Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উড্রো উইলসন: যার শান্তির বাণী প্রত্যাখ্যান করে অনুশোচনায় ভুগেছিল আমেরিকা

আমেরিকার ২৮তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ছিলেন একজন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন পণ্ডিত। তার পাণ্ডিত্যের ব্যাপক চর্চা ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে, এখনো আছে। তিনি আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম সমাদৃত প্রেসিডেন্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার দৃঢ়তার পরিচয় পেয়েছে বিশ্ব। তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তোলেন ‘লিগ অব নেশন্স’ যার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও জেতেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই আমেরিকায় নারীদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের উপর অগাধ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন এই ব্যক্তি অবশ্য একটা পর্যায়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। সেটি ভার্সাই চুক্তির কারণে। কিন্তু সে বিতর্ক সাধারণ মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারেনি একজন উড্রো উইলসনকে।

থমাস উড্রো উইলসনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টন্টন শহরে। ১৮৫৬ সালের ২৮ ডিসেম্বরেই মূলত তার বাবা জোসেফ রাগলস উইলসন ভার্জিনিয়ায় চলে আসেন। এর আগে ওহাইয়োতে বাস করতেন এই স্কটিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন, যিনি কি না আমৃত্যু প্রেসবিটারিয়ান মন্ত্রী ছিলেন। উড্রোর মা জেনেট উড্রোও ছিলেন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক। অর্থাৎ, উড্রোর বাবা-মা উভয়েই আমেরিকার বাইরে জন্মেছেন। এতে করে উড্রোর আরেকটি পরিচয়ও পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের পর তিনিই দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট যার বাবা-মা উভয়েই বিদেশে জন্মেছেন।

কিশোর উড্রো উইলসন; Image Source: wilsonboyhoodhome.org

স্টন্টন শহরটি কেবলই উড্রোর জন্মের সাথে সম্পর্কিত। এর বাইরে এ শহরের সাথে জড়িত কোনো স্মৃতি নেই তার। কেননা জন্মের এক বছরের মাথাতেই তার বাবা আবারো বাসস্থান পরিবর্তন করে চলে যান দক্ষিণ ক্যারোলিনার জর্জিয়া শহরে। জর্জিয়ার অগাস্টা চার্চের ফাদারদের সংস্পর্শে বেড়ে উঠতে থাকেন তিনি। তথাপি, পড়ালেখা শুরু করতে পারেননি ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায়। এরই মাঝে অগাস্টা চার্চটি অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয় গৃহযুদ্ধের সময়। যে চার্চে ছোটাছুটি করে দিন কাটাতেন, সে চার্চে শত শত আহত মানুষ, তাদের অঙ্গচ্ছেদের আর্তনাদ আর স্বজনদের আহাজারি দেখে বিস্ময়ে, ভয়ে, হতাশায় বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন শিশু উইলসন।

১০ বছর বয়সে ডিজলেক্সিয়া কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন উড্রো উইলসন। দেরিতে শুরু করলেও তার মেধার বিচ্ছুরণ ঘটতে সময় লাগেনি। স্থানীয় স্কুলে মাধ্যমিক শেষ করে ডেভিডসন কলেজে পড়ালেখা করেন ১ বছর। এরপর ভর্তি হন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরবর্তীতে যার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রিন্সটনে ভর্তি হয়েই মূলত তিনি নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন সাধনে লেগে যান। যাবতীয় পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কাজে অংশ নেয়া, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ জ্ঞানের তাবৎ শাখায় বিচরণ শুরু করেন, সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায়। স্নাতক শেষ করার পূর্বেই জীবনের প্রথম তাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা করে ফেলেন। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল মার্কিন সরকার ব্যবস্থার সাথে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তুলনা।

