Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জন স্টুয়ার্ট মিল: সামষ্টিক মঙ্গলই যার দর্শনের মূলকথা

“রক্ষণশীলতা সর্বদা বোকামি নয়, বরং অধিকাংশ বোকা মানুষই রক্ষণশীল।”- জন স্টুয়ার্ট মিল

জন স্টুয়ার্ট মিল একাধারে একজন দার্শনিক, লেখক, অর্থনীতিবিদ এবং নৈতিকতা ও রাজনীতি বিষয়ক তাত্ত্বিক। উনিশ শতকে ইংরেজি ভাষার দার্শনিকদের মধ্যে তার মতো প্রভাব কারোরই ছিল না। তার বই এবং প্রবন্ধগুলোতে যুক্তিশাস্ত্র থেকে শুরু করে অর্থনীতি, জ্ঞানতত্ত্ব, ধর্ম, সমাজ, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক দর্শন- সবই ছিল। ‘অ্যা সিস্টেম অব লজিক’, ‘অন লিবার্টি’ এবং ‘ইউটিলিটারিয়ানিজম’ বা উপযোগবাদ হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ কাজ, যেগুলো তাকে তার সময়কার তো বটেই, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও একজন প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে।

জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ); source: Bio.com

হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটিকে কে না ভালোবাসে? এই হিমুর বাবার পাগলামির কথাও আমাদের সকলেরই জানা। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে হিমুকে মহামানব হিসেবে গড়ে তুলবেন। মহামানব কি ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা যায়? আপনি না জেনে থাকলে জেনে নিন, মহামানব তৈরি করা যায়! জন স্টুয়ার্ট মিলই তার উদাহরণ। আপনি তাকে মহামানব মনে করবেন না? কোনো সমস্যা নেই, অন্তত এতটুকু জেনে রাখুন তার দার্শনিক হয়ে ওঠা হচ্ছে তার বাবারই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা! ১৮০৬ সালের ২০ মে যেদিন মিল জন্ম নেন, সেদিনই তার বাবা জেমস মিল ঠিক করে ফেলেন যে তিনি তার ছেলেকে একজন বিখ্যাত দার্শনিক আর চিন্তাবিদ রূপে গড়ে তুলবেন। জেমস নিজেও ছিলেন একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ তার বিখ্যাত লেখা।

জন স্টুয়ার্ট মিলের জন্মের পরপরই অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছলতার মুখ দেখেন জেমস। তখন তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আরেক বিখ্যাত দার্শনিক জেরেমি বেন্থামের সাথে। বেন্থাম জেমসের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। এই দুজন মিলে ব্রিটেনে ‘ফিলসফিক রেডিক্যাল’ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ব্রিটিশদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই আন্দোলন করার পেছনে জেমসের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই যে তার ছেলে এই অন্দোলন দেখতে দেখতে বড় হবে এবং গোঁড়া চিন্তা বাদ দিয়ে ‘রেডিক্যাল’ চিন্তা-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হবে। উপরন্তু, জেমস এবং বেন্থাম উভয়েই এই রেডিক্যাল আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে মিলের কথাই ঠিক করে রেখেছিলেন।

জেমস মিলের বইয়ের প্রচ্ছদ; source: World Digital Library

মাত্র ৩ বছর বয়সেই জন স্টুয়ার্ট মিলের পড়ালেখার জীবনের হাতেখড়ি হয়। যখন তার বয়স ৮ বছর, তখন তিনি গ্রীক আর ল্যাটিন ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এরপরই পড়ে ফেলেন নিউটনের ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞান। একইসাথে পড়তে থাকেন যুক্তিশাস্ত্র, দর্শন, গ্রীক এবং রোমান ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি ইত্যাদি। গণিত আর মেটাফিজিক্সেও মিল ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু এতকিছু একসাথে পড়তে গিয়ে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি তা কিন্তু নয়। নিজের আত্মজীবনীতে মিল এই সময়কালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন যে, “এটি ছিল মানসিক বিপর্যয়ের একটি সময়!” এই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি কৈশোর পেরোনোর পরই সেকুলারিস্ট দর্শন আর জটিল সব সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়াবলী পড়া বন্ধ করে প্রেম বিষয়ক উপন্যাসে ডুব দিলেন। কিন্তু বেশিদিন ডুবে থাকেননি মিল। দ্রুতই ফিরে এলেন দর্শনে আর পড়তে শুরু করলেন কার্লাই, অগাস্ট ক্যোঁৎ, জন রাস্কিন, টকেভিল, হার্বারট স্পেন্সার, জন স্টার্লিং আর এম. গুস্তাভদের লেখা।

১৮৩৬ সালে মিলের বাবা জেমসের মৃত্যু হয়। ততদিনে তিনি সফল হয়ে গেছেন। মিল ততদিনে একজন পরিপক্ক চিন্তাবিদ যিনি দর্শন নিয়ে কাজ করতে উৎসুক। মিল তার বাবা এবং বেন্থামের শুরু করে যাওয়া ‘ফিলসফিক রেডিকালিজম’-কে নতুনভাবে উপস্থাপন করা শুরু করেন। তিনি জেমস আর বেন্থামের প্রতিষ্ঠিত ওয়েস্টমিনিস্টার রিভিউয়ের পরিবর্তে লন্ডন রিভিউ চালু করেন। তার এই কাজে তাকে সহায়তা করেন তার বান্ধবী হ্যারিয়েট টেইলর। দ্রুতই মিল টেইলরের প্রেমে পড়েন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মিলের মনোভাব টেইলর বুঝতে পারেননি। ১৮৩২ সালে টেইলর বিয়ে করে ফেললে কিছুদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন মিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা বোঝা দায়, বিয়ের পর মিলের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন টেইলর! শুরু হয় মিল আর টেইলরের অবৈধ গোপন সম্পর্ক যা পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে যায় এবং ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। অবশেষে দীর্ঘদিনের পরকীয়ার সম্পর্ক প্রকাশ হলে ১৮৫১ সালে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান টেইলর। সে বছরই বিয়ে করেন মিলকে। কিন্তু এরপর যা হলো তা আর কোনোভাবেই ক্ষতিপূরণযোগ্য ছিল না। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় মারা যান টেইলর। টেইলরের মৃত্যুতে বিবশ হয়ে পড়েন মিল।

জন স্টুয়ার্ট মিল ও তার সৎকন্যা হেলেন টেইলর; source: alamy.com

বাবার মতো মিলও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করতেন। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি সেখান থেকে অবসর নেন। তবে অবসরের পরে তিনি কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নেন। প্রথমত, তিনি ব্রিটেনে ১৮৬৬ সালের শ্রম অধিকার আইন রদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগ দেন। দ্বিতীয়ত, জ্যামাইকাতে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে ‘জ্যামাইকা কমিটি’তে যোগ দেন। তৃতীয়ত, ১৮৬৭ সালের রিফর্ম বিল সংশোধনের চেষ্টা করেন এবং ‘ম্যান’ শব্দটির স্থলে ‘পারসন’ ব্যবহার করার প্রস্তাব দেন যেন নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য না হয়। তবে এসবের কোনোটিই খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। মনঃক্ষুণ্ণ মিল ১৮৭০ এর দিকে ফ্রান্সে চলে যান এবং সেখানে টেইলরের কন্যা হেলেন টেইলরের সাথে নিভৃত জীবন যাবন করতে শুরু করেন। ১৮৭৩ সালের ৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হেলেনের কাছে বলে যান-

“তুমি জানো যে আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।”

মিলের কাজের ক্ষেত্র অত্যন্ত প্রশস্ত ও বৈচিত্র্যময়। তিনি অসংখ্য বিষয়ে লিখেছেন। তবে তার সব লেখাই শেষতক তার নতুন ‘ফিলসফিক রেডিকালিজম’কে সমর্থন করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, নৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন করে। তাই তার প্রধান কয়েকটি কাজ নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট। সেক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসবে ‘সিস্টেম অব লজিক’ এর কথা।

