Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইসহাক আখমেরভ (পর্ব–২): মার্কিন–জাপানি যুদ্ধের নীলনকশা এঁকেছিলেন যে সোভিয়েত গুপ্তচর

(প্রথম পর্বের পর থেকে)

১৯৩৮ সালের জুলাইয়ে নিউইয়র্কে অবস্থানরত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সোভিয়েত ‘ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সে’র রেসিডেন্ট বোরিস বাজারভ নিখোঁজ হয়ে যান। এর ফলে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির তুর্কি ছাত্র মুস্তাফা তাগমাক (ওরফে সোভিয়েত গুপ্তচর ইসহাক আখমেরভ) কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কোথায় গেলেন বাজারভ? তাকে কি মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ ধরে ফেলল? আখমেরভ আন্দাজ করতে পারছিলেন, তার নিজের ভাগ্যেও হয়তো বিপজ্জনক কিছু অপেক্ষা করছে।

ভাগ্যের পরিহাস এই যে, বাজারভের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ‘বিদেশি শত্রু’দের কোনো হাত ছিল না। শীঘ্রই আখমেরভ জানতে পারলেন যে, বাজারভকে নিউইয়র্ক থেকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নতুন এনকেভিডি প্রধান লাভ্রেন্তি বেরিয়ার নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাজারভের অপরাধ ছিল, তিনি অতীতে রুশ সম্রাটের সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। এর ফলে অন্য অনেকের মতো তিনিও পরিণত হন সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে চলমান ‘গ্রেট পার্জে’র ভুক্তভোগীতে।

‘গ্রেট পার্জ’ (Great Purge) বা ‘গ্রেট টেরর’ (Great Terror), যেটি রুশ ইতিহাসে ‘ইয়েজভশ্চিনা’ নামে পরিচিত, ছিল ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত এক ভয়াবহ শুদ্ধি অভিযান। অপরাধ থাকুক আর নাই থাকুক, এই শুদ্ধি অভিযানের ফলে হাজার হাজার সোভিয়েত সরকারি ও কমিউনিস্ট দলীয় কর্মকর্তা, সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও অন্যান্য পেশার মানুষকে হয় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়, নয়তো শ্রম শিবিরে প্রেরণ করা হয়। এনকেভিডি যাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার তালিকা প্রস্তুত করেছিল, তাদের মধ্যে ইসহাক আখমেরভের নামও ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আখমেরভের এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না, কিন্তু বাজারভের পরিণতি দেখে তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, তার ভাগ্যেও হয়তো একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। এই অবস্থায় আখমেরভ একটি বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নেন, যা এনকেভিডির সিনিয়র কর্মকর্তারা কেউ আশা করেননি। আখমেরভ একটি গোপন সাঙ্কেতিক বার্তার মাধ্যমে মস্কোকে জানান যে, তিনি মার্কিন নাগরিক হেলেন লোয়রিকে বিয়ে করার অনুমতি চাইছেন!

এই ঘটনায় লুবিয়াঙ্কায় যেন আক্ষরিক অর্থেই বাজ পড়েছিল। তখন ছিল এমন একটা সময়, যখন কেবল কোনো বিদেশির সঙ্গে পরিচয় থাকার জন্যই বহু সোভিয়েত নাগরিক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। আর একজন এনকেভিডি অফিসার কিনা এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করার অনুমতি চাচ্ছে! হেলেন যদিও এনকেভিডির হয়েই কাজ করছিলেন, কিন্তু তার (বা অন্য কোনো বিদেশির) ওপর এনকেভিডির বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। বলাই বাহুল্য, এনকেভিডি প্রধান বেরিয়া আখমেরভের ‘ঔদ্ধত্যে’ যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