উড্রো উইলসনের শৈশব কেটেছিল এ বাড়িতে; Image Source: wilsonboyhoodhome.org

রাজনীতিতে প্রবেশ করাটা উড্রোর জন্য অপ্রত্যাশিত কোনো ব্যাপার ছিল না। কারণ, কৈশোরেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন! এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই প্রিন্সটনে স্নাতক সম্পন্ন করে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন পড়বার জন্য। উল্লেখ্য, সে সময় রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আইনই ছিল সবচেয়ে উপযোগী বিষয়। আইনে স্নাতক শেষ করে আটলান্টায় দু’বছর আইন ব্যবসাও করেন। এ দু’বছরে আইনের প্রতি ঝোঁক একেবারেই উঠে গেলে তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ার জন্য ভর্তি হন এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

উড্রো উইলসনের পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল তার স্নাতক জীবনের রচিত প্রবন্ধটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই গবেষণা প্রবন্ধটিই ‘কংগ্রেশনাল গভার্নমেন্ট: অ্যা স্টাডি ইন আমেরিকান পলিটিক্স’ শিরোনামে তার লেখা প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে তিনি ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থা আর মার্কিন কংগ্রেশনাল সরকার ব্যবস্থার তুলনা আরো প্রসারিত করেন। এই বইয়ে তিনি মার্কিন সরকার ব্যবস্থাকে আরো জনকল্যাণমূলক এবং জবাবদিহিতামূলক করে তোলার জন্য কিছু পরামর্শও দেন। পরবর্তী জীবনে সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তার লেখাগুলো একটির চেয়ে আরেকটি শ্রেয়তর হয়েছে। ‘দ্য স্টেট: এলিমেন্টস অব হিস্টরিক্যাল অ্যান্ড প্র্যাক্টিক্যাল পলিটিক্স’, ‘ডিভিশন অ্যান্ড রিইউনিয়ন’, ‘অ্যা হিস্ট্রি অব আমেরিকান পিপল’ ইত্যাদি বইয়ে তার রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়।

উড্রো উইলসনের প্রথম বই; Image Source: quidprolaw.com

১৮৮৫ সালে এলেন লুইস এক্সসনকে বিয়ে করেন উড্রো উইলসন। এই দম্পত্তির সংসার ছিল সবরকম সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরপুর। তিন সন্তান নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসারে অশান্তির শুরু হয় উইলসনের একটি অবৈধ সম্পর্ক থেকে। ম্যারি অ্যালেনের সাথে উইলসন যখন একটি অদূরদর্শী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তার স্ত্রী এলেন তখন প্রচণ্ড মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। উইলসনের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মাত্র ১ বছরের মাথায় তার মৃত্যু ঘটে। আর তাতে ঘোর কাটে উইলসনের। ম্যারির সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে শোকের সাগরে নিমজ্জিত হন তিনি। প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভোগেন বছরখানেক। অবশেষে তাকে হতাশা থেকে মুক্তি দেয় এডিথ গল্টের প্রেম, যাকে এলেনের মৃত্যুর তৃতীয় বছর, ১৯১৫ সালে বিয়ে করেন উইলসন।

যা-ই হোক, ফিরে আসি প্রেসিডেন্ট উইলসনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘটনাপ্রবাহে। ১৮৮৫ সালের দিকে তিনি একটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তখন রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে শংকা এবং হতাশায় ভুগছেন তিনি। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পেয়ে সে হতাশা কিছুমাত্রায় কেটে যায়। বরঞ্চ, অল্প সময়ের মাঝেই নিজের চমৎকার বাচনভঙ্গি আর মেধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বেশি বেতনের অধ্যাপকে পরিণত হন উইলসন। আর তাতে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ব্যাপারটা যেন কিছু সময়ের জন্য ভুলেই গিয়েছিলেন! অবশ্য সে কথা মনে রাখবেনই বা কেন, প্রিন্সটনে যোগ দেয়ার মাত্র ৭ বছরের মাথায়ই যে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, এতটাই ছিল তার জনপ্রিয়তা। এরই সাথে শৈশবের প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন প্রথম ধাপে পূরণ হয়ে গেল, হোক না সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট!

