Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাহমুদ দারবিশ: ফিলিস্তিনের এক অদম্য কলমযোদ্ধা

‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। 

জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। তবে সময়ের সাথে সাথে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের জনসাধারণ। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই তাদের। রাজনৈতিক দলগুলো হাঁটছে কূটনৈতিক পথে, সশস্ত্র সংগঠনগুলো বেছে নিয়েছে যুদ্ধের কৌশল। 

এই দলে আছেন লেখক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকগণও। যদিও তারা অস্ত্র হাতে তোলেননি, তবু বোধহয় তাদের যোদ্ধা বললে ভুল হবে না। কলমযোদ্ধা তো বলাই যায়। যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের লেখনে তুলে ধরেছেন সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের কথা। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরিতে রেখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কাজগুলো করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ধরা পড়লেই বন্দী জীবন, আবার কখনো সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন নির্যাতন।

যুবক বয়সে মাহমুদ দারবিশ; Image source: Al Akhbar

মাহমুদ দারবিশ ছিলেন তাদেরই একজন, যার লেখা কবিতা হাজারো মুক্তিকামী ফিলিস্তিনির হৃদয় নিংড়ানো আবেগ। তার কবিতার একেকটি লাইন যেন দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইস্পাত-দৃঢ় প্রাচীর। যিনি বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ কিছু মুক্তিকামী মানুষের অসহায় আর্তনাদ। 

ফিলিস্তিন থেকে লেবাননের শরণার্থী ক্যাম্পে

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হবার পর ফিলিস্তিনের শাসনক্ষমতায় কারা বসবে, তার সমাধানে জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীন রেখে দ্বি-রাষ্ট্র গঠনের পরামর্শ দেয় জাতিসংঘ। যেখানে ফিলিস্তিনের ৫৬% ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। যদিও সেসময় গোটা ভূ-খণ্ডের মাত্র ছয় ভাগের মালিক ছিল ইহুদিরা। তাই স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘের এরূপ অন্যায় আবদার মেনে নেয়নি তৎকালের আরব বিশ্ব ও ফিলিস্তিনিরা।

১৪ মে ১৯৪৮, বিকেল ৪টা। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই ব্রিটিশ শাসনের ইতি ঘটবে ফিলিস্তিনে। সেই মুহূর্তে ইহুদি নেতা ডেভিড বেন-গুরিয়ন ঘোষণা দিলেন, “আজ থেকে ইসরায়েল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।” 

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই ইসরায়েল পেয়ে যায় স্বাধীনতার স্বীকৃতিও। তৎকালের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া জানায় বেন-গুরিয়নের ঘোষণার পক্ষে। আর এতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে আরব বিশ্বের দেশগুলো। 

পরদিন বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। এই সংঘাত ফিলিস্তিনের ভাগ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি দুঃখ বয়ে আনে। কারণ সম্মিলিত আরব বাহিনী পরাজিত হয়, জয়ী হয় ইসরায়েল। এরপরই শুরু হয় ইসরায়েলি দমন-পীড়ন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত মালিকদের উচ্ছেদ করে অসংখ্য ঘরবাড়ি দখল করে নেয় ইহুদিরা। বন্দরনগরী অ্যাকারের অদূরেই আল-বিরওয়া গ্রাম। সেখানেও তান্ডব চালায় দখলদার ইসরায়েলিরা। স্থানীয়দের জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে রাতারাতি সেই গ্রামের হর্তাকর্তা বনে যায় তারা। 

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় হাজারও ফিলিস্তিনি এভাবেই পাড়ি জমায় লেবাননে; Image source: David Margolick

মাহমুদ দারবিশের বয়স তখন ছয় বছর। আল-বিরওয়াতে জন্ম, এ গ্রামেই বেড়ে ওঠা। আকস্মিক ইহুদি আক্রমণের আগে কোনোদিন কল্পনাও করেননি নিজেদের পৈত্রিক ভিটেমাটি এভাবে কেউ দখল করে নেবে। যে রাতে ইসরায়েলি বাহিনী অ্যাকারে হামলা চালায়, সে রাতেই দারবিশের পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশে। রাতভর দুর্গম পথ পেরিয়ে ভোরে পৌঁছায় লেবাননে। আশ্রয় মেলে সেখানকার এক শরণার্থী শিবিরে।

শুধুই কি দারবিশের পরিবার? আরো অনেক ফিলিস্তিনির ভাগ্যে নেমে এসেছিল একই দুর্দশা। অল্প ক’দিনের ব্যবধানে লেবাননে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর ঢল নামে।

