Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাডা লাভলেস: পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করে আসা সকলেরই অ্যাডা লাভলেসের নাম জানা আছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা হিসেবে না হলেও, পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে। তবে এই মহিয়সী নারীর সম্পর্কে অধিকাংশের জ্ঞানই কম্পিউটার শিক্ষা বইয়ের দু-চার লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ একজন দুর্দান্ত গণিতবিদের পাশাপাশি, অ্যাডা ছিলেন একজন চমৎকার কবিও। নিজেকে তিনি বিশ্লেষক এবং দার্শনিক বলতে ভালোবাসতেন। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, সংবেশন নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেছেন। নিজের গাণিতিক সংশয়গুলোকে কবিতার সাথে মিলিয়ে ফেলতেন অধিকাংশ সময়। তার এসব কাজকে অনেকে ‘পোয়েটিকাল সায়েন্স’ বলেও অভিহিত করেছেন। ১৯৩৫-৩৬ সালে প্রথম আধুনিক কম্পিউটার নির্মিত হবারও ১০০ বছর আগে, যখন কম্পিউটার শব্দটা শুধু বিমূর্ত ধারণাই দিত, তখন কম্পিউটার বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে পারা চাট্টিখানি কথা তো নয়! এই কঠিন কাজকে কীভাবে নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনে বাস্তবায়িত করলেন অ্যাডা লাভলেস, তা-ই জানবো আজ।

অ্যাডা লাভলেস; source: biography.com

১৮১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন অগাস্টা অ্যাডা বায়রন। লাভলেস মূলত বিয়ের পর তার পরিবর্তিত বংশনাম। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগপর্যন্ত অ্যাডা জানতেন না তার পিতা কে। কারণ, তার বয়স যখন মাত্র ১ মাস, তখনই তার মদ্যপ, বদমেজাজি এবং উন্মাদ প্রকৃতির বাবা লর্ড বায়রন তাকে এবং তার মা ইসাবেলাকে ত্যাগ করেন। অ্যাডার দুঃখের কেবল শুরু তখন।

পিতৃস্নেহ বঞ্চিত অ্যাডার জন্য অভিশাপ হয়ে আসে তার মায়ের অবহেলা। কোনো অজানা কারণে অ্যাডার প্রতি নিজের প্রায় সব আকর্ষণই হারিয়ে ফেলেন লেডি বায়রন। লেডি বায়রন জীবিত থাকলেও, মা বলতে অ্যাডার আর কেউ ছিল না! পিতামাতা উভয়ের জীবিতাবস্থায় এতীম বনে যাওয়া অ্যাডার লালনপালনের দায়িত্ব নেন তার আশীতিপর বৃদ্ধ নানী।

কয়েক বছর পর মাতামহীও অ্যাডাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। অভিভাবকহীন অ্যাডা প্রতিপালিত হন নানী বাড়ির আয়াদের কাছে। অবশ্য, মেয়ের থেকে আলাদা থাকলেও ইসাবেলা অ্যাডার পড়ালেখার ব্যাপারে মনযোগী ছিলেন। তিনি নিয়মিত অ্যাডার পড়ালেখার খোঁজ নিতেন এবং গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ১০ বছর বয়সেই তিনি ডায়েরী ঘেটে অ্যাডার মাঝে সুপ্ত সাহিত্য প্রতিভা আবিষ্কার করেন। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল সাহিত্য চর্চা মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলে, ঠিক যেভাবে লর্ড বায়রনের নৈতিক স্খলন হয়েছিল! এই বিশ্বাস থেকেই তিনি মেয়েকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে এবং বিজ্ঞান চর্চার কাছে রাখবার চেষ্টা করেন।

লর্ড বায়রন; source: poetryfoundation.org

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে অ্যাডাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন লেডি বায়রন। ততদিনে যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনাহারে, অপুষ্টিতে ক্লান্ত অ্যাডা। তার পিতার অপকর্মের বোঝা যেন তার কাঁধে এসে পড়েছিল। পান থেকে চুন খসলেই তাকে পড়তে হয়েছে মায়ের রোষের মুখে। বয়সের তুলনায় তাকে পড়তে হয়েছে অনেক বেশি বই এবং করতে হয়েছে অত্যাধিক গৃহস্থালি কাজকর্ম। এসবের পেছনে লেডি বায়রনের যুক্তি ছিল যে, শৈশব থেকে প্রচণ্ড পরিশ্রমী হলে ভবিষ্যতে সফল হবে অ্যাডা। অন্যথায় তার দেহে যে লর্ড বায়রনের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তা তাকে একদিন ঠিকই বিপথে নিয়ে ছাড়বে!

