“চেয়ে তব মুখপানে বসে এই ঠাঁই
প্রতিদিন যত গান তোমারে শুনাই
বুঝিতে কি পার সখি, কেন যে তা গাই?
বুঝ না কি হৃদয়ের
কোন খানে শেল ফুটে
তব প্রতি কথাগুলি
আর্তনাদ করে উঠে!”
(সন্ধ্যাসঙ্গীত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কবির সব প্রেম, নৈবদ্য কিংবা বিরহের কবিতার পেছনে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থাকে কোন নারীর ছায়ামূর্তি। কখনো সেটা রক্ত মাংসের রমনী, কখনো সেটা কবির আধেক কল্পনা- আধেক মানবী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা ছিল তার বউদি কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে।
কবিগুরুর ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গ উঠলে যে নারীর নাম অবধারিতভাবে উঠে আসে তা হল কাদম্বরী দেবী, সম্পর্কে তার বড়দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুকের স্ত্রী। একদম কাছাকাছি বয়সের এই দুই মানব-মানবীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের কোন শেষ নেই। কিন্তু তারপরও, কিছুটা জটিল, কিছুটা সহজ এই সম্পর্ক যতটা না মুখরোচক গল্প করার ব্যাপার, তার থেকেও বেশি অনুভব করার ব্যাপার।
কাদম্বরী দেবী, (বিবাহ পূর্ববর্তী নাম মাতঙ্গিনী) এর আদিনিবাস বাংলাদেশের যোশরে। বয়স যখন তার ৯ কি ১০, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তিনি উঠে আসে্ন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ষষ্ট সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বধূ হিসেবে। বিদ্যা-বুদ্ধিতে স্বামীর তুলনায় কোন অংশে কম ছিলেন না তিনি। তবে ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে যখন আসেন, তখন সামান্য আক্ষর পরিচয় ছিল মাত্র। পরে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সবার আগ্রহে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে ঠাকুরবাড়িতে এমনই ছিল রীতি।
স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তখনকার দিনের ঠাকুরপরিবারের উজ্জলতম নক্ষত্র- ধূমকেতু বলাটা কি বেশি যুক্তিযুক্ত হবে? কারণ জীবনের শেষের দিকে এই প্রবাদপুরুষের পতন আমরা দেখতে পাই। দীর্ঘকায়, মজবুত গড়ন, তীক্ষন্নাশা- রূপ যেন দেবতাকেও হার মানায়। দেবেন্দ্রথা ঠাকুরের চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রের যশ ছিল আকাশ ছোঁয়া। পিতার অনুপস্থিতিতে জমিদারির দেখাশোনা থেকে শুরু করে খেলাধূলা, অশ্বারোহণ ও শিকারে দক্ষ। তেমনি সফল নাট্যকার, সঙ্গীত রচনাকারী। তার অনেক নাটক রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত অভিনীত হয়েছে সেসময়, বাংলা সাহিত্যের একেকটি অমূল্য রত্ন সেগুলো।
কাদম্বরী দেবী আর জ্যোতিরিন্দ্রের এই বিয়েটা ঠিক যেন সুখের ছিল না। দু’জনের মধ্যে ছিল যোজন যোজন দূরত্ব। হাড়কাটা গলির শ্যাম মিত্র তার বাবা দেখে ঠাকুরবাড়ির অনেকেই কাদম্বরীকে নিচু চোখে দেখত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদাদেবী তো প্রায়ই বলতেন,‘ নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কী যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায় ওর বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নীচু হয়, সেই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায় হয়তো, সুখী হওয়া যায় না। নতুন তো সারাক্ষণ আমার কাছেই পড়ে থাকে। গান বাজনা থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের দুঃখটা ভুলে আছে।’