লেবানন থেকে আবার ফিলিস্তিনে 

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলেও দারবিশের পরিবার তখনও শরণার্থী শিবিরে। আরব দেশগুলো যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় ফিলিস্তিনের অনেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে চলে গেছে। তাই লেবাননের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দেশে ফিরবার আশা নেই।

তবে দারবিশের পরিবার নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এমন একজনকে পাওয়া গেল যে তাদের গোপন এক পথে ফিলিস্তিনের গ্যালিলিতে নিয়ে যেতে পারবে। যেখান থেকে পরে সহজেই অ্যাকারের আল-বিরওয়া গ্রামে যাওয়া যাবে।

আবারও রাতের অন্ধকারে রওনা হয় তারা। সেবার ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়ে লেবাননে এসেছিল, এবার মাটির টানে নিজের দেশের পানে হাঁটছেন। নিরাপদে গ্যালিলিতে পৌঁছে এক আত্মীয়র কাছে তারা আশ্রয় নেন। 

এরপর নিজ গ্রামের খোঁজ করে জানতে পারেন, সেখানে আরব মুসলিমদের বসতিগুলোর কোনো চিহ্নই নেই। ততদিনে আল-বিরওয়াতে গড়ে উঠেছে ইহুদি বসতি। আর তাদের ভাবসাব দেখে বুঝবার উপায় নেই যে জমিগুলো দখল করে নেওয়া হয়েছে। মনে হবে, তারাই সেখানকার আদি বাসিন্দা!

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর যেভাবে ইসরায়েলিরা দখল করে নিয়েছে ফিলিস্তিন; Image source: Dominique Ferré

নিজেদের গ্রামে তো আর আশ্রয় হলো না। নতুন থাকার জায়গা হয় গ্যালিলির দীর আল-আসাদ গ্রামে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, সেখানেও তাদের পরিচয় হয় ‘শরণার্থী’! কারণ ইসরায়েলের করা নাগরিক তালিকায় দারবিশের পরিবারের কারোরই নাম নেই। থাকবে কী করে? তালিকা প্রণয়ণের সময় তো তারা ছিল লেবাননের শরণার্থী শিবিরে। তাই সশরীরে উপস্থিত হলেও কাগজে-কলমে অনুপস্থিত থাকায় নিজের মাতৃভূমিতেই নামের পাশে যুক্ত হয় ‘শরণার্থী’ শব্দ। 

আইডেন্টিটি কার্ড

গ্যালিলির দীর আল-আসাদ গ্রামের পর দারবিশের নতুন ঠিকানা হয় বন্দরনগরী হায়ফার আল-জেদাইদ গ্রামে। টানা দশ বছর সেখানেই থাকে তার পরিবার। নিজের দেশে শরণার্থী হয়ে ফিরে আসার পর সেই গ্রামে এসেই থাকার মতো একটি বাড়ি পায় তারা। তবে তখনও নাগরিকত্বের হিস্যা মিলেনি। যদিও বা তারা পেয়েছিল আইডি কার্ড, কিন্তু সেটি ছিল অন্যদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। যেখানে তাদের না ইসরায়েলি হিসেবে দেখানো হয়েছিল, না ফিলিস্তিনি। তাদের পরিচয় ছিল শুধুই ‘আরব’। তাই পূর্ণ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যান দারবিশ ও তার পরিবার। 

নিজের দেশে রিফিউজি হয়ে বাঁচার যন্ত্রণা কতটা পীড়াদায়ক, মাহমুদ দারবিশ তার আইডেন্টিটি কার্ড কবিতায় সেই অভিব্যক্তি তুলে ধরেন, 

লিখে রাখো!
আমি একজন আরব
এবং আমার পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটি সন্তান
আর নবমটি পৃথিবীতে আসবে গ্রীষ্মকালের পর
তোমরা কি ক্ষুব্ধ হবে তাতে?

লিখে রাখো!
আমি একজন আরব।”

হায়ফাতে আসার পরপরই দারবিশের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয়। লেখালেখির ঝোঁক আসে তখন থেকেই। প্রায়ই স্কুলের অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতেন। 

১৯৬৪ সালে লেখেন আইডেন্টিটি কার্ড কবিতাটি। মূলত এরপরই সকলের নজরে আসা। কারণ তার এই কবিতা একেকটি লাইন যেন সেসব আরবেরই কথা বলে যারা নিজেদের দেশেই ছিল পরিচয়হীন। হাজারও অধিকারবঞ্চিত ফিলিস্তিনি তাদের অব্যক্ত অনুভূতি খুঁজে পায় দারবিশের লেখায়। অল্পদিনের মাঝেই আলোড়ন সৃষ্টি হয় আইডেন্টিটি কার্ড কবিতাটি নিয়ে। 

