টেনিসের এক সত্যিকারের জাত শিল্পী যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড় সেরেনা জ্যামেকা উইলিয়ামস। বর্তমান বিশ্ব টেনিসে মহিলা এককে এক উজ্জ্বল নাম সেরেনা, বিশ্ব টেনিসের এক নম্বর আসনটি এখনো পর্যন্ত তারই দখলে।
১৯৮১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে জন্ম এই তারকার। রিচার্ড উইলিয়াম ও ওরেসেনা প্রাইসের পঞ্চ কন্যার ছোটটি হলেন সেরেনা উইলিয়ামস। রিচার্ড ছিলেন লুইজিয়ানার একজন প্রাক্তন ভাগ চাষী। তিনি তার দুই মেয়ে ভেনাস এবং সেরেনাকে টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং সবসময় চাইতেন, তার এই মেয়ে দু’টিকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দেয়ার জন্য। তাই ছোটবেলাতেই কোলের শিশু সেরেনাকে সাথে নিয়ে গোটা পরিবার সহ রিচার্ড সংসার পাতলেন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জলেসের শহরতলি কম্পটন অঞ্চলে।
সেরেনার হাতেখড়ি হয়েছে বাবার কাছ থেকেই। বাবা আর মেয়ের ঘাঁটি ছিল বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের এক টেনিস কোর্টে। যখন সেরেনা তিন বছরে সবে পা দিয়েছে, তখন তার বাবা টেনিসের বই আর নির্দেশ সংক্রান্ত ভিডিও টেপ কিনে দিন-রাত টেনিস খেলার ধরন এবং নানা নিয়মকানুন সম্পর্কে পড়াশোনা করতেন। শুধু রিচার্ডই নন, সেরেনার মা-ও সঙ্গী ছিলেন এই কাজে। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই, তাদের মেয়ে ভেনাস ও সেরেনাকে নিজস্ব নিজেদের তত্ত্বাবধানে তৈরি করবেন।
যেমন বাবা, তেমনই ছিল মেয়ে সেরেনা। সেরেনার শৈশব কেটেছে বোন ভেনাসের সঙ্গে টেনিস কোর্টে। একনাগাড়ে তিন বছর ধরে প্রতিদিন নিয়ম করে বাবার কাছে টানা দু’ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নিত ছোট্ট সেরেনা। তালিম নেয়ার পর সাড়ে চার বছরেই তিনি ঢুকে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের অনুর্ধ্ব ১০ প্রতিযোগিতার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে। পাঁচ বছরে ৪৯টি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ৪৬টিতে জেতে সেরেনা। ঐ বয়সে তার বিভাগে তিনিই ছিলেন নাম্বার ওয়ান।
১৯৯১ সালে রিচার্ড উইলিয়ামস সিদ্ধান্ত নিলেন, মেয়েকে তিনি আর জুনিয়রদের গ্রুপে অংশগ্রহণ করাবেন না। তিনি মেয়ের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য কোচ খুঁজতে লাগলেন। মেরি পিয়ার্স ও জেনিফার ক্যাপ্রিয়েতির কোচ রিক ম্যাসিকে মেয়ের কোচ হিসেবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লেন তিনি। কোচ রিক ম্যাসি এলেন কম্পটনে, দেখলেন সেরেনার খেলা, তার পরিশ্রমের ক্ষমতা দেখে অবাক হলেন। বুঝলেন, দক্ষতার পাশাপাশি সেরেনার শারীরিক সক্ষমতাও প্রচুর। রিকের আহবানে সাড়া দিয়ে নিজেকে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেরেনা নতুন উদ্যমে যোগ দিলেন ফ্লোরিডা একাডেমিতে।
১৯৯৭ সাল, টেনিস ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটেই তেমন আশানুরূপ হয়নি সেরেনার, যদিও ১৯৯৫ সালেই পেশাদার টেনিসের মঞ্চে তার প্রবেশ হয়। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সেরেনা ১৯৯৭ সালের টেনিস র্যাংকিংয়ে ৯৯তম স্থানে আসেন। ষোল বছরের মেয়ে সেরেনার এই স্থান অর্জনেই রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় টেনিস বিশ্বে। খেলার সাথে সাথে পড়াশোনায়ও কোনো কমতি রাখলেন না। টেনিসের ফাঁকে ফাঁকেই হাই স্কুলের গণ্ডি পেরুলেন। এদিকে পুমার বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুবাদে ১২ মিলিয়ন ডলার প্রাপ্তিযোগ হলো। সব মিলিয়ে তার টেনিস ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং সাফল্যের শিখরে উঠার প্রাথমিক সিঁড়ি হিসেবে রচিত হয়েছিল কৈশোরেই।
১৯৯৯ সালে ঘটে গেল দারূণ এক চমকপ্রদ ঘটনা। ইউ এস ওপেন আসরে দুই বোন সেরেনা আর ভেনাস প্রথম একসাথে ফাইনালে মুখোমুখি হলেন। টেনিস ভক্তদের অধীর আগ্রহ, দু’বোনের টেনিস যুদ্ধে কে জিতবে গ্র্যান্ড স্লাম? অবশেষে জয়ের মুকুট শোভা পেল সেরেনার ঝুলিতেই। সেটিই প্রথম সেরেনার গ্র্যান্ড স্লাম পদক।
২০০২ সাল। সেরেনা উইলিয়ামসের টেনিস জীবনে এক স্বর্ণালী বছর। এই বছরে সেরেনা ছিলেন যেন এক কথায় অপ্রতিরোধ্য। ১১টি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ৮টিতেই তিনি বিজয়ী! প্রাইজমানি পেলেন ৪ মিলিয়ন ডলার। ২০০৩ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেন সেরেনা।
