নাসিরুদ্দিন শাহ, মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা থেকে আলাদা ধরনের সিনেমাতে অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া বলিউডের এক নক্ষত্র। সেই ‘আক্রোশ’ বা ‘মাসুম’ সিনেমাগুলোতে অভিনয় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আলাদা আলাদা ধরনের সিনেমাতে বৈচিত্রময় চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজের প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন তিনি, কাজ করেছেন ‘লিগ অব দ্য এক্সট্রাঅরডিনারি জেন্টেলম্যান’ এর মতো হলিউডের সিনেমাতে ক্যাপ্টেন নিমোর মতো চরিত্রে। পাকিস্তানি সিনেমা জগতে কাজ করেও মুগ্ধ করেছেন সেখানকার দর্শকদের। তার প্রথম পাকিস্তানি সিনেমা ‘খুদা কি লিয়ে’-তে অতিথি তারকা হিসেবে অল্প সময়ের অভিনয়ের দারুণ প্রশংসা আর গ্রহণযোগ্যতার পর তার অভিনীত দ্বিতীয় পাকিস্তানি সিনেমা ‘জিন্দা ভাগ’ ভারতের ৮৬ তম একাডেমি এওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার সিনেমা বিভাগে পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। তার সময়ের তরুণদের থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের তরুণদের মধ্যেও নিজের অভিনয়ের স্বীকৃতি অর্জন করে চলা বলিউডের এই পরিচিত মুখ পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ (২০০৩), পদ্মশ্রী সহ চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরো তিনটি জাতীয় পুরষ্কার, তিনটি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার ও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মাননা পুরষ্কার। এত প্রতিষ্ঠা আর প্রতিভা সত্ত্বেও তার জীবন খুব সরলভাবে কাটেনি, তারও জীবনের বাঁকে বাঁকে সিনেমার মতোই অনেক গল্প জমা আছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
টেলিভিশনের পর্দায় যে মানুষগুলো আমাদের এত পরিচিত, সেই মানুষগুলোর সত্যিকার জীবনের গল্প কতটুকু জানি আমরা? নায়ক হিসেবে যার জয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত হই কিংবা যে খলনায়কের পরাজয়ে স্বস্তি পাই, সেই মানুষগুলো পর্দার পিছনে কেমন, কেমন তাদের জীবনের ওঠানামা- তা আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের জানার বাইরেই থেকে যায় বেশিরভাগ সময়ে। প্রিয় অভিনেতা সম্পর্কে যখন একটু একটু করে খোঁজ করি আমরা, কেবল তখনি জানতে পারি তার নিজের জীবন সম্পর্কে কিছুটা। ভারতের নাট্যমঞ্চের ও চলচ্চিত্রের বড় পর্দার এই উজ্জ্বল তারকার ঘটনাবহুল জীবনের মোড়গুলো ঘুরে আসা যাক আজ।
তার জীবনও তার সিনেমাগুলোর মতো অসাধারণ আর বৈচিত্র্যময়। পারিবারিক জীবনে বাবার সাথে তার বেশ দূরত্ব ছিল আর সেই কথা তার আত্মজীবনী থেকেই জানা যায়। অন্যান্য বেশিরভাগ বাবা-মাদের মতো তার বাবাও মেনে নিতে চাননি লেখাপড়ার প্রতি তার অনাগ্রহ এবং খারাপ প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল। তিনি চেয়েছিলেন পড়াশোনা করে নাসির কিছু করুক, জীবনে বড় কিছু হোক। তাদের মধ্যকার সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে যখন নাসির প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর সামনে এগিয়ে নিয়ে না গিয়ে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির নাট্যমঞ্চের সাথে জড়িয়ে যান। কিন্তু অভিনেতা নিজেই উল্লেখ করেছেন, তার পিতা বকাবকি করা ছাড়া কোনদিন তার ওপর একটা আঙ্গুলও তোলেননি। তাছাড়া আত্মজীবনীতে তিনি স্বীকার করেন, নিজের সন্তানদের মাধ্যমেই তিনি এখন তার বাবার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারেন।
