“অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা। এটাই নিয়ম।”
– ইবনে রুশদ
অষ্টম শতক পর্যন্ত আরবে গ্রীক দর্শনকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। দর্শন ধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ বলেই ভাবা হতো। তবে মুতাজিলা (যারা দর্শনকে ধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ ভাবতো না) ধর্মতত্ত্বের প্রবর্তনে গ্রীক দর্শন কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পায়। কিন্তু ইমাম আবু আল হাসান আল আশ’আরী প্রবর্তিত ‘আশ’আরী’ তত্ত্ব নতুন করে দর্শন বিরোধিতা শুরু করে এবং সবধরনের যুক্তি-তর্ক আর প্রশ্ন করার ব্যাপারটিকে তারা ‘অবিশ্বাস’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। ইবনে রুশদ এমনই এক প্রতিকূল পরিবেশে নিজের দর্শন রচনা করে গেছেন। তিনি অবশ্যই কুরআনকে সত্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন যে কুরআনের অনেক কিছুই গভীর অর্থবহ, যা বুঝতে হলে দর্শনের প্রয়োজন। তিনি যে রাজবংশের হয়ে রাজনীতি করেছেন, সে বংশের উদার পৃষ্ঠপোষকতাই তাকে তার দর্শন নিয়ে এগোতে সহায়তা করেছে। তবে ক্রমশ বাড়তে থাকা উদারবাদী দর্শন বিরোধী আন্দোলনের মুখে তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে নির্বাসনের পূর্বেই রুশদ তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘ডিসিসিভ ট্রিটিজ’ রচনা করে ফেলেছিলেন।
“যারা চিন্তা ও গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে।”- সূরা আল ইমরা; আয়াত-১৯১
“অতএব, চক্ষুষ্মানরা শিক্ষা গ্রহণ করো।”- সূরা আল হাশর; আয়াত- ২
ইবনে রুশদ তার ডিসিসিভ ট্রিটিজে দর্শন কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে আলোচনা শুরু করেছেন পবিত্র কুরআন থেকে উপরোক্ত দুটি আয়াত দিয়ে। তার মতে, দার্শনিক আর আইনজীবীরা একই পন্থা অবলম্বন করে। আইনজীবীরা নির্দিষ্ট কিছু ধারা পূর্বেই শিখে রাখেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করেন। তেমনিভাবে দার্শনিকদের সৃষ্টি ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক দর্শন মূলত ধর্ম থেকেই আসে। ধর্মগ্রন্থই মানুষকে চিন্তা করতে বলে এবং সে চিন্তার সীমাও ঠিক করে দেয়। অন্যদিকে জ্ঞানের বিস্তৃতির চিরাচরিত প্রথাই হচ্ছে এই যে, একজন পণ্ডিতের জ্ঞানচর্চা থেকেই তার পরবর্তী প্রজন্ম সত্য মিথ্যার আলোকে, জ্ঞান আহরণ, পরিবর্ধন এবং বর্জন করবে। যদি কারো দর্শন সত্য হয়, তাহলে তার ধর্ম ভিন্ন হলেও সে দর্শন গ্রহণ করা উচিৎ। ঠিক যেমনি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে গেলে যেসব দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তা সর্বদা স্বীয় ধর্মের লোকদের দ্বারা তৈরি না-ও হতে পারে। তাই দর্শন আর ধর্ম কখনোই সাংঘর্ষিক নয়।
সবাই দর্শন থেকে সত্য খুঁজে পাবে না, এটিই স্বাভাবিক। রুশদের মতে, ধর্মগ্রন্থকে তিনভাবে বিশ্লেষণ করে তা থেকে দর্শন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রতিপাদন, ন্যায়শাস্ত্রে যাচাই এবং অলংকারশাস্ত্র। আর এই তিন উপায়ে ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা করে মানবজাতি তিন শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণী দার্শনিকদের। দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকে ধর্মতাত্ত্বিকরা। আর সবশেষে সাধারণ মানুষের অবস্থান। রুশদ ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আন্তরিক মুসলিম। তাই কুরআনকেই শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ বলে ঘোষণা দেন তিনি। তার মতে, প্রতিপাদক পদ্ধতিতে সত্য যাচাই করতে গেলে শেষতক কুরআনের কাছেই পৌঁছুতে হবে। কারণ কুরআনে প্রকৃতির সত্য উদঘাটন করা হয়েছে। আর যদি কোনোকিছুর প্রতিপাদন কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তবে সেটা কেবলই সাময়িক একটি ব্যাপার। ভবিষ্যতে তার সমাধানও অনিবার্য। আবার কোনো ক্ষেত্রে যদি ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ উভয়েই কোনো বিষয়ের অস্তিত্বে বিরোধ প্রকাশ করে, তবে সেক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থকে রূপকার্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। আর রূপক শুধু দার্শনিকরা ব্যবহার করেন না, ধর্মতত্ত্ববিদরাও ব্যবহার করেন। তাই দর্শনকে ধর্মতত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক ভাবাটা যুক্তিসঙ্গত নয়।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এবং অসীমত্ব সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্বলিত একটি ছোট গ্রন্থও রচনা করেছেন ইবনে রুশদ। ‘আল কাশফ আন মানাজিল আল আদিল্লা ফি আকিদা আল মিল্লা’ নামক গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘দ্য এক্সপোজিশন অব দ্য মেথডস অব প্রুফ কনসার্নিং দ্য বিলিফ অব দ্য কমিউনিটি’। এই গ্রন্থের মূল আলোচনা ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় গোত্রের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত বিশ্বাসের তুলনা। প্রথমে তিনি চারটি মূল গোত্রীয় বিশ্বাসের বর্ণনা দিয়েছেন। গোত্র চারটি হচ্ছে মুতাজিলি, আশ’আরী, সুন্নি এবং ‘লিটারেলিস্ট’ বা আক্ষরিক, যারা ধর্মগ্রন্থের বিকৃত এবং মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়। এই চার গোত্রের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত ব্যাখ্যাই ইবনে রুশদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং কুরআনে খুব সহজ উপায়ে আল্লাহর অস্তিত্বের বর্ণনা রয়েছে বলেই মনে করেন রুশদ।
রুশদের মতে, আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে দুটি যুক্তিই যথেষ্ট। একটি হচ্ছে দূরদর্শিতার যুক্তি। পৃথিবীর সবকিছুই আদতে মানুষের ব্যবহারের জন্যই সৃষ্টি। চাঁদ, সূর্য, গাছপালা, পশুপাখি, মাটি, পানি, বায়ু এবং দেখা অদেখা সবকিছুই যেন এক চূড়ান্ত সুরের মূর্ছনায় প্রতিনিয়ত বিমোহিত করে চলেছে মানবজাতিকে। এমন নিখুঁত সুর যেহেতু অস্তিত্ববান, তাহলে এর সুরকার তো কেউ একজন অবশ্যই আছেন! দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে উদ্ভাবনের যুক্তি। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত আমরা যা দেখি বা ব্যবহার করি, সব কিছুই কারো না কারো দ্বারা উৎপাদিত। ঠিক তেমনি মানুষ বা পশুপাখিও এমনি এমনি পৃথিবীতে চলে আসেনি। কেউ একজন সেগুলো তৈরি করেছেন অবশ্যই। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই আল্লাহ। তবে সৃষ্টিকর্তা দুজন হতে পারে কিনা, এর উত্তর সম্পূর্ণ করতে পারেননি রুশদ। প্রথমে তিনি ব্যাখ্যা করেন, সৃষ্টিকর্তার প্রধান গুণ হচ্ছে, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যদি দুজন সৃষ্টিকর্তা থাকতো, তাহলে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনো একজনের ইচ্ছানুযায়ী কাজ হলে অপরজনের বিরুদ্ধাচরণ হতো, যা তার সর্বশক্তিমান গুণের বিপরীত। তাই সৃষ্টিকর্তা একজনই। কিন্তু সমালোচকরা পুনরায় প্রশ্ন করেন, যদি উভয় সৃষ্টিকর্তা সহমতের ভিত্তিতে মহাবিশ্ব চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে কী হবে? ইবনে রুশদ বেঁচে থাকলে হয়তো কোনো উত্তর দিয়ে যেতেন, তবে তিনি ততদিনে পরলোকগমন করেছেন।