এদিকে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ এই কবিতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের করে। আটক করা হয় দারবিশকে। হায়ফা নগরী ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে জুড়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা। একরকম গৃহবন্দী হয়ে পড়েন তিনি।

দারবিশের লিখা কবিতাগুলো অনুবাদ করা হয়েছে প্রায় ২০টি ভাষায়; Image source: The Palestine Project

অবস্থা এমন হয় যে ইসরায়েলি পুলিশ নিয়মিতই তার বাড়িতে এসে নিশ্চিত হতো তিনি পালিয়ে গেছেন কিনা। যখন ইচ্ছে আটক করে নিয়ে যেত জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে, আর এ সবকিছুই হতো কোনো আইনি নোটিশ ছাড়া।

মাহমুদ দারবিশ লিখতে শুরু করেছিলেন শখের বশে। পরে তিনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার তাড়না অনুভব করেন। আইডেন্টিটি কার্ড লেখার পর প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন নিজের লেখনীর ধারালো ক্ষমতা কতটুকু!

ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি ও পিএলও (PLO)-তে যোগদান

নিজের বাড়িতে নজরবন্দি থাকা অবস্থায় পুলিশের হয়রানি দারবিশকে আরো বেশি প্রতিবাদী করে তোলে। ফলে রাজনৈতিকভাবেও সক্রিয় হয় ওঠেন তিনি। যোগ দেন ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার মাধ্যমে। আল-ইতিহাদ ও আল-জাদিদ পত্রিকায় নিয়মিত লেখা চালিয়ে যান। কিছুদিন পরেই আল-জাদিদের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন।

শুরুর দিকে ইসরায়েলি প্রশাসন মাহমুদ দারবিশকে একজন সাধারণ প্রতিবাদী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু পরে বুঝতে পারে যে শীঘ্রই  লাগাম টেনে না ধরলে ছোট ছোট কবিতাগুলোই হতে পারে মুক্তিকামীদের বিপ্লবের হাতিয়ার। ফের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ফলে দেশে থাকা সম্পূর্ণ অনিরাপদ হয়ে ওঠে। তাছাড়া দারবিশও চেয়েছিলেন কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত হতে।

১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার ব্যবস্থা হয় তার। কয়েক মাস মস্কোতে থাকার পর চলে যান মিশরের কায়রোতে। সেখানে তিনি বেশ ভালো রকমের আতিথেয়তা পান। আবারও শুরু করেন কর্মব্যস্ত জীবন। যুক্ত হন আল-আহরাম পত্রিকার সাথে।

কায়রোর পরে দারবিশের গন্তব্য হয় লেবাননের বৈরুত। ছন্নছাড়া জীবনে তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখান থেকেই লিজের লেখায় তুলে ধরেছেন প্রিয় মাতৃভূমির অসহায় মানুষগুলোর জীবনচিত্র। বৈরুতে এসেও তাই ‘প্যালেস্টাইন অ্যাফেয়ার’ জার্নালের সম্পাদনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু লেবাননেও থাকা সম্ভব হয়নি। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের সাথে দেশটির যুদ্ধ বেধে গেলে দারবিশকে খুঁজতে হয় নতুন ঠিকানা। 

লেবাননের সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান সিরিয়ার দামেস্কে। সেখানে তার সাক্ষাৎ হয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে। দারবিশ খুব কাছে থেকে দেখলেন, কী কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন আরাফাত। তখনই মনস্থির করেন, পিএলও-র সংগ্রামী পথচলা নিয়ে তিনি লিখবেন।

লেবানন ছাড়ার ঠিক আগের বছর দারবিশ তার নিজের প্রচেষ্টায় ‘আল-কারমেল’ নামে একটি জার্নাল নিয়ে কাজ শুরু করেন। আরফাতকে এ ব্যাপারে জানালে তিনি উৎসাহিত করেন জার্নালটি চালু রাখতে। 

পিএলও-এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে দারবিশ; Image source: Patrica Damiano

আরাফাত আর দারবিশের পথ ভিন্ন হলেও উভয়ের গন্তব্য ছিল অভিন্ন। তাই হয়তো অল্প আলাপেই দুজন বিপ্লবীর মাঝে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। দামেস্ক থেকে তিউনিসিয়া হয়ে দারবিশ পাড়ি জমান ফ্রান্সের প্যারিসে। কাজ শুরু করেন ‘আল-কারমেল’ জার্নাল নিয়ে। এর কয়েক বছর পর সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন পিএলও-র নির্বাহী কমিটিতে।