ইসহাক আখমেরভ; Source: Realnoe Vremya

কিন্তু সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আর্ল ব্রাউডারের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। হেলেন ছিলেন ব্রাউডারের আপন ভাগ্নি, এজন্য স্তালিনের নির্দেশে বেরিয়া আখমেরভের আবেদন মঞ্জুর করেন। আখমেরভ ও হেলেনের বিয়ে হয়, এবং এই সম্পর্কের কারণেই আখমেরভ প্রাণে বেঁচে যান। অবশ্য তাকে ও হেলেনকে মস্কোয় চলে যেতে হয়। সেখানে আখমেরভকে ‘শাস্তি’ হিসেবে ডিমোশন দেওয়া হয় এবং তাকে এনকেভিডির ডিরেক্টরেট অফ ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টসের আমেরিকান ডিপার্টমেন্টে একজন ইন্টার্ন হিসেবে বদলি করা হয়। অবশ্য এ নিয়ে আখমেরভের কোনো আফসোস ছিল না। তিনি যে বেঁচে ছিলেন, এটিই তখন তার জন্য যথেষ্ট ছিল।

এদিকে গ্রেট পার্জের ফলে এনকেভিডির বহু অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তরুণ কমিউনিস্ট দলীয় সদস্যদেরকে এনকেভিডিতে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর তাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ রকমই একজন তরুণ আখমেরভের ডিপার্টমেন্টের প্রধান নিযুক্ত হন। ভিতালি পাভলভ নামক এই তরুণের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর এবং তিনি কখনোই বিদেশে ছিলেন না। ভাগ্যচক্রে এরকম অনভিজ্ঞ একজন কর্মকর্তা আখমেরভের সিনিয়রে পরিণত হন।

ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, এবং কোনো বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই তাদের সুসম্পর্ক ছিল না। ১৯৩০–এর দশকে জাপানে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে। ১৯৩১ সালে জাপান উত্তর–পূর্ব চীন (যেটি ‘অভ্যন্তরীণ মাঞ্চুরিয়া’ নামে পরিচিত) দখল করে নেয় এবং সেখানে ‘মাঞ্চুকুয়ো’ নামক একটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন কিন্তু কার্যত জাপানি–নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র স্থাপন করে। এদিকে ১৯১০ সাল থেকেই কোরীয় উপদ্বীপ ছিল জাপানের উপনিবেশ। এই দুইটি বিস্তৃত অঞ্চল দখল করেই জাপানিরা ক্ষান্ত ছিল না, এবং ১৯৩৭ সালে তারা চীনের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের এশীয় অংশ ও সোভিয়েত বলয়ভুক্ত মঙ্গোলিয়ার দিকেও তাদের নজর ছিল। এর ফলে ১৯৩০–এর দশকে জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে জাপান ও মাঞ্চুকুয়োর তীব্র সীমান্ত সংঘাত চলতে থাকে।

অন্যদিকে, একই সময়ে ইউরোপে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে, এবং তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরোপীয় অংশ দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ১৯৩৬ সালে জার্মানি ও ইতালির মধ্যে ‘অ্যান্টি–কমিন্টার্ন চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, এবং ১৯৩৭ সালে জাপান এই চুক্তিতে যোগ দেয়। এই চুক্তির মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত সরকার আশঙ্কা করতে থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ত একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আক্রান্ত হবে। এটি ছিল সোভিয়েতদের জন্য দুঃস্বপ্ন স্বরূপ, কারণ একই সময়ে পশ্চিম দিকে জার্মানি ও ইতালির এবং পূর্বদিকে জাপানের মোকাবিলা করা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৯৩৮ সালে জাপানিরা সোভিয়েত ইউনিয়নের খাসান হ্রদ অঞ্চলে আক্রমণ চালায়, কিন্তু পরাজিত হয়। ১৯৩৯ সালে জাপানিরা সোভিয়েত মিত্ররাষ্ট্র মঙ্গোলিয়ার খালখিন গোল নদী অঞ্চলে আক্রমণ চালায়, এবং সোভিয়েত ও মঙ্গোলীয় সৈন্যরা জাপানিদের বিরুদ্ধে এক তীব্র সীমান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ সময় মস্কো আশঙ্কা করছিল যে, জাপানের সঙ্গে তাদের পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। ওদিকে ইউরোপেও প্রচণ্ড উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই পরিস্থিতিতে দুই রণাঙ্গনে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য সোভিয়েতরা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে মিলে একটি জোট গঠনের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর ফলে সোভিয়েতরা ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট জার্মানির সঙ্গে একটি অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তকে সাময়িকভাবে সুরক্ষিত করে। এরপর তারা জাপানিদের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি জাপানিরা পরাজিত হয়। ততদিনে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

