Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পরিবেশ রক্ষায় র‍্যাচেল কারসন ও কিঙ্করী দেবীর লড়াইয়ের গল্প

পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার জন্য পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে আমরা অনেকেই সেই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাই। পৃথিবীর বহু দেশে উন্নয়নের নামে নেয়া অনেক উদ্যোগ সেসব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনলেও সেখানকার পরিবেশকে করেছে বিপর্যস্ত। আর তাই আজ সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন ফোরাম থেকে প্রবল দাবি উঠছে।

এই পরিবেশকে রক্ষার জন্য কত মানুষের নিরলস চেষ্টা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কেউ গাছ কাটা ঠেকানোর জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদ করেছেন, কেউ পরিবেশের ক্ষতি রুখতে জনমত গঠনের জন্য দিনের পর দিন অনশন করে গেছেন, আবার কেউ তার লেখনীর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন পরিবেশ দূষণ ও তার ক্ষতিকর প্রভাব। এমনই দুজন অসামান্য নারীর জীবন কাহিনী নিয়ে আজকের এই আয়োজন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীববিজ্ঞানী র‌্যাচেল কারসন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে কীটনাশক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কৃষিজমির ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বিনাশে এবং মানুষের জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার জন্য মশা-মাছির উপদ্রব কমাতে সারা আমেরিকা জুড়ে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তখনও এই কীটনাশকের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না।

এমনই এক সময়ে ম্যাসাচুসেটসের ডাকসবেরি অঞ্চলের পোকামাকড় ও মশা নিধন করতে কর্তৃপক্ষ ডিডিটি নামক একধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ছোট বিমানের সাহায্যে শহর জুড়ে স্প্রে করতে শুরু করে। শহরবাসীদের এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার কয়েকদিন পর ওই অঞ্চলেরই ওলগা ওয়েন্স হাকিন্সের পক্ষিশালার বেশ কিছু পাখিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এই হঠাৎ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিলেন ওলগার বান্ধবী র‌্যাচেল কারসন। মৃত পাখিদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি জানতে পারলেন, এর জন্য ডিডিটি-ই দায়ী। র‌্যাচেল ডিডিটি নিয়ে আরো পরীক্ষা চালান। ডিডিটির ক্ষতিকর প্রভাব দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। র‌্যাচেল সবাইকে জানাতে লাগলেন ডিডিটির ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা, যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ সহ সমগ্র জীবজগৎ। ডিডিটির কারণে মানুষের স্নায়ুঘটিত রোগ, ক্যান্সারেরও আশঙ্কা থাকে। ডিডিটির এই অন্ধকার দিকটি সকলের সামনে তুলে ধরলেন র‌্যাচেল তার বই ‘Silent Spring’ এ। ১৯৬২ সালে বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই ব্যাপক আলোড়ন তোলে সারা বিশ্ব জুড়ে।

জীববিজ্ঞানী র‌্যাচেল কারসন; Image Source: thoughtco.com

বিজ্ঞানীরা চমকে গেলেন কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পেরে। সে সময় অনেকেই এই বিষয়ে খুব একটা জানতেন না। র‌্যাচেলের এই বইয়ের কারণে ধাক্কা খেলো কীটনাশকের জমজমাট ব্যবসা। তখন অনেকেই তার সাথে সহমত ছিলেন না। কীটনাশক তৈরির প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক মহল, এমনকি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও র‌্যাচেলকে হুমকি দেয়া হয় এবং তার নামে নানা অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু অসম্ভব সাহসী র‌্যাচেল ভেঙে পড়বার মতো মহিলা নন। অদম্য মনোবলের সাথে জনমত গঠনে তিনি সচেষ্ট হলেন। সাড়া পেলেন বেশ। তদন্ত শুরু হলো। তদন্ত প্রতিবেদনে মেনে নেয়া হলো র‌্যাচেলের বক্তব্য। ১৯৬৩ সালে র‌্যাচেল কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে এক বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় নতুন নীতি প্রবর্তনের দাবি জানান।  

১৯৬২ সালে প্রকাশিত র‌্যাচেলের সাড়া জাগানো বই ‘Silent Spring’; Image Source: rachelcarson.org

পরবর্তীকালে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সাইলেন্ট স্প্রিংকে মানব সভ্যতার জন্য বিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাখ্যান হিসেবে উল্লেখ করেন। ‌র‌্যাচেলের বইটি মানব সভ্যতার গতিপথ অনেকটাই বদলে দিল। বিজ্ঞান গবেষণার ইতিহাসে যুক্ত হলো এক নতুন অধ্যায়, পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ সম্পর্কে র‌্যাচেল একাধিক বই রচনা করেছেন।Under the SeaWind, The Sea Around Us The Edge of the SeaThe Sense of Wonder বইগুলোতে পরিবেশের বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণের ফলে সমুদ্রের প্রাণিজগতের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে র‌্যাচেল তার মতামত তুলে ধরেছেন।

র‌্যাচেল তার বিভিন্ন লেখায় পরিবেশ দূষণের প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে কাজ করেন; Image Source: wilderness.org