দারবিশের রাজনৈতিক বিচ্ছেদ

দারবিশের ধারণা ছিল, মস্কো হলো গরিবের স্বর্গ। অথচ তিনি সেখানে সাম্যের দেখাই পাননি। ১৯৭০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছাবার সময়ও কমিউনিজম ছিল তার রাজনৈতিক আদর্শ। কিন্তু মস্কোয় থাকার সময় কমিউনিজমের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। অনীহা জন্মায় মার্ক্সিজমের প্রতিও। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে আসার পর লম্বা একটা সময় ধরে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেননি। এরপর ইয়াসির আরাফাতের সাথে পরিচয় হলে পিএলও হয়ে ওঠে দারবিশের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। 

পিএলও-র সাথেও বেশিদিন কাজ করা হয়নি। ১৯৯৩ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন নির্বাহী কমিটি থেকে। কারণ সেই বছর ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ স্বাক্ষর করে অসলো (Oslo) চুক্তিনামায়, যে চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল ও পিএলও-র মাঝে সমঝোতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যার প্রেক্ষিতে পশ্চিম তীর ও গাজায় পাঁচ বছরের জন্য একটি অন্তবর্তীকালীন স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 

অসলো’র লিখিত পয়েন্টগুলো দেখে শান্তি স্থাপনার উদ্যোগ মনে হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতে ফিলিস্তিনের উপকারের তুলনায় ক্ষতিই হয়েছিল বেশি। কারণ ততদিনে ইসরায়েল নিজেদের অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে নেয়, যেগুলোর প্রয়োগ কয়েক বছর পরেই দেখে পুরো বিশ্ব। 

বাস্তবতা অনুমান করতে পেরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের অনেকেই মেনে নিতে চায়নি সেই চুক্তি। দারবিশও ছিলেন তাদেরই একজন। তাই দল থেকে পদত্যাগ করেন। অবশ্য এই চুক্তির পরেই ১৯৯৬ সালে দীর্ঘদিন বাদে দেশে ফিরতে পারেন তিনি।

লেখালেখির ভূবন 

লেখালেখির শুরু কৈশোরে। জীবনের শেষাবধি এ কাজের সাথেই যুক্ত ছিলেন। প্রথমে কবিতার দিকে ঝোঁক থাকলেও পরিণত বয়সে বিচরণ ছিল গদ্যের জগতেও। 

তরুণ বয়সের কবিতাগুলো ছিল বেশ জটিল। ক্লাসিক্যাল আরবি সাহিত্যের অনুরাগী হওয়ায় লেখাতেও এর প্রভাব এড়াতে পারেননি। কিন্তু পরে উপলব্ধি করেন, তার কবিতাগুলো সাধারণ মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। অথচ সবই তো তাদের অনুপ্রাণিত করতেই লেখা। তাই নিজের লেখার ধরনে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন, যা ১৯৭০-৭২ সাল পরবর্তী কবিতাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। 

সমগ্র জীবনে যত কবিতা লিখেছেন, সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৩০টি বই আকারে। এছাড়াও রয়েছে ৮টি গদ্যের বই। মাহমুদ দারবিশের এই সাহিত্যকর্ম শুধু আরব বিশ্বেই নয়, বরং গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছেই বেশ জনপ্রিয়। ২০টির বেশি ভাষায় তার বিভিন্ন লিখা অনূদিত হয়েছে। 

দারবিশ তার পুরো জীবনে পেয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার; Image source: Mahmoud Darwish Foundation 

সেই সাথে স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন লোটাস প্রাইজ ফর লিটারেচার, লেনিন পিস প্রাইজ, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর অ্যারাবিক পোয়েট্রি প্রাইজসহ আরো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার। 

গান ও চলচিত্রে মাহমুদ দারবিশ  

দারবিশের বিভিন্ন কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে গান। এগুলোর মাঝে Rita and the Rifle, Birds of Galilee, I Yearn for my Mother’s Bread শিরোনামের গানগুলো বেশ জনপ্রিয়। 

রিতা, এই একটি নাম নিয়ে তার বেশ কয়েকটি রোমান্টিক ঘরানার কবিতাও রয়েছে। রিতা নামে সত্যি সত্যিই কেউ ছিল কিনা তা জানতে চাইলে প্রতিবারই দারবিশ জানিয়েছেন, একেবারেই কাল্পনিক এই নারী। 