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন অনুষদ; Image Source: flickr.com

এর পরের গল্পটা সিনেমার মতোই মনে হতে পারে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলনলচে বদলে দিয়ে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ চূড়ায় চড়ে বসেন। এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে তাকে নিউ জার্সির গভর্নর হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। উইলসনের আর কী চাই? এই সময়টার অপেক্ষায়ই তো ছিলেন তিনি। সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং অধ্যাপনায় ইস্তফা দিয়ে ডেমোক্র্যাটদের হয়ে গভর্নর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। রাজনীতিতে নতুন হলেও জনপ্রিয়তায় তার ধারে কাছেও ছিল না প্রতিদ্বন্দ্বীরা। ফলে বড় ব্যবধানে নির্বাচন জিতে গেলেন তিনি। অফিস বুঝে নিয়েই নিজের পূর্বেকার রাজনৈতিক সংস্কার বিষয়ক জ্ঞানগুলো ব্যবহারিকভাবে কাজে লাগান। আর তাতেই দেশসুদ্ধ মানুষের কাছে বাহবা পেয়ে হয়ে গেলেন ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থী। ১৯১২ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে আমেরিকার ২৮তম প্রেসিডেন্ট হন উড্রো উইলসন।

নির্বাচনে উইলসনের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন থিওডোর রুজভেল্ট, যার নির্বাচনী প্রচারণার মুখ্য বিষয় ছিল ‘নিউ ন্যাশনালিজম’। উইলসন এর বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন ‘নিউ ফ্রিডম’, যা বাস্তবায়নে প্রথম থেকেই কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তনও আনার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি এবং এর জন্যও কাজ করেছেন। তিনি চাইতেন, তার কাজগুলো যেন প্রধানমন্ত্রীর মতো হয়। সেজন্য নিয়মিত আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বৈঠকও করেছেন। ক্ষমতার প্রাথমিক সময়ে তার সবচেয়ে চমৎকার সিদ্ধান্ত ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জেনিংস ব্রায়ানকে নিয়োগ দেয়া। ডেমোক্রেটদের তিনবারের প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন দৌড়ে অংশ নেয়া জেনিংসের অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে বেশ কাজে লেগেছিল তার।

কংগ্রেসে উইলসনের প্রথম প্রশাসনিক জয় ছিল একটি ট্যারিফ সংক্রান্ত বিলে, যেটি সংবিধানে ১৬তম সংশোধনের মাধ্যমে পাস করা হয়। এর দ্বারা কর ব্যবস্থায় সরকারের হাতছাড়া হওয়া পাওনা কর আদায় করার জন্য ভিন্ন একধরনের কর চালু করা হয়। উইলসনের দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিল মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার সংস্কার, যার জন্য তার বেশ কসরত করতে হয়েছিল। কয়েকমাস কংগ্রেসে তপ্ত বিতর্কের পর তিনি জয় ছিনিয়ে আনেন এবং ব্যাংক ব্যবস্থার বড় ধরনের সংস্কারের বিল পাস করতে সক্ষম হন। তার এই বিলের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ব্যবস্থায় ‘ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম’ চালু হয়, যা অর্থনীতিতে এখনো মার্কিন সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাবক। এর কিছুকাল পরই তিনি ‘ক্লেটন অ্যান্টিট্রাস্ট অ্যাক্ট’ পাস করেন, যে আইনটি যুক্তরাষ্ট্রে লেবার ইউনিয়নগুলোকে মুক্ত করেছিল এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকে সহজ করেছিল।

