Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সক্রেটিস: যিনি জানতেন যে তিনি কিছুই জানেন না

“নিজের ব্যাপারে আমি বলবো, আমি এটাই জানি যে আমি কিছুই জানি না”

দার্শনিক সক্রেটিস, পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন যাকে বলা হয়, উপরের উক্তিটি তারই। জীবদ্দশায় তিনি যেমন ধাঁধার মতো ছিলেন, মৃত্যুর পরও চিরন্তন এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। দর্শন বিষয়ে যদিও কিছুই লিখে যাননি, তবুও তাকে হাতে গোনা কয়েকজন মহামানবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাদের দ্বারা পৃথিবীর মানুষের দর্শন চিরতরে বদলে গেছে। তিনি যেমন নিজের ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেছেন কিছুই জানেন না, আমরাও আদতে তার ব্যাপারে কিছুই জানি না। যতটুকু জানি, সবই তৃতীয় পক্ষের দেয়া তথ্য। তার উপর সেসব তথ্য নিয়েও আছে ব্যাপক মাত্রায় বিতর্ক। তথাপি যুগে যুগে সক্রেটিস অমর হয়ে আছেন।

সক্রেটিস; ছবিসূত্রঃ Wikipedia Commons

একাডেমিক দর্শন শাস্ত্রের মৌলিক বিষয় হিসেবে সক্রেটিস পড়ানো হয়। কিন্তু তার প্রভাব কেবল দর্শনের মধ্যে আটকে নেই। দর্শন ছাড়িয়ে তিনি মিশে গেছেন প্রতিটি যুগের মানুষের মাঝে। কেন তার এতো প্রভাব? কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না, নেই তার কোনো বই, তবু তাকে কেন বলা হয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক? চলুন জানার চেষ্টা করি তার সম্পর্কে। দেখা যাক কতটুকু জানা যায়।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (মতান্তরে ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এথেন্সের সিরকা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সফ্রোনিসকাস ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি ও ভাস্কর, মা ফায়েনারেত ছিলেন একজন ধাত্রী। সফ্রোনিসকাসের আয় একেবারে কম ছিল না, আবার পুরোপুরি স্বচ্ছলও বলা যায় না। অ্যালোপেস নামক রাজনৈতিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা সক্রেটিস শৈশব থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচিত হন। এথেন্সের নিয়মানুযায়ী ১৮ বছর বয়সের সকল যুবককে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হতো। এসব দায়িত্বের মধ্যে মূল দায়িত্ব ছিল মিলিটারিতে যোগ দেয়া। অন্যদিকে মিলিটারি বিষয়ক বিভিন্ন দিক নির্ধারণ এবং বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য যে অ্যাসেম্বলি ছিল, তাতেও যোগ দিতে হতো। এই কাজগুলোতে কোনো আপত্তি ছিল না সক্রেটিসের।

তখনকার এথেন্স সমাজে নারীর সৌন্দর্য নয়, বরং পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা হতো। সুন্দর, সৌম্য চেহারার পুরুষদের বিশেষ মূল্য দেয়া হতো সমাজে! কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, সক্রেটিস ছিলেন অতিমাত্রায় কুৎসিত! চোখগুলো তার কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইতো। নাকটি ছিল একেবারেই বোঁচা। তথাপি সক্রেটিস নিজের চেহারার এই কদর্য রূপের জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখী ছিলেন না। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন না করে বরং একই ময়লা জামা গায়ে দিয়ে আর স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া সক্রেটিসকে আরো কদর্য দেখাতো। এক কথায় কদর্য শব্দটিও যেন তার জন্য মানানসই নয়! পাঠক এখানে বলতে পারেন- লেখক একজন মহান মানুষকে কুৎসিত প্রমাণ করার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছে! আসলে আপনি, আমি বা আমরা কেউই কোনোদিন সক্রেটিসকে দেখিনি। তাই ইতিহাস যা বলে, তা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় আছে কি?