দর্শনের চিন্তা-ভাবনার দুয়ার সকল দিকে উন্মুক্ত করলেও মিলস নিজে কেবল একটি দরজাই খোলা রেখেছিলেন, সেটা হচ্ছে  ‘ন্যাচারাল সায়েন্স’। ন্যাচারাল সায়েন্স বলতে সকল ভৌত বিজ্ঞানকেই বোঝায় যা আমাদের পরিপার্শ্বকে ব্যাখ্যা করে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান কিংবা ভূগোল, সবই ন্যাচারাল সায়েন্সের অন্তর্গত। মিলের মতে সকল জ্ঞানের উৎসই হচ্ছে এই ন্যাচারাল সায়েন্স। প্রকৃতির সবকিছুর সাথেই মানুষের মানবিক কার্যাবলীর যোগসূত্র খুঁজে বেড়িয়েছেন মিল। অন্যদিকে ‘ইনটিউশনিজম’কেও অস্বীকার করেছেন তিনি। তার মতে সকল জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা কিংবা আলোচনা, যেগুলোর উৎস আমরা ভুলে যাই সেগুলোকেই আমরা ইনটিউশন বা স্বজ্ঞা বলে চালিয়ে দেই। সবকিছুই আদতে প্রকৃতির কোনকিছু থেকেই আসে। তার বিতর্কের একটা বড় অংশ জুড়ে তিনি মানুষের ইনটিউশন বা স্বজ্ঞার উৎস খুঁজেছেন। এজন্য অনেকে তাকে ‘অ্যান্টি প্রায়োরিস্ট’ও বলে যিনি কিনা প্রায়োরিজমের ঠিক বিপরীত মেরুতে গিয়ে কাজ করেছেন। ইনটিউশনিজম আর প্রায়োরিজমের সমালচনা মিল চালিয়ে যান আমৃত্যু। তার লেখা ‘অ্যান এক্সামিনেশন অন স্যার উইলিয়াম হ্যামিল্টনস ফিলসফি’ আক্ষরিক অর্থে ইনটিউশনিজমেরই সমালোচনা।

স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগিতাবাদ; source: amazon.co.uk

১৮৬১ সালে ফ্রেজারস ম্যাগাজিনে মিলের ‘ইউটিলিটারিয়ানিজম’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৮৬৩ সালে এটি পুস্তক আকারে বের হয়। ইনটিউশনিস্ট আর প্রায়োরিস্টদের সাথে তার যে কলম যুদ্ধ চলছিল, ইউটিলিটারিয়ানিজম প্রকাশের পর তিনি অনেকটাই এগিয়ে যান। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে এই যে সর্বোত্তম কাজ সেটিই যা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকারে আসে। অবশ্য মিলকে ইউটিলিটারিয়ানিজমের স্রষ্টা ভাবলে ভুল করবেন। এই তত্ত্ব চলে আসছে তারও বহু আগের সময় থেকে। জন লক আর থমাস হবসরাও এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন, তবে খুব গভীরে গিয়ে নয়। এই তত্ত্ব মূলত এর আনুষ্ঠানিক অবকাঠামো পায় জেরেমি বেন্থামের হাত ধরে এবং জন স্টুয়ার্ট মিল পরে সেটা পূর্ণ করেন। ইউটিলিটি বা উপযোগিতার প্রথম দিককার সমর্থক ছিলেন ধর্মীয় তাত্ত্বিকগণ যারা বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়াবলীকে উপযোগিতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতেন। এর কাছাকাছি সময়ে ধার্মিকদের বিপরীতে সেকুলার মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করেন সেকুলারিস্ট ইউটিলিটারিয়ানরা। সেকুলার ইউটিলিটারিয়ানিজমের নতুন সংস্করণই বলা চলে জেরেমি বেন্থামের রাডিকালিজমকে। যেখানে বেন্থাম তার কাজ শেষ করেন, সেখান থেকেই মিল শুরু করেন।

ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগিতাবাদের ব্যাখ্যায় মিল মোট পাঁচটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে মিল মূলত ইনটিউশনালিজম আর ইউটিলিটারিয়ানিজমের মধ্যে তফাৎ স্পষ্ট করেছেন।

