মানুষের সৃষ্টির ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিকে নতুন ভাষা দান করার একটি মাধ্যম হলো সিনেমা। আজকের দিনে সিনেমা শুধুমাত্র বিনোদনের উপায় হয়েই বসে নেই, দর্শকের মনে অপার আনন্দের জন্ম দেবার পাশাপাশি এ মাধ্যমটি তুলে নিয়েছে তাদের অনুভূতিকে তীক্ষ্ণ করা এবং চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবার দায়িত্ব। মানুষের মনন, চিন্তা, দৈনন্দিন আচার ব্যবহারে সিনেমার প্রভাব নিয়ে আর নতুন করে বলার অবকাশ নেই।
বর্তমান যুগের একজন অনন্য প্রতিভাধর পরিচালক হয়তো সিনেমার এই বিপুল সম্ভাবনার কথা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ধারা। দর্শকের চোখের সস্তা মনোরঞ্জন অথবা নিম্নস্তরের চিত্তবিনোদন নয়, তিনি চান তার নির্মাণ দর্শকদের মনে চিন্তার ঝড় তুলুক, অনুসন্ধিৎসু করে তুলুক এবং মনে সঞ্চার করুক অজস্র ভাবনার। তবে তার পরিচয় শুধু মাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতাই নয়, তিনি একাধারে চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং পরিচালক।
তার পুরো নাম ক্রিস্টোফার এডওয়ার্ড নোলান, ডাকনাম ক্রিস। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭০ সালের ৩০ জুলাই যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টারে। মা আমেরিকান এবং বাবা ইংরেজ হবার কারণে নোলানের শৈশব কেটেছে লন্ডন এবং শিকাগোতে। ক্রিস্টোফার নোলান মূলত আইরিশ বংশদ্ভুত। তার দুই ভাই জোনাথন নোলান এবং ম্যাথিউ ফ্রান্সিস নোলান। বাবা ব্রেন্ডান নোলান ছিলেন একজন বিজ্ঞাপন কপিরাইটার এবং মা ক্রিসচিনা জেন্সেন ছিলেন একজন বিমানবালা।
ছোটবেলায় দেখা ‘ব্লেড রানার’, ‘স্টার ওয়ার্স’ এবং পরবর্তীতে ‘নোয়ার’ ধারার সিনেমাগুলো ভীষণভাবে দাগ কাটে তার মনে। বাবার সুপার এইট ক্যামেরা দিয়ে করা টুকিটাকি ভিডিওগুলোও তাকে ভীষণভাবে অনুরণিত করে। মাত্র ৭ বছর বয়সেই বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেন সুপার এইট সিনেমা। তাতে অভিনয় করান তার ছোট খেলনা এ্যাকশন ম্যানদের। কালক্রমে, ১৫ বছর বয়সেই তার আত্মোপলব্ধি হয়- তাকে সিনেমা তৈরির কারিগর হয়ে উঠতে হবে। এখনকার প্রাপ্তবয়স্ক নোলানের অনুপ্রেরনা রাইডলি স্কট কিংবা স্ট্যানলি কুবরিক হলেও কিশোর নোলানের অনুপ্রেরণার তালিকায় রয়েছেন গ্রাহাম সুইফট, এলান পার্কার, নিকোলাস রোয়েগ, জ্যাকুয়েস টোরনার প্রমুখ।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার সময় যুক্ত হন কলেজের ফিল্ম সোসাইটির সাথে। স্ত্রী এমা থমাসের সাথে এখানেই পরিচয় এবং একই সাথে সিনেমা নিয়ে কাজ করা শুরু। কলেজে পড়া অবস্থায় নোলান ১৯৮৯ সালে ‘টারান্টিলা’ এবং ১৯৯৬ সালে ‘লার্সেনি’ নামের দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানান। প্রথমটি যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের একটি ফিল্ম ও ভিডিও শোকেসে প্রদর্শিত হয় এবং দ্বিতীয়টি ১৯৯৬ সালে Cambridge Film Festival-এ, UCL- এর সেরা শর্ট ফিল্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। নোলান ১৯৯৩ সালে সিনেমা তৈরির উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি ক্যামেরা এবং সাউন্ডওয়ার্কের উপরও প্রশিক্ষণ নেন।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা হিসেবে তৈরি করেন ‘ডুডলবাগ’। ১৯৯৭ সালে নির্মিত মাত্র তিন মিনিটের এই সিনেমার মাধ্যমে নোলান বেশ সমাদৃত হন।
