মাঝে মাঝে মানুষ হয়ে ওঠে পশুর চাইতেও ভয়ংকর। আর মানুষের জীবন? সেটা হয়ে যায় কল্পনার চাইতেও বেশী কঠিন ও কষ্টসাধ্য। অরুণা শানবাগ। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে ভারতের খবরের কাগজগুলোতে বারবার ছাপা হচ্ছিল অরুণা নামের এই মেয়েটির নাম। আদালত থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, চায়ের কাপ থেকে শুরু করে ঘরোয়া আলাপ- সবখানে ছিল নার্স অরুণা শানবাগের নাম। কেন? কী হয়েছিল অরুণা শানবাগের সাথে? বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া গা শিউরে ওঠা সেই ঘটনাটি চলুন আজ জেনে নিই আরেকবার।
হলদিপুর গ্রামের তরুণী অরূণা বম্বে আসে কাজের খোঁজে। বম্বে মিউনিসিপ্যালিটির কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে ট্রেইনি নার্স হিসেবে কাজ শুরু করে সে। সময়টা সত্তর দশকের প্রথমদিক। সন্দীপ সরদেশাই নামে জনৈক জুনিয়র ডাক্তার তখন হাসপাতাল সংলগ্ন হোস্টেলে থেকে এমডি এন্ট্রান্সের জন্য পড়াশোনা করছেন। কর্ণাটক থেকে আসা নার্স অরুণাকে ভালো লেগে গিয়েছিল তার। ভালোবাসা থেকে তাদের সম্পর্ক গড়ায় বিয়ে পর্যন্ত। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় অরুণা ও সন্দীপ। আর ঠিক সেসময় ভয়ানক এক ঘটনা তাদের দুজনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
অরুণার হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করতো সোহানলাল বাল্মীকি। অরুণার কড়া আচরণে বেশ ক্ষেপে ছিল সে অরুণার উপরে বেশ কিছুদিন ধরে। সুযোগ খুঁজছিল প্রতিশোধ নেওয়ার। আজ থেকে ৪৪ বছর আগের এক রাতে সেই সুযোগ পেয়ে যায় সোহানলাল। নার্সদের জামা পাল্টানোর জন্য হাসপাতালের বেজমেন্টে যেতে হতো। সেদিন ডিউটি শেষে অরুণাও বেজমেন্টে গিয়েছিল। আর এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল সোহানলাল। লুকিয়ে ছিল সে বেজমেন্টের ঘরে। হাতে ছিল কুকুর বাঁধার লোহার শেকল। অরুণা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই শেকল দিয়ে আক্রমণ করে সোহানলাল।
অরুণার দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার চলে প্রায় এক ঘন্টা সময় ধরে। অরুণা জ্ঞান হারায়। সোহানলাল অরুণার বেতের ব্যাগ থেকে একটা সোনার চেন, সামান্য কিছু টাকা ও পরনের গোলাপি শাড়িটা নিয়ে ঘর ছেড়ে পালায় ও পরদিন সকালে অন্যান্য দিনের মতোই নির্বিকার চিত্তে কাজে আসে। কুকুরের চেন দিয়ে বাঁধার ফলে অরুণার মস্তিষ্কে আঘাত লাগে। মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও রক্ত সরবরাহ কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে AHI বা Anoxic Hypoxic Injury। এই পরিস্থিতিতে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি সময় মানুষ একটানা থাকলে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে হয়তো কোমায় চলে যাওয়া থেকে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু অরুণার বেলায় তেমন কিছুই হয়নি। ঘটনাস্থলে টানা ১১ ঘন্টা একই অবস্থায় পড়ে থাকে অরুণা। তাকে প্রথম আবিষ্কার করে হাসপাতালের আরেক নার্স প্রমিলা কুশে। প্রমিলা কুশে পরবর্তীতে নিজের জবানবন্দীতে জানান, তিনি হাসপাতালের বেজমেন্টের খালি অপারেশন থিয়েটারে অরুণাকে খুঁজে পান। সোহনলাল বাল্মীকির পাশবিক নির্যাতনের পর সেখানে চেইন দ্বারা আটক অবস্থায় ছিল অরুণা। প্রমিলা দ্রুত দৌড়ে গিয়ে মেট্রন বেল্লিমালকে ডেকে আনেন। বেল্লিমাল যখন আসেন তখন ঠোঁটদুটো হালকা নাড়ানোর চেষ্টা করে অরুণা। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না অরুণার। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অরুণা। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় অরুণাকে। সে বেঁচে যায়। তবে এই বাঁচাও হয়ে পড়ে অরুণার জন্য অসম্ভব কষ্টকর।
পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেটে অবস্থায় চলে যায় অরুণা। যে অবস্থায় মানুষ না কিছু অনুভব করতে পারে, না কিছু প্রকাশ করতে পারে। অরুণা কেবল জীবনটুকু আটকে রাখতে পেরেছিল নিজের শরীরে। আর কিছু নয়। তবে ধীরে ধীরে একটা সময় অরুণার শরীরে খানিকটা প্রাণের উপস্থিতি দেখা যায়। হালকা হাসির ভাব, খাবার গিলে ফেলা, দাঁতে দাঁত ঘষার মতন কিছু কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল অরুণা। তবে সেটা অনেকের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। এই অবস্থায় কাউকে বাঁচিয়ে রাখার চাইতে মেরে ফেলা ভালো- এমনই দাবী নিয়ে আদালতে যান পিঙ্কি ভিরানি। অরুণাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। এর ভেতরে অনেকগুলো সময় পার হয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় লেখেন পিঙ্কি ভিরানি-
“অরুণা স্যান্যাল ভালো নেই। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। সে চোখে দেখতে পায় না। কথা বলতে পারে না।” সব মিলিয়ে পিঙ্কি জানান, অরুণার মানুষ হিসেবে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মস্তিষ্কের যে অংশগুলোর দরকার পড়ে সেগুলো কর্মক্ষম না। তার বদলে অরুণার মস্তিষ্কের কেবল সেই অংশটিই কাজ করছে যেটি কষ্ট আর ব্যথা ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না তাকে। ফলে অরুণাকে এই অবস্থা থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন।
ডিসেম্বর ২০০৯ এ পিঙ্কি ভিরানি অরুণার জন্য তার নিকটতম বন্ধু হিসেবে মার্সি কিলিং বা পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর আবেদন জানান। এর আগে, ভারতীয় আইনে ইউথেনেশিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল না। ২০১১-র ৭ মার্চ দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, যেখানে জানানো হয়, আবেদনকারীর সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালত দুটি অপরিবর্তনীয় ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর অনুমতি দিতে পারে। পরপর দু’বার অরুণাকে তার হাসপাতালের নির্দিষ্ট বিছানা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করা হলে দুটো পক্ষের জন্ম হয়।
প্রথম পক্ষ চায়নি অরুণাকে হাসপাতালে এমন জীবন্মৃত অবস্থায় রাখতে। নার্সরা রুখে দাঁড়ায় এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। একজন রোগী নয়, তার চাইতেও নিজেদের কেউ যেন হয়ে গিয়েছিল অরুণা হাসপাতালের সবার কাছে। ১০ বছর ধরে হাসপাতালের ডিন হিসেবে কাজ করতে থাকা ডক্টর পাই কঙ্কানি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তিনি প্রতিদিন অরুণার বেডের কাছে যেতেন। সেখানে বেশ খানিকটা সময় কাটাতেন। প্রতি বিকেলে অরুণার সাথে গল্প করতেন তিনি। তাকে গান শোনাতেন। তার বিশ্বাস ছিল অরুণা সব শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে আর কোনো একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে। শুধু গল্প বলা বা গান করাই নয়, নানারকম রঙ্গীন পর্দা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি অরুণার ঘরটিকে, এনেছিলেন সাউন্ড সিস্টেম।
শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক মানুষের মতোই মৃত্যু হয় অরুণার। ২০১৫ সালের ১৮ মে দীর্ঘ ৪২ বছর কোমায় থেকে অতঃপর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি। দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। অরুণার সেই হবু স্বামী সন্দীপ দেশাইয়ের কী হল?
অরুণার অসুস্থতার প্রথমদিক থেকেই সন্দীপ ছিল অরুণার পাশে। সকাল-বিকেল এসে বসে থাকত সে অরুণার কাছে। অরুণা একদিন সাড়া দেবে এই আকাঙ্ক্ষায় তাকে বই পড়ে শোনাত, গল্প বলতো। কয়েক মাস পর ডিন তাকে ডেকে পাঠান এবং এ সমস্ত ঘটনা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সোহানলালা বাল্মীকিকে যে আর খুঁজে পাওয়া যাবে সেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবাই। প্রথমে অরুণার ভবিষ্যতের জীবনের কথা ভেবেই ধর্ষণের দিকে আঙ্গুল তোলে তার পরিচিতরা। সোহানলাল তাই এদিক দিয়ে খুব কম শাস্তি পায়। শাস্তি পাওয়া শেষে সে জেল থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অরুণার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই খুঁজে পাওয়া যায় সোহানলালকে।
তাকে পাওয়া যায় পশ্চিম উত্তর প্রদেশের পরপা গ্রামে তার শ্বশুর বাড়িতে। পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও ছিল দুই ছেলে, এক মেয়ে ও তিন নাতি-নাতনি নিয়ে সুখের সংসার তার। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সোহনলাল চলে যায় পশ্চিম উত্তর প্রদেশে, তার পূর্বপুরুষদের গ্রাম দাদুপুরে। সেখান থেকে আশির দশকের দিকে সে চলে যায় পরপাতে, যেখানে সে শ্রমিক ও পরিষ্কার-কর্মী হিসেবে কাজ করে ২৫ কিলোমিটার দূরের এক পাওয়ার স্টেশনে। সে তখন সাইকেলে চড়ে কাজে যেত ও ফিরতো। রোজগার ছিল দৈনিক ২৬১ রুপি। অরুণার মৃত্যুর খবরও অনেক পরে জেনেছিল এমনটা জানায় সোহানলাল।
অরুণার অবস্থার কথা জেনেও এত দিনেও তাকে কেন হাসপাতালে দেখতে যাননি জানতে চাইলে সোহানলাল জানান, “ঐদিনের ঘটনার পর ১০ বছর আমি রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি। কীভাবে আবার তাকে দেখতে যাই আমি?” অনুতপ্ত সোহানলাল বলেন, “যদি আমি মরে যেতাম! আমার ছেলেরাই আমার বউয়ের দেখভাল করতে পারতো। স্মৃতিগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় এখনো! আমি জেলে থাকার সময় আমার এক মেয়ে মারা যায়, সব আমার এই এক দোষের কারণে।”
সোহানলাল নিজেকে দোষী মানতে নারাজ। তার মতে, সে অরুণাকে ধর্ষণ করেনি, যা হয়েছে সে হঠাৎ রাগের মাথায় ঘটিয়ে ফেলেছে। “অন্ধকারে আমাদের হাতাহাতি হচ্ছিলো, আমি তখন সম্ভবত তার গলার অলংকারে ধরে টান দিই। সেটা লেগেই অরুণা দিদির এমন অবস্থা হয়েছে। কিন্তু আমি ধর্ষণ করিনি দিদিকে।”
অরুণার উপর তার রাগ থাকার কারণ কী ছিলো? জানতে চাইলে বলে সোহানলাল, “অরুণা দিদি সারাক্ষণ আমার পিছে লেগে থাকতো। আমি কুকুর ভয় পেতাম। তাই সে আমাকে সবসময় কুকুরের কাছেই পাঠাতো খাবার দিতে। আমার নামে মিথ্যা বিচার দিত। সেই রাতে আমি দিদির কাছে ছুটি চাইতে যাই। কারণ আমার মা তখন ভয়াবহ অসুস্থ। কিন্তু ছুটি তো দূরের কথা, তিনি উলটো আমাকে হুমকি দেন আমার নামে নাকি বিচার দিবেন, আমি খাবার চুরি করি আবার ছুটি চাইতে যাই! আমি যেখানে কুকুরকেই ভয় পাই, কুকুরের খাবার কীভাবে চুরি করব? আমি দিদিকে দেখতাম অন্যান্য ওয়ার্ড বয় ও নার্সদের সাথে তাস খেলতে কাজ বাদ দিয়ে। তিনি আমার নামে বিচার দেয়ার হুমকি দেয়ায় আমিও তখন বলি আমিও তার নামে বিচার দিবো যে, তিনি কাজ ফাঁকি দিয়ে তাস খেলতো। এ কথা শুনে তিনি রেগে যান এবং আমাকে মারা শুরু করেন, এভাবেই মারামারির শুরু আর এসব হয়। যা হয়েছে সব হঠাৎই হয়েছে এবং আমি তাকে ধর্ষণ করিনি।”
সোহানলালের বড় ছেলে কিষাণ জানায়, তার বাবা কখনো এই কেসের ব্যাপারে কথা বলেনি। ছোট ছেলে রবীন্দ্র জানায়, বারো বছর বয়সে এই কথাগুলো জানতে পারে সে। আর এজন্য কম ভুগতে হয়নি তাদের। তবু কখনো বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলেনি তারা। সত্যিটা কী? সোহানলাল যেটা বলছে সেটা নাকি এতদিন ধরে যেটা জেনে আসছে সবাই সেটা? উত্তরটা পরিষ্কার নয়। তবে যাকে নিয়ে এত কথা, সেই নার্স অরুণা শানবাগ আর নেই। প্রশ্নের উত্তরগুলো না হয় এভাবেই থাকুক!
ফিচার ইমেজ- Blasting News UK