যুবক সক্রেটিসকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তার বাবা সফ্রোনিসকাস দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি এথেন্সের সকল যুবকের মতো সাধারণ বাধ্যতামূলক শিক্ষার বাইরেও সক্রেটিসের উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, বিশেষ করে সাহিত্য, সঙ্গীত এবং অ্যাথলেটিকসে। ফলে সক্রেটিস কাব্যচর্চায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একইসাথে তিনি সঙ্গীতে এবং শরীরচর্চায়ও দক্ষ হন। এ সময় বাণিজ্যটাও মোটামুটিভাবে রপ্ত করেন সক্রেটিস। তিনি ‘দ্য আগোরা’তে (আমাদের সুপারশপ আগোরা নয় কিন্তু, এথেন্সের বাজারকে আগোরা বলা হতো) মানুষকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে সময় কাটাতে ভালবাসতেন। এর ফলে অভিজাত পরিবারের যুবক শ্রেণীর মাঝে তার মোটামুটি রকমের জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়। এখানে প্লেটোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিয়ে

সক্রেটিসের দাম্পত্য জীবন নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে রয়েছে চরম বিতর্ক। কেউ মনে করেন তার একমাত্র স্ত্রী জ্যানথিপ, যার গর্ভে জন্ম হয় সক্রেটিসের তিন ছেলের। আবার কেউ দাবি করেন জ্যানথিপের ঘরে সক্রেটিসের প্রথম সন্তান ল্যাম্প্রোক্লেস এর জন্ম। পরে সক্রেটিস মির্তো নামক এক নারীকে বিয়ে করেন। মির্তোর গর্ভে জন্ম হয় সক্রেটিসের অপর দুই ছেলে সফ্রোনিসকাস এবং মেনেক্সেনাস এর। তবে আরেকদল পণ্ডিত মনে করেন সক্রেটিস আসলে দুজনকে একসময় বিয়ে করেছিলেন, কেননা এথেন্সে তখন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা কম ছিল!

ছবিসূত্রঃ davidmcleish

যা-ই হোক, সক্রেটিসের প্রথম বা একমাত্র স্ত্রী জ্যানথিপ ছিলেন অত্যন্ত ঝগড়াটে। প্রতিদিনই সক্রেটিসের সাথে তার ঝগড়া হতো। একদিন প্রচণ্ড রাগান্বিত জ্যানথিপ চিৎকার করে যাচ্ছিলেন আর সক্রেটিস বরাবরের মতো নিশ্চুপ ছিলেন। এক পর্যায়ে জ্যানথিপ সক্রেটিসের মাথায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন। তখন সক্রেটিস তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন,

“After thunder comes the rain”

বিয়ে সম্পর্কে তার আরো একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, “আপনি বিয়ে করুন আর না-ই করুন, উভয় ক্ষেত্রে পস্তাবেন!”

যোদ্ধা জীবন

সক্রেটিস তার মিলিটারি দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন। তিনি পতিদা যুদ্ধে বেশ বীরত্বের সাথে লড়াই করেন এবং এথেন্সের বিজয়ে সাহায্য করেন। যুদ্ধকালীন তিনি এথেন্সের জেনারেল অ্যালসিবিয়াদেসের জীবন বাঁচান। তিনি দিলিয়াম এবং অ্যাম্ফিপোলিস এর যুদ্ধেও অংশ নেন। তবে শেষোক্ত উভয় যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয় ঘটে।

পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ

৪৩১-৪০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এথেন্সবাসী তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রতিবেশী স্পার্টানদের সাথে এই যুদ্ধই পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে এথেন্সের একটি শ্রেণী, বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণী, স্পার্টানদের পক্ষে চলে যায়। কেননা এথেন্সের গণতন্ত্র ও মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় তারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার চেয়ে স্পার্টান সমাজ তাদের পছন্দ ছিল যেখানে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা চালু ছিল এবং সমাজের নিচু শ্রেণীর কথা বলার কোনো অধিকার ছিল না। যুদ্ধে শেষতক স্পার্টানদেরই জয় হয়। তবে স্পার্টানরা সরাসরি এথেন্সের ক্ষমতা নিয়ে নেয়নি। বরং তাদের সমর্থক অভিজাত এথেন্সবাসীদের মধ্যে বাছাই করে ৩০ জন ব্যক্তিকে ক্রিটিয়াসের নেতৃত্বে এথেন্সের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। এই ৩০ জন ‘দ্য থার্টি’ বা ‘টাইরেন্ট থার্টি’ নামে পরিচিত হয়।

গণতন্ত্রের শত্রু

বিভিন্ন কারণে ডেমোক্র্যাটরা সক্রেটিসকে গণতন্ত্রের শত্রু ভাবতে লাগলো। অ্যাম্ফিপোলিসের যুদ্ধের সাত বছর পর আনুমানিক ৪১৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন এথেন্সের নৌবাহিনী সিসিলি দ্বীপে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন এথেন্সে দেবী হার্মিসের কিছু মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, দেবী হার্মিসকে বলা হয় ভ্রমণকালীন নিরাপত্তা দানের দেবী। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে ‘ইলিউসিনিয়ান শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান’-এর অপবিত্রকরণ করে একদল লোক। অপবিত্রকরণ বলতে তারা অনুষ্ঠানটি কোনো পুরোহিতের উপস্থিতি ব্যতিরেকে নিজেদের বাড়িতে পালন করে যা রীতিবিরোধী। এই উভয় কাজেই যার নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তিনি অ্যালসিবিয়াদেস। ফলে তাকে নৌবাহিনী থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। শাস্তির ভয়ে তিনি স্পার্টায় আশ্রয় নেন।

কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য অনেকের শাস্তি হয়। দেখা যায় অনেকেই সক্রেটিসের ঘনিষ্ট। এতে সামান্য পরিমাণে হলেও সক্রেটিসের উপর সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এরই মাঝে ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একদল নাগরিক মিলে গণতন্ত্র অস্বীকার করে ক্যু করে বসে। অ্যালসিবিয়াদেস এই ক্যু এর সমর্থক ছিলেন। অন্যদিকে পারস্যের সাথেও তখন এথেন্সের দ্বন্দ্ব চলছে। অ্যালসিবিয়াদেস পারস্যের পক্ষ নেন। একে তো তিনি প্রথম থেকে স্পার্টানদের পক্ষপাতী, তার উপর পারসীদের সাহায্য করা। অর্থাৎ এথেন্সের দুই প্রধান শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে অ্যালসিবিয়াস হয়ে ওঠেন এথেন্সের ডেমোক্রেটদের প্রধান শত্রু। কিন্তু এই জটিল পরিস্থিতেও সক্রেটিস অ্যালসিবিয়াসের সাথে তার সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং তার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেন। ফলে অ্যালসিবিয়াদেসের কর্মকাণ্ডে পরোক্ষভাবে সক্রেটিসের হাত আছে বলেই ধারণা করে এথেন্সবাসী।

দ্য থার্টির অ্যাসেম্বলি এই স্থানেই হতো; ছবিসূত্রঃancient.eu

৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন ‘টাইরেন্ট থার্টি’র শাসন চলছে, তখন তাদের প্রধান ক্রিটিয়াস সক্রেটিসকে ৩০ বছরের নিচে কোনো যুবকের সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেন। একদিকে সক্রেটিসের সাথে ক্রিটিয়াসের অনেক পূর্বে থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল, অন্যদিকে সক্রেটিস ক্রিটিয়াসের আদেশ নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন। এই দুটি বিষয় সন্দেহ ঘনীভূত করে।

এদিকে ‘দ্য থার্টি’ এথেন্সের গণতন্ত্রকামীদের উপর অত্যাচার শুরু করে। তারা অসংখ্য ডেমোক্রেটকে নির্বাসনে পাঠায়। অনেককে অন্যায় অভিযোগ দিয়ে হত্যা করে। নির্বাসিতদের একদল সংগঠিত হয়ে ৪০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে ফিরে আসে এবং ক্রিটিয়াসকে হত্যা করে। স্পার্টার মধ্যস্থতায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এথেন্সে পুনরায় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং ডেমোক্রেটরা ‘জেনারেল অ্যামনেস্টি’ বা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। ফলে সক্রেটিসের প্রতি তাদের সন্দেহ প্রবল হলেও অ্যামনেস্টির কারণে তারা গণতন্ত্র বিরোধীতার নামে সক্রেটিসকে ফাঁসাতে পারছিল না

সক্রেটিস ও অ্যালসিবিয়াদেস; ছবিসূত্রঃ thegreatcoursesdaily.com

ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ

অ্যামনেস্টির কারণে আর কোনোভাবে ফাঁসাতে না পেরে সক্রেটিসের নামে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বলা হয় তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মের ক্ষতি করেছেন, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেননি, যুব সমাজকেও ধর্মবিরোধী করেছেন। মূলত প্রাচীন গ্রীসের ধর্ম বলতে শহরের লোকজনের জন্য পুরোহিত ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঠিক করে দেয়া রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানকে বোঝাত। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য আক্ষরিকভাবে ধরে রাখার নামই ছিল পবিত্রতা। অর্থাৎ ধর্ম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত ছিল। সে অর্থে ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করা মানে রাষ্ট্রে বিরুদ্ধে অপরাধ করা।