এ ব্যাপারে উপরে আলোচনা করা হয়েছে। তাই আমরা এখন দ্বিতীয় অধ্যায়ে চলে যাবো। এই অধ্যায়ে মিল উপযোগিতাবাদের মূলনীতির ব্যাপারে প্রচলিত কিছু ধারণার খণ্ডন করেন। যেমন, অনেকেই বলে থাকেন যে উপযোগিতাবাদ পরোক্ষভাবে ‘ইপিকিউরিয়ানিজম’ বা ইন্দ্রিয় ভোগবাদকেই সমর্থন করে। ফলে এই তত্ত্ব কেবল শূকরের জীবনের সাথেই যায় যেখানে সুখ ছাড়া আর কোনো প্রত্যাশা নেই। মিল এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে প্রশ্ন করেন, যদি তাই হয় তাহলে শূকর যেসব বিষয়ে (যৌনতা, খাদ্য) সুখ ভোগ করে সেসব বিষয় ছাড়া অন্যদিকে যাবার কি ক্ষমতা নেই মানুষের? উপযোগিতাবাদের বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ হচ্ছে এই তত্ত্ব এমন প্রণোদনা দেয় যে মানুষ সর্বদাই সামাজিক মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। মিল এখানে বলেন, উপযোগিতাবাদ কোনো কিছু করতে বলে না বরং করার ধরণ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে কথা বলে। কোনো মানুষ যদি নিজের ভালোর জন্যও কিছু করে তবে তার সেই কাজ চূড়ান্তভাবে সমাজের ভালো করবে। কেননা সে ব্যক্তিটি সমাজেরই একজন সদস্য। তবে এই কাজ ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতি করছে।

তৃতীয় অধ্যায়ে মিলস মূলত ইউটিলিটারিয়ানিজমের প্রয়োজনীয়তাই নানা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন উপযোগিতাবাদের নৈতিক দিক নিয়ে। সবশেষে পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি এনেছেন ন্যায়বিচারের ব্যাপারটি। এক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসে কর্তব্যের কথা। কর্তব্য হচ্ছে তা যা না করলে সমাজ আমাকে শাস্তি দেবার অধিকার রাখে। অন্যদিকে ন্যায়বিচার শুধু কর্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যায়বিচার যেমন সীমানা নির্ধারণ করে সমাজের সদস্যরা কোন কাজগুলো করতে পারবে আর কোন কাজগুলো করতে পারবে না, তেমনি নিশ্চিত করে সদস্যদের ব্যক্তিগত অধিকার। আমার নৈতিকতা বলে আমার প্রয়োজনের অধিক অর্থ থাকলে অবশ্যই গরীবদেরকে দান করতে হবে। এটা আমার নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু এক্ষেত্রে এই কর্তব্য পালন না করলে আমাকে কেউ বাধ্য করতে পারবে না। এটিই হচ্ছে কর্তব্য আর নৈতিকতার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু ন্যায়বিচার ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়। আমার প্রয়োজনের অধিক অর্থ আমি যখন একজন অভাবীকে দান করবো তখনই ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। উপযোগিতাবাদ ন্যায়বিচারেরই প্রবক্তা।

source: Secret Life of a Reader

“যে একমাত্র উদ্দেশ্যে কোনো সভ্য সমাজের সদস্যের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ বৈধতা পাবে তা হচ্ছে সমাজের অন্যান্য সদস্যদেরকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা।”- জন স্টুয়ার্ট মিল

১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় মিলের অন্যতম সেরা কাজ ‘অন লিবার্টি’। এই বইয়ে মিল আলোচনা করেছেন ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্বাধীনতা নিয়ে। তিনি শুরু করেছেন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা শাসক আর শাসিতের মধ্যে দ্বন্দ্বের আলোচনা দিয়ে যা আবার আধুনিককালে গণতন্ত্র হয়ে ‘টিরেনি অব দ্য মেজোরিটি’ তে রূপ নিয়েছে। সংখ্যাধিক্যের অত্যাচার তখন ঘটে যখন তারা প্রত্যেকে নিজেদের মনোভাবকে নিজের সমরূপ চেতানাধারী মানুষের মনোভাবের সাথে তুলনা করে ন্যায্যতা প্রদান করে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র অনেক সময় মানুষের স্বাধীনতার পরিপন্থী হয়ে ওঠে। মানুষের স্বাধীনতা অবাধ কিন্তু সীমাবদ্ধ। স্বাধীনতার অসীমত্ব হচ্ছে এরূপ যে একজন ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছার অধীন এবং তিনি ততক্ষণ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারবেন যতক্ষণ না অন্য কারো স্বাধীনতাকে বাঁধা দিচ্ছেন।

