কবিতা চর্চা। লাহোর অরিয়েন্টাল কলেজ এবং পরে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন ৬ বছর। তারপর ১৯০৫ সালে পাড়ি জমান ইউরোপে। এই আবহাওয়া পরিবর্তন তাকে পুরোপুরি বদলে দিল। ম্যাকটাগার্ড এবং জেমস্ ওয়ার্ডের মতো দার্শনিকদের কাছে থেকে নেন দর্শনের পাঠ। ইতোমধ্যে লন্ডন থেকে করেন ব্যারেস্টারি।
১৯০৮ সালে প্রত্যাবর্তন করেন দেশে। লাহোর সরকারি কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ধীরে ধীরে চাকুরি ইস্তফা দিয়ে পুরো দমে শুরু করেন আইন ব্যবসা। কারণ, তাতে মুক্তভাবে চিন্তা করার অবকাশ থাকে। কবিতায় আন্দোলন তোলে তরুণ রক্তে। কবিত্বকে ছাপিয়ে যায় দর্শন। কখনো কবিতায়, কখনো বক্তব্যে প্রকাশ করতে থাকেন মৌলিক দার্শনিক চিন্তা।
কবিত্ব আর দার্শনিকতা সমাজ ও রাজনীতি থেকে বিমুখ করতে পারেনি। ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এলাহাবাদ অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির আভাস দিলেন। বিলেতের গোলটেবিল বৈঠকে দেখা যায় তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ। পরবর্তী পদক্ষেপ আরো জাঁকজমকপূর্ণ হতে পারতো। কিন্তু জীবন তাকে আর সুযোগ দেয়নি। ১৯৩৮ সালের ২১শে এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই ক্ষণজন্মা।
চিন্তা
ছন্দবদ্ধ ভাষায় মনের ঐকান্তিক আবেগকে সামনে তুলে আনার সময় ইকবাল কবি। অবশ্য কবিতার মধ্যেই স্ফুরিত হয়েছে তার দর্শন। কবিত্ব কিংবা দর্শন তাকে জীবন বিচ্ছিন্ন সাধনায় আবদ্ধ করেনি। উপরন্তু মানুষকে তৈরি করে দিয়েছে মুক্তির রাস্তা। আত্মবিশ্বাসের বলে মানুষ জল স্থল অন্তরীক্ষে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জানান দেবে; ইকবালের মূল শ্লোগান সেটাই।
মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হবে। দুর্বলতা কিংবা সমাজ বিমুখতার কোনো সুযোগ নেই সেখানে। মানুষ দুনিয়ায় এসেছে নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর দায়িত্ব নিয়ে। যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে সেই দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবে। তার জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। তারানায়ে মিল্লাতে ইকবাল গেয়েছেন-
“আরব হামার চীন হামারা হিন্দুস্থা আমার
মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতান হ্যায় সারে জাহা হামারা।”
অর্থাৎ
আরব আমার ভারত আমার চীন আমার নয় গো পর
মুসলিম আমি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে আমার ঘর।
ইকবালের চিন্তার মূল প্রেরণা ইসলামের প্রাণশক্তি। দার্শনিক নিৎশে এবং বার্গসৌঁ- এর প্রভাব থাকলেও জালাল উদ্দিন রুমিই তার ভাবগুরু। ছিল ইসলামি দর্শন এবং ইউরোপীয় চিন্তার মধ্যে সেঁতু বন্ধনের প্রয়াস। কোরান হাদিসে বিধৃত কর্মবাদ এবং পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে গভীর ঐক্য উপলব্ধি করেছেন তিনি। সেই সাথে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন পশ্চিমা চিন্তায় আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অভাবকে। ফলে কর্মবিমুখ আধ্যাত্মবোধ এবং আধ্যাত্মবোধ বিমুখ দর্শনচিন্তা উভয় দলই ইকবালের কলমে সমালোচিত।
খুদি
ইকবালের দর্শনের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে খুদি। খুদি বাস্তব সত্তা- যা নিজের জোরেই অস্তিত্বশীল। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আমরা এই সত্তার সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। প্যানথেইস্টিক দার্শনিকদের মধ্যে খুদির অস্তিত্ব অস্বীকারের প্রবণতা আছে। তাদের চোখে দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব এবং অলীক। জগৎ সত্তায় অস্বীকৃতি মানুষের নৈতিক, সামাজিক দায়িত্ব এবং আকাঙ্ক্ষার বিলুপ্তি ঘোষণা করে। ফলে জন্ম নেয় সীমাহীন কর্মহীনতা এবং জীবনবিরোধিতা।