সক্রেটিসের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো তার সমসাময়িক সমাজ তার মতো প্রখর জ্ঞানী ছিল না। তারা ছিল রক্ষণশীল এবং সংকীর্ণমনা। সে সমাজের মানুষ বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এমনই ছিল যে, ঈশ্বর তাদের সৃষ্টি করেন নি বরং তারাই ঈশ্বরদের সৃষ্টি করেছিল! তৎকালে ঈশ্বরের সম্পর্কে নানান কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল, যেখানে দেখা যেতো দেবতারা সবসময় মানুষের উপকার করছেন না। বরং কখনোবা হিংস্র হয়ে উঠেছেন, কখনোবা ক্ষমতার প্রতাপে অন্ধ হয়ে মানবজাতির ক্ষতি সাধন করেছেন। কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন দেবতারা এরকম হতে পারেন না। তারা সর্বদা সত্যবাদী, উপকারী এবং জ্ঞানী। তিনি বিশ্বাস করতেন দেবত্ব যৌক্তিকতার অপর নাম। তারা মানুষের কাছে অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান আশা করেন না! তার এই তত্ত্ব ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে তার উপর এই অভিযোগও আনা হলো যে তিনি মানুষকে ঈশ্বর থেকে পৃথক করতে চাইছেন।

মৃত্যুদণ্ড

৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আদালতে সক্রেটিসের বিচারের রায় দেয়ার জন্য ৫০১ (মতান্তরে ৫০০ জন) জন জুরির সমন্বয়ে জুরিবোর্ড গঠন করা হলো। সক্রেটিসের যুক্তি হেরে গেল। ২২১ জনের নির্দোষ ঘোষণার বিপরীতে ২৮০ জন সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। সম্ভবত সক্রেটিস নিজের যুক্তিতে অনড় থেকে বিপদ বাড়িয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কি নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছেন কিনা। কিন্তু সক্রেটিস যেন খুব করে চাচ্ছিলেন তাকে মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হোক! দোষ স্বীকার করলে রায় অন্যরকমও হতে পারতো। কিন্তু তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবী করেন এবং তার কর্মকাণ্ডকে যুক্তিযুক্ত বলেন। তিনি তার অসাধারণ প্রজ্ঞা আর প্যারাডক্সিকাল বাচনভঙ্গিতে বিচারকদের কটাক্ষ করেন। দোষ স্বীকার তো দূরের কথা, তিনি বরং পুরস্কার দাবি করে বসলেন। বিচারকরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যান। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে রায় তার বিরুদ্ধে যায়। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। তিনি শান্তভাবে রায় মেনে নেন।

একটি ধর্মীয় উৎসবের জন্য তার মৃত্যুদণ্ড ৩০ দিন পিছিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠরা তাকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিলেও তিনি রাজি হননি। প্লেটো তাকে অন্তত প্যারোলে ৩০ দিন বাইরে থাকার আবেদন জানান। জেল কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার দ্রাকমার বিনিময়ে রাজি হয়। এখানেও সক্রেটিস তাদের উপহাস করেন এবং ১০০ দ্রাকমা দেয়ার প্রস্তাব করেন।

জীবনের শেষ দিনেও তিনি ছিলেন হাসিখুশি ও সহজ স্বাভাবিক। বিষ নিয়ে আসা লোকটির হাত থেকে বিষের পেয়ালা নিয়ে ‘হেমলক’ পান করতে তিনি খুব একটা বিলম্ব করলেন না। বিষ পান করার পর তিনি বিষক্রিয়ায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত ধীরে ধীরে হাঁটাহাঁটি করেন। তার বন্ধু এবং অনুসারীরা তাকে ঘিরে ছিল। যখন বিষ কাজ করতে শুরু করলো, তার পা অবশ হয়ে এলো, তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। ক্রিটো, অ্যাপোল্লোডোরাস, জেনোফোন সবাই একসাথে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বললেন, “ক্রিটো, আমি এসক্লিপিয়াসের কাছ থেকে একটা মুরগী ধার করেছিলাম, সেটা শোধ করে দিও।” কান্না বিজড়িত কণ্ঠে ক্রিটো দ্রুত উত্তর দিলেন, “অবশ্যই করবো, আপনার আর কোনো ইচ্ছা আছে?” এবার আর কথা বলছেন না সক্রেটিস। তার দেহ শীতল হয়ে এসেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। তবু সবাই চেয়ে আছে তার দিকে। তিনি আরো কিছু বলবেন সে আশায় কান খাড়া সকলের। কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না কেন? তার চোখগুলো স্থির হয়ে ক্রিটোর দিকে চেয়ে আছে। সক্রেটিস আর নেই। হেমলক তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।

ছবিসূত্রঃ lookandlearn.com

অনুসারীদের কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে কমে এলো, শোকের ছায়াও কমে এলো কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু যে প্রহসনের বিচার সেদিন হয়েছিল, তা আজ হাজার বছর পরেও যেন কল্পনায় ভেসে ওঠে আর ঘৃণায় ভরে ওঠে মন। মহাজ্ঞানীর সেই করুণ মৃত্যু অন্তর কাঁপিয়ে দেয় বারবার।

সক্রেটিক সমস্যা

১৯ শতকে প্রথম সক্রেটিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সক্রেটিসের জীবন, তার দর্শন ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসবিদরা যে সমস্যার সম্মুখীন হন তাই হচ্ছে সক্রেটিক সমস্যা। সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল না থাকাটাই মূল সমস্যা। সক্রেটিসের কয়েকজন অনুসারী তার সাথে কথোপকথনগুলো লিখে গেছেন, যেগুলো ‘লোগোই সক্রাটিকো’ বা ‘সক্রেটিক অ্যাকাউন্টস’ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে কেবল প্লেটো আর জেনোফোনের ডায়লগগুলোই টিকে আছে। ঊনিশ শতক পর্যন্ত সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রেটিসকে জানার জন্য কেবল জেনোফোনের ডায়লগের উপর নির্ভর করা হতো। তবে ফ্রেডরিখ শ্লেইয়ারম্যাসার তার গবেষণায় দেখান যে কেবল জেনোফোনের উপর নির্ভর করে সক্রেটিসের দর্শন বোঝা সম্ভব নয়। বরং প্লেটোর ডায়লগগুলো সক্রেটিস সম্পর্কে অধিক স্বচ্ছ ধারণা দেয়। এই দুজনের বাইরেও শ্লেইয়ারম্যাসার আরো একজনের গুরুত্ব তুলে ধরেন সক্রেটিসের দর্শন জানার ক্ষেত্রে। তিনি হচ্ছে অ্যারিস্টোফেন। তাছাড়া প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও সক্রেটিস সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে যান।

সক্রেটিসের দর্শন ও আরো কিছু বিষয়

  • সত্যিকারের জ্ঞানী হবার প্রক্রিয়াটি তখনই শুরু হবে যখন আপনি জানবেন যে আপনি কিছুই জানেন না।
  • আত্মার উন্নয়ন না করে শারীরিক সুস্থতা অর্থহীন। জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধনই মানুষের প্রথম ও প্রধান কাজ।
  • সক্রেটিসের দর্শনের আরেকটি দিক হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতে নিজের অবস্থান ধরে রাখা যদি কোনো ভুল না থাকে। এ প্রসঙ্গে আদালতে জুরিদের সামনে তার বক্তব্যের একাংশ তুলে ধরছি- “তোমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে যে দেবতারা আমাকে পাঠিয়েছেন তাদেরই দোষী প্রমাণ করা হবে। আমি সদা সর্বদা মানুষকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছি। আমার মতো কে আছে ? অতএব আমাকে মুক্তি দাও। এটা আমার আবেদন নয়, উপদেশ!”
  • “জ্ঞানই পুণ্য”- সক্রেটিসের শ্রেষ্ঠ দর্শন।
  • “অপরীক্ষিত জীবনের কোনো অর্থ নেই”- জুরিদের কাছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর সক্রেটিস এই উক্তিটি করেন। এর অর্থ এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়- জীবন পুষ্পশয্যা নয়। জীবনে সুখ দুঃখের উপস্থিতি আছে বলেই জীবন অর্থবহ।
  • সক্রেটিসের একটি বিশ্বাস ছিল এমন যে, কেউই সত্য জেনে ভুল করে না। মানুষের কাছে যা ভাল মনে হয়, তাই সে করে। সমাজ জানে চুরি করা মন্দ কাজ, কিন্তু একজন চোরের নিকট চুরি করাটা তার জীবন কিছুটা সহজ করার রাস্তা। তাই চোরের ধারণা চুরি করা ভাল কাজ এবং সে তা করে।
  • সক্রেটিসের দর্শনের আরেকটি দিক ছিল এমন যে অন্যায় করার চেয়ে অন্যায় সহ্য করা শ্রেয়।
  • সক্রেটিস তার প্যারাডক্সিকাল বাচনভঙ্গির জন্য বিখ্যাত। উদাহরণস্বরূপ- এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি সক্রেটিস?” সক্রেটিস তখন বললেন, “প্রমাণ করুন যে আমি সক্রেটিস নই!” প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিও তার কথার সামনে বোকা বনে যেত।

ফিচার ছবিসূত্রঃ Wikimedia Commons

Related Articles