পরের বছর ফিচার ফিল্ম ‘ফলোয়িং’ তৈরি করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেন নোলান। ৬৯ মিনিটের এই সিনেমার চিত্রনাট্য ও পরিচালনার দায়িত্ব তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। স্বল্প বাজেটের সাথে মানিয়ে নিতে অভিনেতাদের দিয়ে প্রচুর রিহার্সেল করিয়ে নিতেন তিনি, যাতে ১-২ বারেই ফাইনাল টেক করে নেয়া যায়। সিনেমাটি মুক্তি পায় সান ফ্রান্সিসকো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। মাত্র ৬,০০০ ডলার বাজেটে তৈরি সিনেমাটি অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয়, ফলোয়িংকে বিবেচনা করা হয় একটি ‘ক্লাসিক নোয়ার’ হিসেবে। এই সিনেমাকে ঘিরে নোলান ঘটান এক মজার ঘটনা। ১৯৯৯ সালের হংকং ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘ফলোয়িং’ এর প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শকদের কাছ থেকে পরবর্তী সিনেমা ‘মেমেন্টো’ তৈরির ফান্ডিং জোগাড় করেন তিনি। বলা যায়, এই সময়টার পর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি নোলানকে।
২০০০ সালে স্ক্রিন রাইটার ছোটভাই জোনাথন নোলানের ছোট গল্প ‘মেমেন্টো মোরি’ অবলম্বনে নোলান তৈরি করেন তার দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম ‘মেমেন্টো’। সিনেমায় গল্পটি গড়ে ওঠে বিশেষ ধরনের অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত এক ব্যাক্তিকে নিয়ে, প্রেমিকার হত্যার প্রতিশোধের নেশায় যিনি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন তার প্রেমিকার ঘাতকদের।
মাত্র সাড়ে চার মিলিয়ন ডলার বাজেটকে পুঁজি করে ২৫ দিনের মধ্যে শুটিং শেষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন নোলান। ভিন্নধর্মী উপস্থাপন এবং ব্যতিক্রমধর্মী স্ক্রিনপ্লের জন্য সিনেমাটি সমালোচক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এছাড়াও এটি সে বছরই বেস্ট স্ক্রিনপ্লের জন্য অস্কার মনোনয়ন পায়। এটাই তার জীবনের প্রথম অস্কার নমিনেশন। চলচ্চিত্র মহলে এরপর নোলানের স্থান বেশ পাকাপোক্ত হয়। সমালোচক থেকে শুরু করে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার, প্রযোজকদের মনে শ্রদ্ধার স্থান দখল করে নিতে থাকেন তিনি।
দর্শকদের অপেক্ষাকৃত জটিল এবং গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্ন সিনেমা উপহার দেবার পর তিনি কাজ করেন হলিউড জগতের দুই কিংবদন্তী আল পাচিনো এবং রবিন উইলিয়ামসকে নিয়ে। ‘ইনসমনিয়া’ নামে ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি মূলত একটি নরওয়েজিয়ান সিনেমার রিমেক।
এক নিদ্রাহীন পুলিশের গল্প ইনসমনিয়া। এই সিনেমার পর পরই নোলান রুথ মেন্ডের ‘দ্য কি টু দ্য স্ট্রিট’ থেকে চিত্রনাট্য বানান যা এখনও মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও তিনি চেয়েছিলেন ‘হওয়ার্ড হিউজ’ কে নিয়ে তার লেখা অন্যতম সেরা চিত্রনাট্য দিয়ে একটি ছবি বানাবেন, যার নাম ভূমিকায় থাকবেন জিম ক্যারি। কিন্তু মার্টিন স্করসিজের ‘দ্য এভিয়েটর’ এর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যাবার কারণে সে কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি মনোনিবেশ করেন ডিসি কমিকস সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজ ব্যাটম্যান সিরিজের শেষ তিন পর্বের প্রতি।