খালখিন গোল যুদ্ধের সময় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত সাঁজোয়া যানের কাছে জাপানি পদাতিক সৈন্যরা; Source: Wikimedia Commons

১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি ও জাপানকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করে একসঙ্গে দুই রণাঙ্গনে যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হলো বটে, কিন্তু সোভিয়েত সরকার এটি ভালোভাবেই জানত, কোনো না কোনো সময় এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাঁধবেই। এক্ষেত্রে সোভিয়েত সরকারের জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল এটি নিশ্চিত করা যে, জার্মানি এবং জাপান যেন একসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ না চালাতে পারে। এটি নিশ্চিত করার জন্য তারা যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে রাজি ছিল।

১৯৪০ সালের শেষ নাগাদই এটি স্পষ্ট হতে শুরু করে যে, জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এমতাবস্থায় সোভিয়েতরা তাদের পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং বস্তুত ১৯৪০ সালের অক্টোবর থেকে এনকেভিডি জাপানকে নিয়ে একটি পরিকল্পনা করতে শুরু করে। তারা জানত, সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রশ্নে জাপানি নীতিনির্ধারকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাপানি সেনাবাহিনী ছিল ‘হোকুশিন–রোন’ বা ‘উত্তরাঞ্চলীয় সম্প্রসারণে’র পক্ষপাতী। তাদের বক্তব্য ছিল, জাপানের উচিত প্রথমে উত্তর দিকে আক্রমণ চালিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের এশীয় অংশ ও মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়া, এবং এরপর সেখান থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ব্যবহার করে দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করা। অন্যদিকে, জাপানি নৌবাহিনী ছিল ‘নানশিন–রোন’ বা ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় সম্প্রসারণে’র পক্ষপাতী। তাদের বক্তব্য ছিল, জাপানের উচিত প্রথমে দক্ষিণ দিকে আক্রমণ চালিয়ে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া দখল করে নেয়া, এবং এরপর সেখান থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ব্যবহার করে উত্তর দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করা। কার্যত দুই পক্ষের লক্ষ্য একই ছিল, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের পথ ছিল ভিন্ন।

এমতাবস্থায় এনকেভিডির পরিকল্পনা ছিল খুবই সরল। তারা চাইছিল, জাপানে যাতে ‘নানশিন–রোনে’র সমর্থকরা প্রাধান্য বিস্তার করে। এতে করে জাপানিরা দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু করবে, এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রায় পুরোটাই যেহেতু ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের উপবিবেশ, সেহেতু এদের সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ বেঁধে যাবে। তদুপরি, জাপানের চীন আক্রমণ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় জাপানিরা আক্রমণ চালালে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাত। সেক্ষেত্রে জাপানিরা দক্ষিণ দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার সুযোগ পেত না।

কিন্তু এনকেভিডির এই পরিকল্পনায় মারাত্মক একটি ফাঁক ছিল। সেটি হচ্ছে, জাপানি সরকারের অভ্যন্তরে এনকেভিডির প্রভাবাধীন কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিল না। ফলে জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। এই পরিস্থিতিতে এনকেভিডির পরিকল্পনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্র। জাপানি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে যেহেতু প্রভাবিত করা সম্ভব নয়, সেহেতু এনকেভিডি পরিকল্পনা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। সেক্ষেত্রেও জাপানকে এই সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে, এবং তারা উত্তর দিকে মনোনবেশ করতে পারবে না।