ইকবালের ভাষ্যে, অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আমরা খুদিকে সরাসরি জানতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিরাট কাজ ও গভীর অনুভূতির সময় ওয়াকেবহাল হই খুদির অস্তিত্ব সম্পর্কে। ফলে সকল ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই খুদির প্রকাশ। খুদি ব্যক্তিত্বের আধার। ইচ্ছা, অনিচ্ছা, বিচার-বিবেচনা, সিদ্ধান্তের মধ্যে ক্রিয়াশীল।
খুদি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ক্রিয়াকে অনুভব করে নিজের মূল্যায়ন করে। ফলে খুদির অস্তিত্ব ইচ্ছাময়। প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার দিকে মানুষ যতো অগ্রসর হয়; জীবনের পথে সে ততো উন্নত। ইচ্ছাময় জীবন সম্প্রসারণশীল। ইচ্ছার সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েই খুদি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের রূপ লাভ করে। গতিতে জীবন; স্থিতিতে মরণ।
ইতর প্রাণী সহজাত প্রবৃত্তির বশেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে পরিবেশকে করে নিয়ন্ত্রণ। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণাধীন করার জন্য ও পরিবেশের উপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য মানুষ তার ইচ্ছাকে সম্প্রসারিত এবং খুদিকে বিকশিত করে। তার মানে, খুদি কোরানের তাকদীর ধারণাকে অস্বীকার করে না। বরং মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। তার চিন্তায় সৌন্দর্য প্রমাণের জন্য এই একটা গজলই যথেষ্ট।
জগৎ
দীর্ঘদিন ধরে দার্শনিকদের মধ্যে বহির্জগতের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়। ইকবালের কাছে বহির্জগত বাস্তব। আমরা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে এমন এক সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করি, যা অস্বীকার করা যায় না। আবার, প্রত্যেক প্রকার জ্ঞানের ক্ষেত্রেই ব্যক্তি এক বাস্তব সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করে। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়-এর দ্বৈত সত্তা প্রত্যেক জ্ঞানের জন্য অপরিহার্য। কাজের প্রচেষ্টা সচেতনতার শ্রেষ্ঠতম অবস্থা। কাজের প্রচেষ্টায় অবিরাম বিরোধী শক্তির বাঁধা আসে। এই বিরোধী শক্তি খুদি ছাড়া অন্য বস্তু। বাস্তব জীবন তাই খুদি ও পারিপার্শ্বিক জগতের নিরন্তর সংঘাত।
বিজ্ঞানীদের ভাষ্যে, জগৎ নিষ্ক্রিয় কণা পরমাণুর নামে সমবায়ে গঠিত। পদার্থ যেন পরমাণুর সমষ্টি ছাড়া কিছু না। দার্শনিক বার্কলে দেখিয়েছেন, বস্তু আসলে গুণ ছাড়া কিছু না; আর গুণ মনের প্রত্যক্ষণ মাত্র। অন্যদিকে এরিস্টটলিয় মতবাদে জগতকে নিশ্চল ও স্থির বিবেচনা করা হয়। ইকবাল এ ধরনের স্থির ও জড় জগতের ধারণায় বিশ্বাসী না। তার মতে, জগতের তাৎপর্য আছে, গতি আছে এবং উদ্দেশ্য আছে। জগতের নিয়ত পরিবর্তন এবং নবসৃষ্টির চাঞ্চল্য পূর্ববর্তী মতবাদগুলোতে উপেক্ষিত হয়েছে।
ইকবালের মতে, জগতে সকল পরিবর্তনের মূলগত সত্তা প্রাণ-প্রবাহ; যা প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই প্রবাহিত। মানুষের মধ্যে প্রাণ প্রবাহের প্রকাশ হলো ইচ্ছা। সমস্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্যেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা দেখা যায়। মানুষ শুধু বেঁচে থাকতে চায় না; জীবনকে উন্নত করার জন্য সংগ্রাম করে। ধর্ম, কলা, বিজ্ঞান এবং নীতি জীবনকে শক্তিশালী করার উপায় স্বরূপ। তাই ইকবালের মতে,
যা ব্যক্তিত্বকে শক্তিশালী করে, তা ভালো এবং যা ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করে, তা-ই মন্দ।
খোদা