ডেভিড গয়েরকে সাথে নিয়ে ২০০৫ সালে ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’ নির্মাণের কাজ শুরু করেন নোলান। ব্যাটম্যানের সিরিজকে তিনি উপস্থাপন করেন নতুন আমেজে, নতুন ভঙ্গিমায়। সিনেমাতে প্রতিটি চরিত্রের চিত্রায়নে নোলান নিয়ে আসেন হলিউডের প্রথিতযশা অভিনেতাদের। বিশ্বস্ত কর্মচারী আলফ্রেডের চরিত্রে মাইকেল কেইনের মতন নামী অভিনেতা, ফ্যাল্কনির চরিত্রে টম উইলকিন্সন আর গর্ডনের চরিত্রে নিয়ে আসেন গ্যারি ওল্ডম্যানকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান চরিত্র ব্যাটম্যানের ভূমিকায় তিনি বেছে নেন সদ্য ‘দ্য মেশিনিস্ট’ সিনেমার কাজ শেষ করা ক্রিশ্চিয়ান বেলকে। ‘দ্য মেশিনিস্ট’ সিনেমার জন্য নিজের শরীরে ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে ফেলেছিলেন বেল। সেসময় এমন একজনকে ব্যাটম্যান হিসেবে মনোনীত করা হয়তো কেবল নোলানের পক্ষেই সম্ভব ছিলো। ব্যাটম্যানের উপযোগী শারীরিক গঠন তৈরি করার জন্য তিনি বেলকে ৬ মাস সময় দেন। আর ৬ মাসের পর পেয়ে যান তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাটম্যানরুপী ক্রিশ্চিয়ান বেলকে। দর্শকদের মন জয় করে ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’ আয় করে প্রায় ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এরপর ২০০৬ সালে ১৯ শতকের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জাদুকরের কাহিনী নিয়ে নোলান তৈরি করেন ‘দ্য প্রেস্টিজ’ নামক মিস্ট্রি থ্রিলার ঘরানার সিনেমা যার সূত্র ক্রিস্টোফার প্রিস্টের একই নামের বই। নোলান ভ্রাতাদ্বয়ের চিত্রনাট্যের এই সিনেমা যৌথভাবে প্রযোজনা করেন ক্রিস্টোফার নোলানের স্ত্রী এমা এবং বন্ধু এরন রাইডার।
নোলানের অসাধারণ নৈপুণ্য আর নির্মাণশৈলীর কারণে সিনেমাটি জয় করে নেয় বিশ্বের লাখো দর্শকের মন। ৪০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই সিনেমাটি আয় করে নেয় প্রায় ১০৯ মিলিয়ন ডলার। তারই সাথে বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি এবং বেস্ট আর্ট ডিরেকশন ক্যাটাগরিতে একাডেমি এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় ‘দ্য প্রেস্টিজ’। সিনেমাতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ব্যাটম্যান এবং উলভারিন খ্যাত ক্রিশ্চিয়ান বেল এবং হিউ জ্যাকম্যান।
এরপরের সময়টা ইতিহাস তৈরির। ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’ এর বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত সিক্যুয়াল ‘দ্য ডার্ক নাইট’ এর ইতিহাস। এই সিনেমায় নোলান হিথ লেজারকে দেন জোকারের এক ভিন্ন রূপ। নোলান কি জানতেন, হিথ লেজারের অমায়িক অভিনয় দক্ষতায় সুপারহিরোকে ছাপিয়ে ভিলেনকেই সবাই আপন করে নেবে? আর মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পরেই তার সিনেমা কালজয়ী হয়ে উঠবে?