মোটামুটিভাবে এই ছিল এনকেভিডির পরিকল্পনা, এবং এই পরিকল্পনায় ইসহাক আখমেরভের ভূমিকা ছিল প্রণিধানযোগ্য। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা (এবং মার্কিন অর্থমন্ত্রী হেনরি মর্গেন্থাউয়ের ডান হাত) হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটের ওপর আখমেরভের ব্যাপক প্রভাব ছিল, এবং এটিকে কাজে লাগিয়েই এনকেভিডি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে দ্বন্দ্ব উস্কে দিতে চাচ্ছিল। অবশ্য এই পরিকল্পনা তখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি। যখন জার্মানির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধ বেঁধে যাবে, তখনকার জন্য তারা এই পরিকল্পনা সংরক্ষণ করে রেখেছিল।

‘কান্টোকুয়েন’ পরিকল্পনার একটি মানচিত্র। এটিতে জাপানি সৈন্যরা কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতো, সেটি দেখানো হয়েছে; Source: Wikimedia Commons

১৯৪১ সালের এপ্রিলে জাপানের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি ‘নিরপেক্ষতা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে। কিন্তু সোভিয়েতরা ভালোভাবেই জানত, এই চুক্তি বস্তুত ‘এক টুকরো কাগজ’ ছাড়া আর কিছুই নয়, এবং জাপানিরা যেকোনো মুহূর্তে এই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে। সুতরাং সোভিয়েত–জাপানি সীমান্ত বরাবর প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়।

এদিকে সেসময় জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। জার্মানি থেকে এনকেভিডি এজেন্টরা বারবার মস্কোয় বার্তা প্রেরণ করছিল, যেকোনো সময় জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালাবে। অবশ্য সোভিয়েত নেতা স্তালিন এই তথ্যের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তখন পর্যন্ত জার্মানি ব্রিটেনকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি। স্তালিনের ধারণা ছিল, ব্রিটেনকে পরাজিত করার আগ পর্যন্ত জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালাবে না। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একসঙ্গে দুই রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে গিয়েই জার্মানি পরাজিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে, এটা স্তালিন ধারণা করেননি।

কিন্তু জার্মান–সোভিয়েত উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে স্তালিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, এবং জার্মানির সঙ্গে যদি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বেঁধেই যায়, সেক্ষেত্রে জাপানকে নিষ্ক্রিয় করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এমতাবস্থায় তিনি ১৯৪০ সালে প্রণীত এনকেভিডির জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সংক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের অনুমতি প্রদান করেন। এই অভিযানের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন স্নো’ (Operation Snow)।

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, এনকেভিডি হোয়াইটের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এজন্য আখমেরভকে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করাই ছিল যৌক্তিক, কিন্তু বেরিয়া আখমেরভকে বিশ্বাস করতেন না। এজন্য তিনি আখমেরভের সিনিয়র ভিতালি পাভলভকে আখমেরভের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। পাভলভ ইতিপূর্বে কখনো যুক্তরাষ্ট্রে যাননি এবং হোয়াইটকেও চিনতেন না। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে তিনি ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি ছদ্মবেশে নিউইয়র্কে পৌঁছান, এরপর সেখান থেকে ওয়াশিংটনে যান।

ছদ্মবেশী পাভলভ হোয়াইটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, এবং নিজেকে ‘তুর্কি নাগরিক মুস্তাফা তাগমাকে’র প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন। হোয়াইট আগ্রহের সঙ্গেই পাভলভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাভলভ আখমেরভের/তাগমাকের পক্ষ থেকে হোয়াইটকে জাপান সম্পর্কে বিস্তারিত নথিপত্র প্রদান করেন এবং বেশকিছু প্রস্তাবনা লিখিত আকারে তার নিকট হস্তান্তর করেন। এই প্রস্তাবনাগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে আখমেরভের লেখা। এই প্রস্তাবনাগুলো হোয়াইটের পছন্দ হয়। তিনি সেগুলো গ্রহণ করেন এবং সেই মোতাবেক কাজ করতে সম্মত হন।

মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট (বামে); Source: Wikimedia Commons

১৯৪১ সালের ২২ জুন সকল জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জার্মানি ও তার ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো অতর্কিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই সোভিয়েত বিমানবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, এবং লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য হতাহত হয়। জার্মান সৈন্যরা পশ্চিম সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। এদিকে জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরপরই জাপানি সরকারের একাংশ সোভিয়েত–জাপানি নিরপেক্ষতা চুক্তি বাতিল করে পূর্ব দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে।

জাপানি সেনাবাহিনী ‘কান্টোকুয়েন’ নামক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মঙ্গোলিয়ার ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য প্রায় ১২ লক্ষ জাপানি সৈন্যকে প্রস্তুত করা হয়। ১৯৪১ সালের ৭ জুলাই, অর্থাৎ, জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের ঠিক দুই সপ্তাহ পরে, এই পরিকল্পনা জাপানি সম্রাট হিরোহিতোর আংশিক অনুমোদন লাভ করে।

এদিকে একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরেই জাপানিরা ফরাসি ইন্দোচীনের উত্তরাংশ দখল করে নিয়েছিল। এবার জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৪১ সালের জুলাইয়ে জাপান ফরাসি ইন্দোচীনের দক্ষিণাংশে প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রশক্তির ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূমিতে থাকা সমস্ত জাপানি সম্পদ জব্দ করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন জাপানের নিকট তেল রপ্তানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন–জাপানি সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।

১৯৪১ সালের নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্ডেল হাল জাপানি সরকারের নিকট উভয় পক্ষের সম্পর্কোন্নয়ন করার জন্য একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করেন। ইতিহাসে এটি ‘হাল নোট’ (Hull Note) নামে পরিচিত। এই নোটে মার্কিন–জাপানি সম্পর্কোন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে মার্কিনিরা বেশকিছু কঠোর দাবি উত্থাপন করে। এই দাবিগুলোর মধ্যে ছিল – চীন, ফরাসি ইন্দোচীন ও অভ্যন্তরীণ মাঞ্চুরিয়া থেকে জাপানকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে মিত্রতা বাতিল করতে হবে। নোটটির কঠোর ভাষা জাপানি সরকারকে ক্ষুব্ধ করে। তারা এটিকে একটি চরমপত্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং ধারণা করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জাপানিরা নিজেরাই আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার নৌঘাঁটি ধ্বংস করে মার্কিনিদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরকে বিধ্বস্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করে। এমতাবস্থায় জাপানে ‘হোকুশিন–রোন’ বা উত্তর দিকে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং ‘নানশিন–রোন’ গৃহীত হয়। জাপানে অবস্থানরত এনকেভিডির আরেক দুর্ধর্ষ গুপ্তচর রিচার্ড সোর্গে এই তথ্য জানতে পারেন এবং মস্কোকে সেটি জানিয়ে দেন। এ সময় জার্মান সৈন্যরা মস্কোর সন্নিকটে উপস্থিত হয়েছিল। জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালাবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ চালাবে, এই তথ্যের ভিত্তিতে সোভিয়েত সরকার সোভিয়েত–জাপানি সীমান্ত থেকে কয়েক লক্ষ সৈন্য সরিয়ে তাদেরকে মস্কোর সুরক্ষার জন্য নিয়োগ করে।

পার্ল হারবারে জাপানি আক্রমণের ফলে ডুবন্ত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘আরিজোনা’; Source: Wikimedia Commons