ওভাল অফিসে উইলসন; Image Source:nationalreview.com

প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে উড্রো উইলসন ছিলেন অভূতপূর্ব সফল। কংগ্রেসে প্রথম ৩ বছরে তিনি প্রতিপক্ষের কাছে কখনো হেরে যাননি। প্রতিটি সংস্কার আইনই তিনি পাস করিয়ে আনতে পেরেছেন। সরকারি কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা, শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা, আয়কর ও রাজস্ব বৃদ্ধি করা, শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘন্টা নির্ধারণ, দেশের প্রথম ইহুদি বিচারপতি নিয়োগের মতো সংস্কার কাজে তিনি ছিলেন পুরোপুরি সফল। তবে সমস্যাও ছিল একাধিক। তার মধ্যে প্রথমেই চলে আসবে বর্ণবাদের ব্যাপার। উড্রো উইলসনের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ ছিল। তার মন্ত্রীসভায় বেশ কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ছিলেন, যারা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা বিশ্রামকক্ষ (রেস্টরুম) নির্মাণের দাবি তোলে এবং উইলসন বিস্ময়করভাবে তাতে সায়ও দেন! প্রথম মেয়াদে তিনি যদি কারো কাছে অজনপ্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে তারা হলো আফ্রিকান আমেরিকানরা। এই শ্রেণীর মানুষ উইলসনের শাসনামলে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন কোনোরূপ বাছবিচার ছাড়াই। যদিও প্রতিবাদের মুখে আলাদা বিশ্রামকক্ষ বন্ধ করা হয়, তথাপি আফ্রিকান আমেরিকানদের নিকট তিনি খলনায়ক হয়ে ওঠেন।

বৈদেশিক সম্পর্কেও কিছু জায়গায় বিপত্তি বাধায় উইলসন প্রশাসন। প্রথম সমস্যা শুরু হয় লাতিন আমেরিকা থেকে। হাইতি আর ডমিনিক রিপাবলিক দখল করে সেগুলোতে শান্তি প্রচেষ্টার চেষ্টায় তীব্র বৈশ্বিক সমালোচনা বয়ে আনে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। অন্যদিকে মেক্সিকোতে সামরিক শাসক হুয়ের্তাকে উৎখাতের সিদ্ধান্তও ভুল প্রমাণিত হলে তার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সমালোচকদের মনে সন্দেহ জাগে। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল তার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। যুদ্ধ শুরুর বছর তার প্রথম স্ত্রী এলেনের মৃত্যুতে এমনিতেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তাই যুদ্ধের শুরুর বছরটা কোনো ধরনের বড় সিদ্ধান্তে না গিয়ে নিরপেক্ষভাবেই কাটিয়ে দেন।

কিন্তু, যত দিন গড়ায়, উইলসনের উপর কিছু করবার চাপ তত বাড়তে থাকে। জার্মানদের ইউবোটগুলো ব্রিটিশদের জাহাজ ডুবিয়ে দিতে থাকে প্রতিদিনই। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তো জার্মানদের হামলায় এক ব্রিটিশ জাহাজডুবির ঘটনায় ১১০০ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, যার মাঝে ১২৮ জন ছিলেন মার্কিন নাগরিক। এবার আর চুপ করে বসে থাকার উপায় ছিল না। দেশের জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার ডাক দিলেন উইলসন। তথাপি যুক্তরাষ্ট্র তখনো সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেয়নি। কিন্তু জার্মানির উপর নানারকম প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করে সাবমেরিন দ্বারা বেসামরিক মানুষ হত্যা বন্ধের জন্য। পরবর্তীতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তৎপরতায়ই যুদ্ধে সাবমেরিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জার্মানি। অবশ্য তাতেও ব্রিটিশরা খুব একটা খুশি হতে পারেনি। আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় তারা ক্ষুব্ধ ছিল।

উইলসনের ১৪ দফা; Image Source: tes.com

এদিকে যুদ্ধের মাঝেই চলে এলো ১৯১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ায় রিপাবলিকান পার্টি। চার্লস হিউজেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার শ্লোগান, “হি কেপট আস আউট অব ওয়ার” বা “সে (উইলসন) আমাদেরকে যুদ্ধে যেতে দেয়নি” রিপাবলিকানদের পুনর্জীবন দান করে। প্রচুর মানুষের সমর্থন পায় এ শ্লোগান। তথাপি নানাবিধ উন্নয়ন ও সংস্কার কর্মকাণ্ডের জন্য উইলসনের জনপ্রিয়তাও একেবারে কমে যায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচনটিতে শেষতক উইলসনই জিতেছিলেন ২৩টি ইলেক্টোরাল ভোটের ব্যবধানে।

দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেও নিজের আগের অবস্থান ধরে রাখেন উড্রো উইলসন। যুদ্ধ নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। তিনি “পিস উইথ ভিক্টোরি”র চেয়ে “পিস উইদাউট ভিক্টোরি”কে মহান বলে ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সবগুলো যুদ্ধরত দেশকে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। ১৯১৭ সালের এক বিখ্যাত ভাষণে ‘লিগ অব নেশন্স’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন তিনি। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ থেকে দূরে থাকবার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। কিন্তু জার্মানরা সেই বছর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পুনরায় ইউবোট ব্যবহার করে বেসামরিক জাহাজ ডোবাতে শুরু করে। এর উপর একটি গোপন টেলিগ্রাম ফাঁস হয়ে যায়, যেখানে মেক্সিকোকে জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিনিময়ে যুদ্ধ জয়ের পর মেক্সিকোকে টেক্সাস, অ্যারিজোনা আর নিউ জার্সি দিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করা হয়। এই ঘটনার পর উইলসনের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। তিনি কংগ্রেসে যুদ্ধে যাবার প্রস্তাব উত্থাপন করেন যা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। তবে তা কেবলই শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য, দেশ দখলের জন্য নয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশ সাফল্যের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন উড্রো উইলসন। আর আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে যুদ্ধের স্থায়িত্ব কমে আসে। যে যুদ্ধ দশকজুড়ে চলার আশংকা করা হচ্ছিল, তা ১৯১৮ সালেই শেষ হয়। তবে যুদ্ধের পরই দেশে নানা সমস্যার মুখোমুখী হন উইলসন। তার প্রধানটি ছিল সদ্য শেষ হওয়া যুদ্ধ নিয়েই। কংগ্রেসের একটা বড় অংশই ছিল শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পক্ষপাতী। যুদ্ধ চলাকালীনই দেয়া একটি ভাষণে উত্থাপন করা ১৪ দফা দাবি নিয়েই তিনি কাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। কিন্তু দেশীয় বাধার মুখে এ শর্তগুলো ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ‘প্যারিস পিস কনফারেন্সে’ অধিকাংশের অমত থাকা স্বত্বেও ব্যক্তিগতভাবে যোগ দিয়ে আরো বিতর্কের জন্ম দেন। প্রায় ৭ মাস আলোচনা-সমালোচনার পর ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তিতেও সই করেন। তার অনেক লক্ষ্যই এই চুক্তি পূরণ করতে পারতো না। তথাপি লিগ অফ নেশন্সের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় তিনি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেন।

প্যারিস শান্তি চুক্তির জন্য ফ্রান্সে উইলসন; Image Source: tes.com

ভার্সাই চুক্তি সংক্রান্ত দৌড়ঝাঁপে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, দুটোরই ক্ষতি করে ফেলেন উইলসন। চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশে ফিরে যে তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়েন, তা সামাল দেয়ার মতো মানসিক জোর তার অবশিষ্ট ছিল না। রিপাবলিকানরা দাবি করে, হয় এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, নয়তো চুক্তিতে থাকা লিগ অব নেশন্সে আমেরিকার অবদান কমিয়ে আনতে হবে। উইলসন রিপাবলিকানদের সাথে মাসাধিককাল বিতর্ক করেন নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে। তাতে ব্যর্থ হয়ে শুরু করেন জনসমর্থন আদায়ের প্রচারণা। মাত্র ৩ সপ্তাহের ব্যবধানে দেশ ঘুরে ৩৯টি বক্তৃতা দেন ভার্সাই চুক্তিতে কেন আমেরিকার থাকা প্রয়োজন তা বর্ণনা করে।