হয়তো জানতেন না। কারণ শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে, নিজের দীর্ঘ সময় ধরে পুষে রাখা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে টাকার দরকার ছিল, তার যোগানের জন্য জন্যই মূলত ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজ নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নোলান। কিন্তু নামটা যখন ক্রিস্টোফার নোলান, তখন ভেবে নেয়াই চলে আর পাঁচটা সাধারণ সুপারহিরো সিনেমার মতন হতে যাচ্ছে না সেটি, হয়েছেও তাই। এই সিনেমায় তিনি প্রচলিত সুপারহিরো সিনেমার সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দুর্নীতি, রাজনীতি, নৈরাজ্য, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ সবকিছু মিলিয়ে এক অসাধারণ মনস্তত্তের অবতারণা ঘটিয়েছেন। যার ফলস্বরূপ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আজীবন জায়গা দখল করে নিয়েছেন অভিনেতা হিথ লেজার এবং নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান।
২০১০ সালকে নোলানের ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবেই বলা যায়। কারণ এই বছর তিনি তার দীর্ঘ ১০ বছরের কল্পনা, পরিকল্পনা এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে তৈরি করেন সাই-ফাই ঘরানার সিনেমা ‘ইনসেপশন’। স্বপ্নকে বুনিয়াদ করে নিজের লেখা চিত্রনাট্যকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দেন, তার চিন্তার গভীরতা, অতুলনীয় সৃষ্টিশীলতা এবং অনন্য শিল্পীস্বত্ত্বাকে।
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগেও নোলান এই সিনেমায় ব্যবহার করেন ফটো ক্যামিকেল টাইমিং যা সিনেমায় ব্যবহৃত অনেক পুরনো প্রযুক্তি। সিনেমার মুখ্য চরিত্র হিসেবে তিনি বেছে নেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে। বিশ্বজোড়া হাজারো বিমোহিত দর্শককে সিনেমার শেষ দৃশ্য নিয়ে সংশয়ে ফেলে ‘ইনসেপশন’ আয় করে নেয় প্রায় ৮২৫ মিলিয়ন ডলার।
‘ইনসেপশন’ দর্শকদের মন যতটা জয় করে নিয়েছিল, ঠিক ততটাই হতাশ করেছিল ব্যাটম্যান সিরিজের শেষ অধ্যায় ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’। সিনেমায় গল্পের কিছু অসামঞ্জস্যতার ফলে সমালোচনার মুখোমুখি হন নোলান।
‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমার ব্যর্থতা নিয়ে বসে থাকেননি নোলান। বরং আরো অনেক বেশি উদ্দীপনা নিয়ে তার পরবর্তী সিনেমার কাজ শুরু করেন। কল্পবিজ্ঞানপ্রিয় সিনেমা পিপাসুদের মনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে ২০১৪ সালে তার নির্মিত গ্র্যাভিটেশনাল ফিজিক্স এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সূত্রনির্ভর সিনেমা ‘ইন্টারস্টেলার’। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে তিনি সাহায্য নিয়েছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কিপ স্টেফান থোর্নের। সিনেমার ভিএফএক্স উপদেষ্টা হিসেবে কাজও করেছেন। এই সিনেমা নিয়ে নোলানের বক্তব্য,
“ইন্টারস্টেলারকে পুরোপুরি বুঝতে হলে একবার দেখলে হবে না। অন্তত তিনবার কিংবা চারবার দেখে এর প্রতিটি বিষয় হয়তো বিশ্লেষণ করা সম্ভব।”
ওয়ার্ম-হোল, ব্ল্যাকহোল, স্পেস-টাইম রিপ্রেজেন্টেশন ভিজুয়ালি যতটা সম্ভব নির্ভুলভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন নোলান। ৮৭তম একাডেমি এওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ২৬টি বিভাগে মনোনয়ন লাভ করার পাশাপাশি সে বছর সর্বোচ্চ সাতটি বিভাগে অস্কার লাভ করে ছবিটি।