১৯৪১ সালের ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত সৈন্যরা মস্কোর নিকটে প্রতি–আক্রমণ শুরু করে, এবং জার্মান সৈন্যদেরকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। অন্যদিকে, ৭ ডিসেম্বর জাপানিরা অতর্কিতে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং মার্কিন–জাপানি যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে জাপানের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সম্ভাবনাও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে আখমেরভের কৃতিত্বটা ঠিক কোথায়? আগেই বলা হয়েছে, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আগে থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ ছিল। কিন্তু এই উত্তেজনার স্ফূলিঙ্গকে প্রজ্বলিত করেছিল ১৯৪১ সালের নভেম্বরে জাপানকে প্রদত্ত ‘হাল নোট’, যেটিকে জাপানিরা মার্কিন চরমপত্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নোটটি হস্তান্তর করেছিলেন কর্ডেল হাল, কিন্তু এটি লিখেছিলেন মার্কিন অর্থমন্ত্রীর ডান হাত হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট। এবং হোয়াইট এই নোট লিখেছিলেন সেই প্রস্তাবনার ভিত্তিতে, যেটি তাকে আখমেরভের পক্ষ থেকে পাভলভ সরবরাহ করেছিলেন! অর্থাৎ, সহজ ভাষায়, যে ‘হাল নোটে’র কারণে মার্কিন–জাপানি যুদ্ধ শুরু হয়, সেটির মূল প্রণেতা ছিল সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি!

এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ্য। হোয়াইট আখমেরভের প্রকৃত পরিচয় জানতেন না। তিনি আখমেরভকে একজন তুর্কি প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে চিনতেন। একজন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা একজন তুর্কি প্রাচ্য বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জাপান বিষয়ে জ্ঞান নিতেই পারেন, সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যেটি অস্বাভাবিক, সেটি হচ্ছে, তিনি কেন একজন তুর্কি প্রাচ্য বিশেষজ্ঞের কথামতো পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করবেন? যিনি মার্কিন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে পেরেছেন, তিনি আর যাই হোন না কেন, বোকা নিশ্চয়ই ছিলেন না। এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদরা দুইটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে থাকেন।

প্রথম সম্ভাবনাটি হচ্ছে, হোয়াইট নিজেও ছিলেন একজন কমিউনিস্ট কিংবা সম্ভবত এনকেভিডি এজেন্ট। এটি সম্ভব যে, আখমেরভই হোয়াইটকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন, এবং এজন্যই হোয়াইট জেনেশুনে এনকেভিডির কথামতো কাজ করেছেন। তাত্ত্বিকভাবে, এটি সম্ভব। কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হোয়াইটের বিরুদ্ধে ‘কমিউনিস্ট গুপ্তচর’ হওয়ার অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু হোয়াইট সোভিয়েত গুপ্তচর ছিলেন, এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণই নেই। এবং প্রমাণ যেহেতু নেই, কোনো অপরাধও নেই!

দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হচ্ছে, হোয়াইট কমিউনিস্ট ছিলেন না বা এনকেভিডি এজেন্টও ছিলেন না, কিন্তু তিনি আখমেরভের পরিচিতি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এবং তারপরেও আখমেরভের পরামর্শমতো কাজ করেছিলেন। এক্ষেত্রে এটি সম্ভব যে, হোয়াইট নিজেই বিশ্বাস করতেন, এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করার জন্য জাপানকে প্রতিহত করা জরুরি, এবং এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আখমেরভের পরামর্শ মোতাবেক মার্কিন–জাপানি যুদ্ধ উস্কে দিয়েছিলেন।

১৯৪২ সালের সোভিয়েত জেনারেল স্টাফের দূরপ্রাচ্য সংক্রান্ত রণপরিকল্পনার মানচিত্র। আখমেরভের পরিকল্পনা সফল হওয়ার পরেও সোভিয়েত সমরবিদরা দূররাচ্যে জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারেননি; Source: Wikimedia Commons