তার ঘটনাবহুল জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় পর্ব শুরু হয় যখন ১৯-২০ বছরের নাসির পরিবারের সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ৩৬ বছরের মানারা শিকরিকে বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী মানারা শিকরি পারভিন মুরাদ নামেও বেশ পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন তালাকপ্রাপ্তা মহিলা এবং প্রথম স্বামীর ঘরে তার একাধিক সন্তান ছিল। নাসির ও পারভিনের বিয়ের এক বছরেরে মধ্যেই তাদের ঘর আলো করে আসে এই দম্পতির একমাত্র সন্তান, তাদের কন্যা হিবা শাহ। কন্যার জন্মের এক বছরের মধ্যেই ঘর ভেঙ্গে যায় পারভিন-নাসির দম্পতির। কিন্তু আগের বিয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে পারভিন যে পরিমাণ মোহর নাসিরের সাথে বিয়ের সময় নির্ধারণ করেছিলেন তা পূরণ করে জীবন নতুন করে শুরু করতে অভিনেতা নাসিরের ১২ বছরের বেশি সময় লেগে যায়। তারুণ্যের লাগামছাড়া আবেগ বেশ ভালোই ভুগিয়েছিলো অভিনেতাকে। আর তালাকের সাথে সাথে এক বছরের কন্যার সাথে যোগাযোগের সকল রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়, পরে হিবা যখন প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে নিজে থেকে দেখা করতে আসে কেবল তখনই বাবা-মেয়ের পুনর্মিলন সম্ভব হয়। মানুষের জীবনও সত্যিই সিনেমার গল্পের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
নাসির ভারতের উত্তর প্রদেশে আলি মোহাম্মদ শাহ ও তার স্ত্রীর সংসারে তিন ছেলের একজন হয়ে পৃথিবীতে আসেন। তিনি ১৯ শতকের আফগান সেনাপতি জান ফিশান খান বা সায়্যিদ মোহাম্মদ শাহের উত্তরসূরি। সায়্যিদ মোহাম্মদ শাহ আফগানদের সাথে ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পরে ভারতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজদের সাহায্য করেন। স্কুল-কলেজ শেষ করার পর আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭১ সালে মানবিক বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরে তিনি দিল্লিতে জাতীয় নাট্য স্কুলে ভর্তি হন। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তরুণ নাসির একই ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নরত ৩৪ বছরের পারভিনের প্রেমে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। নাসির তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, “পারভিনের উপস্থিতি তার জীবনের দিক নির্দেশনে ও লক্ষ্য নির্ধারণে দারুণভাবে অবদান রাখে”। ১৯৬৯ সালের ১লালা নভেম্বর তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু নাসিরের দিল্লিতে নাট্যস্কুলে ভর্তির সাথে সাথে তাদের সম্পর্কেও ফাটল দেখা দেয়। নাসির তার এই সম্পর্ক ভাঙ্গার পিছনে নিজের অনিরাপত্তা আর খারাপ মানসিক অবস্থাকেও অনেকটা দায়ী করেন। নিজের কন্যা সন্তানের প্রতিও নাসির তার প্রথম জীবনে যথেষ্ট ঔদাসিন্য দেখান। নিজের আত্মজীবনীতে সেই ভুলের কথা স্বীকার করে নাসির বলেন যে, ওই সময় তরুণ নাসির চলচ্চিত্রের জমকালো জীবনের সামনে বিয়ে ও পিতৃত্বকে বাধা হিসাবে দেখতে শুরু করে, এর ফলাফল হিসেবে ১২ বছর তিনি তার কন্যার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।