পরম সত্তা বস্তুত খুদি বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সত্তা। তিনি অতুলনীয়; স্থান এবং কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ না। পরম খুদি সৃজনশীল; সৃষ্টি তার স্বরূপের বিকাশ মাত্র। কোনো খুদিকেই চরিত্র ব্যতীত চিন্তা করা যায় না; তাই পরম খুদির চরিত্র আছে।
খোদা সর্বজ্ঞানী। সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন কর্তা এবং কর্মের পার্থক্য চেতনা থাকে। খোদার ক্ষেত্রে এই দুইটি অভিন্ন। তিনি এক এবং বর্তমান মুহূর্তেই সমগ্র সৃষ্টিকে জানেন। আসলে খুদির নিকট অতীত কিংবা ভবিষ্যতও এক অনন্ত বর্তমান। অর্থাৎ বর্তমানের মধ্যেই অতীত ও ভবিষ্যত নিহিত। পরম খুদি সর্বশক্তিমান। তার মানেই এই না যে, তিনি সীমাহীন অন্ধতা, স্বেচ্ছাচার আর খেয়ালের বশবর্তী। এক বিশেষ অর্থে তিনি সীমিত নিজের স্বভাবের মধ্যে। খোদার এই শক্তি নিয়ম, ঐক্য ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ইকবালের বহু লেখাতেই পরম সত্তার সাথে মানব সত্তার যোগাযোগ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রাহাত ফতেহ আলির কণ্ঠে ডুব দেয়া যেতে পারে ইকবালের ভাব অনুসন্ধানে।
ইকবালের ভাষ্যে, পরম খুদির সাথে সসীম খুদির সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব। তবে, পরম খুদির মধ্যে লুপ্ত হওয়া সসীম খুদির লক্ষ্য না। পরম খুদির মধ্যে সসীম খুদির বিলুপ্তির আরেক অর্থ খুদির বিনাশ। খুদির বিলুপ্তি ইসলামের মূল শিক্ষার বিরোধী। খুদির বিনাশ সাধিত হওয়ার মানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ক্রিয়াবলির কোন অর্থ না থাকা। জীবন অর্থহীন না।
বিকাশ
পারিপার্শ্বিকতার সাথে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব। নিষ্ক্রিয় ও কর্মবিমুখ যোগী জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে অস্বীকৃতির নামান্তর। ইকবাল তাই বৈরাগ্যের ঘোরবিরোধী। সম্পূর্ণ নিশ্চল জগৎ মানুষের দাসত্বের ইঙ্গিত বহন করে। জগৎ গতিশীল ও বর্ধিষ্ণু, মানুষ তার নিরন্তর সাধনা ও সক্রিয়তার সাহায্যে জগৎকে আপন আদর্শে গড়ে তুলবে। ফলে মুসলিম জাতির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার জন্য ইকবালের চোখে কর্মবিমুখতা আর নিষ্ক্রিয়তা দায়ী।
মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ কতিপয় বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ শর্তের উপর নির্ভর করে। অতীত ইতিহাস ও কৃষ্টি খুদির বিকাশের পথে সহায়ক। কিন্তু অন্ধ অনুকরণ খুদিকে দুর্বল করে তুলে। খুদির বিকাশ অতীত আর বর্তমানের সমন্বয় করে। অতীত ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে বর্তমানের সীমাহীন সম্ভাব্যতার পতাকা উড়ায়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন নতুন উদ্দেশ্য সৃষ্টি ও তার বাস্তব রূপায়ণ। ইকবাল বলেন, ‘হৃদয়ে ইচ্ছা জাগ্রত রাখো, যাতে তোমার ধূলিকণা সৌধে পরিণত হয়।’ মুসলিম জাতির অধঃপতনে স্রষ্টার প্রতি অভিযোগ আকারে ‘শিকওয়া’ এবং সেই অভিযোগের জবাব ‘জওয়াবে শিকওয়া’-তে আছে ইকবালের বিশ্লেষণ। জনপ্রিয় দুইটাকে একসাথে শোনা যেতে পারে নাতাশা বেগ, ফরিদ আয়াজ এবং আবু মুহম্মদ ক্বাওয়ালের কণ্ঠে।
মুসলমানদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ পরজগতকেই কেবল আগ্রহের বিষয় করে তোলা। এই অতি অপার্থিবতা তাদের ইহজগতের শিকড় দুর্বল করে দিয়েছে। পৃথিবীতে স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠিত হতে হলে মুসলিম জাতিকে কর্মের পথে সক্রিয় ও উদ্দীপিত হতে হবে। ইহকাল এবং পরকাল- উভয়বিধ মঙ্গল লাভ ইসলামি জীবনাদর্শ। এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলেই পতন। ফলে ইকবাল এমন সমাজ প্রবর্তনের পক্ষপাতী যেখানে মানুষ পাবে আত্মবিকাশের পূর্ণ অধিকার। সমস্ত নিষ্পেষণের বাইরে গিয়ে থাকবে খুদির পূর্ণ বিকাশের সুযোগ। ইকবালের ভাষ্যে, সেই সমাজেই দার্শনিক নিৎশের স্বপ্ন দেখা সুপারম্যানের আবির্ভাব ঘটবে।