প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সোভিয়েত গুপ্তচর ইসহাক আখমেরভ মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটকে ব্যবহার করে মার্কিন–জাপানি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। উল্লেখ্য, যদি জার্মানি ও জাপান একযোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ করত, সেক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় ছিল প্রায় নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরোপীয় অংশ জার্মানির এবং এশীয় অংশ জাপানের হস্তগত হতো। এমতাবস্থায় মার্কিন–জাপানি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার মাধ্যমে আখমেরভ কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

এদিকে আখমেরভের তৈরি পরিকল্পনায় যখন এতকিছু হয়ে যাচ্ছিল, তখন আখমেরভ কী করছিলেন? ১৯৪১ সালের জুলাইয়ে এনকেভিডি সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় সোভিয়েত ‘ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সে’র নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আখমেরভ ও তার স্ত্রী হেলেনকে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই মোতাবেক ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে আখমেরভ ও তার স্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রাচ্যের দেশগুলো হয়ে ঘুরপথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন।

এবার আখমেরভ একজন পশম ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করেন। ছোটবেলায় নানার কাছে তিনি যে পশমের কাজ শিখেছিলেন, সেটি এ সময় কাজে লাগে। শীঘ্রই তিনি একজন সফল পশম ব্যবসায়ীতে পরিণত হন, এবং ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তৈরির কাজে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে তিনি কারো সন্দেহের উদ্রেক না করেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে পারতেন এবং তার নিয়োগকৃত এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। একই সময়ে তার স্ত্রী হেলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এই গুপ্তচর দম্পতি এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে, তারা নিয়মিত ঘুমানোর সময়ও পেতেন না।

ক্রমশ আখমেরভ যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে বিস্তৃত করতে থাকেন, এবং প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। মার্কিন পররাষ্ট্র, অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিচার মন্ত্রণালয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ (এফবিআই) ও অন্যান্য সংস্থায় তার নিজস্ব এজেন্ট ছিল। এর পাশাপাশি মার্কিন পরমাণু প্রকল্প (প্রোজেক্ট ম্যানহাটন) এবং মার্কিন বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘অফিস অফ স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসে’ও তিনি গুপ্তচর নিযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নিয়োগকৃত এজেন্টদের মাধ্যমে তিনি মার্কিন সরকারের বহু গোপন তথ্য জানতে পারেন, এবং সেগুলো মস্কোকে জানিয়ে দেন।

যেমন: ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তেহরান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের আগেই আখমেরভ মার্কিনিদের পরিকল্পনাগুলো জানতে পারেন এবং মস্কোকে জানিয়ে দেন। মার্কিন পরমাণু প্রকল্প সম্পর্কিত প্রচুর তথ্য তিনি সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো মস্কোকে সরবরাহ করেন। তদুপরি, মার্কিন সামরিক অবকাঠামো ও সামরিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্রও তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

তেহরান সম্মেলনে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী স্তালিন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। এই সম্মেলনে রুজভেল্ট কী কী প্রস্তাব পেশ করবেন, আখমেরভের প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে স্তালিন সেগুলো আগে থেকেই জানতেন; Source: Wikimedia Commons

আখমেরভ ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত ‘ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সে’র রেসিডেন্ট ছিলেন। এই সময়ে তিনি কমপক্ষে আড়াই হাজার গোপন নথিপত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রেরণ করেন। এগুলোর মধ্যে ছিল– জার্মানির সামরিক–রাজনৈতিক সামর্থ্য সম্পর্কে মার্কিন মূল্যায়ন, মার্কিন সরকারের ভবিষ্যৎ সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৈঠকের জন্য প্রস্তুতকৃত খসড়া চুক্তির নথি এবং ভ্যাটিকানে অনুষ্ঠিত জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত গোপন আলোচনা বিষয়ক তথ্য। শুধু তাই নয়, তিনি তথাকথিত ‘ট্রুম্যান লিস্টে’র একটি কপিও সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এটি ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান কর্তৃক প্রণীত একটি তালিকা, যেটিতে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন কোন শহরের ওপরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হবে, সেটি তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল!