পারভিনের সাথে সম্পর্কে যখন ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠেছিলো, তখন ১৯৭০ সালে নাসির স্বনামধন্য অভিনেত্রী ডিনা পাঠকের মেয়ে রত্না পাঠকের প্রেমে মজেন। একদিন রাস্তার পাশের জুসের দোকানে দাঁড়িয়ে কিংবদন্তীতুল্য পরিচালক সত্যাদেব দুবের সাথে তার এক মঞ্চনাটকের ব্যাপারে কথা বলছিলেন, সেখানেই তিনি রত্নাকে দেখে মুগ্ধ হন। রত্নাও ওই একই নাটকে অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি আর রত্না পাঠক আরো অনেকগুলো সিনেমাতে একসাথে অভিনয় করেন, যার মধ্যে আছে ‘জানে তু… ইয়া জানে না’, ‘মিরচ মাসালা’, ‘দ্য পারফেক্ট মার্ডার’ প্রভৃতি। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি রত্না পাঠককে তার জীবনের সত্যিকারের প্রেম বলে আখ্যা দেন। দীর্ঘ অনেকগুলো বছর রত্নার সাথে একসাথে থাকার পর যখন শাহ তার প্রথম স্ত্রীর মোহরের পুরো টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হন, তখন ১৯৮২ সালে নাসির ও রত্না বিয়ের পিড়িতে বসেন। এই দম্পতি এখন তাদের দুই ছেলে ইমাদ শাহ ও ভিভান শাহ এবং নাসির ও পারভিন দম্পতির মেয়ে হিবার সাথে বোম্বেতে থাকেন।
নাসিরুদ্দিন শাহের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে আছে আক্রোশ, নিশান্ত, মিরচ মাসালা, স্পার্শ, ত্রিকাল, আলবার্ট পিন্টোকো গুসসা কিউ আতা হ্যায়, ডার্টি পিকচার, ইশকিয়া ও আরো অনেক। ‘সারফারোশ’ ও ‘ওয়েডনেস ডে’র মতো সিনেমাগুলোতে তার অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসা পায়। এছাড়া ছোটপর্দায় ও মঞ্চ নাটকে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার মঞ্চনাটকের দল ‘মোটলে প্রোডাকশনস’ তাদের প্রথম নাটক স্যামুয়েল ব্যকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডোট’ এর মাধ্যমেই এই ক্ষেত্রে প্রশংসা কুড়ানো শুরু করে। অভিনয় তার কাছে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকেছে সব সময়। প্রতিভাহীন তারকাদের জমকালো জীবনের ব্যাপারে তিনি বলেছেন– “প্রবাদ আছে, তারারা ক্ষণজন্মা আর তা সত্যিও। দিনের আলোতে তারা সহজেই হারিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত অভিনেতা হচ্ছে গাছের মতো, দিন ও রাত- সবসময়ই সে সগৌরবে বজায় থাকে।” অভিনয়ের প্রতি তার এই নিবেদন তার ঝুলিতে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সিনেমা ও টেলিভিশন ক্লাবের অধীনে থাকা এশিয়ান সিনেমা ও টেলিভিশন একাডেমিতে আজীবন সদস্যপদসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কার, স্বীকৃতি ও সম্মাননা।
ব্যক্তিজীবনে তিনি খুবই স্পষ্টভাষী। তার উদ্বেগহীন স্পষ্টবাদিতার উদাহরণ আমরা পাই যখন অভিনেতা নিজেই তার মারিজুয়ানা গ্রহণের কথা স্বীকার করে বলেন, “আমি এটাতে অন্যদের উৎসাহ দেব না, কিন্তু এটা গ্রহণ আমাকে নিজের ভাবনা আর লক্ষ্য আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে।” নিজের অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি এটাও বলেন যে, তিনি নিজেকে সচরাচর সিনেমাগুলোর নায়কদের মতো পর্দায় নাচতে, গাইতে এবং খারাপ লোকদের সাথে মারামারি করতে দেখতে চান, কিন্তু তিনি এও জানেন যে তাকে তা মানায় না।
স্পষ্টভাষী এই অভিনেতা প্রায় ১০ বছর ধরে তার জীবনের তিক্ততা আর মাধুর্য নিজের ১০০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীতে সাজিয়ে ২০১৪ সালে “And Then One day” নামে সকলের সামনে তুলে ধরেন।