জাতির মুক্তি ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রতিটি সংগ্রামে তারা ছিলেন সম্মুখ সমরে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় যোদ্ধা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সদস্য কল্পনা দত্তকে নিয়ে আজকের এই লেখা।
অন্যান্য সাধারণ বাঙালী মহিলাদের থেকে বেশ খানিকটা লম্বা, ছিপছিপে গড়নের, সুন্দর, ঋজুদেহ, বলিষ্ঠ, কাঁচা হলুদ গায়ের রঙের সাথে ছিল ভীষণ মিষ্টি এক হাসি। তেমনি ছিলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দু’জন নারীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে তাদের একজন হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আর অন্যজন কল্পনা দত্ত। তিনি ছিলেন মাস্টারদার প্রিয় পাত্রী, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’ এবং চট্টগ্রামে সকলের ‘ভুলুদা’ নামে পরিচিত। নারীরাও যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন, সেই সময়ে তা কল্পনা করা যেত না। নারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ভিতকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
অনেকেই বিপ্লবী দলই মেয়েদের দলে নিতে উৎসুক ছিল না। কারণ বিপ্লবী কাজে প্রতি মুহূর্তেই বিপদ। বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদী ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজের অনুপযুক্ত। একজন নারীর পক্ষে তো বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সংগ্রামে যুক্ত হওয়া নিতান্তই কঠিন কাজ। তাছাড়া ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শেরও স্খলন ঘটতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করতেন। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছিলেন, “It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.” সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এই আইরন রুল-এর বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত।
১৯১৩ সালের ২৭শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর অঞ্চলে বোয়ালখালি গ্রামে কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মাতা শোভন বালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ইংরেজ প্রশাসনও তাকে যথেষ্ট সম্মান দিতেন। ফলে তাদের বাড়িটা সবসময় পুলিশের নজরের বাইরে ছিল। তবে শৈশব থেকেই কল্পনা ছিলেন অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা। মানসিক দিক থেকেও ছিলেন ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর। দুঃখী মানুষের দুঃখের কাহিনী তাকে ব্যথিত করতো। শৈশব তাই সকলকে নিয়ে এক সুখী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন।
বারো বছর বয়স থেকেই স্বদেশ ভাবনা তার মননে জাগ্রত হতে থাকে। তিনি নানা স্বদেশী বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ‘পথের দাবী’ এই ধরনের স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তার মনে হতে লাগলো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশে স্বাধীনতা আসবে, দেশের দুঃখ দূর হবে। তার ছোটকাকা তাকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার জন্য সর্বদা অনুপ্রেরণা দিতেন। ধীরে ধীরে দুঃসাহসিক কাজের জড়িত হওয়ার প্রতি তার আগ্রহ জাগে।
পড়াশুনায় বেশ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন কল্পনা। চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৯ সালে। সেসময় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। কলকাতার ঐতিহ্য সম্পন্ন বেথুন কলেজে এসে ভর্তি হন আইএ প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রাজনৈতিক জীবনকেই তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বেথুন কলেজে পড়তে পড়তে তিনি নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে। ফলে বেথুন কলেজে ছাত্রীদের উদ্যোগে সংঘটিত হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেয়ে স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে ভোরবেলায় কারও ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেল চালানো শুরু করেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন। এ সময়ে বিপ্লবী সূর্য সেনের অনুরাগী পুর্নেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে তিনি মাস্টার দার সাথে পরিচিত হন এবং মাস্টার দা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন। দলের সদস্য হয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।
১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়। লুণ্ঠন পরবর্তী সময়ে কল্পনা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য। তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামে। বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মাধ্যমে সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী হন। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টার দার সাক্ষাৎ হয়।
ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে কল্পনার এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে ফেরার সময় তিনি গোপনে কিছু বিষ্ফোরক নিয়ে আসেন, এছাড়াও গোপনে গান কটনও তৈরী করেছিলেন। সেগুলি চলে যেত জেলের ভেতরে। চট্টগ্রাম জেলে অনন্ত সিং প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ হতো কল্পনা দত্তের মাধ্যমে। এই সময় বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও সাজা রুখতে তিনি কোর্ট এবং জেলে ডিনামাইট দ্বারা বিষ্ফোরণের পরিকল্পনা করেন, যাতে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ পালাতে সক্ষম হন।
কিন্তু ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। কল্পনাকে সন্দেহ করে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেয় সরকার। চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে বিএসসি পড়ার অনুমতি দেয় সরকার, তবে অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয়। সেই সময়ে অনেকবারই রাত্রে পালিয়ে গ্রামে চলে যেতেন এবং সূর্য সেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতেন। এই সময় তিনি প্রায়ই মাস্টার দার সাথে তার গ্রামে ঘুরে গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের খবর নিতেন, বন্দুক চালানো শিখেন।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। কিন্তু তার পূর্বেই পুরুষের ছদ্মবেশে সহকর্মী নির্মল সেনের সঙ্গে মাস্টার দার কাছে দেখা করতে যাবার সময় পুলিশ কল্পনা দত্তকে গ্রেফতার করে। দুই মাস জেলে থাকার পর প্রমাণের অভাবে তিনি জামিনে মুক্ত হন। পুলিশ তার বিরুদ্ধে ১০৯ ধারায় অর্থাৎ ‘ভবঘুরে’ বলে মামলা দায়ের করে। পুলিশের সন্দেহ দৃষ্টি এড়াতে তাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন মাস্টারদা। এ সময় চট্টগ্রামকে মিলিটারি এরিয়া বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল মিলিটারি ক্যাম্প।
আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী সমুদ্র তীরবর্তী গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরে মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তিন মাস পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা দত্ত এবং তার সতীর্থ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন।
ঐ বছর ১৪ আগস্ট একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিপ্লবীদের বিচার শুরু হয়। এই মামলার নাম ছিল ‘‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’’। এর অভিযোগে ছিল রাজদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামী ছিলেন সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। তবে অনেক চেষ্টার পর সেই দ্বীপান্তরের আদেশ স্থগিত করা হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ বলেন, ‘‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না।’’ শাস্তি পাওয়ার পরেই হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় জায়াড, কোল, বার্নাড শ-এর লেখা সোস্যালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বই তার হাতে এলো। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। এতদিনকার পড়া বিপ্লবী সাহিত্যভাবের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছিল, তীব্র অনুভূতি মরণকে তুচ্ছ করতে শিখিয়েছিল। ‘‘সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদ’’ তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়।
১৯৩৭ সালে প্রদেশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। বিনা বিচারে রাজবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া, রাজনৈতিক বন্দীদের আন্দামান থেকে নিয়ে আসা এবং তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বাইরে জনসাধারণের তুমুল আন্দোলন হলো। বন্দীদের আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনা শুরু হলো ১৯৩৭-এর নভেম্বর মাসে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধীজী, রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। কারাবাস থেকে মুক্ত হবার সাতদিন পরেই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। শুরু হয় তার অন্য জীবন। সে সময়ে নিষিদ্ধ থাকা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন, মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। সাম্যবাদই প্রকৃত দেশপ্রেম এবং সেই দেশপ্রেম মানে জনগণের মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার কাজে আত্মনিবেদন করেন।
১৯৪০ সালে কলকাতায় চলে আসেন বিএ পরীক্ষা দিয়ে। জুলাই মাসে বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে চট্টগ্রামে পাঠানো হলো। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জাপানী আক্রমণের আশঙ্কায় জাপান বিরোধী প্রচারকাজে অংশগ্রহণ করেন কল্পনা। ১৯৪৩ সালে এদেশে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সারা বাংলায় ৫০ লক্ষ ও চট্টগ্রামে ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি নিরন্ন ক্ষুধাতুর মানুষদের সেবায় এগিয়ে আসে। ত্রাণের কাজে তিনি ঘুরে বেড়াতেন চট্টগ্রামের সর্বত্র।
১৯৪৩ সাল কল্পনা দত্তের জীবনে স্মরণীয়। এই বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন তিনি। বছরের শেষে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বরপক্ষের হয়ে সই করেন বি টি রণদিভে আর কন্যাপক্ষের হয়ে মুজফফর আহমেদ। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ির পাঠানো লাল রেশমি শাড়ি পরেননি কল্পনা। পরে সকলে মিলে সেই শাড়ি কেটে কেটে পার্টি ফ্ল্যাগ তৈরি করেছিলেন। বিয়ের পর তার নিজের জায়গা চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে মানুষের মধ্যে কাজ শুরু করেন কল্পনা।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগে, দেশী-বিদেশী উচ্ছৃঙ্খল সেনাদল চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার কাছাড়পাড়া গ্রামে আকস্মিক আক্রমণ করে। গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক অত্যাচার চালায়। কল্পনা পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সাহায্যে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করেন। সাতদিন হরতাল পালন করা হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ও সেনাবাহিনী পিছু হটে।
১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে, কংগ্রেস প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। নির্বাচনে কল্পনা জয়লাভ করতে পারেনি। খেটে খাওয়া গরিব নিম্নবর্গের মানুষদের ভোটাধিকার সে সময় ছিল না।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলো। জন্মভূমি ছেড়ে চলে এলেন ভারতে। রুশ ও চীনা ভাষায় দক্ষ ছিলেন। পরবর্তীকালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব রাশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সম্পাদক ও শিক্ষিকা হন। সক্রিয় ছিলেন পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসাইটি ও ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন-এর কার্যকলাপে। পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও জীবনাচরণে ও বিশ্বাসে আজীবন তিনি থেকে গিয়েছেন কমিউনিস্ট।
ইংরাজী ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তার লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ‘‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’’ নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। তার জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন সামান্য এক ভুলের কারণে। সেই মনোবেদনা নিয়ে ১৯৯৫-র ৮ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে কল্পনা দত্ত মৃত্যুবরণ করেন। দেশ ভাগের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন দু’বার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সমব্যথী।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত একটি চিরস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন এক অকুতোভয় নারী যোদ্ধা- কল্পনা দত্ত।