“মানুষের সহজাত প্রকৃতি কোনো নির্দিষ্ট নীতি নিয়ম মেনে চলে না। একটি গাছ যেমন ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, মানুষের মধ্যেও তেমনি ক্রমাগত প্রচেষ্টায় তার সহজাত স্বার্থান্বেষী ইচ্ছার বিপরীত মনোভাব গড়ে তোলা সম্ভব।”- জন স্টুয়ার্ট মিল

১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রিন্সিপ্যাল অব দ্য পলিটিকাল ইকোনমি’ বইটি। ১৯ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত এই বইটি ছিল ব্রিটিশদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধান পাঠ্য। তিনি সভ্যতার আধুনিকায়ন কীভাবে শিল্পায়ন আর অসাম্প্রদায়িকতার সূচনা করেছে তা বিশ্লেষণ করেন। আবার এই আধুনিকায়ন নানাভাবে মানুষের নৈতিক দিকগুলোর উপরেও প্রভাব ফেলছে। শিল্পায়নের প্রভাবে মানুষের কর্মক্ষেত্র দিন দিন প্রতিযোগিতামূলক থেকে বৈরিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই বৈরিতার সমাধান হচ্ছে শ্রম সংক্রান্ত সহযোগিতা। অনেক সমাজবিজ্ঞানী কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাকে একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করলেও মিল বলেছেন বিপরীত কথা। এই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতাই মানুষের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখানে প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতা দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে বলেছেন মিল। তিনি দুটি নির্দিষ্ট সমাধানও দেখিয়েছেন। প্রথমত, কোনো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন সে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের অনুপাতে ঠিক করতে হবে। তাহলে শ্রমিকগণ ন্যায্য বেতন পাবে এবং কাজ করতেও উৎসাহী হবে। দ্বিতীয়ত, সকল শ্রমিকই হবে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের মূলধনে সকলেরই অংশীদারিত্ব থাকবে। ফলে একটি সর্বসম পরিবেশের উদ্ভব ঘটবে।

source: Secret Life of a Reader

পলিটিকাল ইকোনমি আলোচনা করতে গিয়ে মিল ধর্মীয় অর্থনীতির ব্যাপারটিও বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি রচনা করেন ‘থ্রি অ্যাসে অন রিলিজিয়ন’। তিনি প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের সমালোচনা করে ‘মানব ধর্ম’ কে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে প্রচার করেন। তিনি প্রচলিত ‘ক্রিশ্চিয়ানিটি’ বা খ্রিস্টবাদকে ভ্রান্ত, মানুষের সুখভোগের শত্রু এবং কুসংস্কারপূর্ণ বলে আক্রমণ করেন। তবে তার মতে ধর্ম মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা বোধকে জাগ্রত করতে সহায়তা করে এবং মানুষকে নিষ্কলুষ জীবনযাপন করতে সহায়তা করে। ধর্মকে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা না হলে ধর্ম সমাজে শান্তির প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। তিনি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই মনে করতেন, তথাপি মহাবিশ্বের জটিল গঠণের একজন ‘ডিজাইনার’ তথা সৃষ্টিকর্তা রয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। ধর্মকে পুঁজি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার প্রচেষ্টাকে তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।

শেষ করার আগে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। জন স্টুয়ার্ট মিলের দর্শন তার সমসাময়িক পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি মানুষের মনোভাব পরিবর্তনে জ্ঞান আর দর্শনের প্রয়োজনীয়তা, সংরক্ষণশীলতার বদলে যুক্তিবাদের প্রয়োজনীয়তা, রাজনীতিতে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা মানুষের কাছে স্পষ্ট করে গেছেন। তার দর্শন তার সময়ের সাপেক্ষে রচিত হলেও তা আজ অবধি প্রাসঙ্গিক। সব মিলিয়ে জন স্টুয়ার্ট মিল দর্শনকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়।

ফিচার ছবিঃ BBC

Related Articles