পরিবেশ সংরক্ষণে আর্থিকভাবে প্রভাবশালী শক্তিশালী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন ‌র‌্যাচেল কারসন। পরিবেশ আন্দোলনে তার সংগ্রামী ভূমিকার জন্য তাকে ‘মাদার অব দ্য এনভায়রনমেন্টাল মুভমেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯০৭ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নেয়া এই মহিয়সী নারী ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার আদর্শ ও সততা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো।

ভারতের হিমাচল প্রদেশের কিঙ্করী দেবী

১৯২৫ সালে ভারতের হিমাচল প্রদেশের ঘাতন গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে কিঙ্করী দেবীর জন্ম। শিক্ষার আলোও কখনও পাননি। নিজের সইটি শুধু করতে পারতেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ হলেও পরিবেশ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল খুবই প্রখর।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছিল। খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু সেই বিয়ে কিঙ্করী দেবীর জীবনে সুখ বয়ে আনলো না। ২২ বছর বয়সে হলেন বিধবা। আবার শুরু হলো কষ্টের জীবন। কোনোমতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর একটি কাজ জোগাড় করলেন, তারপর থেকে এলাকার রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতেন।

প্রকৃতির প্রতি তার ভালবাসা ছিল অটুট। সবুজ গাছপালা, নদী, পাহাড় সবকিছুই যেন তার বড় আপন। এর ক্ষতি যেন তারই ক্ষতি। সবসময় ভাবতেন তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, তা-ই দিয়ে এই পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বুঝতে পারলেন, মানুষ সচেতন না হলে তার একার পক্ষে এই পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়। অশিক্ষিত হয়েও তিনি তার আশেপাশের মানুষদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করতে থাকেন এবং পরিবেশের ক্ষতি যাতে না হয়, সে সম্পর্কে সকলকে সজাগ থাকতে বলতেন।

পরিবেশ আন্দোলনের এক সংগ্রামী মুখ ভারতের কিঙ্করী দেবী; Image Source: thebetterindia.com

হিমাচলের দুন উপত্যকাটি চুনাপাথরে একসময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল। ১৯৮৫ সালে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব চুনাপাথর উত্তোলনের জন্য খনির মধ্যে খননকার্য শুরু হয়। হিমাচল প্রদেশের এক বিশাল এলাকা জুড়ে চুনাপাথরের খননশিল্পের বিস্তার ঘটে। খননকাজের সুবিধার জন্য দুন উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত পানির স্রোত বন্ধ করে দেয়া হয়। আর এর ফলে এই অঞ্চলে পানির স্তর কমে যেতে থাকে। জঙ্গল আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে। পানির স্তর কমে যাওয়ায় চাষাবাদেরও ব্যাপক ক্ষতি হতে লাগলো।

খনির কার্যক্রম বন্ধের জন্য কিঙ্করী দেবী একটানা ১৯ দিন শিমলা হাইকোর্টের সামনে অনশন করেন; Image Source: diaryofamountaingirl.in

অশিক্ষিত হয়েও প্রকৃতিপ্রেমী কিঙ্করী দেবী বুঝতে পারলেন, এ সবই হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত খননকার্যের কুফল। স্থানীয়দের তিনি এ বিষয়ে বোঝাতে শুরু করলেন। তারপর স্থানীয়দের নিয়ে শুরু করলেন আন্দোলন। আন্দোলনের একপর্যায়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় কিঙ্করী দেবী ও গ্রামবাসী মিলিতভাবে ১৯৮৭ সালে অবৈজ্ঞানিক ও অনিয়ন্ত্রিত খননকার্য বন্ধের দাবিতে ৪৮ জন খনি মালিকের বিরুদ্ধে শিমলা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন। সেই মামলা আদালতে টিকলো না। আদালত থেকে কোনোরকম সুফল না পাওয়ায় কিঙ্করী দেবী শিমলা হাইকোর্টের সামনে অনশন শুরু করেন। একটানা ১৯ দিন চলে তার এই অনশন। সারা ভারতজুড়ে এই নিয়ে প্রবল হৈচৈ শুরু হয়। ফলস্বরূপ, শিমলা হাইকোর্টে আবার মামলাটি ওঠে।

পরিবেশ রক্ষায় কিঙ্করী দেবীর অসামান্য ভূমিকার জন্য দেশে-বিদেশে তাকে সম্মানিত করা হয়; Image Source: Flickr.com

এবার আদালত এই খননকার্যে স্থগিতাদেশ জারি করে। পরে সুপ্রিমকোর্টও কিঙ্করী দেবীর পক্ষেই রায় দেয়। কিঙ্করী দেবীর দৃঢ়চেতা ভূমিকার কারণে বিশ্ববাসী জানলো পরিবেশ রক্ষায় এক অসামান্য নারীর গল্প। আর এই মহিয়সী নারীকে সম্মান জানানোর জন্য ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে তাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৯৯ সালে ‘ঝাঁসী কি রানী লক্ষ্মীবাঈ স্ত্রী শক্তি’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৭ সালে ৮২ বছর বয়সে এই সংগ্রামী নারীর প্রয়াণ ঘটে।  

ফিচার ইমেজ- rachelcarson.org

Related Articles