থ্রিলার, সাই-ফাই, সুপারহিরো ঘরানার একেক পর এক অনবদ্য সিনেমা উপহার দেবার পর নোলান সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধের পটভূমিতে সিনেমা তৈরি করবেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে মুক্তি পেল তার পরিচালিত সিনেমা ‘ডানকার্ক‘।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ১০ কোটি ডলার বাজেটের এই সিনেমাটি যৌথভাবে প্রযোজনা করছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন ফিওন হোয়াইটহেড, টম হার্ডি, কেনেথ ব্রানাগ, হ্যারি স্টাইলস প্রমুখ। এই সিনেমার দৃশ্যধারণ শুরু হয় ২০১৬ সালের মে মাসে ফ্রান্সে, আর শেষ হয় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। দীর্ঘ সময় নিয়ে জাহাজ, বিমান ও যোদ্ধাদের সমরাস্ত্র ডিজাইন করার পাশাপাশি এর দৃশ্যপট এবং সংলাপ নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন নোলান। বরাবরের মতন এবারও সমালোচক এবং দর্শকদের নিজস্ব চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার মুন্সিয়ানা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন তিনি। ফলে মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই ডানকার্ক আয় করেছে নির্মাণব্যয়ের অর্ধেক।
নোলানের অন্যান্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি হলো ‘জেঙ্গিস ব্লুজ’, ‘দিস আমেজিং শ্যাডোস’, ‘সাইড বাই সাইড’, ‘মেকিং ওয়েভস: দ্য আর্ট অফ সিনেমাটিক সাউন্ড’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ‘ম্যান অব স্টিল’, ‘ট্রান্সেন্ডেনস’ এবং ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস’ সিনেমাসমূহের প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হলিউড অঙ্গনের অসম্ভব প্রতিভাধর এই পরিচালক ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করতে নারাজ। স্ত্রী এমার সাথে ১৯৯৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং বর্তমানে তিনি চার সন্তানের জনক। এমা একজন পরিচালক এবং নোলানের সব ছবিই মোটামুটি তার সাথে যৌথ প্রযোজনায় তৈরি। তার বেশিরভাগ মুভিই শুটিং হয়েছে নকল নামে যা আদতে তার ছেলেমেয়েদের নামের সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়। যেমন-
- দি ডার্ক নাইট (২০০৮)- Rory’s First Kiss
- ইনসেপশন (২০১০)- Oliver’s Arrow
- দি ডার্ক নাইট রাইজেস (২০১২)- Magnus Rex
- ইন্টারস্টেলার (২০১৪)- Flora’s Letter
ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রচন্ড কর্মঠ এবং রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। আধুনিক যুগের পরিচালক হয়েও তার নেই কোনো মোবাইল ফোন, না আছে ইমেইল আইডি। ডিজিটালের চেয়ে ফিল্ম স্টকে শুটিং তার প্রথম পছন্দ। সিনেমায় ডিআই এমনকি সেকেন্ড ইউনিট ব্যবহার করেন না তিনি। ওয়ালি ফিস্টারকে নিয়ে নিজেই প্রতিটি শট পরিচালনা করেন। চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে ঘটনা এবং চরিত্র সম্পর্কে প্রচুর চিন্তা করে গল্পের আউটলাইন তৈরি করেন। নোলান তার দর্শকদের তার সিনেমার সাথে সম্পৃক্ত করতে চান, তাই তার বেশিরভাগ সিনেমাতে তিনি ‘নন লিনিয়ার স্টোরিটেলিং’বেছে নেন। তার সিনেমায় লক্ষ্য করা যায় প্রতিশোধ, ক্রোধ, অপরাধবোধ, একাকিত্ব, আত্মত্যাগ, স্মৃতি, ঘোরে আবদ্ধ থাকার মত সাধারণ কিছু বিষয়বস্তু। নৈতিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, বাস্তববাদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তিনি তার দর্শকদের উপর ছেড়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকেন। এ সম্পর্কে নোলান নিজেই বলেন,
“আমার মনে হয় দর্শকেরা এখনকার যুগের সিনেমার সাথে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে। তারা যা দেখছে এবং শুনছে সেটাই বিশ্বাস করে নিচ্ছে। তাই আমি সিনেমাকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করার পথ বেছে নিয়েছি।”
‘ইনসেপশন’, ‘ইন্টারস্টেলার’ খ্যাত হলিউডের বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর পরিচালকের ঝুড়িতে অনেক পুরস্কার থাকলেও এখন অব্দি অস্কারের সম্মান অর্জন করতে পারেননি নোলান। সেরা পরিচালকের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি আজও অধরাই রয়ে গিয়েছে তার। আশা করা যায়, এই বছর তার পরিচালিত ‘ডানকার্ক’ সিনেমাটি তার ক্যারিয়ারের ম্যাগনাম ওপাস হয়ে নিয়ে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত সম্মান এবং শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি।
ফিচার ইমেজ- y101fm.com