বলাই বাহুল্য, আখমেরভের প্রেরিত তথ্যসম্ভার সোভিয়েত সরকারকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল। ১৯৪৬ সালে আখমেরভকে চূড়ান্তভাবে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়, এবং তিনি ও হেলেন যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। মস্কোয় ফেরার পর তাকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের উপ–পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। প্রায় ১০ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে বিভিন্ন দেশে ‘ইলিগ্যাল’ সোভিয়েত এজেন্টদের সহায়তা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন, এবং কেজিবির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহুদিন যাবৎ শিক্ষকতা করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষার ক্ষেত্রে আখমেরভের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আখমেরভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ প্রদান করা হয়নি, কারণ তাকে এই পদক দিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যা যা করেছেন, সবই প্রকাশ হয়ে পড়ত। এটি যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানরত সোভিয়েত গোয়েন্দাদের ও তাদের নিয়োগকৃত এজেন্টদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতো। এজন্য আখমেরভকে ‘অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার’ পুরস্কার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

ইসহাক আখমেরভ কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ খেতাব লাভ করেননি; Source: Realnoe Vremya

ব্যক্তিগত জীবনে আখমেরভ সুখীই ছিলেন বলা যায়। বিয়ে করেছিলেন তার পার্টনার-ইন-ক্রাইম মার্কিন নারী হেলেন লোয়রিকে। হেলেন পরবর্তীতে ‘এলেনা ইভানোভনা আখমেরোভা’ নাম ধারণ করেন এবং সোভিয়েত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৮ জুলাই মস্কোয় আখমেরভের মৃত্যু হয়। এর দুই বছরের মধ্যেও হেলেনও মৃত্যুবরণ করেন। আখমেরভ ও হেলেনের চার সন্তান এখনো জীবিত, এবং তারা রাশিয়ায় বসবাস করছেন।

গুপ্তচরবৃত্তির গোপনীয়তার জগতে সাধারণত তারাই বিখ্যাত হন, যারা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান। কিংবদন্তী সোভিয়েত/রুশ গুপ্তচর রিচার্ড সোর্গে, রুডলফ অ্যাবেল কিংবা আন্না চ্যাপম্যান– প্রত্যেকেই ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছেন, কারণ তারা প্রত্যেকেই ধরা পড়েছিলেন। আখমেরভ তার ঘটনাবহুল জীবনে কখনো শত্রুর হাতে ধরা পড়েননি, সুতরাং তিনি বিশেষ পরিচিতিও অর্জন করেননি। এজন্য যখন আখমেরভকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময় তাতারস্তানের রাষ্ট্রপতি রুস্তাম মিন্নিখানভকে এই প্রামাণ্যচিত্রে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছিল, তিনি হতবাক হয়ে আখমেরভের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এ রকম মানুষ আসলেই আছে?”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, তখন মার্কিন জেনারেল জর্জ প্যাটন আক্ষেপ করে মন্তব্য করেছিলেন, “আমরা ভুল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি!” অর্থাৎ, তার মতে, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। প্যাটন যদি জানতেন, তারা যে এই ‘ভুল শত্রু’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, এটি ছিল আসলে তাদের ‘আসল শত্রু’র এজেন্ট ইসহাক আখমেরভের নীলনকশার ফল, তাহলে তিনি কী বলতেন?

This is the second part of a Bengali article about Ishak Akhmerov, a legendary Soviet spy.

Sources:
1. Mikhail Birin. "Ishak Akhmerov: the Tatar who arranged Pearl Harbor." Business Online, December 24, 2017. https://m.business-gazeta.ru/article/367938

2. Mikhail Birin. "Ishak Akhmerov: 'If it wasn't for him, the Union would have been torn in half!'" Business Online, December 30, 2017. https://m.business-gazeta.ru/article/368556

3. "Akhmerov Ishak Abdulovich." Website of the Foreign Intelligence Service of the Russian Federation. http://svr.gov.ru/history/person/ah.htm

Source of the featured image: Transforming Society

Related Articles