ইবনে রুশদ তার ‘তাহাফাত আল তাহাফাত’ গ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা থেকে সৃষ্টির দিকে চলে যান। তিনি পৃথিবীর চিরস্থায়িত্ব নিয়ে বিশ্বাস করাকে দার্শনিকদের ভাবনার স্বাধীনতা বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল বিদ্যমান অস্তিত্বকেই তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যার মধ্যে দুটি হচ্ছে চরম এবং একটি মধ্যবর্তী। চরম বা চূড়ান্ত শ্রেণীর একটি রূপ হচ্ছে এমন যে, সেগুলো কোনোকিছু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি হচ্ছে সময়, যা কিনা মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে শুরু হয়ে এখনো চলছে। দ্বিতীয় চরম শ্রেণীটি হচ্ছে প্রথমটির ঠিক বিপরীত। এটি কোনোকিছুর দ্বারা কিংবা তা থেকে সৃষ্টি হয়নি। এর অস্তিত্ব চিরন্তন। আর তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। আর শেষ শ্রেণীটি হচ্ছে এমন কিছু, যা কোনো পদার্থের দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে কিন্তু সময়ের অগ্রবর্তী নয়। অর্থাৎ মহাবিশ্ব, যা সৃষ্টির পরই সময় চলতে শুরু করে। মহাবিশ্বকে রুশদ মধ্যবর্তী বলেছেন এজন্য যে, তিনি বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব না প্রাক-চিরন্তন, না কোনো বিন্দুতে সৃষ্ট। কারণ, যদি মহাবিশ্ব চিরন্তন অতীত থেকে চলে আসতো তাহলে তা হবে অর্থহীন। আবার যদি মহাবিশ্ব কোনো বিন্দুতে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে এর ধ্বংস হবার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু (রুশদের মতে) মহাবিশ্ব নিত্য এবং তা ধ্বংস হতে পারে না।
ইবনে রুশদ ছিলেন একজন আপাদমস্তক অ্যারিস্টটলীয়ান। তার দর্শনে যেমন অ্যারিস্টটলের প্রতিফলন রয়েছে, তার মেটাফিজিক্সকেও অনেক তাত্ত্বিক এক কথায় অ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্সেরই নতুন সংস্করণ বলে আখ্যায়িত করেন। তাই রুশদের মেটাফিজিক্স নিয়ে বাড়তি আলোচনা না করে তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা যাক। তার মনস্তত্ত্ব বিষয়ক প্রধান গ্রন্থ হচ্ছে ‘তকবিস কিতাব আল নফস’। সেখানে তিনি মানব মনের পাঁচটি কর্মক্ষমতার কথা বলেছেন। পুষ্টি সংক্রান্ত, সংবেদনশীলতা, চিন্তাশীলতা, জৈবিক চাহিদা এবং যৌক্তিকতা। সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদের প্রাথমিক মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতাই হচ্ছে পুষ্টি সংক্রান্ত বা জায়মান ক্ষমতা। বাকি চারটি ক্ষমতাই এই প্রাথমিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল এবং এর ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সেগুলো বিকশিত হয়।
প্রথমত, প্রাথমিক পুষ্টি সংক্রান্ত সক্ষমতাই সকল খাদ্য ও অন্যান্য জৈব পদার্থের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে (সম্ভাবনা বলতে পুষ্টি বোঝানো হয়েছে) বাস্তবতায় রূপ দেয়। এটি প্রাণীর মৌলিক বিকাশ এবং প্রজননের জন্য জরুরি। অন্যদিকে সংবেদনশীলতা হচ্ছে একটি অকর্মক সক্ষমতা, যা সরাসরি কোনো কিছু করায় না, কিন্তু করবার জন্য মনকে উৎসাহিত বা অন্য কথায় (প্রভাবক দ্বারা) উত্তেজিত করে। আবার প্রাণীর মানসিক চিন্তাশীলতা পুরোপুরি সংবেদনশীলতার উপরেই নির্ভরশীল। কেননা, প্রাণী যা কিছু ভাবে বা কল্পনা করে, সবই কোনো না কোনোভাবে সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতা (দর্শন, স্পর্শ ইত্যাদি) থেকেই পাওয়া। আর সবশেষ চিন্তাশীলতাই জৈবিক চাহিদা ও অন্যান্য আকাঙ্ক্ষাকে উসকে দেয়। এসবের বাইরে থাকে যৌক্তিকতা। যৌক্তিকতা মানুষের অন্তর্নিহিত একটি গুণ, যা পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করে। যে ব্যক্তির যৌক্তিকতা পৃথিবীকে যত বেশি বুঝতে সক্ষম হয়, তিনি তার কাজে কর্মে তত বেশি যৌক্তিক এবং নৈতিক হন। মনের এই যৌক্তিকতার শক্তি বা বিচারশক্তিই মানুষকে ভাবতে শেখায়, বুঝতে শেখায়, নতুন নতুন আবিষ্কার করায়, নৈতিক বানায়। এই যৌক্তিক মনের আবার দুটি অংশ থাকে। একটি হচ্ছে ব্যবহারিক, অপরটি তাত্ত্বিক।
ইবনে রুশদের সামগ্রিক দর্শনের একটা সংক্ষিপ্ত রূপ আমরা দেখলাম। এবার তার জীবনীতে যাওয়া যাক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাকে আমরা ইবনে রুশদ বলে চিনি, তার সবচেয়ে পরিচিত নাম কিন্তু অন্যকিছু! আবু আল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ তার পুরো নাম। তবে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত ‘অ্যাভেরোস’ নামে। অ্যাভেরোসের ভিন্ন কোনো অর্থ নেই। তার পুরো নামের সংক্ষিপ্ত অংশ ইবনে রুশদেরই ল্যাটিন উচ্চারণ হয়েছে অ্যাভেরোস। কীভাবে হয়েছে? ইবনে হয়ে গেছে ‘অ্যাবনে/অ্যাভেন’ আর রুশদ হয়ে গেছে ‘রুশিদ/রুসদ/রুস’। আর শেষ পর্যন্ত অ্যাভেন আর রুস মিলে হয়ে গেল অ্যাভেরোস।
ইবনে রুশদ ১১২৬ সালে স্পেনের কর্ডোভায় এক সম্ভ্রান্ত এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা আলমোরাভিদ রাজবংশের শাসনামলে কর্ডোভার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার বাবা আবুল কাসিম আহমাদও আলমোরাভিদ রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তবে ১১৪৬ সালে আলমোরাভিদ রাজবংশের পতন ঘটে এবং ক্ষমতায় আসে আলমোহাদ বংশ। তখন কিছুটা সংকটের মুখে পড়ে আহমাদ পরিবার। তবে রুশদের গতানুগতিক ধারার শিক্ষাজীবনে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। শিক্ষাজীবনের শুরুই করেছিলেন হাদিস শিক্ষা, কুরআন এবং ফিকহ শাস্ত্র, সাহিত্য এবং আইনশিক্ষা দিয়ে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে বিজ্ঞান এবং দর্শনে প্রাথমিকভাবে খুব একটা আকর্ষণ ছিল না রুশদের। ফলে শৈশবটা অন্তুত এসব থেকে দূরেই ছিলেন তিনি। তবে তার গৃহশিক্ষক এবং বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে বাজ্জাহের দর্শনই সম্ভবত তাকে প্রথম দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
কর্ডোভার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক আবু জাফর ইবনে হারুনের নিকট তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক নিজের অসাধারণ গ্রন্থ ‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আল তিব্ব’এ তিনি হারুনের নিকট কৃতজ্ঞ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার এই বই পরবর্তী প্রায় কয়েক শতাব্দী যাবত সমগ্র ইউরোপ এবং আরব বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান পাঠ্য বই ছিল।