জীবন কখনো এক গতিতে চলমান নয়। সেরেনার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম হলো না। ২০০৩ সালে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে বোন ইয়েতুন্দে প্রাইসের মৃত্যু হলে সেরেনার টেনিস খেলার সুতো কেটে যায়। এই হত্যাকাণ্ডের আজও কোনো সুরাহা হয়নি। বোনকে হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। মনঃসংযোগে ঘাটতি দেখা দেয়। মানসিক অবসন্নতা গ্রাস করতে থাকে তাকে। এরপর আবার পড়লেন ইনজুরিতে। তিন বছর পরেই দেখলেন, টেনিস র্যাংকিংয়ে তার অবস্থান নেমে গিয়ে দাঁড়ালো ১৩৯ এ।
২০০৯ সালে প্রকাশিত হলো তার আত্মজীবনী ‘কুইন অফ দ্য কোর্ট’। এ বছরই ফিরে পেলেন বিশ্ব টেনিস র্যাকিংয়ের প্রথম স্থান। চতুর্থবারের মতো জয় করলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং তৃতীয়বারের মতো পেলেন উইম্বলডন খেতাব। সেই বছরই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ও উইম্বলডনে বোন ভেনাসকে নিয়ে ডাবলসের শিরোপা জেতেন।
২০০৯ এ যেমন তার উত্থান, তেমনি এই বছরটা ছিল তার জীবনের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সেপ্টেম্বরে ইউএস ওপেনের সেমিফাইনালে কিম ক্লাইস্টার্সের কাছে হেরে যান। এই খেলায় সেরেনা বেশ কয়েকটি ফুট ফল্ট করেন এবং তা নিয়ে লাইন্সওম্যানের সাথে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। লাইন্সওম্যান সেরেনার বিরুদ্ধে খেলায় অশোভন আচরণ এবং তার জীবন হুমকির অভিযোগ আনেন। এজন্য তৎক্ষণাৎ যুক্তরাষ্ট্র টেনিস এসোসিয়েশন সেরেনাকে দশ হাজার ডলার জরিমানা করে এবং দু’মাস পর গ্র্যান্ড স্ল্যাম কমিটি দু’বছরের জন্য তার আচরণ ও কার্যকলাপ পর্বেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া তাকে আরো ৮২,৫০০ ডলার জরিমানা প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়। এতো বিশাল অঙ্কের জরিমানা দণ্ড এর আগে কোনো খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়নি।
২০১০ সালে সেরেনা এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। সে বছরে মহিলা একক দ্বৈতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং চতুর্বারের জন্য উইম্বলডন এককের শিরোপা জেতেন। ২০১১ সালে একের পর এক অসুস্থতায় শরীর কাহিল হয়ে পড়ে সেরেনার। ফুসফুসে রক্ত জমে এমন অবস্থা হলো, এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো মিডিয়া জগতে যে, সেরেনার টেনিস জীবন শেষ। কিন্তু মেয়েটির নাম তো সেরেনা, এত সহজে হার মানতে তিনি নারাজ। সেপ্টেম্বরের দিকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন তিনি।
২০১২ সালে উইম্বলডন সেমিফাইনালে ভিক্টোরিয়া অ্যাজেরেংকাকে পরাস্ত করে উঠলেন ফাইনালে। মুখোমুখি হলেন ২৩ বছরের অ্যাগনিসকার সাথে। জয়ী হওয়ার সুবাদে পঞ্চমবারের মতন উইম্বলডন জেতার অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন সেরেনা। সে বছরেই লন্ডনে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্ম অলিম্পিকে মারিয়া শারাপোভাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো মহিলা এককে অলিম্পিকের শিরোপা জেতেন। পরের দিনেই বোন ভেনাসকে সঙ্গে নিয়ে জেতেন মহিলা দ্বৈতের চতুর্থ অলিম্পিক সোনা।
২০১৩ সালের জুন মাস। ফ্রেঞ্চ ওপেনে ৬-৪, ৬-৪ ব্যবধানে শারাপোভাকে হারিয়ে ১৬তম গ্র্যান্ড স্লাম সিঙ্গেলস খেতাব করায়ত্ত করেন সেরেনা।
২০১৬ সালে রেডিট প্রতিষ্ঠানের কো-ফাউন্ডার অ্যালেক্সিস ওহেনিয়নের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সেরেনা উইলিয়ামস। ২০১৭ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেন, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তিনি যখন জানুয়ারি ২০১৭তে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা জেতেন, তখন তিনি ৪ সপ্তাহের সন্তানসম্ভবা! টেনিস ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিঙ্গেলস (২৩), মহিলা ডাবলস (১৪) এবং মিক্সড ডাবলস (২) মিলিয়ে মোট ৩৯ খানা গ্র্যান্ড স্লাম সেরেনা উইলিয়ামসের ঝুলিতে রয়েছে। তাছাড়া অলিম্পিকে চার বার সোনার পদকও জিতে নিয়েছেন তিনি। এই বিশাল অর্জন সম্ভব হয়েছে তার হার না-মানা মানসিকতার কারণেই। বিবিসির পাঠকদের দেওয়া ভোটে সর্বকালের সেরা নারী টেনিস খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তার আপামর টেনিস ভক্তদের বিশ্বাস, মা হওয়ার পরও তার এই সাফল্যের পথ চলা অব্যাহত থাকবে।