আগস্ট, ১৯৯৫। দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের হেড অফিসের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন এক ব্যক্তি। গাড়ি কেনার জন্য লোন নিতে এসেছেন তিনি। ম্যানেজার লোন দিতে রাজি হলেন, কাগজপত্রও ঠিকঠাক। চলে যাবার সময় ম্যানেজারকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য দাওয়াতও দিয়ে বসলেন সেই ভদ্রলোক।
সেদিন রাতের ঘটনা। ফুটাঙ্গা বাবানি সিসোকো নামের সেই লোকের বাড়িতে হাজির হয়েছেন ব্যাংক ম্যানেজার মোহাম্মাদ আইয়ুব। খাওয়া শেষ করলেন, তারপর হালকা গল্পগুজব করতে করতেই সিসোকো দাবি করে বসলেন তার জাদু ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতার সাহায্যে তিনি টাকার অঙ্ক মুহূর্তের মধ্যেই দ্বিগুণ করে ফেলতে পারেন। সিসোকো তার আমিরাতি বন্ধুকে আবারো বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন, এবং অবশ্যই নগদ টাকা সহ। বন্ধুর সামনেই তিনি তার কেরামতি দেখাবেন।
মোহাম্মাদ আইয়ুব কৌতূহলবশত ভাবলেন, দেখা যাক আদৌ কিছু হয় কিনা। পরেরবার সিসোকোর বাড়িতে যখন এলেন, তখন সাথে করে নগদ টাকা নিয়ে আসলেন। তার বাড়িতে ঢুকতেই এক অপরিচিত লোক তার দিকে ছুটে এলো, বললো তার উপর জিন ভর করেছে, আর ভুল করেও যেন জিনকে না রাগানো হয়। তাহলে কিন্তু তার টাকা দ্বিগুণ হবে না। আইয়ুব আর কী করবেন, তাই টাকাগুলো লোকটির হাতে দিয়েই অপেক্ষা করতে থাকলেন। টাকাগুলো নিয়ে জিনে ভর করা ব্যক্তি তার ‘ম্যাজিক রুম’ এ ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরেই আইয়ুব দেখতে পেলেন দরজার নিচ থেকে অদ্ভুত আলো দেখা যাচ্ছে, সাদা ধোঁয়া বের হয়ে আসছে, শোনা যাচ্ছে আত্মাদের ফিসফিস শব্দ, আর তারপরেই সব চুপচাপ।
আইয়ুব টাকা ফেরত পেলেন, যা নিয়ে এসেছিলেন তার দ্বিগুণ। তার আনন্দ আর দেখে কে? কালোজাদুর ফলাফল ভেবে সিসোকোকে আরো টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, যাতে তার টাকা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ব্যবহার করবেন ব্যাংকের টাকা, আর সমপরিমাণ অর্থ যাবে তার পকেটে। তার কিছুটা সিসোকোর পকেটে গেলেও ক্ষতি তো আর হচ্ছে না।
১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮, এই তিন বছরের মধ্যে সিসোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৮৩ বার টাকা পাঠালেন আইয়ুব, আর টাকার অংকটাও বেশ মোটা। সিসোকোও এখন আর ছোটোখাট কাজ করতে রাজি নন, আইয়ুবও ব্যবস্থা করে দিলেন যাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোনোরকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই সিসোকোর অ্যাকাউন্টে চলে যেতে পারে।
১৯৯৮ এর ঘটনা। দুবাইয়ের স্থানীয় এক সংবাদপত্রে খবর ছাপানো হলো যে, ব্যাংকের টাকার তহবিলে টান পড়েছে। এই খবর দেখে জনগণ তাদের টাকা ফেরত পেতে ব্যাংকের সামনে জমায়েত হলো। দুবাই কর্তৃপক্ষ সামান্য যান্ত্রিক সমস্যার কথা বলে জনগণকে আশ্বস্ত করলো, আর জনগণের টাকার উপর কোনোরকম প্রভাব পড়েনি বলে পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। টাকার হিসেবে এতটাই গরমিল ছিল যে বীমা কোম্পানিও তা পূরণ করতে পারেনি। অবশেষে দুবাই সরকার তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে টাকা প্রদান করে ব্যাংকটিকে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
কিন্তু জাদুকর ফুটাঙ্গা বাবানি কোথায়? তিনি এতক্ষণে অন্য মহাদেশে থেকে মজা লুটছেন, টাকা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করার জন্য তার দুবাইয়ে থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই।