ইবনে রুশদ মারাকেশ ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে তিনি খলিফা আবদ আল মুমিনের সংস্পর্শে আসেন। খলিফা তাকে তার দার্শনিক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় যথেষ্ট সহায়তা করেন। এ সময় রুশদ ধীরে ধীরে আলমোহাদ বংশের সাথে নিজের সম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা করেন। ১১৫৯-৬৯ পর্যন্ত তিনি মারাকেশে বসবাস করেছেন। এ সময় তিনি খলিফা আবু আল ইয়াকুবের রাজ চিকিৎসক আবু তোফায়েলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। তোফায়েলের মুখে রুশদের প্রশংসা শুনে একসময় খলিফা রুশদকে তার দরবারের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন। খলিফা আবু ইয়াকুবই ইবনে রুশদকে গ্রীক দর্শনের উপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ প্রবন্ধ রচনা করার নির্দেশ দেন। আর এই নির্দেশ থেকেই তিনি গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক কাজ, অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস’, প্লেটোর ‘রিপাবলিক’, আলেকজান্ডারের ‘ডি ইন্টেলেকটু’, টলেমির ‘আলমাজেস্ট’, নিকোলাসের ‘মেটাফিজিক্স’ সহ অনেক বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিকের বিখ্যাত সব দর্শনের উপর প্রবন্ধ রচনা করেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই তিনি গ্রীক দর্শনের প্রেমে পড়েন। বিশেষ করে অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের।
“নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা উচিৎ, গৃহপালিত প্রাণী নয়।” – ইবনে রুশদ
উপরের উক্তিটি প্রমাণ করে তৎকালীন মুসলিম মনিষীদের মধ্যে ইবনে রুশদ ছিলেন সবচেয়ে বেশি উদারমনাদের একজন। তবে তার উদারমনা দর্শন অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যে খলিফা ইয়াকুবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি নিজের দর্শন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই খলিফাই একসময় রুশদের অতিমাত্রায় (তৎকালীন মুসলিম দর্শনের তুলনায়) উদার দর্শনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে “রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মনাশ করছে রুশদ”- এরকম জনশ্রুতি তৈরি হয়। ১১৯৫ সালে ক্রমাগত বাড়তে থাকা প্রতিকূল জনমত রুশদের সকল দর্শন বর্জন ঘোষণায় সহায়ক হয়। পাশাপাশি তাকে লুসিনা নামক একটি ইহুদী সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামে নির্বাসিত করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই তার সকল লেখা নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা থেকে সকল গ্রন্থ এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ১১৯৭ সালে মারাকেশ ফিরে আসা অনুমতি পান ইবনে রুশদ। তবে শর্ত ছিল, তিনি কিছুই লিখতে পারবেন না। লেখার আর সময়ও পাননি অবশ্য। ১১৯৮ সালে মারাকেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইবনে রুশদ। কর্ডোভায় তাকে দাফন করা হয়।
মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং পণ্ডিত হিসেবে ইবনে রুশদের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তার জনপ্রিয়তা আঁচ করতে পারবেন যখন আপনি জানবেন যে বিখ্যাত ইতালিয়ান কবি দান্তের ভুবনখ্যাত ‘ডিভাইন কমেডি’তে ইবনে রুশদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতীয় লেখক সালমান রুশদি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন যে তার বাবা তাদের পরিবারের নাম ‘রুশদি’ রেখেছিলেন ইবনে রুশদের সম্মানে। ১৯৭৩ সালে রুশদের সম্মানে একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয় ‘৮৩১৮-অ্যাভেরস’। একটি বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদের গণ ‘অ্যাভেরোয়া’ করা হয় ইবনে রুশদের সম্মানে। তাছাড়া চাঁদের একটি ক্রেটারের নাম তার নামে ‘ইবনে রুশদ’ রাখা হয়।
ফিচার ছবি: spainisculture.com