স্বামীর দৃপ্ত পদচারণার তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা নিষ্প্রভই ছিলেন কাদম্বরী। কিন্তু তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। লোকজন চারপাশে বসিয়ে অনর্গল গল্প করে আসর মাতিয়ে রাখার যে প্রবণতা দেখা যেত সে সময়ের ড্রয়িংরুম কালচারের কর্ণধার সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ভেতর, সেটা তার ভেতর একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। আসরের মধ্যমণি নয়, তিনি স্বস্তি পেতেন নিজের মনে একা একা থেকে- নিজের কল্পনার আকাশে। রাজ্যের বই তার সঙ্গী ছিল একাকীত্বের। দীর্ঘাঙ্গী,গাঢ় ভ্রূ, বড় বড় অক্ষিপল্লব, কৌতুকময় চোখ, পরিমিত বেশভূষা, কথা বলার ভঙ্গী সবকিছু নীরবে জানান দিত তার ব্যক্তিত্বের মহিমা। জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতন না, তার সৌন্দর্য ছিল গ্রীক দেবীর মতন। স্বল্পভাষী, রহস্যময়ী, প্রচণ্ড অভিমানী- জেদী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মায়ের স্নেহপরায়ণা, বালিকার মত উচ্ছল স্বভাবের। কঠিন কোমলের অপূর্ব সমন্বয় এই নারীকে তাই রবি ডাকত গ্রীক দেবী হেকেটি নামে।
তবু কিছুটা নিজের মধ্যে গুটানো এই মানুষটাকে ভুল বোঝেনি এমন খুব কম মানুষই ছিল সে সময়। শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে তিনি ছিলেন দেমাগী, মিশতে পারে না একদমই। এর উপর ছিলেন নিঃসন্তান। রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে ঊর্মিলা ছিল কাদম্বরীর ভারী ন্যাওটা। পরে ঊর্মিলা যখন মারা গেল, আত্মীয়স্বজন, ঝি-ঠাকুর সবাই কানাঘুষা করা শুরু করল কাদম্বরী হল আঁটকুড়ি, হিংসা করে খেয়ে ফেলেছে এত্তটুকুন মেয়েটাকে।
স্বামী দিনরাত ব্যস্ত কাজ নিয়ে, নাহলে নাটক- নভেল নিয়ে। তাদের দুজনের মনের মিলও তেমন ছিল না। তাই স্ত্রীর মর্যাদা পুরোপুরি তিনি কখনো পাননি। যে তলার মানুষের সাথে তার স্বামীর চলাফেরা সেখানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারতেন না কাদম্বরী। তাই তার দিন কাটতো জোড়াসাঁকোর তেতলায়। একা। তার একাকীত্ব আর অবসাদের জীবনে ছোট্ট একটা ছুটির মতন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাত্র দুই বছর ব্যবধান তাদের বয়সের। তাই সেই দশ বছর বয়সে বউ সেজে যে টুকটুকে মেয়েটি এসেছিল, তার সাথে রবির ভাব করে নিতে এতটুকু বেশি সময় লাগেনি। প্রায় সমবয়সী ছিল দেখে বন্ধুত্বও ছিল সমানে সমানে। রবির যত টুকিটাকি আবদার সব সে এসে করত নতুন বৌঠানের কাছে। আর বৌঠান শুনতে চাইতো রবির লেখা নতুন কোন কবিতা অথবা গল্প। পরস্পরের সান্নিধ্যে তারা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল দিনগুলি।
সময়টা তখন সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে প্রবেশের। সময়টা তখন কিছুটা লোখচক্ষুর আড়ালে থাকবার বয়সের। সদ্য যুবক রবি তখনও হয়ে উঠেনি দেশবরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুইবার বিলেত থেকে পড়াশুনা শেষ না করেই ফিরে আসা রবির তখন আত্মীয়স্বজনের বাক্যবাণ থেকে বাঁচতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সে সময় তার ত্রাণকর্তা হিসেবে রঙ্গমঞ্চে এলেন নতুনদা। দাদা-বউদির সাথে সে অবকাশ যাপন করতে লাগল চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির দিনগুলির কথা ঘুরে ফিরে অনেক বার এসেছে তার লেখায়।
নিভৃত সাহিত্যচর্চার এই সময়টি ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম সুন্দর সময়। সে সময় রবির সব লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন কাদম্বরী। কী অসাধারণ সূক্ষই না ছিল তার রুচিবোধ, সৌন্দর্যবোধ আর সাহিত্যজ্ঞান! লেখার প্রশংসা, প্রেরণা কিংবা সমালোচনা- কাদম্বরীর জায়গা নিতে পারেনি পরবর্তীতে কেউই। রবির অসংখ্য লেখায় কিংবা গানে ছায়া পাওয়া যায় শ্রীমতি হে’ এর। একি সাথে তিনি ছিলেন রবির দেবী, হৃদয়ের রাণী, খেলাঘরের সাথী, বিচক্ষণ পাঠিকা। তার রূপের বর্ননা, তাদের কাটানো সময়ের কথা, তাদের খুনসুটি- এসব নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গান। ‘বউঠাকুরানির হাট’ উপন্যাসের পরিকল্পনা তিনি দুপুরবেলা বউঠানের পাশে বসে হাতপাখার বাতাস খেতে খেতেই করেছিলেন।
