‘৯০ দশকের ‘দ্য লেডি’ খেতাব পাওয়া জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সু কি। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বিশ্ববাসীর মন জয় করা এক নারীর নাম। তার দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে নিঃশর্তে মেনে নিয়েছিলেন পরিবারবিহীন নির্জন, বন্দী জীবন। বাবা ছিলেন তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতার অগ্রনায়ক। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেছিলেন তার দেশ মিয়ানমার তথা বার্মাকে সামরিক জেনারেলদের হাত থেকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনার লড়াই। মহাত্না গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলার অনুসারী এই নেত্রী গণতন্ত্রের লড়াইয়ে আপোষহীন থেকে অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। তাই ১৯৯১ সালে তাকে দেয়া হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার।
তবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি কতটা সফল আর কতটা বিফল তা আজ প্রশ্নের উদ্রেক করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া আর পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পুরো ঘটনাচক্রে হয় তিনি নীরব থেকেছেন, নতুবা বিতর্কিত মতবাদের পক্ষ নিয়েছেন। এতেই হয়েছেন বিশ্বজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে তাকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবীও তুলেছেন।
অং সান সু কির জন্ম ১৯ জুন ১৯৪৫ সালে। বাবা অং সান ছিলেন তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতার জনক। সু কি ছিলেন বাবা-মায়ের সবচেয়ে ছোট সন্তান। স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাস আগে তার বাবা অং সান আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন।
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৬০ সালে স্বাধীন বার্মার নতুন সরকার সু কির মা খিন কি-কে ভারত ও নেপালে বার্মার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। সু কি মায়ের সাথে চলে আসেন ভারত।
তিনি নয়া দিল্লির কনভেন্ট অব জিসাস এন্ড ম্যারি স্কুলে পড়ালেখা করেন। দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধীন লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং পরে সেইন্ট হাগ’স কলেজ, অক্সফোর্ড থেকে ১৯৬৭ সালে লাভ করেন বিএ ডিগ্রী। ১৯৬৮ সালে শেষ করেন স্নাতকোত্তর।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে সু কি নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে তিন বছর কাজ করেন। তিনি জাতিসংঘের বাজেট বিষয়ক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন।
১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি অং সান সু কি বিয়ে করেন ড. মাইকেল এরিসকে যিনি ছিলেন তিব্বতিয়ান সংস্কৃতি ও সাহিত্যের গবেষক এবং ভুটানে বসবাসরত। ১৯৭৩ সালে সু কির প্রথম সন্তান অ্যালেকজান্ডার এরিস জন্মগ্রহণ করে। ১৯৭৭ সালে লন্ডনে সু কি জন্ম দেন তার দ্বিতীয় সন্তান মাইককে।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনে এম ফিল ডিগ্রী করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধীন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে তিনি বার্মিজ সাহিত্যের উপর গবেষণা করেছিলেন।
১৯৮৮ সালে সু কির মা খিন কি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মায়ের দেখাশোনা করতে সু কি মিয়ানমার তথা বার্মায় ফিরে আসেন। তখন মিয়ানমার প্রচন্ড রাজনৈতিক উথাল-পাথাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
১৯৬২ সালে জেনারেল ইউ নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং তৎকালীন বার্মায় শুরু হয় সামরিক শাসন। তারপর থেকেই গণতন্ত্রের দাবীতে আন্দোলন চললেও ১৯৮৮ সালে হাজার হাজার ছাত্র, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, জনতা, বৌদ্ধ সন্যাসী রাস্তায় নেমে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে একজোট হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই গণবিক্ষোভের মুখে সেই বছর আগস্টে নে উইন পদত্যাগ করে ক্ষমতা সামরিক জান্তার কাছে হস্তান্তর করেন। ৮-৮-৮৮ নামে সেই আন্দোলন আজও পরিচিত।
সু কি মায়ের দেখাশোনা করতে দেশে ফিরলেও তিনি সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। নে উইন পদত্যাগ করলেও পরবর্তী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন জনসভায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আর মানবাধিকার নিয়ে কড়া বক্তব্য রাখেন। এর ফলে শীঘ্রই তিনি সামরিক সরকারের রোষানলে পড়েন।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে সামরিক সরকার সু কি কে গৃহবন্দী করে বহির্বিশ্বের সাথে তার সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যদিও সামরিক জান্তা তাকে দেশত্যাগের শর্তে মুক্তির প্রস্তাব দেয়, তিনি সেই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে বন্দীত্ব বেছে নেন।
