Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উইলিয়াম হার্ভে: রক্তসঞ্চালনের সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী

ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, যা আজ গ্রহণযোগ্য নয়, তা কাল সবাই গ্রহণ করবে। যার আবির্ভাব কাল হবে তাকে সবাই পরশু ভালোবাসবে! এরকমই তো হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভের কথাই ধরা যাক। তার জন্মের ১,৪০০ বছর আগে ইতালির রোমে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতেন গ্যালেন। তখন তিনি মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের একটি তত্ত্ব দাঁড় করান, যা ছিল ভুলে ভরা। একেবারেই সঠিক নয় যে তা-ও নয়, আংশিক সত্য বলা যায়। সে যা-ই হোক, গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা সমসাময়িক হাতুড়ে ডাক্তারদের নিকট বাড়াবাড়ি ঠেকলো। ফলে গ্যালেনকে এক সময় রোম ছেড়ে পালাতে হলো প্রাণের ভয়ে! সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো, একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, যখন গ্যালেনের সেই ভুল তত্ত্ব সংশোধন করলেন উইলিয়াম হার্ভে। হার্ভের যদিও প্রাণের ভয়ে শহর ত্যাগ করতে হয়নি, তথাপি ডাক্তার হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে গিয়েছিল অনেকটাই। কারণ হাতুড়ে ডাক্তাররা যে এবার গ্যালেনের শিষ্য!

উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭); source: thefamouspeople.com

“আপনি ভালো করেই জানেন আমার আগের গবেষণা কীরূপ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। কখনো কখনো নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল প্রকাশ করার চেয়ে ঘরে বসে জ্ঞানী হওয়াই শ্রেয়। কেননা প্রকাশ করলে তা এমন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে যা পরবর্তী জীবনের শান্তিটুকুও কেড়ে নিতে পারে!”

কথাগুলো উইলিয়াম হার্ভের। রক্ত সঞ্চালন বিষয়ক তার মাস্টারপিস ‘ডি মটু করডিস’ প্রকাশের পর যে বিতর্কের ঝড় ওঠে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একবার এক ব্যক্তি হার্ভেকে প্রশ্ন করেছিলেন যে তিনি আরো গবেষণা করবেন কিনা। তখন দুঃখ করে কথাগুলো বলেছিলেন হার্ভে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, গ্যালেনের চলে যাবার পর চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিশেষ করে অ্যানাটমির কোনোরূপ অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। গ্যালেনের করে যাওয়া ভুল শুধরাতেই লেগে যায় ১,৪০০ বছর! তবে অন্ধত্বের সেখানেই শেষ নয়। হার্ভে যখন সঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন ব্যাখ্যা করেন, তখন তার কথায় কর্ণপাত করার মতো কেউ ছিল না। হার্ভের তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের লেগে যায় আরো দুশো বছর!

রাজা জেমসের চিকিৎসা করছেন উইলিয়াম হার্ভে; source: Famous Scientists

১৫৭৮ সালের ১ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ফোকস্টোনে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম হার্ভে। ফোকস্টোনের মেয়র ও সফল ব্যবসায়ী থমাস হার্ভে এবং তার স্ত্রী জোয়ান হার্ভের ঘরে জন্ম নেয়া নয় সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম হার্ভে জ্যেষ্ঠতম। ধনী পরিবারের সন্তান হওয়ায় পড়ালেখা করতে তার কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। ফোকস্টোনের একটি এলিমেন্টারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পড়ালেখা শেষ করে হার্ভে চলে যান ক্যান্টারবুরিতে তার চাচার বাসায়। সেখানে তিনি কিংস গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন এবং ল্যাটিন ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। মেধার পরিচয় দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ লাভ করেন হার্ভে। স্কলারশিপ নিয়ে ১৫৯৩ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন। অক্সফোর্ডে ছয় বছরের পড়ালেখার জীবনে শেষ দু’বছর তিনি জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়ান। উদ্দেশ্য নিত্যনতুন জ্ঞানার্জন।

ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়; source: De Winter Retreat – WordPress.com

১৫৯৯ সালে অক্সফোর্ডে হার্ভের পড়ালেখা শেষ হয়। তখন চিকিৎসা বিষয়ক পড়ালেখার জন্য ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত ছিল। ২১ বছর বয়সী হার্ভে পাদুয়াতে ভর্তি হয়ে গেলেন। সেখানে হিয়েরোনিমাস ফাব্রিসিয়াস ছিলেন তার অ্যানাটমি শিক্ষক যিনি একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসকও ছিলেন। ফ্যাব্রিসিয়াসই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি মানুষের রক্তসঞ্চালন নালীতে (শিরা, ধমনী) ভাল্বের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, ১৫৭৪ সালে তিনি এই আবিষ্কার করেও সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কীভাবে গ্রহণ করবে, সে চিন্তায় দীর্ঘকাল প্রকাশ করেননি। অবশেষে ১৬০৩ সালে তিনি নিজের পর্যবেক্ষণের কথা প্রকাশ করেছিলেন! যা-ই হোক, এই ফাব্রিসিয়াসের সাহচর্যেই হার্ভে তার পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান এবং তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই অ্যানাটমির প্রতি আগ্রহ বাড়ে তার। ১৬০২ সালে তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পড়ালেখা শেষ করেন।

কলেজ অব ফিজিসিয়ান,লন্ডন; source: e-architect

গ্রাজুয়েট ডাক্তার হিসেবে ১৬০২ সালে লন্ডন ফিরে আসেন উইলিয়াম হার্ভে। সে বছর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি লন্ডনে ডাক্তারি পেশায় যুক্ত হন। দুবছর পর, ১৬০৪ সালে তিনি ‘কলেজ অব ফিজিসিয়ানস’-এ যোগ দেন। ১৬০৭ সালে হার্ভে বার্থেলোমিউ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক পদে নিযুক্ত হন। ১৬১৮ সালে ৪০ বছর বয়সী উইলিয়াম হার্ভেকে লন্ডনের সেরা চিকিৎসক ঘোষণা করা হয়। সেবছরই তিনি ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা জেমসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত হন।