অশোক বসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে
আপনার রূপের মাঝারে,
রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে
রূপেতেই লুকায় আবার।…
(ছবি ও গান-আচ্ছন্ন, ১)
বউদিকে সাজতে দেখে রবি আপন মনেই সাজিয়েছিল এই চরণগুলো। এমনই রূপের বর্ননা তাকে ছাড়া আর কাকেই বা মানায়? নিঃসন্তান, একাকী এই নারীর জীবনে রবির উপস্থিতি, রবির লেখাগুলি ছিল সূর্যের মতন। অমোঘ এবং অপরিহার্য। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চর্চায় এক অনিবার্য উপস্থিতি ছিলেন কাদম্বরী। তার লেখার উৎস, প্রেরণার উৎস… সবটুকু ঘিরে ছিল নতুন বউঠান।
এমন ইন্দ্রপুরীর ছন্দপতন হওয়া শুরু করল তখন যখন থেকে রবিও জ্যোতিরিন্দ্রের মত বারমুখো হওয়া শুরু করল। তা বাহিরমুখী হবে না বা কেন? একটু একটু করে তখন রবির লেখার যশ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল সবখানে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা রবি একসময় কোকুন কেটে বের হয়ে আসলো সবার সামনে। কিন্তু নতুন বউঠান? সে আগের মতই। সবচেয়ে ভালো যে মানুষটা লিখতে পারত, সবচেয়ে ভাল যে মানুষটা তার সুন্দর মন দিয়ে চারপাশ আলো করে রাখতে পারত, সে যেন ধনুর্ভাঙ্গা পণ করেছে লিখবে না বলে, বের হবে না। রবি বাইরের হাতছানিতে চলে গেল কিন্তু সে আগের মতই ডুবে গেল বিষন্নতার রাজ্যে। অশোকবনের সীতার মতন বন্দিনী জীবন কাটাতে লাগলো সে তেতলাতেই। রবির বিয়ের পর তার বড় সাধ ছিল নতুন বউকে সে গড়েপিটে যোগ্য করবে রবির। কিন্তু সে আহ্লাদেও বাদ সাধল জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, রবির আরেক বউঠান। যেন সবাই মিলে নিঃসঙ্গতার শাস্তি দিতে চায় নতুন বৌঠানকে!
ঠাকুরবাড়ির তেতলার এক বিকেল বেলার কথা। কাদম্বরীর মন আজ অনেকখানিই লঘু। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর আজ যে একটু শরীর ভাল লাগছে। চেহারায়ও হারানো লাবণ্য ফিরে এসেছে। তিনি আর সেজেছেন গাঢ় নীল নয়ন সুখ সিল্কের শাড়িতে। জ্যোতিরিন্দ্রের প্রথম জাহাজ “সরোজিনী” আজ প্রথম ভাসবে পানিতে। আর সে উপলক্ষ্যেই এই পার্টি হবে জাহাজে। তাকে নিতে আসবে তার স্বামী। আর সেজন্যই এত সাজ। কিন্তু বেলা গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যেয় আসার কথা অথচ বাজছে রাত দশটা। কাদম্বরী বুঝে গেলেন তার স্বামী আজ আসছেন না। সবসময় যেটা হয়ে এসেছে- তাকে ছাড়া সব আমোদ আহ্লাদ- তেমনটা হবে আজকেও। দিনে দিনে জমানো অভিমান আর কষ্টের বিশাল হিমবাহে অবশেষে ফাটল ধরল। ধীর স্থির, স্বল্পভাষী, নিজের কষ্ট গোপন করা নারীটি আজ ধৈর্যের শিকল ছিঁড়ল। … সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রথম আলো” উপন্যাসে এমনই নিখুঁত বর্ননা আছে কাদম্বরীর মৃত্যুর দিনের। আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। যে বয়সে মানুষ স্বাধীনতা আস্বাদ করে প্রথমবারের মত, যে বয়সে মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারে পুলকিত হয় ক্ষণে ক্ষণে ঠিক সেই বয়সে আশি বছরের বৃদ্ধার মত রিক্ত হৃদয়ে, পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে চলে গেলেন কাদম্বরী দেবী। এক নক্ষত্রের প্রস্থান- এক হৃদয়ের রাণীর মৃত্যু হল সেদিন।