১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাস। আইয়ুবকে জাদুর কেরামতি দেখানোর কয়েক সপ্তাহ পরেই সিসোকোকে দেখা গেল নিউ ইয়র্কের আরেকটি ব্যাংকে। এবার শুধু অ্যাকাউন্ট খোলা নয়, আরো বড় কাজ করে ফেললেন সিসোকো।
নিউইয়র্ক সিটি ব্যাংকে কোনোরকম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলেন তিনি, আর কয়েকদিনের দেখা সাক্ষাতেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাও রাজি হলেন। সিসোকো এরকম করেছিলেন মূলত সিটি ব্যাংকের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখার জন্য। তার স্ত্রীর সাহায্যে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক থেকে নিউ ইয়র্কের সিটি ব্যাংকে পাচার হয়ে গেল ১৫১ মিলিয়ন ডলার, আর তা কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই। দুবাই ইসলামিক ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সময় সিটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করে বসে। যদিও পরবর্তীতে মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়।
যে ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে সিসোকো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সহায়তার জন্য তাকে ৫ লক্ষ মার্কিন ডলার দিয়ে অন্য জায়গায় আস্তানা গাড়লেন সিসোকো। মেয়েটিও বুঝতে পারলো সিসোকোর এরকম অনেক তথাকথিত স্ত্রী আছে; নিউ ইয়র্ক, মায়ামি কিংবা আফ্রিকা সবখানেই ছড়িয়ে আছে অগণিত স্ত্রী। তাই আর বাক্যব্যয় না করে নিজের ভাগ্য মেনে নিলেন তিনি।
ব্যাংকের টাকা হাতে আসতেই সিসোকো তার স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, পশ্চিম আফ্রিকার জন্য আলাদা এয়ারলাইন গঠন করলেন। ব্যবহার হওয়া একটি হকার-সিডলি ১২৫ আর দুটো পুরনো মডেলের বোয়িং ৭২৭ উড়োজাহাজ দিয়েই শুরু হলো এয়ার দাবিয়ার যাত্রা, নামকরণ করা হয়েছে মালিতে সিসোকোর গ্রামের নামানুসারে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই সিসোকো বেশ বড় একটা ভুল করে বসলেন ভিয়েতনামে যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া দুটো সামরিক হেলিকপ্টার কেনার সময়।
সামরিক হেলিকপ্টার কেনার কারণ হিসেবে সিসোকো দাঁড় করালেন এক অদ্ভুত যুক্তি, এগুলো ব্যবহার করা হবে হাসপাতালে রোগী বহন করার জন্য। কিন্তু হাসপাতালে যেসব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় তার তুলনায় এগুলো ঢের বড়। যেহেতু এগুলো গানশিপ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগুলো বাইরে নেওয়ার জন্য আলাদা ছাড়পত্রের প্রয়োজন। সিসোকোর লোকজন তাদের কাজ আরেকটু দ্রুত শেষ করার জন্য কাস্টমস অফিসারদেরকে ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ঘুষ দিতে গিয়েই গ্রেফতার হলো। সিসোকোর বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলো। সিসোকোকে ধরা হলো জেনেভা থেকে, সেখানে আরেকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছিলেন তিনি।
জেনেভার চ্যাম্প-ডোলোন কারাগার থেকে সিসোকোকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে সেখানে ছুটে গেলেন উকিল টম স্পেন্সার। কারাগারের ওয়ার্ডেন স্পেন্সারকে জিজ্ঞাসা করলেন সিসোকোকে কি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হবে? ‘সেই চেষ্টাই তো করছি,’ স্পেন্সারের উত্তর। ‘তাহলে যত দেরি করে তাকে নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করুন,’ অনুরোধ করলেন ওয়ার্ডেন। ‘কেন?’ ‘ কারণ তিনি প্রতিদিন প্যারিস থেকে অসাধারণ সব খাবারের অর্ডার করছেন, কারাগারের সবাই তাই পেটপুরে খাচ্ছে!’