রচনাবলী
গারচি হিন্দি দার উজুবাত শাক্কার আস্ত
তারজ-ই গুফতারি দারি শিরিন তার আস্ত।
অর্থাৎ যদিও হিন্দুস্তানের ভাষা সুমধুর; কিন্তু দারি (ফারসি ভাষার-ই একটা প্রকার) মধুরতর।
কবিতা রচনার গোড়ার দিকে ইকবালের ঝোঁক ছিলো ফারসিতে। কবিতায় রচিত বারো হাজার পঙক্তির মধ্যে প্রায় সাত হাজারই ফারসি। ১৯১৫ সালের দিকে প্রকাশিত হয় আসরার-ই খুদি; আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বিখ্যাত খুদিতত্ত্ব। সমালোচকেরা একে তার শ্রেষ্ঠ রচনা বলে তকমা দেন। এর সূত্র ধরে লেখা হয়েছে পরবর্তী গ্রন্থ রুমুজে বেখুদি।
পারস্যের কবি হাফিজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গ্যাটে ১৮১৯ সালে প্রকাশ করেন ‘ভেস্ট অস্টলিখে দিভান’। পশ্চিমা দুনিয়ার বস্তুবাদকে তিরস্কার করা হয় তাতে। ইকবাল সেই সিলসিলাকে আরো এগিয়ে নিয়ে ১৯২৪ সালে প্রকাশ করলেন পায়ামে মাশরিক। তারপর ১৯২৭ সালে যাবুরে আজম, ১৯৩২ সালে জাভেদ নামা এবং ১৯৩৬ সালে ‘পাস চিহ বাআদ কারদ আয় আক্বওয়ামে শারকি মাআ মুসাফির’।
ইকবালের ফারসি রচনা দেখে ভারতীয় তরুণেরা উর্দুতে লিখতে অনুরোধ করে। সেদিকটা মাথায় নিয়েই ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় বাঙ-এ দারা। জীবনের তিনটা পর্যায়ে লেখা কবিতাগুলোতে দেশ ও জাতির প্রতি প্রেম ফুটে উঠেছে। স্পেন সফর থেকে ফিরে ১৯৩৫ সালে লিখেন বাআলে জিব্রিল এবং ১৯৩৬ সালে জারব-ই কালিম। সর্বশেষ লেখা আরমুগান-ই হিজাজ প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর।
ইকবাল ১৯০৮ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে করা থিসিস Development of Metaphysics in Persia প্রকাশিত হয়; যা মুসলিম ও পারসিক দর্শনচর্চার ইতিহাস তুলে ধরেছে। দীর্ঘদিনের সমস্ত দার্শনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে শক্তিশালী লেখা The Reconstruction of Religious Thought in Islam মূদ্রিত হয় ১৯৩০ সালে। এছাড়া পাঞ্জাবি ভাষাতেও কিছু কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। ভাষা আর বিষয়বস্তুর এই বৈচিত্র্য ইকবালকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। ইংরেজিতে অনূদিত লেখাগুলো দেখতে পারেন এখানে।
সবিশেষ
ইকবাল আধুনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে যুগান্তকারী হিসাবে পরিগণিত। মুসলিম জাতির অধঃপতন তাকে পীড়া দিয়েছিল। এক সময়ের বিশ্ববিজয়ী মুসলিম জাতির অধোগতির কারণ খুঁজতে থাকেন নিয়ত। কবিতা ও দর্শনের মাধ্যমে সেই অধোগতির কারণ বিশ্লেষণ ও সমাধানের নির্দশনা দান করেন। জাতিকে আত্মকলহ, ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিভেদ ভুলে সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের পতাকাতলে সমবেত হবার আহবান জানান।
ইকবাল নতুন সমাজ চেয়েছেন; যেখানে ইশকের মধ্য দিয়ে ইনসানিয়াত পূর্ণতা পাবে। সেই দিক থেকে ইকবাল বিপ্লবী। ইসলামের শিক্ষাকে দেখেছেন বৈপ্লবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখিয়েছেন পশ্চিমা অভিজ্ঞতাবাদের সাথে ইসলামের বিরোধ নেই। বরং ইসলাম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলে। কোরান ইহজগৎ আর পরজগতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মূল্যবোধসমূহের বাস্তব রূপায়ণের নির্দেশনা দেয়। ইকবালের সেই চিন্তাধারা শুধু মুসলিম জাতিকেই উদ্বুদ্ধ করেনি; বিশ্বের প্রগতিশীল মানবমনকেও আন্দোলিত করেছে। আধুনিক মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার যে উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে; তার যুগস্রষ্টা আল্লামা ইকবাল।
আরো দেখতে পারেন- আল্লামা ইকবালের বই, The Reconstruction of Religious Thought in Islam