“যারা ধরে নেয় যে অ্যারিস্টটল, গ্যালেন কিংবা আরো কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে জড়িত যেকোনো বিষয়ই পরম সত্য, তাদের দেখে আমি বিস্মিত হই। কখনোবা তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা দেখে আমার হাসি পায়!”- উইলিয়াম হার্ভে।

ডি মটু কর্ডিস; source: e-architect

বস্তুত উইলিয়াম হার্ভের সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গ্যালেনের প্রভাব ছিল অদ্বিতীয়, বিশেষ করে অ্যানাটমিতে। নতুন কিছু আবিষ্কার না করে বরং পুরাতন প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের ভাবধারায় গা ভাসিয়ে দেয়াই ছিল তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজের নিয়ম। আর সেই নিয়মের বিপরীতে গিয়েই কাজ করেছিলেন হার্ভে। ১৬২৮ সালে তিনি তার যুগান্তকারী গবেষণা ‘ডি মটু করডিস’ বা ‘অন দ্য মোশন অব দ্য হার্ট’ প্রকাশ করেন। এই গবেষণার মাধ্যমেই তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া ও সারাদেহে রক্ত সঞ্চালন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রকৃতপক্ষে হার্ভে এই গবেষণা করতে পেরেছিলেন এজন্য যে তিনি মেডিক্যালে পড়ালেখা করার সময় যেসব বই পড়েছিলেন, সেগুলোকে নির্ভুল মনে করেননি এবং তৎকালীন প্রচলিত পদ্ধতিতে তিনি তার গবেষণা পরিচালনা করেননি। আধুনিককালের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যদিও হার্ভেকে একজন নিষ্ঠুর গবেষক বলে থাকেন (কারণ তখন কোনো অ্যানেস্থেটিক ছিল না এবং হার্ভে জীবন্ত প্রাণীদের শিরা ধমনী অ্যানেস্থেটিক ছাড়াই কেটে পরীক্ষা করতেন), তার গবেষণাই আমাদের প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিয়েছে।

উইলিয়াম হার্ভের রক্ত সঞ্চালন ব্যাখ্যা; source: weired.com

সমসাময়িক অধিকাংশ তত্ত্বের বিপরীতে গিয়ে হার্ভে ঘোষণা করলেন যে শিরা-ধমনী প্রাণীর পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালন করে এবং এই সঞ্চালন হৃৎপিণ্ডের ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণের ফলে ঘটে। ডি মটুতে তার পর্যবেক্ষণের কয়েকটি প্রধান বিষয় একনজরে দেখে নেয়া যাক।

  • শিরা ও ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্টি হয় না।
  • রক্ত সঞ্চালনের জন্য যকৃত নয়, হৃৎপিণ্ড দায়ী।
  • টিস্যুতে পরিবাহিত রক্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না।
  • হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণের সাথে সাথে নাড়ির স্পন্দন সৃষ্টি হয়।
  • নিলয় থেকে রক্ত মহাধমনী এবং ফুসফুসীয় ধমনীতে প্রবেশ করে।
  • হৃৎপিণ্ডের সেপটামে কোনো নালী নেই।
  • ডান নিলয়ের সব রক্ত ফুসফুসে যায় বিশোধনের জন্য এবং সেখান থেকে ফুসফুসীয় শিরার মাধ্যমে বাম নিলয়ে ফিরে আসে।
  • বিপরীতক্রমে বাম নিলয়ের সব রক্ত ধমনীর মাধ্যমে সারাদেহে প্রবাহিত হয়, ব্যবহৃত হয় এবং শিরার মাধ্যমে বিশোধনের জন্য ডান নিলয়ে ফিরে আসে।
  • দেহে শিরা ও ধমনীর মধ্যে রক্তের কোনোপ্রকার বিচ্ছিন্ন পরিবহন ঘটে না। রক্ত সঞ্চালন নির্দিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হয়।

উইলিয়াম হার্ভে ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না। লন্ডন শহরের একজ বিখ্যাত চিকিৎসকের মেয়ে এলিজাবেথ ব্রাউনকে বিয়ে করেন হার্ভে। এই দম্পতির ঘরে কোনো সন্তান জন্ম হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সাথে যুক্ত হয় ‘ইনসমনিয়া’ বা অনিদ্রা। এই অনিদ্রায় ভুগে তিনি এতটাই হতাশ হয়ে পড়েন যে ১৬৫১ সালে ‘লডেনাম’ (১০ ভাগ আফিমের মিশ্রণ) পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন!

১৬৫৭ সালের ৩ জুন উইলিয়াম হার্ভে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে হ্যাম্পস্টেড এসেক্সে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে তিনি পরিচয় গোপন রেখে কলেজ অব ফিজিসিয়ানসে বিশাল অঙ্কের অর্থ দান করেছিলেন একটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণের জন্য। তার মৃত্যুর পর এই তথ্য প্রকাশিত হলে তার সম্মানে সেই হাসপাতালে তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৭৩ সালে তার জন্মস্থান ফোকস্টোনের কাছে অ্যাশফোর্ডে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার অবদানের স্মৃতি হিসেবে ‘উইলিয়াম হার্ভে হসপিটাল’ নির্মাণ করা হয়। বস্তুত, হাসপাতাল নির্মাণ না করলেও কি হার্ভের অবদান ভুলতে পারতো চিকিৎসাবিজ্ঞান?

ফিচার ইমেজঃ djmed.net 

Related Articles