সে সময় ইংল্যান্ডে নারীশিক্ষার পথ একদমই সুগম ছিল না। তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ পেতেন। সে সূত্রে অ্যাডারও পড়ালেখার সুযোগ হয়। তার যখন ১৭ বছর, তখন তার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়া ঘটনাটি ঘটে। তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন কম্পিউটারের জনক বলে পরিচিত চার্লস ব্যাবেজ (যে পদে একসময় আইজ্যাক নিউটন অধ্যাপনা করেছেন)। তিনি জ্ঞাত হন যে, বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন কন্যা অ্যাডা বায়রন গণিতে সকল শিক্ষার্থীর চেয়ে সেরা। সে সময় তিনি ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ নিয়ে কাজ করছিলেন। মেধাবী অ্যাডাকে নিজের গবেষণার সহযোগী হিসেবে পেতে তিনি অ্যাডা ও তার মাকে আমন্ত্রণ জানান ডিফারেন্স ইঞ্জিন দেখার জন্য। আর অ্যাডা? এই আমন্ত্রণ তার নিকট স্বর্গে যাবার আমন্ত্রণের সমতুল্য মনে হয়েছিল!

ডিফারেন্স ইঞ্জিন; source: theverge.co

ব্যাবেজের এই আমন্ত্রণের সূত্রে মা-মেয়ের সম্পর্ক পূর্বের চেয়ে অনেক গাঢ় হয়ে ওঠে। ডিফারেন্স ইঞ্জিন দেখার পর উভয়ের মাথায় এর কর্মপদ্ধতি বোঝার ভূত চেপে বসে। বিভিন্ন যন্ত্রের কলাকৌশল বোঝার জন্য তারা বিভিন্ন কলকারখানায় যাতায়াত শুরু করেন। এর মধ্যে ‘জ্যাকার্ড লুম’ নামক একটি বস্ত্রবুনন যন্ত্র অ্যাডার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়। এ যন্ত্রের কৌশলই তার ভবিষ্যৎ আবিষ্কারের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। জ্যাকার্ড লুম যন্ত্রটি পরিচালিত হতো একপ্রকার পাঞ্চকার্ডের মাধ্যমে। যন্ত্রে নির্দিষ্ট রকমের পাঞ্চকার্ড প্রবেশ করালে নির্দিষ্ট ধরনের বয়ন পরিচালিত হতো। এ ব্যাপারটিকে তিনি যন্ত্রের প্রতি নির্দেশনা তথা ‘মেশিন কোড’ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রোগ্রামিং এর ধারণা তখন থেকেই ঘুরতে থাকে পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামারের মাথায়।

জ্যাকার্ড লুম; source: nms.ac.uk

ব্যাবেজের সাথে কাজ করবার লোভ সংবরণ করে নিজেকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাডা। তিনি গণিতের উচ্চতর শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করতে লাগলেন অবাধে। তার সময়কার অন্যতম সেরা গণিতবিদ সমারভিলের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে গণিত শেখার খাতিরেই। আর সমারভিলের হাত ধরেই তিনি জটিল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেন। এসব কাজের মাঝেও যে ব্যাপারটি তিনি কখনো ভোলেননি তা হচ্ছে ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন।

১৮৩৫ সালে আর্ল অব লাভলেস, উইলিয়াম কিং কে বিয়ে করেন অ্যাডা বায়রন। সেই থেকে তার বায়রন প্রতিস্থাপিত হয় লাভলেস দ্বারা। ১৮৩৬-৩৯ সালের মধ্যে তার গর্ভে আসে ৩টি সন্তান। ঘন ঘন সন্তান জন্মদান এবং তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত অ্যাডার এ সময়টা কেটে যায় গাণিতিক জগতের বাইরে। কিন্তু, ডিফারেন্স ইঞ্জিনের প্রতি ঝোঁক যে তার তখনো প্রবলভাবে বিরাজমান। তাই দ্রুতই নিজের পুরনো ভালোবাসা গণিতের কাছে ফিরে এলেন। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক বিখ্যাত গণিতবিদ ডি মরগানের সাথে শুরু করলেন উচ্চতর সব গাণিতিক সমস্যা সমাধানের কাজ।

অ্যাডা লাভলেসের গণনার জন্য ডায়াগ্রাম; source: ganssle.com

১৮৪১ সালের দিকে চার্লস ব্যাবেজ ডিফারেন্স ইঞ্জিনের চেয়ে অধিকতর আধুনিক এবং জটিল কম্পিউটার ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’ এর ধারণা উপস্থাপন করেন। কম্পিউটারের ইতিহাসে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক অধ্যায়। তবে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের ধারণা সে সময়ের সাপেক্ষে এত অগ্রসর ছিল যে অধিকাংশের জন্যই তা বোধগম্য হচ্ছিল না।

কোনো এক লুইজি মেনাব্রিয়া নামক ফরাসি ব্যক্তি ব্যাবেজের লেকচার এবং অন্যান্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করলেন ‘দ্য স্কেচ অব চার্লস ব্যাবেজ’স অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’। ফরাসি ভাষায় রচিত এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যাবেজের পরিকল্পনাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা। অ্যাডা এই বইটিকে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। তার অনুবাদ এতটাই প্রাঞ্জল হয় যে, ব্যাবেজ তাকে এরকম একটি কাজ নিজে থেকে করার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। এই অনুপ্রেরণা বৃথা যায়নি। দু’বছরের মধ্যে বইটির দ্বিতীয় ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন অ্যাডা, যেখানে মূল বইয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি নিজস্ব নোট যোগ করেন তিনি!

অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের পরিকল্পনা করতে গিয়ে ব্যাবেজ যে সমস্যার সম্মুখীন হন তা হচ্ছে এই ইঞ্জিন গাণিতিক হিসাবগুলো কোন পদ্ধতিতে করবে তা। এক্ষেত্রে ব্যাবেজকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন অ্যাডা। তিনি অসংখ্য বীজগাণিতিক উপায় যোগ করেন তার নোটগুলোতে। অন্যদিকে ‘বার্নোলি সংখ্যা’ নামক একটি জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন ব্যাবেজ। অ্যাডা এই সমস্যার সমাধান করেন। তিনি পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার অ্যালগরিদম রচনা করেন। বার্নোলি সংখ্যার এই অ্যালগরিদমের জন্যই অ্যাডা লাভলেসকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। তবে, শুধু প্রোগ্রামিং এর মধ্যেই তার নাম আবদ্ধ করে ফেললে তার সাথে অবিচার করা হবে।

অ্যাডার অ্যালগরিদম তথা পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং; source: imechearchive.wordpress.com

আজকের যুগের আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা প্রবর্তনে ব্যাবেজের পাশাপাশি অ্যাডার ভূমিকাও অপরিসীম। অ্যালগরিদম রচনা করে তিনি অনুধাবন করেন যে, অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন কেবল গণনাযন্ত্র হিসেবে নয়, ব্যবহৃত হবে আরো অসংখ্য কাজে। তিনি তার নোটে লিখেছিলেন, যে কোনো বিষয় যেমন গান, ছবি ইত্যাদিকে যদি সংখ্যায় পরিণত করার উপায় খুঁজে বের করা যায়, তাহলে কম্পিউটারের মাধ্যমে তার পরিবর্তন করা সম্ভব। আজ আমরা জানি যে, সে উপায়টি হচ্ছে বাইনারি সংখ্যা। অ্যাডা লাভলেসকে তাই ধন্যবাদ না দিলেই নয়। তার জন্যই কম্পিউটার প্রথম ‘কেবল গণনাযন্ত্র’ পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসে। তাই অনেক সময় মনে প্রশ্ন এসেই যায়, চার্লস ব্যাবেজকে যদি আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা যায়, তাহলে অ্যাডা লাভলেসকে কেন আধুনিক কম্পিউটারের জননী বলা যাবে না! অবশ্য, জননী শব্দটির ব্যবহার নেই কোথাও। তাতে কী? অ্যাডার অবদানের কথা মাথায় রেখে এর প্রচলন করাই যেতে পারে।

অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন; source: libertaddigital.com

চার্লস ব্যাবেজ আর অ্যাডা লাভলেস যখন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটানোর দিকে, তখন পিছুটান হয়ে আসে অ্যাডার স্বাস্থ্য। যুগান্তকারী অ্যালগরিদম রচনার কিছুকাল পরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বেশ কয়েকবছর যাবত জরায়ুর ক্যান্সারে ভোগেন তিনি, যদিও তখনকার অনুন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞান তার রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ই করতে পারেনি। তার অবস্থার ক্রমাগত অবনতি দেখে ডাক্তাররা তার উপর গ্যালেনের ‘রক্তক্ষরণ’ পদ্ধতিও প্রয়োগ করে! এতে করে তার মৃত্যুটা বরং আরো ত্বরান্বিতই হয়েছিল। ১৮৫২ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর।

অ্যাডা লাভলেসের মৃত্যুতে সব ওলট পালট হয়ে যায়। তার অ্যালগরিদম বিষয়ক কাজ স্থবির হয়ে যায়, অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হন ব্যাবেজ। ফলে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন আর কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি। আমরা কেবল এ ব্যাপারে আফসোসই করতে পারবো যে, যদি অ্যাডা এত দ্রুত মারা না যেতেন, তাহলে কম্পিউটারের অগ্রযাত্রা হয়তো এতদিনে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেত। মৃত্যুর পূর্বে নিজের পিতাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তিনি এবং অনুরোধ করে গিয়েছিলেন পিতার সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করবার জন্য। তার ইচ্ছা অনুযায়ী নটিংহামের সেন্ট ম্যারি মাগদালিন চার্চে পিতার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

ফিচার ছবি: machinedesign.com

Related Articles