১৯৯০ সালে সামরিক জান্তা একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করলে সু কির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। পার্লামেন্টের ৮০ শতাংশ সীট সু কির দলের দখলে চলে আসে। কিন্তু সরকার সেই নির্বাচনের ফল বাতিল করে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। সু কি গৃহবন্দী থাকেন।
১৯৯১ সালে বন্দী থাকাবস্থায় তাকে নোবেল কমিটি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত করে।
১৯৯৫ সালে সু কিকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্ত হয়ে তিনি ১৯৯৬ সালে এনএলডির কংগ্রেসে অংশগ্রহন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি একটি প্রতিনিধি কমিটি গঠন করে সেটিকে দেশটির বৈধ সরকার ঘোষণা দিলে ২০০০ সালে আবার তিনি গৃহবন্দী হন।
২০০২ সালে তিনি সাময়িক মুক্ত হলেও ২০০৩ সালে সরকার এনএলডি সমর্থকদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ হলে তিনি আবার বন্দী হন। এবার তাকে গৃহবন্দীত্বের সাজা দেয়া হয় যা প্রতি বছর নবায়ন হতে থাকে।
২০০৯ সালে মুক্তির প্রাক্কালে তিনি আবার বন্দী হন। এবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি তার বাড়িতে বহিরাগত প্রবেশ করতে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জন ইয়েত্তাও নাকি তার বাড়িতে দুই রাত থেকেছেন। এই অভিযোগে সু কিকে আঠারো মাসের সাজা দেয়া হয়। যদিও জাতিসংঘ এটাকে মিয়ানমারের আইনেই অবৈধ বলে ঘোষণা দেয়।
সু কি যাতে ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তার জন্য সামরিক জান্তা নতুন নির্বাচনীআইন পাশ করে। এতে বলা হয়, বিদেশী নাগরিককে বিয়ে করা বা বিদেশী নাগরিকত্ব আছে এমন সন্তান যাদের আছে তারা প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। আবার আরেকটি আইন মতে, সাজাপ্রাপ্ত কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না- যার দুটোই সু কির ক্ষেত্রে খাটে, কারণ তার স্বামী এবং সন্তানেরা বিদেশী নাগরিক।
এনএলডি এই আইনের অধীনে নিবন্ধন করতে রাজি হয়নি, তাই ২০১০ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। ২০১১ সালে সু কি মুক্ত হন এবং দলটিকে ওই আইনের অধীনেই নিবন্ধন করতে রাজি হয়ে যান, যার মাধ্যমে ২০১২ সালে সু কি পার্লামেন্টের সদস্য হন।
অনেক দশকের পর ২০১৫ সালে একটি মোটামুটি মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সু কির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে। সু কির বিদেশী সন্তান থাকার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তবে তিনি রাষ্ট্রটির নবসৃষ্ট পদ ‘স্টেট কাউন্সেলর’ এর দায়িত্ব পান। পদটিকে প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদার হিসেবে মনে করা হয়।
রাজনৈতিক এই চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সু কি মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। যদিও এখনও সামরিক বাহিনীর হাতেই মূল ক্ষমতার সুতা। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়গুলো এখনও সামরিক বাহিনীর অধীনে রয়েছে।
’৯০ এর দশকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে অং সান সু কি বিশ্ববাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি সু কির সেই গণতান্ত্রিক চেহারার আড়ালে যে আরেকটি নিষ্ঠুর চেহারা আছে তা প্রকাশ করে দিয়েছে।
২০১৭ সালে দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগণের উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী নির্মম নির্যাতন আর তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করতে যে অভিযান চালিয়েছে এর বিরুদ্ধে সু কি ছিলেন পুরোদস্তুর নিশ্চুপ। বিশ্বের তামাম নেতা, নোবেল বিজেতা, মানবাধিকার কর্মী, জাতিসংঘসহ বিশ্বের সমস্ত মানুষ এই গণহত্যার নিন্দা করলেও সু কি ছিলেন এই বিষয়ে নীরব। কখনও এ নিয়ে মুখ খুললেও শব্দচয়নে ছিলেন অতি সাবধানী অথবা ইঙ্গিতে সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
এতে অং সান সু কি বিশ্বজুড়ে হয়েছেন নিন্দিত এবং অপমানিত। সু কিকে দেয়া পুরস্কার অথবা সম্মাননা অনেক সংস্থা ফিরিয়ে নিয়েছে। দাবী উঠেছে তার নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার। কানাডা সু কিকে দেয়া তার দেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিল করেছে।
এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে (ICJ) গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।
এভাবেই বিশ্বজুড়ে সমালোচনার শিকার হচ্ছেন একসময়ে শান্তি আর গণতন্ত্রের দূত বিবেচিত হওয়া এই নেত্রী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সংগঠিত গণহত্যার দায় তিনি এড়াতে পারছেন না তার একচোখা সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণ নীতির কারণে। ক্ষমতার রাজনীতি যে আসলেই অন্ধ-বধির তা একসময়ে অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী অং সান সু কিকে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ
১) অং সান সুকি