দিনটি ছিল সেপ্টেম্বর ২৮ যেদিন, ৩৯ তম ভাষণ দেয়ার সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন উইলসন। প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয় তার। ডাক্তাররা তার অবশিষ্ট দেশ ভ্রমণ বাতিল করে দেন। অবশ্য তাতে শারীরিক উন্নতি হলেও মানসিক উন্নতি হয়নি। দুই সপ্তাহের মাথায় বড় ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হন উইলসন। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শরীরের বামপাশ সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষতি না হলেও আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভারসাম্য হারান তিনি। প্রেসিডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার মতো দৃঢ়তা আর অবশিষ্ট ছিল না তার মাঝে। তার এই দুর্বলতা ঢাকবার অনেক চেষ্টাই করা হয়। ডাক্তারদের দিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় নিয়ম করে এটা বোঝাতে যে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। বাস্তবতা ছিল উল্টো। মূলত এই অসুস্থতার পর উইলসনের আর কোনোদিন পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠা হয়নি! তখন বড় সিদ্ধান্তগুলো হতো তার উপদেষ্টাদের দ্বারা।

ব্রিটেন, ফ্রান্স আর ইতালির রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে ভার্সাই চুক্তি নিয়ে আলাপ করছেন উড্রো উইলসন; Image Source: art.com

দুর্ভাগ্যক্রমে, সিনেটে উইলসনের ভার্সাই চুক্তি হেরে যায়। জনসমর্থনেও পিছিয়ে ছিল এটি। এদিকে ১৯২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উইলসনের এ ভরাডুবিকেই কাজে লাগায় রিপাবলিকানরা। তারা উইলসনের শান্তি চুক্তিতে যাওয়ার প্রচেষ্টার নাম দেয় ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ’ এবং জনগণকে সেটি পরিত্যাগ করে ‘জাতীয়তাবাদ’ গ্রহণ করার আহ্বান জানায়। তাতে বিশাল জয় পায় রিপাবলিকানরা। ফলে ভেস্তে যায় উইলসনের লিগ অব নেশন্সের স্বপ্ন। আমেরিকা ভার্সাই চুক্তির লিগ অব নেশন্স সংক্রান্ত অংশটি থেকে বেরিয়ে আসে এবং জার্মানির সাথে আলাদাভাবে শান্তিচুক্তি করে, যা অনেকের মতেই ছিল অবিবেচক এবং অদূরদর্শী। লিগ অব নেশন্সসের স্বপ্নদ্রষ্টা একজন আমেরিকান হওয়া সত্বেও আমেরিকায় ছিল না এই সংঘে। উইলসন হতাশ হয়ে বলেছিলেন, আমেরিকার এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা উপলব্ধি করেছিল একজন উইলসনের দূরদর্শীতা ও প্রজ্ঞা।

উড্রো উইলসন (১৮৫৬-১৯২৪ সাল); Image Source: history.com

জীবনের শেষ সময়গুলো রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন উড্রো উইলসন। এই রাজনীতি বিমুখতা যতটা হতাশাপ্রসূত, তার চেয়ে বেশি অভিমানের কারণে। ওয়াশিংটনে যখন জীবন সায়াহ্নে থাকা অভিমানী এই রাজনীতিক পৃথিবী ত্যাগ করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তার বর্ণাঢ্য এবং সাফল্যমণ্ডিত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মুণ্ডুপাত করেই চলেছিল রিপাবলিকানরা। দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন জনগণও তাকে ততদিনে প্রত্যাখ্যান করেছে। একসময় সাফল্য আর জনপ্রিয়তার হিমালয়ে আরোহণ করা উইলসন ১৯২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন ব্রাত্য হয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন জনগণ তো বটেই, পুরো বিশ্ব সেই রিপাবলিকান প্রশাসনের বংশোদ্ধার করেছিল। উইলসনকে তখন তারা ‘আনহিডেড প্রফেট’ বা অনাদৃত ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে অভিহিত করে, যার কথা শুনলে পৃথিবী এত বড় ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়তো হতো না। উইলসন যদি তখন বেঁচে থাকতেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হতো বলতে পারেন?

This article is written in Bangla language. It's about the famous American president Woodrow Wilsons life and political career.
All necessary references are hyperlinked inside the article.

 

Featured Image: politico.com

Related Articles