Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রান্সেস আর্নল্ড: ইতিহাসের ৫ম নারী হিসেবে জিতলেন রসায়নে নোবেল পুরস্কার

– মিসেস আর্নল্ড, আপনি এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন!

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি তথা ক্যালটেকের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োকেমিস্ট্রির লিনাস পলিং অধ্যাপক ফ্রান্সেস আর্নল্ড। চলতি মাসের ২ তারিখ টেক্সাসে যান কোনো এক বিশেষ কাজে। সারাদিন কাজ করার পর হোটেলে ফিরেও কাজ করেন অনেক রাত পর্যন্ত। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। সকাল পেরিয়ে দুপুর হবার পথে তখনো ঘুম ভাঙেনি আর্নল্ডের।

হঠাৎ ব্যক্তিগত সেলফোনটি উচ্চস্বরে চিৎকার করতে শুরু করলে ঘুম ভাঙে তার। ফোনের স্ক্রিনে না তাকিয়েই ফোন রিসিভ করেন তিনি, ভেবেছিলেন ছেলে কল দিয়েছে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো মিসেস আর্নল্ড নোবেল পুরস্কার জিতেছেন! আকস্মিকতার প্রথম ঝাপটাতেই ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেলে তার। তবে বিশ্বাস তখনো হয়নি। “কী বলছেন আপনি?”- ঘুমের ঘোরে ভুল কিছু শুনেছেন কি না তা নিশ্চিত হবার প্রয়াস। কিন্তু মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমুদে গলায় কেউ একজন অভিনন্দন জানিয়ে নিশ্চিত করলেন, আর্নল্ড আসলেই নোবেল পুরস্কার জিতেছেন!

ফ্রান্সেস আর্নল্ড; image source: aiche.org

১৯০১ সাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ‘নোবেল’ প্রদান শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৩রা অক্টোবর তিনজন নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণার সাথে সাথে ১১৭ বছরে রসায়নে নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮০-তে। এই সম্মানিত ১৮০ জনের মাঝে ফ্রান্সেস আর্নল্ড কেবল ৫ম নারী! তবে নোবেল জয়ের সংবাদে উচ্ছসিত আর্নল্ড কিন্তু তার এই সাফল্যকে মোটেও অসম্ভব কিছু ভাবছেন না। বরং শত বছরের বেশি সময় সংখ্যাটা যে মাত্র ৫ এ আটকে আছে, এটাই তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। আর সেজন্য তার বিশ্বাস, আগামী ১০০ বছরে নারীরা পুরুষের চেয়ে অধিক নোবেল না জিতলেও কমও জিতবে না। তার ভাষ্য, “আমি নিশ্চিত যে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা ভাবেন নারীর দ্বারা অনেক কাজই সম্ভব নয়। ভাগ্যক্রমে এরকম ভাবনার মানুষের সাথে আমি পরিচিত নই। আমি নিশ্চিত যে অনাগত সময়ে নারীরা নোবেল জয়ের গৌরব আরো ঘন ঘন ছিনিয়ে আনতে শুরু করবে।”

সদ্য ঘোষিত ২০১৮ সালের রসায়নে নোবেল জয়ীদের তালিকায় ঠাই পেয়েছে তিনটি নাম। এ তিনজনের মাঝে মার্কিন রসায়নবিদ ফ্রান্সেস আর্নল্ড জিতেছেন অর্ধেক সম্মাননা। বাকি অর্ধেক তিনি ভাগাভাগি করেছেন আমেরিকান রসায়নবিদ জর্জ স্মিথ এবং গ্রেগরি উইন্টারের সাথে। স্মিথ এবং উইন্টার তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ক্যান্সারের আরোগ্য বিষয়ক গবেষণার জন্য এ সম্মাননা লাভ করেছেন। তবে আর্নল্ডের ব্যাপারটা মজাদার। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল নতুন এনজাইম প্রস্তুত করা। তিনি একে ‘রিরাইটিং দ্য কোড অব লাইফ’ বলে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে গবেষণাগারে যে এনজাইম উৎপাদন করা হচ্ছে, তার সিংহভাগই আসছে ‘ডিরেক্টেড ইভোলিউশন’ থেকে। আর এই ডিরেক্টেড ইভোলিউশন প্রক্রিয়া প্রথমবারের মতো পরিচালিত হয় যার হাতে তিনি ফ্রান্সেস আর্নল্ড। তার দেখানো পথে হেঁটে এনজাইম উৎপাদনের এ পদ্ধতি আজ অনেক উন্নত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এনজাইম জৈব জ্বালানি, ঔষুধ আর ডিটারজেন্ট তৈরিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়েছে।

২০১৮ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী (বাঁ থেকে) ফ্রান্সেস আর্নল্ড, জর্জ স্মিথ, গ্রেগরি উইন্টার; image source: physicsworld.com

নোবেল প্রাইজ অর্গানাইজেশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আর্নল্ড বলেন, “আমার মনে হয়, আমি যা করি তা সবই প্রকৃতিকে নকল করা। পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য আর বৈচিত্র আসে তো এই সহজ সাধারণ অ্যালগরিদম ডিজাইন থেকে।” তবে এ কথাগুলো যদিও আজ তিনি সহজেই বলে ফেললেন, এ পর্যায়ে পৌঁছুতে তার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

১৯৮০ সালে তিনি প্রথম এনজাইম নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এনজাইম হলো এমন একটি জটিল জৈব অণু, যা বিভিন্ন রকমের অ্যামিনো এসিডের লক্ষ লক্ষ সমবায়ে গঠিত হতে পারে। তাই এনজাইম পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন আর্নল্ড। এক দশকের মতো এর পেছনে সময় ব্যয় করেও কিছু করতে না পেরে এ প্রকল্প বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে দীর্ঘদিনের কাজ সহজে বাতিলের খাতায় ফেলেও দেয়া যায় না। আর্নল্ড তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রকৃতির উপাদান প্রকৃতির নিয়মেই তৈরি করার চেষ্টা করবেন তিনি। এনজাইমকে নিজের মতো করে মডিফাই করতে গিয়ে অনর্থক জটিলতা সৃষ্টি না করে বরং সহজে একে বিবর্তিত করলেই হয়।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি; image source: viveusa.mx

আর্নল্ড বলেন, “আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম কেন শত শত রসায়ন প্রকৌশলীর এনজাইম তৈরি প্রচেষ্টা বৃথা যাচ্ছিল। আমি এটাও বুঝতে পারলাম যে আমার ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক।” তিনি প্রথমে সাবটিলিজিন নামক একটি এনজাইমকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই এনজাইমটিকে একটি জৈব দ্রাবকে পরিণত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর এ কাজটা তিনি করলেন প্রাকৃতিক উপায়েই। তিনি প্রথমে এনজাইমটির জেনেটিক কোডে যদৃচ্ছ মিউটেশন ঘটালেন। আর এই মিউটেটেড বা পরিবর্তিত জিনগুলোকে চিরাচরিত নিয়মে ব্যাকটেরিয়ায় প্রবেশ করিয়ে দিলেন। তারপর নতুন সাবটিলিজিন তৈরির কাজটা ব্যাকটেরিয়াই করে দেয়। প্রাথমিক সাফল্যেই তিনি অন্যান্য এনজাইম নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেননি। তিনি সাবটিলিজিন নিয়েই কাজ করতে থাকলেন যতদিন না এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নমুনাটি তৈরি হলো।

“I am not a scientist and I am not a gentleman. I am an engineer!”- ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সেস আর্নল্ড

এনজাইম মিউটেশনের জগতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের সূচনা ছিল আর্নল্ডের এই গবেষণা। জেনেটিক কোড, অ্যামিনো এসিড সমাহার আর এনজাইমের নানা জটিল বিষয় একপাশে সরিয়ে রেখে আর্নল্ডের ‘ডিরেক্টেড ইভোলিউশন’ প্রয়োগ ছিল একইসাথে সাহসী এবং যুগান্তকারী। অথচ প্রাথমিকভাবে তার গবেষণা নিয়ে নাক সিটকেছেন অনেকেই। একবার তো এক আলোচনা সভায় কোনো এক অধ্যাপক পরোক্ষভাবে তাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “জেন্টলম্যান, যদৃচ্ছভাবে মিউটেজেনেসিস করা কোনো বিজ্ঞান নয়!” আর্নল্ডের কাছে এই বাঁকা মন্তব্য অবশ্য অর্থহীনই বটে। কারণ তিনি তার কাজ ঠিকই চালিয়ে গিয়েছেন এবং সফল হবার পর আজ নির্ভার কণ্ঠে জবাব দিয়েছেন যে, তিনি না কোনো বিজ্ঞানী, না কোনো জেন্টলম্যান

ফ্রান্সেস আর্নল্ডের পিতা পরমাণু পদার্থবিদ উইলিয়াম হাওয়ার্ড আর্নল্ড; image source: dignitymemorial.com

ফ্রান্সেস হ্যামিল্টন আর্নল্ডের জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গে। তার বাবা উইলিয়াম হাওয়ার্ড আর্নল্ড বিখ্যাত পরমাণু পদার্থবিদ হওয়াতে নিজ শহরে তারও একরকম পরিচিতি ছিল শৈশব থেকেই। কিন্তু বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে বাঁধে ফ্রান্সেস আর্নল্ডের। তাই মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন তিনি। স্থানীয় বারে ককটেইল পরিবেশিকার কাজ নেন। আর তখন থেকেই নিজের আলাদা পরিচয় গড়তে শুরু করেন তিনি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে বারে কাজ করার জন্য আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে কত শত কথা হতো। তার কানেও আসতো সেসব, কিন্তু তিনি পাত্তা দিলে তো? বরং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে ওয়াশিংটন ভ্রমণ করে আলোচনার জন্ম দেন কিশোরী আর্নল্ড। ১৯৭৯ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল এবং এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এক বছরের একটি কোর্স শুরু করেন তিনি। কারণ তখন তার ইচ্ছা ছিল কোনো বড় কোম্পানির সিইও বা কূটনীতিক হওয়া। এই স্বপ্নকে ধরতেই ভ্রমণ করেছিলেন ইতালি। সেখানে বছরখানেক একটি পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ কোম্পানিতে নির্বাহী পরিচালক পদে কাজ করেন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। এই কাজ অভিজ্ঞতার সাথে বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁকার অনুপ্রেরণাও যুগিয়েছিল কি না কে জানে!

১৯৮৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ফ্রান্সেস আর্নল্ড। স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতে তার জীবনের গতিপথ ততদিনে পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে তার স্বপ্নও। সিইও হবার জন্য যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দৌড়ে নেমেছিলেন, সে দৌড় থামিয়ে তিনি লেগে গেলেন সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণায়। আর স্নাতকোত্তর পাস করার শেষ বছর একটি ছোট পরিসরের গবেষণার মধ্য দিয়ে এনজাইম বিষয়ক গবেষণার জগতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে আর পিছুটান নেই তার জীবনে। জৈব রসায়ন নিয়ে গবেষণার জন্য ক্যালটেকে (ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) যোগ দেন। সেখানেই ধীরে ধীরে তার গবেষণা ডালপালা মেলতে মেলতে আজকের পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন মাত্র ৪ বছরে। আর পরবর্তী ৮ বছরের মধ্যে তিনি আজকের অবস্থান লিনাস পলিং অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ২০১৩ সালের দিকে তাকে ক্যালটেকের ডোনা ও বেঞ্জামিন বায়োইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের প্রধান পরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। এ পদে এখনো সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি।

সংক্ষেপে ডিরেক্টেড ইভোলিউশন; image source: cen.acs.org

যুক্তরাষ্ট্রে ৪০টির বেশি রাসায়নিক উদ্ভাবনের প্যাটেন্টের অধিকারী আর্নল্ড বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার কানাডা ফ্লিন্ট্রিজ শহরে বসবাস করেন। তিনি প্রথমে তার সহপাঠী জেমস বেইলিকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি ২০০১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বেইলির সাথে তার একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। ২০০২ সালে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট এন্ড্রু লেঞ্জকে বিয়ে করে তিনি। এই দম্পতির ঘরে ২ সন্তানের জন্ম হয়। তবে লেঞ্জের সাথে আর্নল্ডের দাম্পত্য জীবন খুব একটা ভালো কাটেনি। ২০১০ সালে পারিবারিক কলহের কারণে আত্মহত্যা করেন লেঞ্জ। তিন ছেলে আর নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল আর্নল্ডের। কিন্তু গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে তার ছোট ছেলে উইলিয়াম। এ ঘটনায় বেশ মুষড়ে  পড়েছিলেন আর্নল্ড। নোবেল পুরস্কারের সাফল্য তার সেই শোক পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে বলেই তার পরিবার পরিজনের আশা। ন্যাশনাল একাডেমি প্রাইজ, মিলেনিয়াম টেকনোলজি প্রাইজ সহ ১৩টি দেশি-বিদেশি পদক আর একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডিগ্রির তালিকায় সম্প্রতি যোগ হয়েছে নোবেল পুরস্কার। এই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিকে মোটেই সর্বোচ্চ সাফল্য ভাবছেন না ফ্রান্সেস আর্নল্ড। বরং এই সম্মাননা তার সাফল্যের ক্ষুধা আর সাফল্য পাবার চাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের মাত্র ৫ম নারী হিসেবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার জেতা ফ্রান্সেস আর্নল্ডের প্রত্যাশা, তিনি বিজ্ঞান বিশ্বকে আরো অনেক কিছু দেবেন, বিশ্বজুড়ে নারী বিজ্ঞানী আর গবেষকদের জন্য হবেন অনুপ্রেরণা।

ফিচার ছবি: research.princeton.edu

Related Articles