১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনের বিখ্যাত এই কবিকে নিয়ে তৈরি করা হয় একটি ডকুমেন্টারি। ফ্রান্স টিভির প্রযোজনায় যেটি পরিচালনা করেন ইসরায়েলি ডিরেক্টর সিমন বিটন। ২০০৮ সালে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ‘A Soldier Dreams of White Lilies’ ও হেনরি ইবসেনের ‘Terje Vigen’-এর উপর নির্মিত হয় মাল্টিস্ক্রিন ফিল্ম ‘আইন্ডেন্টিটি অব দ্য সোল’। একই বছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনে প্রায় দশ হাজার দর্শকের সামনে প্রদর্শন করা হয় চলচ্চিত্রটি।

ব্যক্তিগত জীবন

ফিলিস্তিন ছেড়ে আসার পর মস্কো, কায়রো, বৈরুত, দামেস্ক, তিউনিসিয়া, প্যারিসসহ আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটিয়েছেন জীবনের পুরোটা সময়। 

বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ালেও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে। জনসমাগম পছন্দ করতেন না। একা একাই থাকতেন পছন্দ করতেন। বিয়ে করেছিলেন দু’দুবার, কিন্তু সংসার করা হয়নি। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিচ্ছেদ হয়। 

দারবিশের প্রথম স্ত্রী রানা কাব্বানি; Image source: Rana Kabbani/Twitter

বিশেষ কোনো কাজ ছাড়া অহেতুক আড্ডাবাজির বাতিক ছিল না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই কফির মগ হাতে বসে পড়তেন নিজের ডেস্কে। ভাবতেন কবিতা নিয়ে, ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী বিপ্লব নিয়ে।

ব্যক্তিগত জীবনে বেশ নিয়ম মেনে চলা মানুষই ছিলেন। বেশি রাত জাগার অভ্যাস ছিল না, ঘুম থেকেও উঠতেন সকাল সকাল। মনে হাজারো আক্ষেপ, যন্ত্রণা থাকলেও শারিরীকভাবে ছিলেন সুস্থ। উল্লেখযোগ্য রোগব্যাধি বলতে ছিল এক হার্টের সমস্যা, যা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেষ জীবনে।

জীবনের শেষ দিনগুলি

২০০৮ সাল, দারবিশ তখন জর্ডানের আম্মানে। ততদিনে পুরনো অসুখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। 

ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশন করাতে আমেরিকা যাবেন। কিছুদিনের মাঝেই বন্ধু আলি হালিলা আমেরিকায় সব বন্দোবস্ত করেন। 

২৮ জুলাই ২০০৮, আরেক বন্ধু আকরামকে নিয়ে রওনা হবেন। কিন্তু কেন যেন তার মন বলছে, হয়তো আম্মানে আর ফিরে আসা হবে না। তাই গৃহকর্মী ও বাসার গার্ডকে ডেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করে কিছু অর্থ অগ্রীম দিয়ে দিলেন। 

২৮ জুলাই পৌঁছে গেলেন আমেরিকার হিউস্টনে। ৯ আগস্ট ২০০৮, মেমোরিয়াল হারম্যান টেক্সাস মেডিকেল সেন্টারে হলো ওপেন হার্ট সার্জারি। দারবিশের ধারণাই সত্যি হলো, আর কখনো আম্মানে ফিরে যেতে পারেননি তিনি। সার্জারির পর চোখ মেলে তাকানো হয়নি। কারণ সেদিনই ইহকালের অধ্যায় শেষে পাড়ি জমান অনন্তকালের পথে। 

লাখো ভক্ত, হাজারো মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি কেউই দারবিশের মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুহূর্তেই যেন ফিলিস্তিনের আকাশ এক কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেল। প্যালেস্টাইন অথোরিটি প্রেসিডেন্ট তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করলেন। সেই সাথে দারবিশের মরদেহ তার প্রিয় মাতৃভূমিতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। 

রামাল্লায় মাহমুদের বিদায়বেলায়; Image source: Ammar Awad

১৩ আগস্ট ২০০৮, ফিলিস্তিনের রামাল্লায় হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগীর জমায়েতে রাষ্ট্রীয় জানাযা শেষে দাফন করা হয় অদম্য এই কলমযোদ্ধাকে। 

দারবিশ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্মাননা পেয়েছেন। অনেক আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবির মর্যাদা লাভ করা, স্বদেশের আপামর জনতার হৃদয় উজার করা ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া। 

মানুষের মৃত্যু হয় এ কথা সত্য, কিন্তু আদর্শের মরণ হয় না। দারবিশও বেঁচে থাকবেন তার কবিতার প্রতিটি লাইনে হাজারও বিপ্লবী ফিলিস্তিনির অনুপ্রেরণা হয়ে।

Related Articles