যুক্তরাষ্ট্রে বিচারের মুখোমুখি হতে হলো সিসোকোকে, কিন্তু সিসোকোর পক্ষে সাফাই গাইতে লোকজনের অভাব নেই। এমনকি একজন সাবেক সিনেট সদস্যও সিসোকোর পক্ষে কথা বললেন। কর্তৃপক্ষ তাকে কাস্টোডিতে আটকে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রায় ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে তাকে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়, তৎকালীন সময়ে যা একটি রেকর্ড।
সিসোকো ছাড়া পেয়ে গেলেন, তার পক্ষে দাঁড়ানো লোকগুলোর প্রত্যেকের গ্যারাজেই একটি করে মার্সিডিজ কিংবা জাগুয়ার যুক্ত হলো। কিন্তু এটা মাত্র শুরু। জুয়েলারির দোকানে মুহূর্তের মধ্যেই অর্ধেক মিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলতেন সিসোকো, জামা-কাপড়ের দোকানে খরচ হতো দেড় লক্ষ ডলারের বেশি। “তিনি প্রতিবার এসেই একবারে তিন-চারটি গাড়ি কিনে নিয়ে যেতেন, পরের সপ্তাহে এসে আবার এরকম তিন-চারটি নিয়ে যেতেন। তার আচরণ দেখে মনে হতো টাকা বাতাসের মতো উড়ে আসছে,” এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন গাড়ির ডিলার রনিল ডুফ্রিন। তিনি একাই সিসোকোর কাছে ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি বিক্রি করেছিলেন।
সিসোকো ক্রমেই মায়ামির একজন তারকায় পরিণত হলো। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন স্ত্রী জুটিয়ে ফেলেছিলেন, তা-ও তাকে আরো বিয়ে করা থেকে থামানো যাচ্ছিলো না। মায়ামির ভাড়া করা ২৩টি অ্যাপার্টমেন্টেই সম্ভবত তার একটি করে স্ত্রী ছিল।
সিসোকো ভালো কাজেও বেশ ভালো পরিমাণ দান খয়রাত করে বেড়াচ্ছিলেন। তার ট্রায়াল যতই কাছে চলে আসছিলো, ততই তার দান খয়রাতের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিলো, সিসোকো খুব ভালো করেই জানতেন খ্যাতির জোর কতখানি। মায়ামির এক হাই স্কুল ব্যান্ডের নিউ ইয়র্কের প্যারেডে অংশগ্রহণের জন্য তিনি প্রায় চার লক্ষ ডলার দান করেছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতেন আর বসতবাড়িহীন লোকদেরকে টাকা-পয়সা দান করে আসতেন। ১০ মাস মায়ামিতে ছিলেন সিসোকো। এই ১০ মাসে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছিলেন তিনি, প্রতি মাসে এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি!
যা-ই হোক, এত দান-খয়রাত করে খুব একটা লাভ হয়নি। সিসোকোকে অপরাধী ঘোষণা করা হলো। আর শাস্তি হিসেবে কারাভোগ করতে হবে ৪৩ দিন, সাথে জরিমানা গুণতে হবে আড়াই লক্ষ ডলার। জরিমানা অবশ্যই দেওয়া হলো, দুবাই ইসলামিক ব্যাংকই তাদের অগোচরে জরিমানা পাঠিয়ে দিলো। কারাভোগের অর্ধেক পার হওয়ার আগেই এক মিলিয়ন ডলার খরচ করলো সিসোকো, এর বিনিময়ে তাকে ফ্লোরিডার কারাগারের বদলে থাকতে দেওয়া হবে মালিতে নিজের বাসায় হাউজ-অ্যারেস্টের মতো। মালিতে পা দিতেই তাকে বরণ করে নেওয়া হলো নায়কের মতো করে।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন সিসোকোর বিচার চলছে, তখন দুবাইয়ে ব্যাংকের অডিটররা টের পেলেন ব্যাংকের হিসাবে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। আইয়ুবও বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়েছেন, কারণ সিসোকো তার ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। শেষমেশ আইয়ুব তার এক সহকর্মীর কাছে তার অপরাধ স্বীকার করলেন, যিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঠিক কত টাকা পাঠানো হয়েছে। আইয়ুব মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে না পেরে কাগজে লিখে দিলেন, ‘৮৯০ মিলিয়ন দিরহাম’, যা ২৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান! আইয়ুবকে ৩ বছরের জন্য কারাভোগে দণ্ডিত করা হলো। এমনও গুজব শোনা যায় যে, কালোজাদুতে বিশ্বাস করার জন্য তাকে এক্সরসিজমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল।
সিসোকোকে কখনোই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। দুবাই আদালত জাদু চর্চা আর প্রতারণার অপরাধে ৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল। ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলো, আর সে এখনো একজন ‘ওয়ান্টেড আসামী’ হিসেবেই রয়েছে।
২০০২ থেক ২০১৪, এই ১২ বছর সিসোকো মালির পার্লামেন্টের সদস্য ছিল, যার ফলে তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। আর শেষ ৬ বছর, এমপি না হওয়া সত্ত্বেও মালির সরকারই তাকে আড়াল করে রেখেছে, যেহেতু তাদের সাথে অন্য দেশের এরকম কোনো চুক্তি নেই।
কালো জাদুকর হিসেবে প্রতারণা করে ব্যাংক থেকে ২৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লুট করে নেওয়া এই ব্যক্তিকে একদিনের জন্যেও কোনো শাস্তিভোগ করতে হয়নি, আর এটাই ফুটাঙ্গা বাবানি সিসোকোর গল্প।
ফিচার ইমেজ: LADBible