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু সেকালের কলকাতা সমাজের অন্যতম স্ক্যান্ডাল ছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তক্ষেপে যদিও কোন আলামত কখনো চাউর হয়নি বাইরে তবুও বাতাসে ভাসতো অনেক কথা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোরালো ছিল রবির সাথে কাদম্বরীর প্রেম। আসলে তাদের মধ্যে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক ছিল সেটা তারা নিজেরা ছাড়া আর কারো স্পষ্ট জানার কথা না। প্রেম, ভালোবাসা জিনিসগুলো যেমন বহুমুখী, ঠিক তেমটাই ধূসর। সাদা-কালো, উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিকে ভাগ করা এত সহজ কিছু না। তবে এতটুকু নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর স্থান ছিল দেবীর আসনে। মৃত্যুর অনেক দিন পরও নতুন বৌঠানের অভাব তিনি অনুভব করতেন সর্বত্র। মৃত্যুর আগেও যেমন সব বই উৎসর্গ করতে তার নামটা প্রথমে আসতো সেটার ধারা অব্যাহত ছিল মৃত্যুর পরেও। কাদম্বরীর মৃত্যুর ঠিক সাত দিন পর রবির বই বের হয়েছিল “প্রকৃতির প্রতিশোধ”। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল শুধু “তোমাকে দিলাম”। “শৈশব সঙ্গীত” এর উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল “বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম।…তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।”
রবীন্দ্রনাথ তার বউঠানকে নিয়ে সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে লিখেছেন নষ্টনীড় গল্পটিতে। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি তাদের কথা না। সেটা যথার্থই নষ্টনীড়। ভুল মানুষের প্রেমে পড়া এক নারীর ভীত হরিনীর মত স্ত্রস্তপায়ে ঘর ছেড়ে যাওয়ার গল্প সেটা। তবুও চারুর ভেতর কাদম্বরীর ছায়া আছে- চরিত্রগুলো না হলেও অন্তত ঘটনার প্রবাহে, কাহিনী প্রেক্ষাপটে মিল আছে। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ আর তার সাথে কাদম্বরীর সম্পর্কের পোস্টমর্টেম হয়েছে অনেকভাবে। অনেক অনেক লেখা আছে তাদের নিয়ে। অনেক অনেক কবিতা। কাল্পনিক সুইসাইড নোট নিয়েও লেখা হয়েছে গল্প। ১৯৬৪ সালে সত্যজিত পরিচালনা করেছেন “চারুলতা” ফিল্মটি নষ্টনীড় অবলম্বনে। হাল আমলে ২০১৫ সালে সুমন ঘোষ পরিচালিত কঙ্কনা সেন শর্মা অভিনীত “কাদম্বরী” নামের একটি ফিল্মও মুক্তি পেয়েছে।
নর-নারীর সব সম্পর্ককে নেহাতই প্রথাগত “প্রেম” এর কাতারে ফেলা ঠিক না। তাদের দু’জনের মনের মিলটা অনেক বেশি ছিল, একজন আরেকজনকে বুঝত সবথেকে ভাল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন মন হল একটা তরল পদার্থের মতন, সে যে পাত্রে রাখা হয় তার আকার ধারণ করে। তবে সব মনের জন্যই একটা মানানসই পাত্র দরকার। তার বেলায় যেটা ছিল কাদম্বরী দেবী। একজন আরেকজনের মানসসঙ্গী ছিলেন তারা। খুব সাধারণ “প্রেম” দিয়ে আসলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না এই সম্পর্কটিকে।
সৃষ্টিশীল মানুষদের অনুভূতির তারটা সবসময়ই চড়া হয়। যে মানুষগুলো তাদের জীবনে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে যেতে পারে, সে মানুষগুলোর অভাব তারা কখনোই কোনভাবে পূরণ করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যখন দেশখ্যাত হলেন, তার ভক্তকুল কিংবা সমালোচকের কোন অভাব ছিল না। স্ত্রী বাদেও একাধিক নারী তার লেখায় ছাপ ফেলেছে, যেমন – ইন্দিরা দেবী, ভিক্টোরিয়া ওকাম্প প্রমুখ। কিন্তু তারপরও, কাদম্বরী দেবীর জায়গাটি কেউ কখনো নিতে পারেনি। তার অরুনকান্তি ছায়া সর্বদা বিরাজমান ছিল কবির পাশে। ঠিক কবির অনেক দিন আগে নতুন বৌঠানের দিকে চেয়ে বাঁধা গানটির মতই-
তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা…